পৃথিবী ধ্বংসের আগে আরেকবার ফিরে আসবেন ফিওদর দস্তয়েভস্কি। সন্তানদের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে নিতেই তাঁর এই ফিরে আসা। ছোটো ছোটো পায়ে পিটার্সবার্গের জীর্ণ কবরখানা থেকে তিনি যখন বেরিয়ে আসবেন তখন বিকেল হেলে পড়েছে সন্ধ্যার দিকে। গোটা রাশিয়া তখন দাবানলের মতো জ্বলছে। যার উত্তাপে গলতে শুরু করবে হিমালয়ের চূড়াও। সেখান থেকেই মূলত পৃথিবী ধ্বংসের শুরু। সন্ধ্যায় বারবনিতারা যখন রেস্টুরেন্টে সসেজে সস লাগিয়ে খেতে শুরু করবেন, তখনই গোগোলের ওভারকোটের পকেট থেকে বেরিয়ে আসেন দস্তয়েভস্কি। গোটা রাশিয়াজুড়ে ‘প্রফেট’ ‘প্রফেট’ রব উঠবে। যেমনটা উঠেছিল ৪০০ বছর আগে বিখ্যাত পুশকিন ভাষণের পর। এরপর থেকেই সবাই সব জায়গায় দস্তয়েভস্কিকে দেখতে শুরু করবে। জুয়ার টেবিলে, পানশালায়, হাসপাতালে মৃগী রোগীদের ওয়েটিংরুমে সব জায়গায় তীব্র ওভারকোট থেকে পপ-আপ করে বেরিয়ে আসতে থাকবেন একজন দস্তয়েভস্কি৷ সব জায়গায় তাঁর একটাই ভাষণ, ‘মানুষ তোমার নরক যন্ত্রণা শেষ হয়েছে, এবার হেঁটে যাও অন্ধকার টানেলের দিকে।’ তাঁর এই বানী শুনে পিঁপড়ের সারির মতো মানুষ হেঁটে যাবে টানেল ধরে, যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় রাসকোলনিকভ, প্রিন্স মিশকিন, সোনিয়া, আলিয়েশা, নাস্তাশিয়া, ক্যাথেরিনা ইভানোভা এবং তলকুঠুরিতে বসে নোট লিখতে থাকা সেইসব ঘৃণ্য মানুষেরা।
২.
এই টাইপকাস্ট সকাল। কিছুই নতুন নয়। একটা বিড়াল এসে চলে গেছে, আর আসবে না। আমি হুল্লোড় থামিয়ে আরেকটু মৃদু হওয়ার চেষ্টা করছি। ঘাসের জঙ্গলে একটা শব্দের ওঠানামা চলছে। কেউ নিশ্চয় বসে ছিল সেখানে। আমি দেখিনি, বালিকারা তখনই কেবল ঋতুকাল ফিরে পেয়েছে। সাবধান সাবধান, কেউ নড়বে না। গোটা বিকেলটাকেই ক্রসফায়ারের দিকে ঠেলে দিয়েছে এই টাইপকাস্ট সকাল। অথচ আমরা কেউই অভিনয় জানি না। শুধু আঙুল নাড়তে শিখেছি পড়ে থাকা কোকাকোলার ক্যান। কেউ খেয়ে ফেলে গেছে এই ঘাসের জঙ্গলে। সে একটু আগেও ছিল। বিকেলের দিকে তাক করে ছিল বন্দুক। বালিকারাও পালিয়ে গেছে তার ভয়ে।
৩.
প্রতিদিন তুমি একটাই স্বপ্ন দেখতে। ঘুমের ভেতর তাড়া করত একটা মিনোটর। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, মহারানি প্যাসিফির সেই অবৈধ সন্তান। যার শরীরটা ছিল মানুষের আর মাথাটা ষাঁড়ের। কিন্তু কোনো দিন সে ধরতে পারত না তোমাকে। ক্লান্ত হয়ে ঘুম ভাঙার আগ মুহূর্তেও দেখতে দৌড়াচ্ছে মিনোটর। এভাবে একই স্বপ্ন রিপিট হতে লাগল প্রতি রাতে। সারা দিন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে আর অপেক্ষা করতে রাত্রিকালীন দৌড় প্রতিযোগিতার। একদিন পারলে না আর। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লে নিজের শরীরের ভেতর। ধীরে ধীরে মিনোটার এগিয়ে আসছে তোমার দিকে। কিন্তু আজ কেউ যেন ক্রুশবিদ্ধ করে রেখেছে তোমার পা, মাটি কামড়ে বসে থাকো। আর অপেক্ষা করো একটি স্বপ্নালু মৃত্যুর। কিন্তু এক সময় মিনোটরও বসে পড়ে তোমার ছায়ায়। তোমাকে জানায়, পথ ভুলে আটকে পড়েছে এই শরীরে। আর পারছে না বের হতে। হঠাৎ বুঝতে পারো, তুমিও দৌড় থামিয়ে আটকে পড়েছ নিজের শরীরে। তোমার শরীরে একটি স্বপ্নের ভেতর তুমি ও মিনোটর।
৪.
