হাসান আজিজুল হক গল্পের বরপুত্রই, তাঁর কলমে গল্পের চরিত্ররা ফুটে ওঠে সুলতানের পেইন্টিংয়ের মতো। যেন জীবন্ত কিন্তু বাস্তাব নয়। এই মনে হচ্ছে ধরা দিচ্ছে আবার মনে হচ্ছে না গল্প গল্পের চরিত্রের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে আধো জাগরনে। অনেকটা গার্সিয়া মার্কেজের চরিত্রুলোর মতো, কথা বলতে বলতে আবার নিখোঁজ হয়ে যায়। বাংলার রাঢ় অঞ্চলের চরিত্ররা কোলাহল করে জেগে ওঠে অথবা নিঃশব্দ পায়ে হারিয়ে যায় হাঁটতে হাঁটতে দিগন্তে। পাঠক বিভ্রান্ত হয় খেই হারিয়ে ভাবে এত বলশালী, শক্তিমান চরিত্রগুলো রক্তমাংস নিয়ে শব্দের বুননে জেগে উঠে আবার কেন চোখের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল! এটিই শক্তিমান গল্পকার হাসান আজিজুল হকের গল্পের বৈশিষ্ট্য।
আমার ছোটোবেলা থেকেই গল্প পড়ার শখ। মালাকাইটের ঝাঁপি, ঠাকুমার ঝুলি কিংবা আরব্য রজনীর গল্প পড়তে পড়তে সুনীল, শীর্ষেন্দু, মহাশ্বেতা, মানিক, ওয়ালিউল্লাহ, শওকত আলী, শওকত ওসমান, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহীর, গার্সিয়া মার্কেজ, কার্লোস ফুয়েন্তেস, ওরহান পামুক, বোর্হেস, লিডিয়া ডেভিস কখন যে প্রিয় গল্পকার বা ঔপনাসিকের জায়গা করে নিচ্ছেন মনের ভেতরে তা অনেকটা অজান্তেই। বেশ ছোটোবেলায় দূর থেকে দেখেছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কিন্তু কাছে থেকে দেখেছি, গল্প করেছি হাসান আজজুল হককে। তাঁকে তখন আর দূর নক্ষত্র মনে হয় নাই। মনে হয়েছে আরে এই সেই হাসান আজিজুল হক যাঁর হাতে ফুঠে উঠছে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী অসম্ভব ভালো গল্পগুলো।
কী অসম্ভব আড্ডাবাজ, রসিক মানুষ তা তাঁর সাথে যারা মিশেছেন তারাই বলতে পারবেন। অসাধারণ উইট এবং হিউমার আছে— যেমনটা তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোতে পাই আমরা। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটি ফুঁড়ে তার গল্পের চরিত্ররা পাঠকের কাছে ধরা দেয় তাদের স্ট্রাগল নিয়ে।
কখনো ভাবিনি তাঁর সাথে একই সেমিনারে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হবো, তাঁর গল্প করা মুড হা করে গিলেছি। কী অসম্ভব আড্ডাবাজ, রসিক মানুষ তা তাঁর সাথে যারা মিশেছেন তারাই বলতে পারবেন। অসাধারণ উইট এবং হিউমার আছে— যেমনটা তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোতে পাই আমরা। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটি ফুঁড়ে তার গল্পের চরিত্ররা পাঠকের কাছে ধরা দেয় তাদের স্ট্রাগল নিয়ে। অসম্ভব ভালো লেগেছে যখন তাঁর ছোটোগল্পগুলো প্রথম পড়ি। তারপর তাঁর উপন্যাস গদ্য সবই অমি পড়তে শুরু করি। এক সময় জানলাম তিনি রাজশাহীতে দর্শনের অধ্যাপক। তাঁর সময়ের আরকজন মানুষকে আমি খুব পছন্দ করতাম তিনি হলেন দ্বিজেন শর্মা। তাঁরা দু’জনেই বন্ধু ছিলেন। সে সময়ের মিথ তাঁরা। দ্বিজেন শর্মার সাথে দেখা করব করব বলে কখনো দেখা হয় নাই।
