শনিবার, নভেম্বর ২৩

উপল বড়ুয়ার কবিতা

0

কবি

অক্টোবরে তার প্রেমিকা চলে যায়
নভেম্বরে আবারও সে বাঁধা পড়ে
নতুন প্রেমে
ডিসেম্বরের শীতে সে স্বপ্ন দেখে নদী
জানুয়ারি তাকে লিখতে বসায় টেবিলে
ফেব্রুয়ারিতে সে প্রেমিকাকে নিয়ে
ঘোরে বইমেলায়
মার্চে অসহায় ইতর, রাত জাগে কামে
এপ্রিলে বাড়ে অভিমান, দূরে থাকা দায়
মে নিজেই বয়ে আনে মেরুন সন্ধ্যা
তাকে লুটপাট করে ঠাপায়
জুনের যৌনতা ফুরিয়ে আসে ধীরে ধীরে
জুলাইয়ে সে নিজেকে সঁপে নিঃসঙ্গতায়
আগস্ট তার পেছনে লেলিয়ে দেয়
অভিযোগের কথাসাপ
সেপ্টেম্বরে সে হয়ে ওঠে তুমুল প্রেমিক
অক্টোবরে তার প্রেমিকা চলে যায়
নভেম্বরে আবারও সে বাঁধা পড়ে
নতুন প্রেমে।

বুদ্ধ

একটি বুদ্ধ জন্ম নিতে পারতো আফ্রিকায়
মাদাগাস্কারের বাওবাব বৃক্ষের ছায়ায়
কালো কালো মানুষের পাশে আলো করে
থাকতো যদি কালো এক মৈত্রীর বুদ্ধ!

একটি বুদ্ধ জন্ম নিতে পারতো সিরিয়ায়
যুদ্ধ বিধ্বস্ত শিশুদের পাশে থাকতো যদি
এক শান্তির বুদ্ধ; ফোঁকলা হাসির বুদ্ধ।

বুদ্ধ নেই ক্ষুধার্ত সোমালিয়ায়। সুদানি
কষ্টের পাশে। বুদ্ধ নেই ইতিহাস হারানো
ইরাকের পাশে; বুদ্ধ নেই বাতাস ও জলে
এমনকি তোমাদের প্রার্থনা বা অন্তস্তলে
বুদ্ধ নেই।

বুদ্ধ থাকতে পারতো মিয়ানমারে নিযার্তিত
রোহিঙ্গাদের পাশে। চীনের লাঞ্ছিত উইঘুররা
যদি দেখতো একবার সম্যকান্তির বুদ্ধ!

কেন বুদ্ধ তুমি কেবল হাসছো উপমহাদেশে
কেন বুদ্ধ শুনেও শোনো না; বলো না কথা
আফ্রিকার জঙ্গলে কেন তোমার হলো না ধ্যান
কেন সইলে না মৃত্যুমাখা সাইবেরিয়ান ঝড়?

কবর জীবন

কবরের ভেতর সে শুয়ে আছে একা
শীতের হিম ঝরছে চুপচাপ, যেন কেউ
না জাগে আর, চোখ মেলে তাকাবার
তবুও তাকায় সে; পাশ ফিরে শোয়
জিহ্বা বের করে মাটি ছুঁয়ে পড়া শিশিরে
ভেজায় গলা, উল্টে রাখা বই খুলে পড়ে
যদি ছাদটা বড় হতো আরেকটু তবে সে
উঠে বসতো, নখের আঁচড়ে দেয়ালে
আঁকতো ফুল ও পাখি, এমনকি লিখতো
প্রেমিকার নামের আদ্যক্ষর তারপর গান
গাইতো চিৎকারে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে
পড়তো ধুলায় কিংবা মাথা ঠুকতে ঠুকতে
মরে যেত সে আরেকবার। কিন্তু কবরে নেই
বালিশ। অথচ কাফনকে সে কাঁথা বানিয়ে
শুয়ে থাকে প্রতিদিন।

তরুণ বুকিশের জন্য এলিজি

অনেক পড়ালেখার পর একদিন সে হুট করে মারা গেলো অক্ষরবমি করতে করতে। তাকে কবর দেওয়া হলো বইয়ের স্তুপে। শিথানে ও পৈথানে বই এবং খরগোশের চামড়া ও সিল্ক কাপড়ের বাঁধানো বই। যেন সে পড়তে পারে অনন্ত কল্পকাল। যেমন সে পড়েছে উঠোনে ও শিরীষের তলে। কয়েক দশক ব্যাপে। বইয়েরা আজকাল তার কাছে যায়। কেননা তাকে ভালোবাসে বই। তার সামনে নাচে ও গায়। কখনও নির্লজ্জের মতো শুয়ে পড়ে তার উপরে। চুমু খায়। বাধ্য করে ঠাপাতে। বই পড়তে পড়তে একদিন সে-ও বই হয়ে যায়। তাকেও পড়ে আরও আরও তরুণ বুকিশ। একদিন কোন বই পড়তে পড়তে সে মারা গেলো? তার বইয়ের গন্ধমাখা কবরে বসে কে বই পড়ে এখন? তবুও আমরা জেনেছি বই পড়ে, তার কবরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এক নিঃসঙ্গ বইবৃক্ষ। তাতে থোকা থোকা ঝুলছে টসটসে বই।