অনেক দিন হলো, আমার হিসাবে প্রায় ৩৪ দিন। ক্যালেন্ডার যেন সেই চৌত্রিশ দিন আগে থেমে গেছে। তারও পর একটি ডাহুক একটু বসে থেকে, মধ্যাহ্ন বিরতিতে উড়ে গেছে। সেই ডাহুকের সাথে দূর থেকে কথা বলি। তার নড়াচড়া দেখি। তার হাত দেখি। সেই হাতে আমার ভবিষ্যৎ দেখি। যেন হাতের ওপর, ভবিষ্যতের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে সেই ডাহুক। তার ডাক শুনি তারবার্তায়। সিনেমার গল্প শুনি। একটি জম্বিকে তাড়া করছে একজন মানুষ, অসংখ্য মানুষ। নায়ক জিতবে তো? হয়তো, হয়তো না। আমরা একসাথে পাতার ওপর পিঁপড়ের হেঁটে যাওয়া দেখি, গাছ দেখি। গাছের স্বপ্ন দেখি। সারিসারি গাছ শনশন শব্দে ভেঙে দিচ্ছে প্রার্থণাকালীন সমস্ত নীরবতা। যেন গাছের পাতার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে অসংখ্য ডাহুক। যা আসলে একটি ডাহুকই। ফলে মৃত গাছগুলোও আকস্মিক জীবিত হয়ে ওঠে। তার ভেতর এই প্রাণ মহাকালের স্তর পার করে মিশে যাচ্ছে বিকেলের ভেতর। যেসব বিকেল আমাদের একসাথে দেখা হয়নি। সেসব ফিরে ফিরে আসে। এবার আমরা দেখব। সমস্ত বিকেলে ঘুড়ি উড়িয়ে তার নিচে মেলে দেবো সাদা সব রুমাল। আমাদের ফিরে আসার শব্দে কারো ঘুম ভাঙবে না। কেবল নিশ্বাসের শব্দ থাকবে।
৫.
বৃষ্টি পড়লে ভিজে যাওয়াটাই ছিল নিয়তি। আমরা ভিজব বলেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। বোর্হেসের পেট থেকে তুলে এনেছিলাম অসংখ্য পাথরের চাকতি। সেগুলোয় নাকি মহাবিশ্বের পূর্বাপর সব লেখা ছিল। লেখা ছিল একটা নখের ওপর দিয়ে পিঁপড়ের হেঁটে যাওয়া এবং বাবলগামের শেষ মুহূর্তে ফেটে পড়া। তুমি যদিও এসব বিশ্বাস করতে না। বলতে বোর্হেস ভুয়া এবং ঈশ্বর বিষয়ক তাঁর সমস্ত ধারণাও। আমরা এসব শুনে হাসতাম আর একের পর এক কোকাকোলার ক্যান খালি করতাম। রাগ, ঘৃণা এবং খেদ এসব জমিয়ে রেখেই তুমি চলে যেতে। বাতাসে কয়েন ছুড়ে দিয়ে আমরা প্রতিদিনের মতো মেপে নিতাম তাপমাত্রা। না গরম না শীত। কিছুই না। তুমুল অট্টহাসির ভেতর ফেলে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলোর পরিধি মাপার চেষ্টা করতাম। কোথাও অবশ্য কিছু নেই। খাতা ভর্তি করে একটা লাইনই শুধু লিখে রেখেছে, ‘দ্য স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার’। এসব ফরএভারের গল্পগুলো যে শুধুই ধান্ধাবাজি তা অনেক আগেই বুঝেছিলাম। বলেওছিলাম, ফরএভার বলে কিছু নেই৷ যা আছে তা কেবলই নিৎসের উত্তরাধিকার আর বোর্হেসের কান্না। তুমি বরাবরই বলতে, কান্না হচ্ছে ফাঁদ। পাখিরা নিজের নিয়মেই সেখানে পা দেয় আর মরে যায়৷
৬.
