ভ্যাবলা একখানা চাঁদ। ড্যাবড্যাব চেয়ে আছে শাপলাবিলের জলে। বিলবহরে আওলা বাতাস। ধেইধেই করে ছুটছে। নিশিপক্ষীরা নির্ঘুম চঞ্চল হয়। বিষেভরা সাপ বিষণ্ন চিত্তে ঘুরেফিরে। করচের ডালে বসে কি সব ভেবে যায় পেঁচামুখো পাখিটা। মহব্বত ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে জলটঙ্গিতে। কালো-সবুজ ডোরে সাপটি তার লুঙ্গি ঘেষে চলে যায়। মহব্বত টেরও পায় না। শাপলা-বিলে জলে একধ্যানে চেয়ে থাকে। মনে মনে শব্দ সাজায়। শব্দ জুড়ে কাব্য বানায়। মহাকাব্য। পঁয়ত্রিশ বছরের কাব্য। শাপলা-বিলে তারা ভাসতে ভাসতে কোথা থেকে কোথা চলে যায়।
মহব্বত মাচায় বসে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঝিঙ্গে ফুল রোদ। মা সে রোদে মাছ শুকাতে দিয়েছে। বাঁশের ডালায় পাঁচমিশালি মাছ। বর্ষায় চারদিক যখন ডুবে একাকার। বাবার বাজার থেকে আনা আলু আর মায়ের শুকানো শুটকি মাছই সম্বল। অথচ বর্ষায় বাপজানের নৌকা করেই ত্রিশ মাইল দূরের বাজার থেকে সবজি-মাছ আসত। বয়ে আনা সবজি বাবার ক্ষুধার্ত পিঠে চেপে ঘাটে নামতো। সেসবে না জুড়াত চোখ, না জুড়াত পেট বরং হাভাতা বুকে জ্বলন হতো। সেই জ্বলুনিতে শুকনা মরিচ আর শুটকি ঘসে ঘসে জীবন কেটে গেছে।
তো ঘাটে বাঁধা নৌকা। গলুইয়ে বসে আছে বাপজান। কপালের ভাঁজে ভাঁজে কত দুখ। বর্ষায় না খেতে পাওয়ার দুখ। রাক্ষুসে হাওরে ধান তলিয়ে যাওয়ার দুখ। দেনার দুখ। পরের নৌকা চালানোর দুখ। এক জীবনে একটি নৌকা না কিনতে পারার দুখ। কত দুখ পানা ফুলের মতো ভেসে ভেসে যায়।
ঐ তো ঘাটে বাঁধা নৌকা। গলুইয়ে বসে আছে বাপজান। কপালের ভাঁজে ভাঁজে কত দুখ। বর্ষায় না খেতে পাওয়ার দুখ। রাক্ষুসে হাওরে ধান তলিয়ে যাওয়ার দুখ। দেনার দুখ। পরের নৌকা চালানোর দুখ। এক জীবনে একটি নৌকা না কিনতে পারার দুখ। কত দুখ পানা ফুলের মতো ভেসে ভেসে যায়। মহব্বত রাতভর সেসব টুকায়ে মাচায় তোলে রাখে। বিলাপ করে, হাসে, শাপশাপান্ত করে।
সেবার ফসল ওঠেনি। এত পানি বেড়েছে যে নৌকা বাইবার জো নেই। হঠাৎ করেই কালো জ্বরে বিছানায় পড়ল ছোটো ভাইটা। নীলা মুন্সী এসে ঝাঁড়ফোক করল। লাভ হলো না। দশ টাকার বিনিময়ে ডাক্তারবাবুর শিশি থেকে জলের ফোঁটাও খাওয়াল। কিসের কি! হঠাৎ এমন বমি শুরু হল। নাড়িভুড়ি যেনো ঠেলে বেরিয়ে আসে। পেটে তো ভাত ছিল না যে বের হবে। বের যা হল তা কেবল লাল। ফ্যাকাশে লাল। সব শেষ। আম্মা কতবছর ভাত নিয়ে বসলেই হু হু করে কাঁদতেন।
এরপর কত পানি গেল, কত পানি এলো, তাদের হাভাতা জীবনের অবসান হলো না। পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে সে কী পেল!
