তরুন : কপারনিকের শহর
শাকুর মজিদ
আমাদের পঞ্চপর্যটকদের নিয়ে ওমর ভাইয়ের ভ্যান গাড়িটি ছুটে চলে ওয়ারশোর দিকে। কিছুদূর যাত্রাও করেছি আমরা, বিকেলের পড়ন্ত রোদে পোল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। চিক চিক করছে সবুজ পাতা। প্রশস্ত হাইওয়ে। গাড়ির স্পিড ঘন্টায় প্রায় দেড় শ কিলোমিটার। গান বাজছে, বাংলাদেশি গান।
আমাদের গাড়িটি ‘তরুন’ লেখা একটা এক্সিটের ভিতর প্রবেশ করে এবং কোপার্নিকাসের নাম লেখা একটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আমরা অতিক্রম করে ফেলি। সামনে একটা নদী। ভিসতুলা নদীর ওপর একটা লোহার সেতু। বেশ পুরনো। এটা পার হতেই চোখে পড়ে এক বিরাট প্রাচীর দেয়াল। আমরা যখন এই তরুণ শহরে এসে পৌঁছি, তখন প্রায় সন্ধ্যা। নদীর পাড়ে মানুষের হাঁটাহাঁটি, নদীর কিনারে গড়ে উঠা ৮ শ বছরের পুরনো রাজপ্রাসাদের অংশ, যার বিম্বিত রূপ এসে পড়েছে ভিসতুলার জলে, তাকে দেখতে দেখতে পুরনো এই শহরটাতে যখন এসেই পড়লাম, তখন এটা একটা মরা হাট।
মিকোলাই কপারনিক
১৪৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। এই তরুন শহরের এক বাড়িতে জন্ম হয় এক শিশুর। তাঁর বাবা জার্মান, মা এই শহরের এক বড়োলোকের মেয়ে। চার ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোটো। ছোটোবেলা ছেলেটার প্রজ্ঞা দেখে বিমোহিত হন তাঁর চাচা। এই চাচা আবার খুব বিদ্বান। তিনি তাঁর ভাতিজাকে ভর্তি করান তরুণের ‘সেন্ট জন’ স্কুলে। ১৯ বছর বয়সে এখান থেকে চলে যান পিতৃভূমি ক্রাকভ শহরে। ক্রাকভ তখন পোল্যান্ডের রাজধানী। সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তিনি ভর্তি হন কলা বিভাগে। একটানা চার বছর এখানে পড়তে গিয়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর জ্ঞানার্জন করেন। ১৪৯৫ সালে কোনো সার্টিফিকেট না নিয়েই ছেড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর আইনশাস্ত্র পড়ার জন্য যান ইতালি। ১৫০৩ সালে ইতালির বলগনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু বড়োই অস্থির তাঁর মন। আইনের সাথে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের কোনোই সম্পর্ক নাই। কিন্তু তিনি ডাক্তারি শিখতে চাইলেন। ভর্তি হলেন মেডিক্যাল স্কুলেও। ১৫০৩ সালে, তিরিশ বছর বয়স-সীমার মধ্যেই শেষ করলেন তাবৎ পড়াশোনা। শুরু হলো কর্মজীবন। এই হলো নিকোলাস কোপারনিকাস।
কোপারনিকাস বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর হেলোসেনট্রিক থিওয়োরির জন্য। কিন্তু এটুকু ছাড়াও তাঁর আরও অনেক পরিচয় ছিল। এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী চিকিৎসক, বিচারক ছাড়াও ছিলেন একজন অংকশাস্ত্রবিদ, অনুবাদক, চিত্রশিল্পী, ধর্মগুরু, শাসক, সেনাকর্মকর্তা, কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ।
কোপারনিকাস বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর হেলোসেনট্রিক থিওয়োরির জন্য। কিন্তু এটুকু ছাড়াও তাঁর আরও অনেক পরিচয় ছিল। এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী চিকিৎসক, বিচারক ছাড়াও ছিলেন একজন অংকশাস্ত্রবিদ, অনুবাদক, চিত্রশিল্পী, ধর্মগুরু, শাসক, সেনাকর্মকর্তা, কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ।