কিন্তু হাসান স্যারের সাথে দেখা হওয়াটা মিস করি নাই, রাবিতে যেয়ে। রাবির দু’তিনজন অধ্যাপক আমার বন্ধু। একজন কবিবন্ধু যিনি বয়সে আমার অনেক ছোটো তার নেমতন্ন পেয়েই রাবিতে যাওয়া। তাকে বলে রাখলাম আমাকে কিন্তু হাসান স্যারের সাথে দেখা করিয়েই দিতে হবে। রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আল মামুন আর তার কবি পত্নী বর্ষা একটা এপয়েণ্টমেন্ট নিয়ে তবেই দেখা করতে গেলাম। যেয়ে দেখি স্যার অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য তাঁর স্টাডি রুমে। আমি আমার পরিচয় দিলাম কুন্ঠাভরে, এগিয়ে দিলাম আমার সিলভিয়া প্লাথের অনুবাদের বইটি তাঁর হাতে। খুব খুশী হয়ে হাতে নিয়ে বললেন জানো এক সময় আমিও কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম কিন্তু কেউ একজন বলেছিল তার বরঞ্চ গদ্য লেখাই ভালো। এবং উনি গদ্য লেখাতেই মনোনিবেশ করেছিলেন, তাতে সাফল্যও পেয়েছেন। তাঁর গল্প দুই বাংলাতেই সমান সমাদৃত। কলকাতেও তাঁর বই কিনতে পড়তে পছন্দ্ করেন পাঠকরা।
হাসান আজিজুল হকের ছোটোগল্পে একটা অধিবাস্তবতার এক ঠাসা বুননে তৈরি হয়। পশিচমবঙ্গ থেকে আসা তার উপর দর্শনের অধ্যাপক হওয়াতে তাঁর লেখা ছোটোগল্পগুলো অনেকটা দার্শনিকতা সম্পন্ন উপরি কঠিন কিন্তু ভেতরে কোমল চরিত্রের মানুষেরা বসবাস করেন
এবার তাঁর গল্পের কথায় আসি। হাসান আজিজুল হকের ছোটোগল্পে একটা অধিবাস্তবতার এক ঠাসা বুননে তৈরি হয়। পশিচমবঙ্গ থেকে আসা তার উপর দর্শনের অধ্যাপক হওয়াতে তাঁর লেখা ছোটোগল্পগুলো অনেকটা দার্শনিকতা সম্পন্ন উপরি কঠিন কিন্তু ভেতরে কোমল চরিত্রের মানুষেরা বসবাস করেন, পাঠকদের জন্য মায়াজাল তৈরি করেন পাঠকের অজান্তেই। আর পাঠক তাঁর তৈরি করা অধিবাস্তাব জগৎকে কখন যে সত্যি ভেবে এগুতে থকে তা টেরও পায় না। এখানেই একজন গল্পকারের সার্থকতা। সে যে গল্প বলছে পাঠকের সাথে তা পাঠক কিছুতেই বুঝতে পারে না। মননশীল, দর্শনিকতাপূর্ণ ভাষার এক নিজস্ব গদ্য কাঠামো নির্মান করেছেন হাসান আজিজুল হক। তাঁর ’আগুনপাখি’ বইটি পড়ে আমি বেশ কিছুকাল অন্য উপন্যাস পড়িনি, সেই আগুনপাখির অধিবাস্তব চরিত্রগুলোর ভেতর নিমজ্জিত ছিলাম। তিনি কেমন করে যেন ঘন গাঢ় চৈত্রের দপুর আঁকছেন, মনে হয এই রাঢ় বঙ্গেও খরখরে রোদ যেন সামনেই, এই বুঝি তার জন্ম চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছি আর একটু একটু করে বেড়ে ওঠার পদধ্বনি।
ছোটোগল্পের চরিত্রগুলোকে মনে হয় সুলতানের স্বপ্নের সেই পেশীবহুল, সংগ্রামী মানুষ যারা হারতে জানে না, নিবিড় নিমগ্নতায় জীবন যাপন করে চলে। যেন অব্যখ্যাত দুনিয়ায় সেই চরিত্ররা অনাগোনা করছে, হাসছে, কাজ করছে, ফসল বুনছে, সংসার করছে। ‘উকি দিয়ে যায় দিগন্ত’ এই বইটি তাঁর আত্মজৈবনিক বই হলেও এর পরতে পরতে গল্পের ঠাসা বুনট। এখানেই তাঁর ভাষার স্বার্থকতা। বাংলাসাহিত্য আজীবন তাকে মনে রাখবে। দার্শনিক দিক থেকে আমার তাকে বরাবরই এক্সটেনসিয়ালিস্ট মনে হয়েছে কিন্তু শেষ দিকে এসে তিনি বললেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথের দর্শনই তাঁর জীবন দর্শন। তার মানে শেষের দিকে তিনি কিছুটা স্পিরিচুয়ালিস্ট হয়ে উঠছেন, হয়তো বয়সের কারণে। এ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক সেমিনারে তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিল। গল্পের জন্য বাংলাদেশের সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের পুরস্কার থেকে প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কারও পেয়েছেন। যেখানেই গিয়েছেন প্রথম সারির আসনটি তাঁর জনইই নির্ধারিত থাকে। আমার সাথে তাঁর কয়েকবারই সরাসরি কথা হয়েছিল সাহিত্য আড্ডায়। তিনি বেশ গুছিয়ে টেনে টেনে রসিয়ে গল্প বলেন এবং শ্রোতাকে ধরে রাখতে পারেন। একবার হে ফ্যাষ্টিভ্যালের বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তাকে আনা হয় সেখানে তিনি একাই থাকলেন মঞ্চে, মঞ্চের সামনের সব আসন কানায় কানায় পূর্ণ, তিনি এক নাগাড়ে ঘণ্টাখানেক লিটেরেচার তাঁর গল্প, জীবনবোধ সব নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। প্রশ্ন উত্তরের জবাবও দিলেন। আবার বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার আড্ডায় মাতলেন তাঁর চাইতে বয়সে তরুণ লেখকদের সাথে।
