.
.
.
.
সুর
সকল সুরের ধ্বনি তুলে রাখছে গাছ,
এ হলো ফুলের বিকিরণ
নিঃশব্দে রক্তের পাশে আলো
আলোর সন্ত্রাসে আত্মা মরে যায়,
ভুলে যাওয়া হাওয়ার সন্ধানে
উন্মাদ প্রদীপ এসেছে আবার?
আত্মাটি শুয়ে আছে অশ্রুভরা ফুলে
আর, বন্ধু হওয়া আমার দেহ
মাড়িয়ে যাও তোমরা…
.
সুরে ধীরে ধীরে আলো হচ্ছে গাছ।
আমি, হোটেলবয় ও অন্যান্য
অপমানের প্রতিটি গল্পে
নামহীন হোটেলবয় আমার পাশে শিস দেয়
শ্মশানে কুড়োনো বন্ধুদের শ্বাস কাঁধ ছুঁয়ে
বলে,
……. ভালো আছিস তো…
আমি ও হোটেলবয় হাসি
গন্তব্যের ওপাশে যেখানে এক আনায়
সন্ধে কেনা যায়,
সেই দিকে হেঁটে যেতে থাকি।
কাউকে জিজ্ঞেস করি—
সাধু, কোথায় পাব দুধভাই,
যে আমার মার স্তন ছিঁড়ে নিয়ে
গহিন রাত্রির বুকে
ঢেলে দিয়েছে আদিমতম জোছনার সর।
তুমি নিশ্চুপে মধুর হয়ে থাকো
আমি তাই হোটেলবয়ের পকেটে
মুহূর্তের হাওয়া আর বেলিফুল গুঁজে দিয়ে বলি,
অপমানের গাছটি বড় হোক
তারপর গন্ধ নিস মৃত মানুষের।
মৃতেরা জানে, ইতিহাস-তৃষ্ণায় ভেঙে যাওয়া টি-স্টলের সাথে
সর্বশেষ আগুনে পাওয়া রাজকন্যাটিও আকুল হয়ে ওঠে,
তাদের বেলি ফুলগাছে তখন থোকায় থোকায় ফুটে থাকে
……. ……. ……. ……. ……. ……. মৃতদেহের প্রেম, আমার হাসি…
আলাদিনের গ্রামে : ২
তোমার উদ্ধার শেষ, দীনে দয়া দাও।
প্যারাসুট হাতে একা মাটিতে পড়েছ
লাফিয়ে নেমেছ চরে। পতনভূষিতা,
বেপথু বাজারে গিয়ে কয়টি কানন
ঘোরা হলো? পত্ৰসখা, প্রতিটি শয্যায়
খাপখোলা ছিল মোহ। গুঞ্জনে ভ্রমর
আসে নাই? ডেকে গেল বাসনারা, শিস
বাজিয়ে নায়কদল বলে হুঁশিয়ার!
দেহে আরও গিরিখাদ। গভীর পর্বতে
ভেতরে হারালে পথ, ও ভাস্কো দা গামা,
পর্তুগিজ এসেছিল। ম্যাপ হাতে তারা
দূরের মোকাম খোঁজে—সেই দেশ কোথা!
তোমামধ্যে সৌরবর্ষ। হেথা ঘোরে দীন,
আড়ালে ফুটিল দেহ…তরি ভেসে যায়…
আলাদিনের গ্রামে : ৪
ভাষাহীন গ্রামে তুমি অন্ধ আলাদিন
আগেই তৃষিত ছিলে তিষ্ঠ তারপর
বক্ষজুড়ে ছাতি ফাটে্—পনির চিৎকার,
জলে কোনো নদী নেই, তীরে বিঁধে আছো!
তোমার ভেতরে একা বসে নমরুদ
জ্বেলে দেয় অষ্টধাতু, মোমের রমণী;
আটঘাট বেঁধে সেই আলোপথ ধরে
এখনো অনেক ক্রোশ…চলো গেঁয়োভূত…
ফিরে এসো খেলাচ্ছলে আপন আড়ালে
পিপাসা তোমার মধ্যে দুই চক্ষু মেলে
আমার কাহিনিকার—লেখে পানিফল।
ওই ফল খেতে গিয়ে সহসা আবার
মিতালি-দোসর তুমি এসো আলাদিন,
এই দেহ ফুলগাছ, কাঁটা হয়ে বসো।
আলাদিনের গ্রামে : ১১
শুধু শুধু বহু পথ ঘুরে আসা হলো
আলগোছে হলো না কিছু; কণ্টক-তারকা
পেরিয়ে গোপনে আসা, প্রত্যহ গুজব
পাড়ায় পাড়ায় জাগে—তোমাদের মুখে
গুম ও গুমোট হয়ে একা বসে থাকি!
