ভারশাবা : ফিনিক্স সিটি
শাকুর মজিদ
৫শ বছরের গৌরবগাঁথা নিয়ে জ্বলজ্বল করছিল প্রাচীন ঐতিহ্যের জনপদ, পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার প্রতি দশটি স্থাপনার মধ্যে আটটিই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ফিনিক্সের ডানার তলা থেকে বেরিয়ে আসা নবজাতক পাখিটির মতো আবার গড়ে উঠে নতুন শহর, অবিকল পুরনো শহরটির মতো। এই বিস্ময়কর পরিবর্তনটুকু একেবারেই হাতে-নাতে পরীক্ষা করার জন্য আমাদের পঞ্চপর্যটক বাহিনীর ওয়ারশো যাত্রা।
কোপারনিকাসের শহর তরুন ছেড়ে এসেছি বিকেল বেলা। ওয়ারশো পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার আলোয় নতুন ওয়ারশো দেখে কোনোভাবেই বোঝার কোনো উপায় নেই যে, মাত্র ৫০-৬০ বছরের মাথায় এই শহর এতটুকুতে এসেছে। ইউরোপের যে কোনো শিল্পোন্নত শহরের মতোই তার অবয়ব। সেই প্রশস্ত রাস্তা, উঁচু উঁচু অফিস বিল্ডিং থেকে ঠিকরে পড়া আলো, সুবিশাল প্লাটফর্মের রেল-স্টেশন এবং তার পাশেই ওয়ারশোর সেই ঐতিহাসিক আইকনিক স্ট্রাকচার, ‘প্যালেস অব কালচার অ্যান্ড সাইন্স’।
গথিক চার্চের আদলে এই সুউচ্চ ইমারতটি যখন বানানো হয় ১৯৫২ সালে, এটাই ছিল পুরো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ভবন। এখনো পর্যন্ত পুরো ইউরোপের মধ্যে উচ্চতার দিকে তার অবস্থান ১২তম।
গথিক চার্চের আদলে এই সুউচ্চ ইমারতটি যখন বানানো হয় ১৯৫২ সালে, এটাই ছিল পুরো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ভবন। এখনো পর্যন্ত পুরো ইউরোপের মধ্যে উচ্চতার দিকে তার অবস্থান ১২তম। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের একটা প্রতীক হিসেবে এক সময় বানানো এই ভবনটি থেকে বর্তমান পোলিশ জনগণ মস্কোপন্থি সমস্ত স্মৃতি নিঃশেষ করতে চাইছে। এটা বানানোর সময় মস্কো তার ৩৫০০ শ্রমিক দিয়ে সাহায্য করেছিল।
নির্মাণের সময়, এমনকি সোভিয়েতভুক্ত সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি পর্যন্ত এই ল্যান্ডমার্ক স্থাপনাটির নাম ছিল সোভিয়েত কম্যুনিস্ট নেতা স্টালিনের নামে ‘যোসেফ স্টালিন প্যালেস অব কালচার এন্ড সাইন্স’। এখনও ভবনটি আছে, কিন্তু তার নাম থেকে প্রথম দুটো শব্দ বাদ পড়েছে। স্টালিন সাহেব বাদ পড়েছেন দালানের লবিতে যেখানে খোদাই করে তাঁর নাম লেখা ছিল, সেখান থেকেও। লেস ওয়ালেসা সোভিয়েত বিদ্বেষী যে চেতনা পোলিশদের ভেতর আন্দোলিত করে দিয়েছিলেন, এটা তারই প্রকাশ।
ওয়ারশোর সকাল
সকাল বেলা কিন্তু রাস্তায় নেমেই দেখি নিকোলাস কোপারনিকাসকে পোল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি শহর স্মরণে রেখেছে। পোল্যান্ডের এই রাজধানী শহরও কোপারনিকাসকে দূরে সরিয়ে রাখেনি।
সিটি সেন্টারের এই খোলাচত্বরের একটি বড়ো অংশে লাল ইট দিয়ে একটি বৃত্ত রচনা করা হয়েছে। এই বৃত্তের ওপরে চিত্রায়িত করা পুরো বিশ্ব ব্রহ্মা-কে। এই ব্রহ্মান্ড ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। মাঝখানে সূর্যকে কেন্দ্র করে জোতিষশাস্ত্রের আঁকিবুকি আর ওপরে চৌ-কোনো বেদীর ওপরে বসে আছেন কোপারনিকাস সাহেব। হাতে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা ব্রহ্মান্ড। এ-যেন কোপারনিকাসের হেলোনেসট্রিক থিওয়োরির এক বাস্তব মডেল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি। একটি প্রধান সড়ক। এই সড়কের একপাশে একটি মূর্তি দেখে আমাদের চোখ আটকে যায়। এটি স্টিফেন কার্ডিনাল ওয়েজেনস্কি প্রেমা পলোস্কীর মূর্তি।