কোপারনিকাসের জন্ম শহর
আমরা সকালবেলা আবার এসে পৌঁছাই এই তরুন শহরে। শহরটা ছোটো। ১১৭ বর্গকিলোমিটারের মতো আয়তন। লোক সংখ্যা ২ লাখের মতো। ১২৩৩ সালে এই জনপদ শহরের মর্যাদা পায়। তখন তার নাম ছিল থর্ন। থর্ন থেকে নাম হয়েছে তরুণ।
শহরের নতুন অংশটিতে দেখার মতো তেমন কিছুুই নাই। ইউরোপের আর দশটা শহরতলীর মতোই তার অবয়ব। কিছু অফিস বিল্ডিং, কিছু দোকানপাট। প্রশস্ত সড়ক, দুইপাশে গাছগাছালি। আমরা নেমে পড়ি পুরান শহরে। এই পুরান শহরটা নিয়েই মানুষের কৌতূহল অনেক বেশি। স্থানীয় কিছু লোকের দেখা আমরা পাই। এই লোকগুলোর বেশিরভাগই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর কালো কাপড় পরা খ্রিষ্টান যাজক।
যে দিকেই চোখ যায়, সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের আভিজাত্য আর কোপারনিকাস।
কোপারনিকাস এখানে জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন বলেই বছরে প্রায় পনেরো লাখ পর্যটক এখানে আসেন। এই খোলা ময়দানের রেস্টুরেন্টে খান, এখানকার হোটেলে থাকেন, বিকাল বেলা ভিসতুলা নদীর পাড় দিয়ে আরাম করে হাঁটেন।
মধ্যযুগে ইউরোপের প্রায় সব শহরেই এক ধরনের নাগরিক উদ্যান অত্যাবশ্যকীয় ছিল। চার দিকে ঘরবাড়ি, মাঝখানে বড়ো খেলার মাঠের মতো একটা খোলা জায়গা। এ জায়গাতে সবাই মিলিত হতেন, হাট-বাজার করতেন, আবার ঘরে ফিরে যেতেন। এই ‘আরবান ফোরাম’-কে কেন্দ্র করেই তাঁদের প্রাত্যহিকতা ছিল। এখনকার জীবনধারা অন্য রকম। বিনোদনের ও শপিংয়ের জন্য ক্ষেত্র বদলেছে। কিন্তু মধ্যযুগে তৈরি হওয়া এই নাগরিক উদ্যানটাতো আর নিঃশেষ করা সম্ভব নয়। তাই শিলা পাথরে বাঁধাই করা পুরনো রাস্তা ধরে আমরাও হাঁটি।
এখানে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই কারো। গাড়ি রাখতে হবে মাইল খানেক দূরে। না হাঁটলে ঘোড়ায় চড়া যাবে। আগের দিনের অভিজাত রাজেন্যবর্গ যেমন ঘোড়ায় চড়েই যাতায়াত করতেন, এখানেও সেই ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের ঘোড়ায় চড়ার সময় নাই, আমি ঘোড়াওয়ালাদের ছবি তুলি। আমার সামনে কোপারনিকাস। এক হাত দিয়ে তিনি আকাশের সূর্য নির্দেশ করছেন। যে সূর্যকে কেন্দ্র করেই আসলে সবকিছু ঘুরছে। আর অন্য হাতে তিনি ধরে আছেন জোতিষশাস্ত্রের স্মারকবাহী গোলক। যে গোলকেরও কেন্দ্রবিন্দু আসলে সূর্য।
এই ছোট্ট শহরটির যে দিকেই চোখ যাবে, কোপারনিকাসকে কেউ অবহেলা করতে পারবেন না। কলেজের নাম, সড়কের নাম, উদ্যানের নাম, সব কিছুর সাথেই একটা কোপারনিকাসযুক্ত হয়ে আছে।
পোল্যান্ড খ্রিষ্টান প্রধান দেশ। এখানে এমন কোনো পুরনো শহর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার আকাশে কোনো গির্জার মিনার নাই। এখানেও একটা গির্জা আছে— চার্চ অব হলি স্পিরিট। গথিক আমলের শেষ দিকের এই চার্চটি কোপারনিকাসের সমান বয়েসি। এই চার্চের যাজকেরাও তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ, তাঁর হেলোসেনট্রিক থিওয়োরিটি ছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীতে। গোঁড়া খ্রিষ্টানরা এ বিষয়টা সহজভাবে নেননি। ‘পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে’—এমন মতবাদ পৃথিবীর বড়ো ৩ টা ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করে। যে কারণে ইহুদী, খ্রীষ্টান বা মুসলমানেরা কেউই কোপারনিকাসের এ যুক্তিটাকে গ্রহণ করতে চাননি। সময় সবচেয়ে বড়ো বিচারক। সময়ের বিচারে কোপারনিকাস উত্তীর্ণ হয়েছেন আরও ৩ শ বছর আগেই। এখন কোপারনিকাস কেবল বিজ্ঞানীই নন, বাণিজ্যের সামগ্রীও। যে এলাকার জনগণ একসময় তাঁকে নিগৃহীত করেছিল, সে সব জনগণের উত্তরপুরুষেরা আজ কোপারনিকাসের জন্য ধন্য। কোপারনিকাস নিজে অবিবাহিত ছিলেন, হেলোসেনট্রিক থিওয়োরি ছাড়া আর কোনো উত্তরাধিকার তিনি রেখে যেতে পারেননি।