এই ভেবে ভেবে মহব্বতের পঁয়ত্রিশটি বছর অন্ধকার হয়ে যায়। ভ্যাবলা চাঁদটাকে মনে হয় কুচকুচে কালো একটা সাপ। এক্ষুনি শরীরটা পেঁচিয়ে আকাশে নিয়ে যাবে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মহব্বত বার ভোল্টের টর্চলাইটটি চেপে ধরে। আলো জ্বালাতে পারে না। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারেনা স্রোতে জাল ফুঁটো হয়ে গেল কি না।
বর্ষায় চুরি বেড়ে যায় এলাকায়। আজকাল মাছ চোর হয়েছে। মাছও একদিন চুরি করতে হবে একথা স্বপ্নেও কি ভেবেছিল সোনাবিলের মানুষ!
ঘুটঘুটে অন্ধকারেও মহব্বত দেখতে পায় জাল ভর্তি রুপালি রঙের মাছ। তিরিং বিরিং লাফাচ্ছে। খাঁচার খাঁচা মাছ নিয়ে হাসি মুখে সবাই ঘরে ফিরছে। মানুষ ভাতের সাথে মাছ খায়। সোনামোড়ল বিলের মানুষজন মাছের সাথে ভাত খেয়েছে। অন্তত মাছে টান পড়েনি। হায়, সেইসব দিন কই গেল! টাকায় ও আজ আর মাছ জুটে না। বিলখেঁকোরা মাছ পানি সব নিয়েছে। এই যে জেলেরা মাছ ধরে। সে রাতের পর রাত পাহাড়া দেয়। বিনিময়ে চুক্তির কয়টা টাকা আর উচ্ছিষ্ট কয়টা মাছ ছাড়াত কিছু মিলে না। সেও কখনো ভালো, কখনো পঁচা গলা। অথচ এই মাছ বাঁচাতে সে কিই-না করেছে? রাতের পর রাত ঘরে ফেরেনি। ফাতিমার সাথে তার বিয়ে হয়েছিল এক বর্ষায়। বিয়ের জন্যে মাত্র তিনরাত সে ছুটি পেয়েছিল। বর্ষার ছয়মাসই ফাতিমা তার আম্মার সাথে ঘুমিয়েছে। নতুন বউ, লজ্জায় মুখ ফোঁটে টো রাও পর্যন্ত করেনি।
বিয়ের বছর ঘুরে ফাতিমা একটি মেয়েও জন্ম দিয়েছিল। পুতুলের মতো দেখতে! মরা বাচ্চা। সে কি কান্না ফাতিমার! সেইসময়ও মহব্বত তার পাশে থাকতে পারেনি। তখন টুইটুম্বুর বর্ষা ছিল। মাছ ভেসে যাবে। মহব্বতের বিল ছেড়ে নড়ার সময় ছিল না। তারপর জন্ম নিল দুই ছেলে। কোনদিক দিয়ে তারা সেয়ান হয়ে গেল মহব্বত টেরটি পেল না। বর্ষা কিংবা বসন্ত কোনোকালেই সে ফাতিমাকে সময় দিতে পারেনি। একহাতে সব সামলেছে ফাতিমা।
একটা কোড়া পক্ষি ডাকছে। ফাতিমার জন্য মহব্বতের বুকটা হু হু করে ওঠে।
কিচ্ছুটি পেল না সে এই জীবনে। সব দুঃখ একদিন ঘুঁচে যাবে সেই আশেই বেগার খেটেছে। কিন্তু নিজের না হলো একটি জাল, না হলো নৌকা! বিলভর্তি মাছ শুধু দেখেই গেছে। বাবা ছিল মাঝি, সে হয়েছে পাহাড়াদার! অথচ একদিন তার নৌকা হবে, নিজের জাল নিজের নৌকা নিয়ে মাছ ধরবে। নিজের নৌকায় বউকে নায়র দিয়ে আসবে। এ জীবনে সেসবের কিচ্ছুটি হলো না। অন্যের ভাগাড় পাহাড়া দিয়েই কেটে গেল তার জনম।