পাক্ষিক অন্যন্যার একটি প্রোগ্রামেও তাকে দেখেছি, সেখানেও তাকে ঘিরে সব পাঠক লেখকদের একই রকম ঔৎসুক্য, তিনি তা পছন্দও করতেন। জানতে চাইতেন কাছ থেকে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া। চাইতেন পাঠক, লেখকরা গল্পকার হাসান আজিজুল হককে ঘিরে থাকুক। হাসান আজজুল হকের দর্শনের উপরও কিছু প্রবন্ধ আছে। ভালো লাগে তিনি যেকোনো বয়সের লেখকের সাথে মিশতে পারতেন এবং জেন্ডার বিবেচনায় না নিয়ে এক নাগাড়েই আড্ডা চালিয়ে যেতে পারেন। এটি তাঁর অন্যন্য দ্ক্ষতা। অনেককেই নামে চিনতে পারতেন। আমাদের সময়ের লেখকদের ভঙ্গুর জীবন তাঁর পছন্দ হতো না। তিনি বলতেন তাঁর সময়ে পরিবার কিংবা ব্যাক্তির বিচ্ছিন্নতা তিনি ভাবতেই পারেন না। আমার যারা সেদিন তাঁর বাসায় আড্ডায় গিয়েছিলাম জানিয়েছিলাম নারী ব্যাক্তি স্বধানতার দিকে এগিয়ে এসেছে লিখছে নিজেকে প্রকাশ করছে ফলে একটি মাত্র সম্পর্ক কিংবা একটিমাত্র পরিবার এই কনসেপ্ট আর থাকতে পারছে না। উনি তাতে বেশ অবাক হলেন। বললেন কেন দু’জন মানুষ এক থেকে আবার আলাদা হয়ে যায়, কেন তারা যদি একে অপরকে একটু ছাড় দিত! এভাবে গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে যায় হাসান স্যারের বিহাস পল্লীর বাসায়। তিনি বারবার করে আবার যেতে বলেছিলেন কিন্তু আমর আর যাওয়া হয়ে ওঠে নাই। খোঁজ খবর পেতাম ঠিকই। ফেরার পথে বলেছিলেন আমিও একটা কবিতার বই করব। আমি বলেছিলাম সত্যি! এবং সত্যি সত্যি গেল বছর তাঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে যা আমর হাতে আসেনি। নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে, তিনি কবিতা অনুবাদও করতেন। ভালো লেগেছিল তাঁর এই কবিতা অনুরক্ততা দেখে।
কিন্তু সময় যে কখন দ্রুত চলে যায় তা আমরা টের পাই যখন ভয়ানক কিছু একটা ঘটে। স্যার মাস খানে বিছানায় পড়ে ছিলেন পরে তাকে হার্টের চিকিৎসার জন্য এয়ার এম্বুলেন্সে হার্ট ফাউন্ডশনে আনা হয়েছে, আশা করি তিনি সুস্থ হয়ে লেখার টেবিলে ফিরবেন দ্রুতই গল্পের বরপুত্র।
নব্বই দশকের কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, এম.এড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জন্ম ঢাকায়, পেশা শিক্ষকতা। আয়শা ঝর্নার কবিতা বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক পরিসরে ইংরেজিতেও ছাপা হচ্ছে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : ‘আাঁধার যান’ (কবিতা, ১৯৯৬), ‘মাত্রমানুষ’ (কবিতা, ২০০৩), ‘উনুনের গান’ (কবিতা, ২০০৫), ‘আয়না রক্ত হল্লা’ (কবিতা, ২০০৭), ‘বাতাস তাড়িত শব্দ’ (কবিতা, ২০১০), ‘শূন্য ও পৃথিবী’ (কবিতা, ২০১৭), ‘গোলাপের নাম মৃত্যু’ (কবিতা, ২০২১), ‘সিলভিয়া প্লাথের এরিয়েল’ (অনুবাদ, ২০১০), ‘নারীস্বর’ (বিশ্বের নারী কবিদের কবিতার অনুবাদ, ২০১৪), ‘কাভাফি’র কবিতা’ (অনুবাদ, ২০১৮), ‘চারকোল’ (গল্প, ২০০৮), ‘শিল্প ও নারীসত্তা’ (প্রবন্ধ, ২০১৩)।