আক্তারুজ্জামান লেবু। কবি। প্রকাশিত কবিতার বই দুটি। প্রথম বই ‘না জল না অনল’। প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের বইমেলায়। প্রকাশক : খড়িমাটি, প্রচ্ছদ : কিংশুক ভট্টাচার্য্য। দ্বিতীয় বই ‘দুষ্পাঠ্য দুটি চোখ’। প্রকাশিত হয় ২৫ ডিসেম্বর ২০২০। কবির জন্মদিনে।
কবির জন্ম ১৯৯২ সালের ২৫ ডিসেম্বর এবং মৃত্যু ২১ মার্চ ২০২১। জন্ম গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাকাইহাট ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। পিতার নাম মরহুম আহসানুল প্রধান। মাতার নাম মোছা. আঞ্জুয়ারা বেগম।
২০০৭ সালে নাকাইহাট বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে নাকাইহাট কলেজ থেকে এইচ এস সি, ২০১৩ সালে গোবিন্দগঞ্জ কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে বিএসএস এবং ২০১৪ সালে বগুড়া আইএইচটি থেকে ফার্মেসিতে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া থেকে সমাজবিজ্ঞানে এমএসএস ডিগ্রি লাভ করেন।
এই বদলে যাওয়া জনপদে, প্রত্যেক গ্রামের প্রত্যেক গেরস্থালি থেকে লোটন কাকার মতো একেকটা চরিত্র আজকাল আর উঠে আসে না, আগে যেমন আসত। পাড়া গ্রামের ঈর্ষা ধরানো সব গহনার মধ্যে এই সুনিবিড় গাছ-গাছালি যেমন— যেমন পুকুর দীঘি সরোবরের সারি; তেমনই অমন আলুথালু সব ভাবুক মানুষের বেড়ে ওঠাটাও ছিল বেতফলের মতো অনায়াস। অমোঘের প্রতি অতুল লোভে এঁরা নিজেই নিজের কাছে হয়ে উঠতে পারতেন অধিশ্বর।
যৌথ পরিবারে একপাল তুতো ভাই-বোন ছিলাম আমরা। মনে আছে, মাসের একটা দিন ছিল আমাদের ‘চুলকাটা দিবস’। দাদীর তত্ত্বাবধানে সেদিন বাহির বাংলোর উঠানে দল বেঁধে বিরক্তিকর এক অপেক্ষা করা লাগত সবার। এই লোটন কাকা তাঁর ঝোলার ভেতর থেকে বের করে আনা বড়ো ছোটো দু-খানা কাঁচি আর ময়লা একটা চিরুনি সম্বল করে মহৌৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়তেন আমাদের কচি চুলের উপরে। দূরে পাতা জলচৌকিকে তখন সাক্ষাৎ এক টর্চার সেল বলে মনে হতো। ভীরু মুখ আর মন নিয়ে একেকজন বসছি, আর চুল কেটে ইঁদুরমুখো বানিয়ে দিচ্ছে লোকটা! পালা শেষ হলে কান্নালাগা মনে দাদীকে সাত সম্পাত করে করে পুকুরের দিকে ছুটছে একেকজন। ততোক্ষণে দাদীর তদারকিতেই উগারঘর থেকে মেপে মেপে ধান দিয়ে দিচ্ছে কেউ একজন। লোটন কাকার পারিশ্রমিক।
আজ মনোরম লাগে, একদিন পিষ্ট করত এই দৃশ্য।
আর কবিতা? কবিতারা কোথায় যায়? কবিতার মতো মানু্ষেরা? আখতারুজ্জামান লেবু? দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু? হিল্লোল’দার ছেলে পাপাই’র মামণিটা? আমার বোনটা? কোন গানের সঙ্গে কোন মহাশূন্যে মিলিয়ে যায় প্রিয় প্রিয় সকল মুখ?
সেই লোটন কাকার বড়ো মেয়ের নাম ছিল কবিতা। ছেলের নাম চন্দন। পরে একদিন বলেছিলেন, ‘কবিতা লিখতে চাইতাম তো এক সময়, ভাতিজা! পুরির নাম এর লাগি কবিতা রাখছিলাম’। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল কবিতার। তারও চেয়ে অল্পতম সময়ে এক পুত্র সন্তানকে সঙ্গী করে বাপের বাড়ি ফিরেও এসেছিল সে! এখন দেশে গেলে আকছার তার সঙ্গে দেখা হয়। আগেও যেমন এক কোলে শিশুপুত্র ও অন্য কোলে এক ছাগশিশুকে বয়ে বেড়াত, এখনো দেখি তাই-ই করে বেড়ায়। শিশুপুত্র বড়ো হয়ে গেছে, তাই এক কোল শূন্য। অন্য কোলে ছাগলের তুলতুলে এক বাচ্চা! আজ নির্জনতা থেকে তাকিয়ে সেই নিরীহ সুন্দর গ্রামটাকে দেখি। মনে পড়ে, ‘কবিতা’ বলতে একটা জীবন পর্যন্ত ব্যর্থ কবি কাম নরসুন্দর যে লোটন কাকা, তাঁর বড়ো মেয়েটাকেই জানতাম আমি। বুকের ভেতর এক নিটোল শব্দহীনতাকে পুষে যে গ্রামময় ঘুরে বেড়াত।
পরের জীবনে আরও আরও কবিতার সঙ্গে দেখা হয়েছে। ডেকেছে। ডেকে বলেছে—
‘সুখ-দুঃখের সাথী, তুমি আমার সঙ্গে চলো।
বাতাস বইছে বেরিয়ে পড়ার বাতাস, গাছের কাছে বলো
আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ুক, পথের কাছে বলো
আমার ফিরতে অনেক রাত্রি হবে— যেন অপেক্ষা না ক’রে
সদর দরজা বন্ধ করে।
তুমি গাইতে পারো গান
কিন্তু সে গান মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবে।
তুমি অনেক রূপকথা
মাথার মধ্যে বয়ে বেড়াও— কাকে বলবে? শুনবে কারা?