মধ্যরাতে জলটঙ্গিতে বসে মহব্বতের মন খিচিয়ে ওঠে। এ বিল, নদী, হাওর থেকে সে এইটুকুও পেল না! একটি জাল, নৌকা রেখে মরতে পারলে ছেলেরা শাহজাদার মতো বাঁচত। বিতৃষ্ণায় মহব্বত মুষ্টি করা হাত শাপলাবিলের দিকে ছুড়ে মাড়ে। এমন সময় দেখে একটি নৌকা। চোখ চকচক করে ওঠে মহব্বতের। দূরের অন্ধকার ভেদ করে ছুটে যাওয়া নৌকায় সে দেখে আলাল আর দুলাল বসে। একজন লগি ধরে বসে আছে। অন্যজন জাল ছড়িয়ে দিয়েছে শাপলা-বিলে। মহব্বত মাঁচা থেকে চিৎকার করে ওঠে।
‘সাব্বাস বাজান। তোর বাপে পারে নাই, আমার বাপে পারে নাই কিন্তু তোরা পারছস।’ হাতের বার বোল্টের বাতিটি উস্কে ওঠে। দুঃখেভরা পানাফুলগুলো হঠাৎ সূর্যমুখীর মতো হেসে ওঠে। দূরন্ত দূর্বার তারা ভেসে যায়। বালুবাহী একটি ট্রলার ভটভটিয়ে এসে শাপলা-বিলের জলে আসে। আলাল দুলালের নৌকাটি মারিয়ে দিয়ে চলে যায়। মহব্বতের ঘোর কাটে। হাতবাড়ি এক জল নিয়ে মুখে ছিটিয়ে দেয়।
কোড়া পক্ষিটা ডানা ঝাপটে উড়ে যায়।
খিদে পেয়েছে বেশ। শেষ রাতের দিকে এমন খিদে পায়। সেই কোন সন্ধ্যাকালে বাড়ি থেকে ডালের বড়া আর অম্বল দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছিল। সে খাবার আর পেটে নেই। আজকাল খাইখাই ভাবটা বেড়েছে। যখন তখন এটাওটা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করে মহব্বতের। এই রাতে তার মনটা আইঢাই করছে বেগুন মুলা দিয়ে রুই মাছের পেটি খেতে।
খিদে পেয়েছে বেশ। শেষ রাতের দিকে এমন খিদে পায়। সেই কোন সন্ধ্যাকালে বাড়ি থেকে ডালের বড়া আর অম্বল দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছিল। সে খাবার আর পেটে নেই। আজকাল খাইখাই ভাবটা বেড়েছে। যখন তখন এটা ওটা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করে মহব্বতের। এই রাতে তার মনটা আইঢাই করছে বেগুন মুলা দিয়ে রুই মাছের পেটি খেতে। এইসময়ে বেগুন জুটবে কোথা থেকে। রুইমাছের পেটি তো চোখেও জোটে না। মাছ যা ধরা পরে চলে যায় সব ঢাকা। অসময়ে বেগুনের আশি টাকা দর। না খেতে পারার আফসোস, না খেতে দেওয়ার আফসোস আবার তাকে অন্ধকার থেকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়। রাগে গজগজ করতে করতে মহব্বত গামছায় বাঁধা মোয়া দু’খানা বের করে। মুড়িগুলো নেতিয়ে গেছে। গুড়ের আঁশটা গন্ধটাও তিতকে। খিদের পেটে তাই সে হামহাম খেয়ে নেয়। মাচা থেকে নুইয়ে, হাতের তালুতে জল তুলে চুকচুক খায়। লাইটের সুইচ অন করে এদিক ওদিকে আলো ফেলে। চোরকে সর্তক করার জন্যে হাঁক ডাকে।
খবরদার! খবরদার! খবরদার!