ওয়েজনস্কি অষ্টাদশ শেষের দিকে রাশিয়ার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে ওয়েজনস্কির বাবা ওয়েজনস্কিকে ওয়ারশোতে পাঠিয়ে দেন। ১৯১৫ সালে একটি গ্রামার স্কুল থেকে তার স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেন।
ওয়েজনস্কি অষ্টাদশ শেষের দিকে রাশিয়ার একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে ওয়েজনস্কির বাবা ওয়েজনস্কিকে ওয়ারশোতে পাঠিয়ে দেন। ১৯১৫ সালে একটি গ্রামার স্কুল থেকে তার স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেন। ২৪ বছর বয়সে ওয়েজনস্কি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হন। তারপর থেকে তিনি ধর্ম-কর্মের প্রতি ঝুকে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি পোল্যান্ডের প্রাইমেট পর্যন্ত নিযুক্ত হন। ওয়েজনস্কিকে প্রাইমেট অব দ্য মিলেনিয়াম বলেও সম্বোধন করা হতো। ওয়েজনস্কি ইহুদিদের সাথে খ্রিষ্টানদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়ের জন্য অনেক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮০ সালের দিকে ওয়েজনস্কি শ্রমিক আন্দোলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালের ২৮ মে ওয়েজনস্কি মারা যান। সে সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। ১৯৮৬ সালে এই সেন্ট যোশেফ গির্জার সামনে পাথুরে ওয়েজিনস্কিকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়। আজও দেশ যখন কোনো কঠিন সময় অতিক্রম করে তখন দেশপ্রেমিক পোলিশরা ফুল হাতে ছুটে আসে ওয়েজনস্কিও মুর্তির সামনে।
ওয়েজনস্কির মূর্তির ঠিক পেছনেই একটি চার্চ। এটি সেন্ট যোশেফ চার্চ। অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে বোরাক স্থাপত্যরীতিতে চার্চটি নির্মাণ করা হয়। এটিই ওয়ারশোর একমাত্র চার্চ যেটি হিটলারের নাৎসী বাহিনীর আক্রমন থেকে অক্ষত ছিল। চার্চের সামনের দিকে ফ্যাসাদগুলোতে বিভিন্ন মূর্তির নিও-ক্লাসিক্যাল বোরাক স্থাপত্যরীতির প্রতিনিধিত্ব করছে।
এই রাস্তা ছাড়াও একটি রাস্তা বেশ বিখ্যাত এই পুরাতন শহরে, এটি রয়েলরুট। এর বাংলা নাম কী হতে পারে? ‘রাজপথ’ নিশ্চয়ই নয়, এ হবে রাজকীয় সরণি। রাজা-রাজরাদের হেঁটে চলার পথ। পুরনো ওয়ারশোতে এ পথ দিয়েই রাজারা রাজ-প্রাসাদে যেতেন। নিশ্চয়ই রাজকীয় বাহনে চড়ে। আমরা হাঁটি পায়ে পায়ে।
এই রাস্তার দু’পাশেই রাজকীয় কিছু ভবন, সুন্দর সুন্দর কারুকাজ করা। প্রায় সবগুলো দালানের গায়ে পাথুরে মূর্তি। কিছুদূর পর-পর সুউঁচ্চ গির্জা।
রয়েলরুট ধরে একটু হাঁটলেই সামনে, আজকের পোল্যান্ডের গণভবন। যেখানে পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট থাকেন।
আধুনিক স্থাপত্যরীতির সব গুণাগুন নিয়ে ১৬৪৩ সাল থেকে এই ভবনটি এখানে দাঁড়িয়ে। শুরুতে এই প্রাসাদটি কয়েকটি অভিজাত পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি ছিল। পরবর্তীতে ১৮১৮ সালে প্রাসাদটি সরকারী স্থাপনা হিসেবে পরিণত হয়।