মধ্যযুগে নির্মিত এই শহরটি কিন্তু নিরিবিলি বেড়ানোর জন্য অনেক চমৎকারও। ১৯৯৭ সালে এ শহরকে ইউনেসকো তাদের হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তরুণের পুরাতন শহর এলাকা পোল্যান্ডের ‘৭টি আশ্চর্যজনক’ এলাকার একটি। শুধু তাই নয়, পুরনো শহরের গথিকরীতির দালানকোঠাগুলো বিশ্বের ৩০টি সুন্দর দালানের তালিকায় আছে।
এই চমৎকার শহরটির সিটি হলের সামনে আমরা এসে দাঁড়াই। চতুর্দশ শতাব্দীর এই দালানটি এখনো বেশ নিখুঁতই। ওপরে একটা ঘড়ি আছে। দশ-তলার সমান উচ্চতার এই সিটি হলটি বানানো হয়েছিল ১৩৮৫ সালে। এ দালানটি বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার হয় ১৬০৪ সালে। গথিকধারার স্থাপত্যের যুগ তখন। সে কারণে সে রীতির প্রভাব এ দালানের সবখানে।
সিটি হলের এই মিনারটি সে সময়ে তরুন শহরের ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৪৩০ সালের দিকে এটি তরুন শহরের কয়েদখানা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। এ দালানটির মাথার ওপরে একটি সোনালি রঙের মুকুট শোভা পাচ্ছে সে সময় থেকেই। এটি যে একসময় কয়েদখানা ছিল এই সোনালি মুকুটি তারই প্রতীক।
মাঝখানে অফুরন্ত খোলা জায়গা রেখেই ফুটপাতের কিনারা ঘেঁষে রাস্তার ওপর অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্টেুরেন্ট। এগুলোতে ভারী খাবার তেমন পাওয়া যায় না। বিয়ার কাফে নামে একে ডাকা হয়। কফি এবং বিয়ার এখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়।
দিনের বেলাতে এই ফুডকোর্টগুলো খোলামেলাই থাকে। কিন্তু রাতে যখন ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করে তখন ফুডকোর্টগুলো ট্রান্সপারেন্ট পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে করে ঠান্ডা বাতাস পর্যটকদের আড়াল করলেও বাইরের দৃশ্যাবলি যেন পর্যটকদের আড়াল না হয় সে কারণেই এ ব্যবস্থা।
আর প্রতিটি ফুডকোর্টেই থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন রঙের কম্বল। পর্যটকেরা খেতে এসে শীতে কষ্ট পাবেন কেন? কোনো পর্যটক চাইলেই এখান থেকে একটি কম্বল চেয়ে নিয়ে শরীরে পেঁচিয়ে নিতে পারেন।
সিটি স্কোয়ারে আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তাদের ফুলের দোকান। বেশ কয়েকটি দোকান এখানে। অনেকটা ফুটপাতের দোকানের মতো। দোকানের ওপর তাঁবু ঝোলানো। অনেক ধরনের ফুল রাখা এখানে। সবগুলো ফুলের গায়ে তার দাম লেখা। দেখি বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এখানকার লোকজন, প্রায় সবাই, দোকানে ঢুকে অন্তত একটা ফুল কিনে নিচ্ছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে এসেছেন যে বুড়ি, একা, তিনিও বাড়ি ফেরার সময় দুটো গোলাপ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন! বাহ!