সমুদ্দুরে জল ওঠে বাতাসেরও জোরে
আবরও হইয়া ঘোরে পবনেরও ভরে
জমিনে পরিয়া শেষে সমুদ্দুরে যায়
জাতেতে মিশিয়া জাত তরঙ্গ খেলায়…
চাইরছিজে পিঞ্জিরা বানাই মোরে করলাই বনধ।
বন্ধু নির্ধনিয়ার ধন, আমিনি পাইমুরে কালা তোর দরশন
গানের তালে তালে বিশাল শাপলা-বিলে একফালি টর্চের আলো নেচেনেচে জানান দেয় মহব্বতের জান থাকতে একটি মাছও কেউ নিতে পারবে না। পাহাড়া দিতে দিতে মহব্বত রাতের প্রহর গুনে। রাত পোহানোর অপেক্ষা করে। ডিউটি শেষ হলেই সে ঘরে ফিরবে। ফাতিমাকে আজকের দেখা খোয়াবের কথাটা বলবে। শেষরাতের খোয়াব সত্য হয়। মন ডাকছে, সুদিন বেশি দূরে নয়। তার বাপের হয় নাই, তার হয় নাই কিন্তু ছেলেদের একটি নাউ ঠিক হবে। টর্চের আলো ছায়ায় সে আলাল দুলালের নৌকায় বসে থাকা দৃশ্যটি দেখতে পায়। গোফের আড়ালে মহব্বতের পোড়া ঠোঁট দুখানা হেসে ওঠে।
মহব্বত বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সতর্ক করে। খবরদার! খবরদার! খবরদার!
চাঁদ পুবদিকে হেলে যায়। দক্ষিণ গাঁওয়ের বটেশ্বরের মেয়ের বিয়ে গেল কাল। বাসিবিয়ের জল ভরার গীত ভেসে আসে।
চলগো সখি জলে যাই
শ্যামনাগরকে দেইখে আই
প্রাণ আমার জুড়াইবো
তাহার রূপ দেখিয়া, আহা তাহার রূপ দেখিয়া, তাহার রূপ দেখিয়া
প্রাণ আমার জুড়াইবো…
বলগো সখি উপায় বল
তোমরা বিনে নাই সম্বল
প্রাণ আমার কাঁন্দেগো
তাহারও লাগিয়া ।
পাহাড়া শেষ করে মহব্বত বাড়ি এসে যখন ঢুকল চুলায় ডালের হাড়িতে তখন বলগ উঠছে। ফাতিমা চুলার আগুন উসকে উসকে দিচ্ছে। ‘আলাল, আব্বারে লুঙ্গি গামছাটা দে’—স্বামীকে দেখা মাত্রই ফাতিমা ছেলেকে ডেকে বলে। ছেলেদের ঘুম তখনও ভাঙেনি। ওরা মায়ের কথা কেউ শুনতেই পায় না। ফাতিমা উঠে গিয়ে গামছা লুঙ্গি বের করে দেয়। এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে মহব্বত স্ত্রীর দিকে তাকায়। ফাতিমা তা খেয়ালও করে না। চুলায় পাতা গুজায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। মহব্বত নিমেরডালে দাঁত ঘষতে ঘষতে ঘাটের দিকে চলে যায়।
খিদে আর শেষ রাতের স্বপ্নের কথা ফাতিমাকে বলার চঞ্চলতায় চটজলদি ডুব সেরে সে ফিরে আসে।
বারান্দায় পাটি পেতে ফাতিমা স্বামীর জন্যে ভাত বেড়ে দেয়। গরম ভাতের উপর দুইটা পোড়া শুকনা মরিচ দিয়ে বাটি পেতে দেয় কালাইয়ের ডাল দেয়। মহব্বতের পেটভরা খিদে। চটপট সে খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ করে চকিতে উঠে বসে। ফাতিমা পানের বাটা সামনে দিয়ে ঝলমলে রোদে কয়টা খুদ শুকাতে দেয়। মহব্বতের ইচ্ছা করে ফাতিমা কিছুক্ষণ পাশে এসে বসুক।
বারান্দায় পাটি পেতে ফাতিমা স্বামীর জন্যে ভাত বেড়ে দেয়। গরম ভাতের উপর দুইটা পোড়া শুকনা মরিচ দিয়ে বাটি পেতে কালাইয়ের ডাল দেয়। মহব্বতের পেটভরা খিদে। চটপট সে খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ করে চকিতে উঠে বসে। ফাতিমা পানের বাটা সামনে দিয়ে ঝলমলে রোদে কয়টা খুদ শুকাতে দেয়। মহব্বতের ইচ্ছা করে ফাতিমা কিছুক্ষণ পাশে এসে বসুক। পানের খিলিটা বানিয়ে দিক। সেই ফাঁকে শেষরাতের কথা সে ফাতিমাকে বলবে। কিন্তু ফাতিমা এটাওটা করেই যায়।
একটা সময় ছিল মহব্বত ঘরে ফিরলে ফাতিমার মনে কী রং! সেসব দিন সব ঝাপসা। অভাবে অভাবে ফাতিমার চোয়ালটা কেমন শক্ত হয়ে গেছে। ঝগরাটে মেয়েমানুষদের মতো কিছু হলেই খেঁকিয়ে উঠে। ন্যাড়া ধানগাছের মতো কঠিন রুক্ষ দেখায় ওর কপালটা।