আধুনিক স্থাপত্যরীতির সব গুণাগুন নিয়ে ১৬৪৩ সাল থেকে এই ভবনটি এখানে দাঁড়িয়ে। শুরুতে এই প্রাসাদটি কয়েকটি অভিজাত পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি ছিল। পরবর্তীতে ১৮১৮ সালে প্রাসাদটি সরকারী স্থাপনা হিসেবে পরিণত হয়।
জন্মের পর থেকে এই প্রাসাদটি বেশ কয়েকবার আগুনে পুড়ে গেছে এবং বেশ কয়েকবার যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে।
১৮৫২ সালে প্রাসাদটির ওপরে এক মহা-দুর্যোগ নেমে আসে। আগুনে পুড়ে প্রাসাদের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়। শুধুমাত্র কয়েকটি দেয়াল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালগুলোর ওপরে আবার নতুন করে প্রসাদটি নির্মাণ করা হয়। ১৮৭০ সালে প্রাসাদটির সামনে ইভান পাচকেভিচের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
১৯১৮ সালে পোল্যান্ড যখন সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে চলে আসে তখন প্রাসাদটি আবারও সংস্কার করা হয়। তখন থেকে ভবনটি প্রধানমন্ত্রীর অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও প্রসাদটির অল্পবিস্তর ক্ষতিসাধন হয়। ১৯৬৫ সালে যখন পুনরায় এটির সংস্কার করা হয় তখন এর সামনে যেখানে ইভান পাচকেভিচের মূর্তি ছিল সেখানে যোশেফ পিওনাটস্কির মূর্তি স্থাপন করা হয়। সেই মূর্তিটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে।
১৯৮৯ সালে পোল্যান্ডে যখন সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিলোপ সাধন হয় তখন থেকে এই প্রাসাদটি পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট এই ভবনটিতে বাস করেন না। তিনি পোল্যান্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট জোসেফ পিলডস্কির সম্মানে প্রেসিডেন্টের বাসভবন বিলুইডারে স্থানান্তর করেন।
গন্তব্য: পুরাতন শহর
পায়ে-পায়ে অতিক্রান্ত হয়ে যায় পায়ে চলা পথ। এখান থেকেই শুরু হয়েছে ওয়ারশোর পুরাতন শহর। ডানে বামে মধ্যযুগীয় স্থাপত্যরীতিতে নতুন করে বানানো পুরনো দালান। এদের ঠিক কোনোটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন পুনঃনির্মাণ আর কোনোটি আদি আকারে, খুব সহজে তা নির্ণয় করা যায় না।
হাঁটতে-হাঁটতে আমরা চলে আসি রয়েল ক্যাসেল স্কয়ারে। রয়েল ক্যাসেল স্কয়ারটি ওয়ারশোতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের একটি অবশ্য দর্শনীয় স্থান। এখানে এসেই সবার আগে যে জিনিসটি সবার নজরে আসে সেটি এই আকাশছোয়া মূর্তিটি।
সিগিসমন্ড কলাম। রাজা তৃতীয় সিগিসমন্ড ১৫৯৬ সালে ক্রাকভ থেকে এই ওয়ারশোতে পোল্যান্ডের রাজধানী স্থানান্তর করেন। সে কারণেই এই প্রাসাদ ভবনের সামনের চত্বরটিতে মূর্তি বানিয়ে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। এটি ওয়ারশোর ল্যান্ডমার্ক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি পুরো ইউরোপের মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেকুলার মূর্তি।
কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, যে কলামটিকে দেখে সত্যি সত্যি সাড়ে চারশ’ বছরের পুরনো মনে হচ্ছে, আসলে কিন্তু তা-নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসীদের বোমার আঘাতে এই পুরো কলামটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হবার পরের বছরই হুবহু একই মাপে, একই ডিজাইনে এবং একই ধরনের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে আবার নতুন করে বানানো হয় এই কলাম। একটি করিন্থিয়ান কলামের ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা তৃতীয় সিগিসমন্ড। তার এক হাতে যিশুর ক্রুস, অন্য হাতে একটি খোলা তলোয়ার।
সিগিসমন্ডের মূর্তির সামনে একটি প্রাসাদ। লাল লম্বা যে ভবনটি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে, এটিই রয়েল ক্যাসেল। একসময় এটি ছিল পোলিশ রাজাদের অফিসিয়াল বাসভবন। ১৫৯৮ সালে রয়েল ক্যাসেলের প্রথম নির্মাণ হয়েছিল। বারবার সংস্কার হয়ে শেষ সংস্কার কাজ হয় এই সেদিন, ১৯৭১ সালে।
প্রাসাদটি শুরুতে ছিল কাঠের তৈরি। ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে কাঠের প্রাসাদটি বানানো হয়।
কয়েকটা যুদ্ধ বিগ্রহে এই প্রাসাদটির বেশ ক্ষতিসাধন হয়। এই প্রাসাদটির ওপরে প্রথম আঘাতটি আনে সুইডিশরা ১৬৫৫ সালে আর শেষ আঘাত হানে হিটলারের নাৎসি বাহিনী ১৯৪৪ সালের ১০-১৩ সেপ্টেম্বর। রাজা জিয়ামন্ট দ্বিতীয় ওয়াজা প্রাসাদটি নির্মাণ করলেও পরবর্তীতে প্রায় দশজন রাজা এই প্রাসাদটিতে বসবাস করেছেন।
বর্তমানে প্রাসাদটির মালিক পোলিশ সরকার। এখন এটা কেবলই দর্শনীয় একটা বিষয়। এই প্রাসাদ চত্বরের সামনে বেশ খোলামেলা জায়গা। এক সময় নিশ্চয়ই রাজকীয় কত আচার অনুষ্ঠান হতো এই ময়দানে। ময়দান চত্বরের পেইভমেন্ট কিন্তু পাথরের ব্লকের।
ধীরে-ধীরে পুরাতন শহরের একটা ছোটো গলিপথের ভিতর দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে। কোথাও কোথাও একটু থেমে যায়। গাইডের বর্ণনা শেষ হলে আবার চালু হয় গাড়ি।
ত্রয়োদশ শতকে এই পুরাতন শহর এলাকা গড়ে উঠলেও অষ্টাদশ শতকে এই এলাকা তার জৌলুসের স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছিল। এ-সময় এই পোল্যান্ডও ইউরোপের এক জৌলুসময় নগরী। তার এই নাগরিক উদ্যানটি ছিল বণিক ও বিত্তশালীদের অভয়ারণ্য। প্রাত্যহিক বেচাকেনা ছাড়াও নাগরিকদের মিলনকেন্দ্র হিসেবে এর বহুল ব্যবহার ছিল। টাউন হলের সামনে এসে আমাদের গাড়িটি কিছুক্ষণ থামে। একটা দালানের সামনে আমরা আটকে থাকি।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে গথিক রীতির নির্মাণ শৈলীতে বানানো এ ভবনটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হলে সপ্তদশ শতাব্দীতে নতুন করে বানানো হয় রেনেসাঁ স্থাপত্যরীতিতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে একে আবার সংস্কার করা হয় বারোক রীতির স্থাপত্য নকশায়। সেই থেকে এটা এখনো বারোক-রীতির নির্মাণ শৈলীর-ধারা বহন করে আছে।