সে তুড়ি মেরে বাতাসকে বদলে দিত হাওয়ায়৷ আর কলার উঁচিয়ে প্রেম করে বেড়াত। তার প্রেমিকারা ছিল গাঢ় সবুজ। অলিভ যুদ্ধের সময় তারা না মরে বেঁচে গিয়েছিল। যুদ্ধের পর স্মৃতি ধরে রাখতে তাদের গায়ে মেখে দেওয়া হয় সবুজ রং। তারা এতটাই সবুজ ছিল যে রাস্তায় বেরোলে গাছগুলোও লজ্জায় মাথা নুয়ে রাখত। এ নিয়ে তার গর্বের শেষ ছিল না। হলোকাস্টের শেষ দিনগুলোতে সে হারিয়ে গিয়েছিল তাল তাল সবুজের ভেতর। যখন বেরিয়ে এলো সে তখন গনগনে সূর্য। তার উত্তাপে গোটা বনভূমি পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। অসংখ্য মানুষ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এসব নিয়ে অবশ্য তার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। সে তখনো কলার উঁচিয়ে হাঁটত আর নতুন নতুন প্রেমিকার সন্ধান করত। এভাবে সে বেঁচে থাকল প্রায় ৭০০ বছর পর্যন্ত।
যদিও সে ফিরে আসত হুটহাট। যেবার সে ম্যাকডোনাল্ডের আয়তকার বক্সের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, গোটা ইউরোপ জুড়ে হইহই পড়ে গিয়েছিল। আরেকবার তাকে দেখা গেল দিল্লির হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়। যদিও সে কোন পক্ষে ছিল বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ফিরে এসেছিল কি না তা কেউ জানে না। কেউ কেউ দাবি করে তিব্বত থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যে দলটি শেষবার শান্তির বার্তা নিয়ে লোকালয়ের দিকে এগিয়ে এসেছিল সেখানেও দেখা গিয়েছিল তাকে। এমনকি কারো কারো দাবি জয়েসের ইউলিসিসের কোনো এক চরিত্রের ভেতর লুকিয়ে আছে সে। যেহেতু পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ ইউলিসিস পড়েনি কিংবা পড়লেও বোঝেনি তাই সে অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে। এসবের সত্যতা নিয়ে অবশ্য নানা মত আছে। হয়তো সত্যি, হয়তো না। প্রাচীন আজটেক দার্শনিকদের রেখে যাওয়া স্মৃতি চিহ্নগুলো বলছে তার আবার ফিরে আসার সময় হয়েছে। এবার সে আসবে উত্তর গোলার্ধের নাতিশীতোষ্ণ কোনো শহর থেকে। তার পরনে থাকবে পিতামহের অহংকার আর প্রেমিকাদের আহ্লাদ। তার নামের প্রথম তিনটা অক্ষর আসবে হারিয়ে যাওয়া ইনিসি ভাষা থেকে। তাই কেউ তাকে নাম ধরে ডাকতে পারবে না।
৭.
বিশ্বস্ত হও, যেমনটা হয়েছিল সানচো পানসা। দুঃসাহসিক অভিযাত্রী কিহোতোর শত্রু টারবাইনগুলোকে একাই ধসিয়ে দিতে চেয়েছিল সে। এমনকি কিহোতোর মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল। তার পায়ের নিচে এক সময় শিকড় গজাতে শুরু করে এবং তা বিস্তৃত হয়ে এসে পড়ে বিষুবরেখা পর্যন্ত। এল নিনোর শেষ দিনগুলোয় পৃথিবী যখন তার বলিরেখা দেখাতে শুরু করে, তখন স্বদেশ সেনের মতো সেও ভাবতে শুরু করে ‘নতুন জিভের অল্প লাল ভাষাটা’র কথা। সেই ভাষার ভেতর ছোটো ছোটো ইগলু বানিয়ে বসতি গড়ে নাও তোমরা, আর ভুলে যাও ক্যাসিয়াসের হলুদ জামা পরা মেয়েদের কথা। সেসব হলুদের খোঁজেই একদিন তুমি চলে এসেছিলে আমার দুয়ার পর্যন্ত। যাওয়ার আগে ছুড়ে দিয়েছিলে দার্শনিকদের বিষণ্ন অভিব্যক্তি। আর বলেছিলে, তোমার পছন্দের মাছ সার্ডিন এবং অঙ্ক করতে তোমার কখনোই ভালো লাগত না।
৮.
পাঠকের নীরবতা নিয়েই ছিল তার উপন্যাসটি। বই জুড়ে তেমন কিছুই ছিল না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সাদা, হুটহাট দুই একটা শব্দ। ক্যাথারসিস, ওল্ডগার, ফিবোনাক্কি, আলেফ, ব্রেথ, সালাম্বো, স্যাটার্ন, কাহোলোম, তিম্বো, প্যাসিফি, বৃষ, কিওথ এমন। এই শব্দের অনেকগুলোর অর্থই ছিল অজানা। বহু ভাষাবিদও যার কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি৷ তবে একটা পৃষ্ঠাতে ছিল পূর্ণাঙ্গ একটি বাক্য, ‘একটি স্কারলেট ম্যাকাওয়ের হাই তোলার ভেতরই টিকে আছে মহাবিশ্ব’। এরপর সেই পাখির খোঁজে পথে নেমে আসে একদল লাতিন যুবক। সাও পাওলো থেকে আমাজন পার হয়ে তারা পৌঁছে যায় সাহারায়। দিন-রাত বালিপথ পাড়ি দিয়ে ম্যাকাও পাখির বদলে তারা খুঁজে পায় একটা কবর-ফলক। যার এপিটাফে ফরাসি ভাষায় লেখা ছিল, ‘আমাদের কর্তব্য হচ্ছে নিজেদের বাগান চাষ করা’।
কবি ও কথাসাহিত্যিক
জন্ম ১৯৮৮, চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই : সূর্যাস্তগামী মাছ (কবিতা) ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার (কবিতা) শেফালি কি জানে (না কবিতা, না গল্প, না উপন্যাস) ক্ল্যাপস ক্ল্যাপস (কবিতা) দ্য রেইনি সিজন (কবিতা) প্রিয় দাঁত ব্যথা (কবিতা) বিষাদের মা কান্তারা (উপন্যাস) সন্তান প্রসবকালীন গান (কবিতা)