বুধবার, নভেম্বর ২০

কায়ান্তর : বহুরূপীর আড়ালে বেদনার এক সিনেকাব্য

0

উন্নয়ন ও প্রযুক্তির কল্যাণে দ্রুতই বদলে যাচ্ছে গ্রাম, তার সাথে শতশত বছরের ঐতিহ্য, শিল্প ও লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানও হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের বুক থেকে। রাজনৈতিক কূটচালে, মৌলবাদের অপতৎপরতায় বিনষ্ট হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও। একসময় গ্রামের মেঠোপথে, বাজারে, মেলায় বহুরূপী শিল্পীদের দেখা পাওয়া যেত। সময় প্রবাহে এখন তা অন্যান্য গ্রামীণ সংস্কৃতির মতোই হারিয়ে যেতে বসেছে, অন্যদিকে শিল্পের বদলে বিভিন্ন মুখোশের আড়ালে বাড়ছে বহুরূপী মানুষের সংখ্যা। রূপান্তরিত সময় ও গ্রামের পটভূমিতে নির্মিত বহুরূপী শিল্পীদের বেদনারই এক সিনেকাব্য ‘কায়ান্তর’ যা আবর্তিত হয়েছে সমাজের বিভিন্ন বাস্তবতায়।

Kayantar_1_Sree

‘কায়ান্তর’ সিনেমার দৃশ্য আছিয়া

‘আলী’ একজন বহুরুপী শিল্পী যিনি মুসলমান হয়েও দেবী কালীর সাজে সাজেন। এটা তার পেশা এবং জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। যে আলীর মনের ভেতর একজন মুক্তমনা শিল্পী বসবাস করে, যিনি তার বাপ দাদার এই জীবিকাকে সম্মানের সাথে বুকে ধারণ করেন, সেই আলীই তার মেয়ের বহুরূপী সাজার বাসনাকে বেশ্যা হয়ে পথে নামা মনে করেন। তার কন্ঠেই আবার শোনা যায় লালনের সম্প্রীতির গান। আলীর মনের এই রূপান্তর গ্রামের ‘হাজী চাচা’র মনেও দেখা যায়। ‘হাজী চাচা’ যখন আলীর ছেলে আসলামের কালী সেজে বহুরূপী হওয়াকে কিছুটা প্রশ্রয়ের চোখে দেখছেন বলে মনে হয়েছে, তিনিই আবার আলীর কাছে এটাকে কাফেরের কাজ বলে আখ্যায়িত করছেন, অনাসৃষ্টি বলছেন।

Kayantar_2_Sree

সিনেমার দৃশ্য-২

বিনোদনের অনেক জানালা খুলে যাওয়ায় অন্যান্য গ্রামীণ শিল্প-সংস্কৃতির মতো বহুরূপী শিল্পও হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছে হাস্যকর বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে। তাই কালীর সাজে সজ্জিত আসলামের পেছনে যখন ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা নিছক মজা নিতে ছোটে, আসলামকে ‘কালী’ ‘কালী’ বলে কটাক্ষ করে— তখন অবাক লাগে না। অবাক লাগে না তখনও, যখন হিন্দু মৌলবাদীদের মিছিল থেকে হেনস্তার উদ্দেশ্যে উপহাসের হাত এগিয়ে আসে আসলামের দিকে। এই উপহাস কি শুধুই মুসলমান হয়ে কালী সেজেছে বলে, নাকি এ উপহাস বহুরূপী শিল্পের প্রতিও? ‘কায়ান্তর’ চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হয়। এই উপহাসে, হেনস্তায় আসলাম নিজেকে বিপন্ন ভাবে, যা তার পিতা ও বোনের দেওয়া বিশ্বাস ও সাহসেও দূর হয় না। আসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাওয়ার ভাবনা তো সমসাময়িক বাস্তবতারই প্রতিফলন। সংখ্যালঘুদের বিপন্নতার ভাবনা তো পৃথিবীর সকল দেশেই সমান।

Kayantar_5_Sree

সিনেমার ‍দৃশ্য-৩

সমগ্র চলচ্চিত্রটি পাঠ করলে বোঝা যায়, পরিচালকদ্বয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন— যা বিপন্ন হচ্ছে ধর্মান্ধদের কূটচালে, কুসংস্কারে আবৃত অসুস্থ মনের রাজনীতিতে। ‘কায়ান্তর’ বদলে যাওয়া গ্রামের কথা বলে, হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পের কথা বলে, বলে নারীমুক্তির কথা। তাই, গ্রামের নিরীহ মেয়ে আছিয়ার চোখে নারীমুক্তির আকুতির ছায়া দেখা যায়। আসলাম যখন বহুরূপী সাজাকে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে তুলনা করে তখন আলীকে ক্ষেপে গিয়ে বলতে শোনা যায় :

‘আমার বাপ দাদার শিল্পকে তুই ভিখ বলে মনে হয়, হারামজাদা!’