পোল্যান্ডের লোকেরা খুব ফুল প্রিয়। ফুল কোনো আনুষ্ঠানিক উপহারের বিষয় নয়। ফুল প্রাত্যহিক ব্যবহার্য এক ধরনের জিনিসে পরিণত হয়ে গেছে তাদের কাছে। পোল্যান্ডের অন্য শহরগুলোতেও একই রকমের বিষয় দেখা যাবে।
পোল্যান্ডের লোকেরা খুব ফুল প্রিয়। ফুল কোনো আনুষ্ঠানিক উপহারের বিষয় নয়। ফুল প্রাত্যহিক ব্যবহার্য এক ধরনের জিনিসে পরিণত হয়ে গেছে তাদের কাছে। পোল্যান্ডের অন্য শহরগুলোতেও একই রকমের বিষয় দেখা যাবে।
তরুনের এই পুরাতন শহরে বেড়াতে আসা পর্যটক আর গোথিক স্থাপত্য-কৌশলে নির্মিত ইমারতসমুহ দেখতে দেখতে আমরা চলে আসি চার্চ অব হলি ঘোস্ট-এর সামনে। গোথিক সময়ের আরও কিছুটা পরে যখন ভবনগুলোর অলংকরণ কিছুটা কমে এসেছে, সে সময়ে কিছুটা গ্রিক স্থাপত্যরীতিকে অনুসরণ করেই এই চার্চটি নির্মাণ করা হয়। সে-কারণেই এই চার্চটিকে কয়েকটি গ্রিক স্থাপত্যরিতীর করিয়ন্থীয় কলামের ওপরে দাঁড় করানো।
সিটি স্কোয়ারের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ে একটা সাইনবোর্ড। তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা, Kopernika বাহ্! তাহলে এ সড়কেই তাঁর বাড়ি?