শোয়ার আগেই ঘুমে ঢুলছে মানুষ-জন, পশু ও পাখি, চন্দ্র তারা।
এমনি করেই জীবনভর কত সময় নষ্ট হল।
এবার সুখ-দুঃখের সাথী, তুমি অন্য কোথাও চলো।’
মাথার ভেতর সেসব রূপকথা বয়ে বেড়িয়েছি। বেড়াই নিরন্তর। এর মাঝেই ক্লান্তি আসে। অবসন্নতা আসে। একেকটা দিন আচমকাই মৃত্যুমুখর হয়ে ওঠে। সকালেও জানতাম না, দিনের শেষে জানা গেল আজ নাকি কবিতা দিবস। ফুলের যদি দিবস থাকে, জোনাকি পোকার জন্য তবে রজনী! আরও কতো কি র কতো কি দিবস! কবিতার থাকবে না কেন? কিংবা কবিতারই তো থাকবে কেবল। তীব্র অভিনব সব কবিতার দিন!
‘মনে হলো, ফাঁসির মঞ্চ থেকে জেলার বলছে, যাও তোমার ফাঁসি বাতিল হলো…’। তখন হয়তো এই খুনে রোগের হাত থেকে বেঁচে যাবার এক চিলতে আশা জেগেছিল কোথাও। তলিয়ে যেতে যেতে এমন চিলতে আশার রশ্মিতে মানুষের মুখ কেমন আভাময় হয়ে ওঠে, সে আমার জানা আছে বৈকি!
এমন বসন্ত বিধুর দিনেই ‘না জল না অনল’ লিখে চলে গেলেন এক কবি। নাম শুনেছিলাম। চিনতাম না। কর্কট রোগের কাছে এসে থেমে গেছে তাঁর সব পঙ্ক্তি। আখতারুজ্জামান লেবু। তাঁর বন্ধু/ সহোদরা প্রতীম কবি আসমা অধরা কে লিখছেন এক খুদে বার্তায়.. ‘মনে হলো, ফাঁসির মঞ্চ থেকে জেলার বলছে, যাও তোমার ফাঁসি বাতিল হলো…’। তখন হয়তো এই খুনে রোগের হাত থেকে বেঁচে যাবার এক চিলতে আশা জেগেছিল কোথাও। তলিয়ে যেতে যেতে এমন চিলতে আশার রশ্মিতে মানুষের মুখ কেমন আভাময় হয়ে ওঠে, সে আমার জানা আছে বৈকি!
পৌনে দশ মাস এ-হাসপাতাল ও-হাসপাতাল ছুটে বেরিয়েছি বাচ্চাটাকে নিয়ে। কখনো একটুখানি আশা সঞ্চারিত হয়েছে, তো ভাই-বোন দুজনেরই চোখ চকচক করে উঠেছে। ভালো হয়ে যাবি বোন। তোকে দেশে নিয়ে যাব। এই আকুতি চিনি আমি। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের সমস্তটুকু দিয়ে পাওয়া এই আভা।
আজ তাই হয়তো আর কিছুতেই আলো জ্বলে না। মৃত্যু প্রান্তের দিকে চলে যাওয়া মন নিয়ে ভাঙাচোরা দিন কাটাই। নিজের ফুরিয়ে যাওয়া দেখি। মাঝে মাঝে শাল্লা কি মাগুরায়, রাজবাড়ীতে মানুষের বদলে হায়ওয়ানের বংশ বৃদ্ধি দেখে অক্ষম আক্রোশ বাড়ে। এইটুকুই।
তবু কবিতার দিন আসে। কবিতার কথা আসে। বিফল কবি লোটন চন্দ্র শীল আসেন। তাঁর সঙ্গে নিজের বিফলতা মিলে যাবার আপাত বিস্ময় আসে। কবীর হয়ে যাওয়ার পূর্বতন চাটুজ্জ্যে সুমনের বাণী আসে— কবি যে কোন চুলোয় যাবে কেউ জানে না, কেউ জানে না!
আর কবিতা? কবিতারা কোথায় যায়? কবিতার মতো মানু্ষেরা? আখতারুজ্জামান লেবু? দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু? হিল্লোল’দার ছেলে পাপাই’র মামণিটা? আমার বোনটা? কোন গানের সঙ্গে কোন মহাশূন্যে মিলিয়ে যায় প্রিয় প্রিয় সকল মুখ?
কবিতা দিয়ে কেন ক্যান্সার ঠেকানো যায় না? সিরিয়ার যুদ্ধ? কিংবা শাল্লার অন্ধ মানুষগুলোকে? তবে তোমার কী কাজ, কবিতা!
মারি ও মড়ক ঠেকাতে পারো না। মওকুফ করতে পারো না এমনকি যাবজ্জীবন উজাড় করে পাওয়া স্মৃতির দণ্ডও!
জন্ম ২৮ জানুয়ারি, মৌলভীবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: নিশিন্দা মেঘের বাতিঘর (কবিতা), ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়োস্কোপ (গল্প)। সম্পাদিত ছোটো কাগজ: স্রোতচিহ্ন।