যখন সহাস্যে বলো, অশ্রুগুলো দাও
অন্তিমে কাঁদিনি খুব, চক্ষুজোড়া খুলে
সঁপেছি ওস্তাদ, হাতে; আলাদিন জানে
আর জেনেছিল মাত্র বোগেনভেলিয়া
তবে তা পুরোটা নয়, কাহিনির আরও
সমুদ্রে ডোবানো ফেনা। তন্মধ্যে একাকী
এই হামলা চোরাগোপ্তা; সেখানে গেরিলা
আমি আর আলাদিন গাঢ় রক্তে লিখি—
‘তরবারি দাওনি তো, হস্তই সম্বল’
আলাদিনের গ্রামে : ১৪
ঘুমিয়ে পড়েছ ভেবে ডাকিনি পৃথিবী
এখানে ফাঁদের তলে বাতাসে লোহিত
দু’টুকরো স্তব্ধতা লিখি, স্বর্গরক্ষী হাসে
নিমেষে কটাক্ষ মেলে তাকায় কামিনী,
তপোবন চোখে নিয়ে মৃগয়াবাগানে
ফুলের পালকে জাগে ভ্রমর-রাক্ষসী
রমণী সে—আঁখিজুড়ে পেট্রলে সজ্জিত;
সেই গন্ধে আলাদিন রচেছি তোমাকে—
না-দিয়ো নজর-ফোঁটা, চাহনি দিয়ো না
নামধাম নেই কোনো, তোমার অলক্ষ্যে
চূর্ণ, ঝাঁঝরা—ফুটে আছি বোমাপুষ্পে…হাতে,
সেখানে তিয়াস আছে জল নাকি নেই;
আমারো পিপাসা বাজে মাটির কলসে।
শতখণ্ড আমি যদি, কে আনাল হক?
কুহক
কোনো কোনো ঘুম
পাশ ফিরে শোয়
চোখের ভেতর
জমে কাঁটাতার
পথগুলো দূরে
আমায় পেরোয়
গেল কোথা একা
ফিরল না আর।
কেউ আসবে না
বসে থাকা কেন?
গোধূলির দেশে
ছিল আলোলতা
দিন শেষে গ্রহে
মুছে গেলে কথা
আমার কালিমা
লোকালয়ে জাগে…
ওড়ো উন্মাদ
নিদ্রাযন্ত্রে
প্রচ্ছন্ন
অসীম গানে লেখা হচ্ছো তুমি
দূরে পৃথিবী স্মৃতির মাঝে একা
ক্ষতের মতো লিখে যাচ্ছে রাত;
সেসব কিছু গভীর হলে আমি
সিলিংফ্যানে ঝুলিয়ে রাখি ছায়া—
কাঁপন দিয়ে কমার পরে দাঁড়ি।
জানিয়েছিলে বিভূতি নেই দেশে
উড়ে এসেছি পয়সাখেকো ভাই,
পথে ভগ্নি পানি-তেষ্টা পেলে
পরের দেয়া কিছু খাসনে যেন।
এই বাক্যে হাতখরচ শেষে
ভুলেও গেছ হলকা-আঁকা দিন!
গরম বালি রুমালে ফোঁড় তোলে,
বেঁচে ছিলাম একটু পর পর।
গল্পে আছে দৈত্যমাখা ভয়
বজ্র-জাগা দুয়োরানির মেয়ে
তার জন্য বাতাসটুকু থাক;
এবার পাশে বসো সিলিংফ্যান
কুয়াশা হয়ে লেখো কেবল ‘আমি
ঝুলন্তকে উড়িয়ে দেবো কাল!’
সমাধি
ভেসে যায় আমরা গল্পের দুধার দিয়ে,
ভাড়াটে খুনির মতো
বাড়িঘরে রহস্যের তীব্র রোদে
স্তব্ধ হাওয়া
উড়ে এসে কাহিনি শোনায়;
যারা ঘুমিয়েছে অথবা বেঁচেছে মরে গিয়ে
নিঃশব্দ হাসির বেদনায় দুলে দুলে মিশে যায়
তোমার শরীরে
ঘটনার মধ্যে দাঁড়িয়ে, ঘটনা থেকে দূরে
এই চোখ
দেখে
তোমার শাড়িতে রক্ত
আর
আমাদের সুখী নৃশংসতা
নীরবে বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো দেখে
টেলিভিশন
তোমার শরীরে আমার লাশটিকে কবর দেওয়া হয়
সহসা দুয়ারে : ৭
‘সহজ এ আয়নার প্রতিবিম্বে দাঁড়ানো মাতাল গানগুলো কবে আর লাগবে জোড়া?’
অন্ধকার গীতিকবির চোখের তলদেশে রাক্ষসী বাক্যটি উজানের নৌকা হয়ে বয়ে যায়। রাক্ষসের গালা বেয়ে নামছে বেহুলা ভাসানো নদী। আর কালো মেয়ের ফুলসহ খোঁপা বৃথা সে নদীতে মেশে—পানির গভীর কোনো কুলটা নীরবতায়। তার মধ্যে সদা যে মেঘলা চাঁদ ওঠে, তোমার মুখশ্রী সহসা সেখানে কেমন দেখাচ্ছে বল? না থেকেও তুমি আছ, ভেসে যাওয়া ফুলের জরায়ুতে অজানা বুদ্বুদ তুলে।
শেষের পরেও গান রাবেয়া বসরির বেশে জলের ওপর টলমল…
জন্ম ২৫ জুন ১৯৮১, ঝিনাইদহ শহরে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। লেখালেখির শুরু নির্লিপ্ত নয়ন নামে, ছোটকাগজে। কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রির অদ্ভুত নিমগাছ’ (২০১১), ‘আলাদিনের গ্রামে’ (২০১৬), ‘কলহবিদ্যুৎ’ (২০১৯), ‘সামান্য দেখার অন্ধকারে’ (২০২০), ‘সহসা দুয়ারে’ (২০২১); নাট্যগ্রন্থ ‘নৃত্যকী’ (২০১৬)। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ ‘ঢোল সমুদ্দুর’ (২০০১), ‘শাখাভরা ফুল’ (২০০৯)। ‘আলাদিনের গ্রামে’র জন্য ‘আদম সম্মাননা ২০১৬’ (ভারত) এবং ‘নৃত্যকী’র জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৭’ পেয়েছেন। কাজ করছেন একটি জাতীয় দৈনিকে। যোগাযোগ : altaf.shahnewaz@gmail.com