বারবার এই ভবনটি তার রূপ পাল্টেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গথিক রীতির নির্মাণ শৈলীতে বানানো এ ভবনটি আগুনে পুড়ে ধ্বংস হলে সপ্তদশ শতাব্দীতে নতুন করে বানানো হয় রেনেসাঁ স্থাপত্যরীতিতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে একে আবার সংস্কার করা হয় বারোক রীতির স্থাপত্য নকশায়। সেই থেকে এটা এখনো বারোক-রীতির নির্মাণ শৈলীর-ধারা বহন করে আছে। বহুবছর ধরে এই ভবনটিই ওয়ারশোর ল্যান্ডমার্ক বিল্ডিং হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
একটা খোলা চত্বরের পাশ দিয়ে আমাদের গাড়িটি ছুটে চলে। একটা আদর্শ নাগরিক উদ্যান।
প্রাচীন কাল থেকেই ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরেই শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এই রকম একটা খোলামেলা জায়গা থাকে, যেখানে এসে নগরবাসীরা মিলিত হন। এই ওল্ডসিটি স্কয়ারটিও ওয়ারশোর মিলন কেন্দ্র।
এখন আর স্থানীয় নাগরিকেরা এখানে এসে বাজারহাট করেন না, মেলামেশা বা বিচারিক কাজের জন্যও জড়ো হন না। ইতিহাসের এই সামগ্রী এখন পর্যটকের আকর্ষনীয় স্থানে পরিণত।
মিনিট বিশেকের মাথায় গাড়িটি আবার এসে হাজির হয়ে যায় সেই সিগিসমন্ড কলামটির নীচে।
সেন্ট জনস ক্যাথেড্রাল
আমরা হাঁটতে থাকি ওয়ারশোর ওল্ডটাউনের রাস্তা ধরে। পোলিশরা আসলে ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান। এদের প্রায় সবাই ক্যাথলিক। সে কারণেই পোল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি শহরেই গির্জার আধিক্য। রাজধানী শহর ওয়ারশোতেও আছে বিখ্যাত কয়েকটি চার্চ।
আমরা চলে আসি সেন্ট জনস আর্চ ক্যাথেড্রালের সামনে। এটি একটি ক্যাথলিক চার্চ। এটিই ওয়ারশোর প্রধান চার্চ। গোথিক স্থাপত্যরীতিতে এই চার্চটি নির্মাণ করা হয় চতুর্দশ শতকে।
বিভিন্ন সময়ে এই চার্চটির সংস্কার করা হয়। শেষ সংস্কারটি হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তখন ওয়ারশো আপরাইজিং প্রকল্পের আওতায় এই চার্চটিকে সংস্কার করা হয়। সংস্কারের সময় খুব বেশি খেয়াল রাখা হয় তার আদিতম রূপের প্রতি। চতুর্দশ শতকে যেমন করে এটা বানানো হয়েছিল, ঠিক সেই কায়দায় নতুন করে বানানো হয় বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।
বারোক-স্থাপত্যরীতিতে যে ধরনের অন্দর-সজ্জার কাজ হতো তেমন অন্দর-সজ্জার কাজ চোখে পড়ে চার্চের ভিতরে। কতগুলো বহুভূজি কলামের ওপরে চার্চের মূল কাঠামোটিকে দাঁড় করানো।
বারোক-স্থাপত্যরীতিতে যে ধরনের অন্দর-সজ্জার কাজ হতো তেমন অন্দর-সজ্জার কাজ চোখে পড়ে চার্চের ভিতরে। কতগুলো বহুভূজি কলামের ওপরে চার্চের মূল কাঠামোটিকে দাঁড় করানো। চার্চের ভিতরে যাতে প্রচুর আলো বাতাস থাকে তার জন্য বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো জানালা। আর এই জানালাগুলোতে রঙিন কাচের ব্যবহার। কাচের জানালাগুলোও পেন্টিং করা।
অত্যন্ত শৃঙ্খলার সাথে গুরুগম্ভীর পরিবেশে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানেরা আসেন এই ঐতিহাসিক গির্জাটির ভেতর এবং তারা একজন একজন করে গিয়ে হাজির হোন ক্রুসবিদ্ধ যিশুর সামনে। মোমবাতি জ্বালিয়ে পিতা যিশুর সামনে মাথা নত করে তার আর্জিটি পেশ করেন।
এই গির্জায় মুল প্রার্থণাটি হয় রবিবারে। এই হলঘরে। সেদিন পুরো হলঘরটি ভরে যায়।
ওয়ারশো মৎস্যকন্যা