শুক্রবার

প্রতিটা শুক্রবার আসে এক বৃহদাকার ডানাঅলা ঘোড়ায় চড়ে
তারপর তারা মুখের ভেতর গলে যায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো।

শুক্রবারের মানুষ সিনেমা দেখে, প্রেমিকার পাশে শুয়ে থাকে একা
শিশুরা খেলে যেহেতু তাদের বন্ধের দিন এবং ভুলে যায় রূপকথা
বৃহদাকার সেই থুত্থুড়ে ডানাঅলা ঘোড়া নিঃসঙ্গ ঘাস খায় মাঠে
সন্ধ্যায় ফের শুক্রবারকে পিঠে তুলে উড়ে যায় আরেক দেশে।

এভাবে সে প্রতিটি ভ্রমণে তোমাদের জন্য আনে রঙবেরঙের ছুটি।

ঘুম

একদিন হয়তো গলায় হেডফোন পেঁচানো অবস্থায় পড়ে থাকবো মৃত। কানে অনর্গল বেজে যাবে বিঠোভেনের সাইলেন্স। মায়ের ভেতরে শুয়ে থাকা শিশুর মতোন আমাকে পাওয়া যাবে এক টুকরো। আমি ঘুমাই ‘দ’ ভঙ্গিতে ও একা। ভেতরে বেজে যায় বিশ্রস্ত রেডিও…

একাকিত্ব

প্রভু দেখো, আমার একাকিত্ব
প্রভু, আমি ভয় পাই তারে খুব
প্রভু, আমার পাশে অন্তত আজ
একটা মানুষ হোক।

কথা বলুক সে, অথবা বসে থাকুক
চুপচাপ ফুরিয়ে যাওয়া কথা নিয়ে
প্রভু, একাকিত্ব এক বিদ্ঘুটে ভূত
তাড়া করে প্রায় ভোঁতা ছুরি হাতে।

একাকিত্ব বেশে ফিরে আসুক সে
যেন কিচ্ছুটি হয়নি, সব আগের মতো
প্রভু, আমাকে বাঁচাও নিঃসঙ্গতার হাত
থেকে, আমাকে সরাও…

নিরুত্তাপে

আকাশকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অস্থিরতাও
একদিন শেষ হয়ে আসে। ভাঙে মৌনী মেঘের ধ্যান
যে সকল শূন্যতা বাষ্প হয়ে উড়ে গিয়েছিল তারাও
তোমার দীর্ঘশ্বাসের কাছে বসে থাকে নতজানু মুখে।

সমূহ উত্তেজনা নিয়ে বোমারু বিমানের চালক তুমি
কেন হঠাৎ ভেঙে ভেঙে পড়ছো পাহাড়ের গায়ে!
তারচে’ দেখো নদীর পাশে বৃক্ষ, শান্ত জলের রেখা
যখন নিঃসঙ্গতা অক্ষয় দানব, তোমার প্রকৃত বন্ধু।

ছুটি

তোমাদের ছুটি, তোমরা চলেছো পাহাড়ে
নদী পাড়ে বসে ভাঙছো ঢেউ; প্রেমিকের
বাহুতে হাত গলিয়ে ভাবছো প্রকৃতির কথা
সমুদ্র আর সূর্যাস্তের তলে এই হিম সন্ধ্যায়
জীবনবোধ ধেয়ে আসছে তোমাদের দিকে।
আমার ছুটি নেই; যাওয়া হচ্ছে না কোথাও
অরণ্যে ফেলা হচ্ছে না তাঁবু আগের মতো।

বুদ্ধের মতো, যীশুর মতো

সোমবারের দেখানো পথে হাঁটছি
অথচ আজ শীতগ্রস্ত শুক্রবার
এবং পৃথিবী উচ্ছন্নে যাওয়া গ্রহ
প্রেম এক সংবেদনশীল পাথর
তাকে হত্যা করো তীব্র শ্বাসরোধে।

ফেরাউনের মতো পবিত্র অন্ধকারে আজ
বসে আছি চুপচাপ। যেন আমিও এক বুদ্ধ।
বুদ্ধের মতো আমিও ঘর পলাতক, আমার
হৃদয়ও হাহাকারে ভরা, নিপুণ ঘোড়সওয়ার
আমার মতোই এক বুদ্ধ, কবিতা লিখতেন।
অথবা যীশু!

যীশুও কি নয় তোমার মতো ক্রুশকাঠে বিদ্ধ?
তোমার হৃদয় আজ যীশুময়, সক্রেতিসে ভরা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

উপল বড়ুয়া। জন্ম: ১৯ ডিসেম্বর। রামু, কক্সবাজার। প্রকাশিত বই: কানা রাজার সুড়ঙ্গ (কবিতা), উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা (কবিতা), তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে (কবিতা) ও ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল (গল্প)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।