ডোম মিকোলাই কোপারনিকা
আমরা তীরচিহ্ন বরাবর হাঁটতে শুরু করি। সেই পাথুরে ইট-বিছানো পথ। দু’পাশে খুব সরু ফুটপাত। ফুটপাতগুলোর ওপরই ৪-৫ তলা উচ্চতার সারি সারি বাড়ি। রাস্তা থেকে ঘর উঠে গেল, কোনো সেটব্যাক নাই। এই নিয়ম ইউরোপেও যেমন, আমাদের তাঁতী বাজারেও তেমন! ৭-৮ টা বাড়ি পার হতেই আমরা থেমে যাই। এটাই সেই জাদুঘর! লোকজনের তেমন ভিড়ভাট্টা নাই।
বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে জোতির্শাস্ত্র-সংক্রান্ত চিত্রকর্ম। তার পাশেই রাখা কোপারনিকাসের লেখা সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্র। এই বইতেই তিনি দেখিয়েছেন, সূর্যই এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত শক্তির আধার। সূর্যকে কেন্দ্র করেই সব কিছু আবর্তিত হচ্ছে। জ্যোতির্শাস্ত্রের আরও অনেক খুঁটিনাটি গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র-নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান এবং কী করে সেগুলো অবস্থান পরিবর্তন করে তার চিত্র।
এই বাড়িটি নতুন করে বানানো হয়েছিল ১৯৬০ সালের দিকে। পঞ্চাদশ শতাব্দীর গথিক স্থাপত্যধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে নতুন করে বানানো হয় এই বাড়িগুলো। বাড়িটির বাইরের ফ্যাসাদ জুড়ে কারুকাজ।
এই বাড়িটিতেই কোপারনিকাস জন্মেছিলেন এবং জন্মের পরের প্রথম সাত বছর এই বাড়িটিতেই কাটিয়েছেন।
বাড়িতে ঢোকার মুখের দরজায় পোলিশ ভাষায় বাড়িটির নাম লেখা ‘ডোম মিকোলাই কপারনিকা’। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে জোতির্শাস্ত্র-সংক্রান্ত চিত্রকর্ম। তার পাশেই রাখা কোপারনিকাসের লেখা সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্র। এই বইতেই তিনি দেখিয়েছেন, সূর্যই এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত শক্তির আধার। সূর্যকে কেন্দ্র করেই সব কিছু আবর্তিত হচ্ছে। জ্যোতির্শাস্ত্রের আরও অনেক খুঁটিনাটি গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র-নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান এবং কী করে সেগুলো অবস্থান পরিবর্তন করে তার চিত্র।
চিকিৎসক কোপারনিকাস যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ঔষধ তৈরি করতেন তা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে সযতনে। কোপারনিকাস যে সব তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন সেসবেরও দেখা মেলে এই জাদুঘরটিতে।
আমরা এ-ঘর ও-ঘর করতে থাকি। ৬ শ বছরের পুরনো সেই কাগজ, সেই দূরবীন, সেই জ্যামিতির কম্পাস দেখে দেখে পুলকিত হই।
এই জাদুঘরে বেশি সময় আর থাকা হয় না আমাদের। পাশাপাশি একই ডিজাইনের দুটো বাড়ি। যে বাড়িটিতে তাঁর জন্ম সেটা ঠিক পাশের দালান। পরপর দু’টো দালান নিয়ে এই জাদুঘর।
তাঁর জন্মঘরটির ৩টি ফ্লোরই সাজানো হয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর ব্যবহৃত তৈজসপত্র দিয়ে। সেই মাটির রান্নাঘর, কাঠের লাকড়ি, ঘর গরম রাখার কয়লা, নিজের কাপড় নিজে বোনার তাত মেশিন, সেই বাসন-কোশন এবং কাপড়চোপড় দিয়ে। কোপারনিকাসের নানা যেহেতু বিত্তশালী ছিলেন, তাই পঞ্চদশ শতাব্দীর সম্ভ্রান্তপরিবারে ব্যবহৃত কাঠের কারুকাজময় শোবার খাট, আলমিরা এবং চেয়ার টেবিলও এখানে রাখা আছে সাজিয়ে। শুধু তাই নয়, সে সময়ের পোশাক পরে মোমের মূর্তির অবয়ব নিয়ে পঞ্চদশ শতকের পোলিশ নারী-পুরুষের ঘরকন্নার পরিবেশটিও প্রায় নিখুঁতভাবে এখানে সাজানো।
কোপারনিকাস দেখা আমাদের শেষ হয়ে যায়। এবার অন্য গন্তব্য। তরুন থেকে ওয়ারশো প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের ওয়ারশো পৌঁছার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতগুলো শুকিয়ে লেস ওয়ালেসার নব জাগরণের পর ওয়ারশো নাকি তরতর করে বেড়ে উঠছে। আমরা ওয়ারশোর পথে রওয়ানা হই।
ধারাবাহিকটির অন্যান্য পর্ব পড়ুন :
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০২
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫। তিনি একজন বাংলাদেশি স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।