Kayantar_3_Sree

শুটিংয়ের সময়

২.
কিশোরী আছিয়া যখন ভাই আসলামকে সাথে নিয়ে বহুরূপী সেজে মেঠোপথ ধরে হেঁটে যায়, তখন পা বেয়ে নেমে আসা রক্তস্রোত দেখে সে বিরক্তই হয়, বিষণ্ন হয়। মনের প্রচণ্ড ইচ্ছেকে বলি দিয়ে তাকে পুকুরে ঝাঁপ দিতে হয়। এর পরেই আমরা তরুণী আছিয়াকে দেখি। এই কায়ান্তরে হয়তো আছিয়ার আর বহুরূপী সাজা হয় না।


`কায়ান্তর’ সিনেমার ট্রেলার


পুকুরের রক্তে মেশা লাল জলে আছিয়ার ইচ্ছেরই বিসর্জন হয়ে যায়। কিন্তু মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে। তাই সে মনের মাধুরী মিশিয়ে শরীরে, মুখে কালি মাখে। মেলায় দাঙ্গার পর আছিয়া ও আলী যখন রেল লাইন ধরে আসলামের খোঁজ করে, তখন বহুরূপী সাজের সরঞ্জাম পড়ে থাকতে দেখে দুটি সম্ভাবনার কথাই মনে পড়ে। এক. দাঙ্গায় আসলামকে হত্যা করা হয়েছে। দুই. রাতের ট্রেন ধরে আসলাম শহরে পালিয়ে গেছে। এখানে পরিচালকদ্বয় দর্শকের উপর নির্ধারণের ভার ছেড়ে দিলেও, তার একটা ঈঙ্গিত আমরা পূর্বের একটি দৃশ্যেই পেয়ে যাই। সেদিন সকালে আলী ও আছিয়ার কাছ থেকে আসলামের বিদায় নেওয়াটা অন্যদিনের মতো ছিল না। একটু ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই সে ‘খোদা হাফেজ’ বলে বিদায় নেয়; যেন সে জানে সে আর ফিরবে না। দাঙ্গার পর ছুটে চলা রাতের ট্রেন, আসলামের বহুরূপী সাজা ছেড়ে দিয়ে শহরে চলে যাবার আকুতি, দ্বিতীয় সম্ভাবনাকেই জোরালো করে তোলে। যাই হোক, দুটো সম্ভাবনার যে কোনো একটি বেছে নিলেও,তা চিত্রনাট্যের গাঁথুনিকে দুর্বল করে না কোনোভাবেই। রেললাইনের উপর অবহেলায় পড়ে থাকা আসলামের সাজের সরঞ্জাম দেখে আলীর আর্তনাদ তো কেবল পুত্র হারানোর বেদনা নয়, এ আর্তনাদ তার বাপ দাদার শিল্পের চরম অবমাননার জন্যও বটে।

৩.
সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জিত না হলেও, নারীরা আজ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান অনেকে শক্তিশালী হয়েছে। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া গ্রামের আছিয়ার মনেও প্রভাব ফেলেছে। তাই হয়তো আছিয়া তার পিতা আলীকে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারে—

‘মেয়েরা তো আজ অনেক কিছুই করছে, তবে আমি কেন আমার বাপ দাদার কাজ করতে পারব না?’