ওল্ড মার্কেটের এই খোলা চত্বরে এক নারী মূর্তি। অধের্ক মাছ, অর্ধেক নারী। সোজা বাংলায় মৎস্যকন্যা। এই কন্যা আবার ঢাল তলোয়ার হাতে। কাছে গিয়ে দেখি, এটা আমার পূর্ব পরিচিত। এমন ছবি আমি অনেক জায়গায়ই দেখেছি। পোল্যান্ডের প্রতীক হিসেবেও এক সময় এটা ব্যবহার হয়েছে।
এই মৎস্যকন্যার পাশেই এক লোক আরাম করে বাজনা বাজাচ্ছে। গ্রামোফোনের মতো একটা কলের গান। হাতলওয়ালা চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিযে সুর তুলছে তার যন্ত্রে। তার পাশেই এক টিয়া পাখি। দুর্বলচিত্তের পর্যটকেরা দুই ইউরো দিলে টিয়া পাখির সুরের তালে নাচতে-নাচতে সামনে রাখা খামগুলোর একটি এনে দেয়।
ফিনিক্স নগরী
হাঁটতে হাঁটতে একপাশে এসে দেখি শিল্পীদের চত্বর এখানে। ইউরোপ আমেরিকা বা চীনেও এমন সব নাগরিক উদ্যাণে এমন দৃশ্য খুব সাধারণ। যেখানেই অনেক লোকজনের সমাবেশ, সেখানেই উন্মুক্ত চত্বরে শিল্পীরা ছবি বিক্রি করেন, ছবি আঁকেনও। কিন্তু এখানকার কিছু ছবি ভিন্ন রকমের। কতগুলো পোস্টকার্ড সাইজের ছবি, সাদাকালো বা সেপিয়া রংয়ের, যেগুলো নিখুঁত হাতে আঁকা স্কেচ, এগুলোকে খুব যত্ন করে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই এই ওয়ারশোতে স্থাপত্যের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের কোর্সের অংশ হিসেবে এক সময় এই পুরাতন শহরের ভবনগুলোর স্কেচ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে, ১৯৪৪ সালের দিকে যখন বড়ো রকমের আগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ এলো এই শহরের বুকে, তখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তেমন কোনো অক্ষত দালান নেই। যা আছে, তাও বিকলাঙ্গ। পোল্যান্ডকে এই দুঃসহ যন্ত্রণাময় সময় থেকে রক্ষা করতে তখন প্রয়োজন হয়েছিল এই স্কেচগুলোর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ওয়ারশো যখন ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করেছে, তখন একে একে নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন হয় ধ্বংস প্রাপ্ত দালানগুলোর। ৪শ বছর ধরে যে ঐতিহ্যে লালিত হয়ে এসেছিল, এক দুষ্ট আগ্রাসীর অপঘাত তাকে আজন্ম ভুলিয়ে দেবে এমনতো হয়-না। সুতরাং সেই স্কেচগুলো সংগ্রহ করে পাওয়া গেল তথ্য উপাত্ত। সবগুলো ভবনের বাহ্যিক আবরণের রূপ। এই স্কেচগুলোকেই অবলম্বন করে এমনভাবে বানানো হলো দালানগুলো যে মনে হবে, ৪শ বছরের পুরনো দালানের গায়ে এই মাত্র নতুন করে রং দেওয়া হয়েছে মাত্র।
ওয়ারশো যেন জেগে ওঠা ফিনিক্স। নিজের ধ্বংসস্তুপ থেকে নতুন করে জন্ম দেওয়া আরেক শহর, যে তার পুরনো শহরেরই অবিকল রূপ।
আমরা হাঁটতে থাকি পুরাতন শহরের মধ্যযুগীয় অলিগলি ধরে। এ গলিগুলোর মায়া ছাড়তে মন চায় না। আমাদের সময় শেষ হয়ে আসে। আমরা ছুটতে থাকি ওয়ারশোর নতুন শহর দেখতে।
ধারাবাহিকটির অন্যান্য পর্ব পড়ুন :
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০২
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৩
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫। তিনি একজন বাংলাদেশি স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।