মহব্বতের ক্লান্ত লাগে। তবু অনেকক্ষণ বসে শেষ রাতের কথাটা বলার সুযোগ খুঁজে। ফাতিমা স্বামীর ভালোমন্দ কোনো কথারই উত্তর করে না। সে নিজেই পানের বাটা থেকে পান বানিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে এইবার বর্ষা শেষে সে ছুটি চাইবে। মহাজনের কাছ থেকে কিছু দেনাও করবে। ফাতিমাকে একবার তার বাপের ভিটেটা দেখিয়ে আনার ইচ্ছে। ছেলেরাও মামার বাড়ি ঘুরে আসল। অনেকবছর ফাতিমাকে সে বাপের বাড়ি নাইয়র যেতে দিতে পারে না। মনে মনে এইকথাটা ভেবে কিছুটা না পারার গ্লানি যেন হালকা হয়। শেষরাতের স্বপ্নের সাথে নাইয়র নিয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটা এঁটে মহব্বত আরো অস্থির হয়ে ওঠে। ফাতিমাকে এক দুইবার ডাকে।
সারা না পেয়ে মহব্বত উঠে যায়। ঘরে গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানায়। সোনাবিলে ভেসে যাওয়া নাউটা এখনো চোখে লেগে আছে। আলাল আর দুলালের নিজের নাউ।
সব ছাপিয়ে মাথার কাছে ঝনঝন করে বেজে ওঠে কিছু একটা। ঠোঁটের কোনে চিলতে হাসিটা ধপপ করে নিভে যায় মহব্বতের। প্রলংকরী ফাতিমা চেঁচিয়ে ওঠে।
‘বলি, দেড়া সুদ করার মুরাদ নাই টাকা ধার করেন কেন? বাড়িতে আইসা কত কি না কইয়া যায়। পোড়া কপাল আমার। আল্লাহ মরন দেয় না। ছেলে দুইটা না থাকলে গলায় কলসি বাইন্ধা মরতাম।’ এইটুকু বলে ফাতিমার গলা ধরে আসে। ধপাধপ শব্দ তুলে, চোখ মুছতে মুছতে সে চলে যায়। মূহূর্তেই এক আকাশ অন্ধকার মহব্বতের পঁয়ত্রিশ বছরকেও ছাপিয়ে যায়! শেষরাতের স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যায় ফাতিমার চোখের জলে। মহব্বত পাশ ফিরে শোয়।
সকালের রোদ চড়াও হয়েছে ফাতিমার উঠানে। ছাতনা পরা খুদগুলোর আষ্টে গন্ধটা কেটে গেছে অনেকটা। গরুর খুঁটির উপর একটি ডাহুক পাখি বসে লেজ নাড়ছে। ক্ষয়ে যাওয়া একটি সাবান দিয়ে ফাতিমা ঘাটের দিকে চলে গেছে। বাপের নাক ডাকার শব্দে আলাল দুলাল এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ ফিরে ঘুমায়।
ভরা বাদলে নেত্রকোণা জেলার মগড়া নদীর পাড়ে জন্ম। তারিখটি ছিল ১১ আষাঢ়। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে মেজো। সমাজকর্মে স্নাতোকোত্তোর। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। গবেষক ও কথাসাহিত্যিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : গবেষণা : বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক্সট্রা অভিনেত্রী, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, তথ্য মন্ত্রণালয়। প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা, জুন, ২০১২, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। ছোটোগল্প : ফিরে আয় মাটির পুতুল, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬, চিত্রা প্রকাশনী। উপন্যাস: অম্বা আখ্যান, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। (জলসিঁড়ি কথা সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত), কবিতার বই : শূন্যাতা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৬, বইপত্র গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স।