আছিয়ার পিতা রাজি না হলেও আসলামের অনুপস্থিতির কারণে আছিয়াকেই সেই শিল্পের ধারা বহন করতে হলো। মিড লং শটে রেল লাইন ধরে কালীর সাজে আছিয়া যখন ক্রমান্বয়ে ক্লোজআপে, বিগ ক্লোজ আপে স্থির হয়, তখন মনে হয় আছিয়া এগিয়ে এলো মুক্তি, শক্তি ও সময়ের প্রতীক হয়ে। গ্রামের সহজ সরল আছিয়া রূপান্তরিত হলো মুক্তি ও শক্তির প্রতীক হিসাবে। পুকুরের লাল জলে যে ইচ্ছের বিসর্জন হয়েছিল তার যেন পুনর্জাগরণ হলো।

শুরুর দিকে আছিয়া ও আসলামের রেললাইনের পাশ দিয়ে ছুটে চলা সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র অপু ও দুর্গার কথা মনে করিয়ে দিলেও, কালীর সাজে আলীকে দেখে আছিয়ার হাতের খেলনার খড়গ পড়ে যাওয়া, ভয় পেয়ে বিষণ্ন মনে মাথার মুকুট খুলে ফেলা এবং ‘আব্বা’ বলে আলীকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য অন্যকিছু বলে যা পরবর্তীতে ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক ছিল। চলচ্চিত্রটিতে শব্দ সংযোজনে সচেতনতার ছাপ পাওয়া যায়। বালক আসলামের ঢোলের কাঠি ভাঙার শব্দ, আছিয়ার ভাসন মাজার শব্দ, ট্রেনের হুইশেল, বাতাসে গাছের পাতার মর্মর, পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, কুকুরের করুণ আর্তনাদে গ্রাম বাংলার পরিবেশ খুব ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। এমনকি আলীর কন্ঠে খালি গলায় লালনের গান, নজরুল গীতি বেমানান ঠেকে না কোনোভাবেই এবং তা আলী চরিত্র রূপায়নকারী জনার্দন ঘোষের কণ্ঠেই গীত হওয়ায় তা আরও প্রাণবন্ত হয়ে যায়। রাতের বেলায় হারিকেনের আলোর দৃশ্যগুলোতে আলোর ব্যবহারের পরিমিতিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও আলোক নিয়ন্ত্রনে হারিকেনের আলো ফুটিয়ে তোলা খুব কঠিন কাজ বলেই মনে হয় তবু ‘কায়ান্তরে’ হারিকেনের আলো ও আঁধারের মায়াবী খেলা খুব ভালোভাবেই চিত্রায়িত হয়েছে।

Kayantar_Directors_Sree

রাজদীপ পাল এবং শর্মিষ্ঠা মাইতি

সর্বোপরি, ‘কায়ান্তরের’ প্রধান তিনটি চরিত্র রূপায়নে মধুরিমা তরফদার (আছিয়া), জনার্দন ঘোষ (আলী), শুভঙ্কর মোহন্ত (আসলাম) নিজেদের অভিনয়ের মেধার পুরোটাই ব্যবহার করেছেন। আছিয়া চরিত্রে মধুরিমা তরফদারের কৌতুকপূর্ণ চোখের মুভমেন্ট এবং ভাইয়ের প্রেমিকার নাম জেনে ঈর্ষা প্রকাশ, খুনসুটি, পিতার সাথে নিজের যুক্তি উপস্থাপনে দৃঢ়তা, গ্রামের বখাটের সামনের কঠোরতা, পিতার শাসনে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা, লুকিয়ে কালী সাজার সময় গোপন আনন্দ এবং রেল লাইন ধরে কালী সেজে এগিয়ে যাওয়ার সময় দীপ্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদি খুব মেপে মেপে করেছেন বলেই মনেই হয়েছে। আছিয়া চরিত্রটির মাঝে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মধুরিমার প্রানবন্ত অভিনয়ে। তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক রাজদীপ পাল এবং শর্মিষ্ঠা মাইতি তাদের ২৯ মিনিটের এই চলচ্চিত্রে গ্রাম বাংলার চিত্র, লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি, মৌলবাদ, মার্তৃহীন ভাই-বোনের ভালোবাসা এবং নারীমুক্তির কথা গভীর পর্যবেক্ষণ, অনুভূতি ও অপূর্ব ডিটেইলিং এর মাধ্যমেই তুলে ধরেছেন। অরোরা ফিল্মস প্রযোজিত ‘কায়ান্তর’ চলচ্চিত্রটি ২০১৯ সালে মুক্তি পায়। ২৯ মিনিটের এ চলচ্চিত্রটি সে বছরই শিকাগো সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রথম প্রদর্শিত হয়।

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

পেশায় ব্যাংকার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। শাবিপ্রবির চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন চোখ ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক ছোটোকাগজ ‘প্রক্ষেপণ’ সম্পাদনায়ও যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েব পত্রিকায় নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধ ও গল্প লিখছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।