বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২

গোপাল ভবন : বিধান সাহা

0

বড়োদাদুরা যেদিন চলে যায় তখন শরৎকাল। রোজকার মতো উঠোনের নারকেল গাছটার মাথার উপর বিকেলের হলুদ রোদ তেরছা হয়ে এসে পড়েছে। বাপি তখন অফিস থেকে মাত্র ফিরেছেন। সাইকেল মাঝের ঘরের বেড়ার সঙ্গে হেলান দিয়ে রেখে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছেন। বেলতলায় তখনও দুইটা চড়ুই পাখি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে খাবার সংগ্রহ করছে। আমি বাপির রাখা সাইকেল নিয়ে গোপনে বের হবার পায়তারা করছি।

দেখলাম বড়োদাদু আর ঠাকুমা বিসজর্নের মতো মুখ করে পরনের ধুতির উপরই ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবী চাপিয়ে বের হচ্ছেন। ঠাকুমার পরনে দুপুরের সেই পুরোনো শাড়িটাই। দাদুর গলার ঘামে ভেজা কাঠের মালাটাকে আজ যেন আরও গভীর কালো মনে হচ্ছে। বের হওয়ার আগে চুপি চুপি আমার ঠাকুমার কাছে এসে বললেন— ‘যাই গো বউ, মুঞ্জুর খুব অসুখ। মরণদশা। হাসপাতালে ভর্তি।’

বাড়ির সকলেই এই সংবাদে তটস্থ হলেও আমি শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি। সাইকেলটা নিয়ে বের হয়ে কখন একছুটে উত্তরপাড়ার জালাল শেখের বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারব।

বড়োদাদুর হাতে পুরোনো চটের একটা ব্যাগ। ঠাকুমার হাতে লাল কাপড়ে মোড়ানো পুটলি। তার মধ্যে সম্ভবত শ্রীমদ্ভাগবত গীতা।

‘তাহলে আমরা সংবাদ পাবো কীভাবে দিদি? কী হয় না হয় আমাগোরে জানাইও কিন্তু।’ ঠাকুমা তটস্থ হয়ে বলে। ‘যাইবা কীসে? রিকশা কি ঠিক করা আছে, ও দিদি?’ পেছন পেছন বাহিরবাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে যায়।

‘আনারের রিকশা ঠিক করা আছে।’ বড়োদাদু বললেন। আনার হলো আলতা পরামানিকের বড়ো ছেলে। আনওয়ার।

বাড়ির সকলে আমার সাইকেল নিয়ে টো টো হওয়ার বিষয়ে মনোযোগহীন এখন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাইকেল নিয়ে ওদের পেছন পেছন আমিও এগিয়ে যাই।

একটা সান্ধ্য মুহূর্ত যেন এসে ভর করেছে এই অবেলায়। যতদূর চোখ যায় দেখলেন। মণ্ডপ ঘরটা আতপ চালের মতো অবসন্ন; ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের পুরোনো বিল্ডিং ঘর—বাড়িতে ঢোকার পথেই বেড়ার গলি আর চিলেকোঠার এপাশে মাঝের বিল্ডিং—তার উপরে চূড়ার মতো ফাঁকা জায়গাটায় লেখা ‘গোপাল ভবন’—যেন একটু একটু করে অন্ধকারে ঢুবে যাচ্ছে।

আনারের রিকশায় দাদু-ঠাকুমা ওঠেন। তাদের মুখে রাজ্যের অন্ধকার। রিকশায় উঠে বড়োদাদু একবার কী মনে করে বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন। সূর্য ততক্ষণে আমাদের বাড়িটার পেছনে আড়াল হয়েছে। একটা সান্ধ্য মুহূর্ত যেন এসে ভর করেছে এই অবেলায়। যতদূর চোখ যায় দেখলেন। মণ্ডপ ঘরটা আতপ চালের মতো অবসন্ন; ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের পুরোনো বিল্ডিং ঘর—বাড়িতে ঢোকার পথেই বেড়ার গলি আর চিলেকোঠার এপাশে মাঝের বিল্ডিং—তার উপরে চূড়ার মতো ফাঁকা জায়গাটায় লেখা ‘গোপাল ভবন’—যেন একটু একটু করে অন্ধকারে ঢুবে যাচ্ছে।

আনারের রিকশা ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করে। বাড়ির সমবেত লোকজন তাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তাকিয়ে থাকাটা শেষ বিদায়ের নয়। মুঞ্জু পিশির অসুস্থতার সংবাদে উদ্ভুত উদ্বিগ্নতার। আমি আনারের রিকশার পেছন পেছন সাইকেল নিয়ে আগাই। কখনও পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে দাদু-ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে থাকি। যেন কালকেই ফিরে আসছেন। আমার শৈশব কি আর এই চলে যাওয়ার গভীরতা বোঝে? মুঞ্জু পিশির অসুস্থতা বোঝে?

বড়োঠাকুমা একবার চোখ মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভালো থাকিস ভাই। বিগাড় করিস না মায়ের সাথে।’

আমি লজ্জা লুকিয়ে বলি, ‘না-আ-হ! তোমরা কাইলকাই চইলা আইসো কিন্তু!’

উত্তরপাড়ার জালাল শেখের বাড়ি পর্যন্ত আমার দৌড় থাকলেও, সেদিন সাহস করে থেউকান্দির তিনমাথা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তিনমাথার মোড়ে গিয়ে আমি থেমে যাই। আনারের রিকশা আমাকে পেছনে ফেলে ক্রমাগত অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে। সদরপাগলার বাড়ি পর্যন্ত রিকশার পেছনটা আবছা দেখা যায়। যতক্ষণ দেখা যায় আমি তাকিয়ে থাকি। তাকিয়েই থাকি।

 

০২.
শেষ রাতের দিকে কোনো এক ছোটো বাচ্চার কান্নার শব্দে দাদুর ঘুম ভেঙে যায়। দাদু কান পেতে থাকেন, ঘুমের ঘোরে ভুল কিছু শুনছেন কি না খেয়াল করেন। না, ঠিকই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বড়োদাদুর ঘরের ভেতরে মানুষের হাটাচলার ঠুস-ঠাস শব্দও শোনা যায়। ঠাকুমাকে ডেকে তোলেন দাদু। ‘দাদারা মনে হয় আর ফিরা আইসপো না গো! আমার দাদা মনে হয় একবারে চইলা গেল!’ ঠাকুমা লাফ দিয়ে ওঠেন।

‘কও কী!’

‘হ, ওই যে মানুষের শব্দ পাইতেছো না? ওই দেখো হেরিকেনের বাতি নড়তেছে।’

দাদু আর ঠাকুমা দরজার গোপন ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে দেখেন। বোঝার চেষ্টা করেন ঘটনা আসলে কী। আকাশ ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে আসে। আসন্ন ভোরের সেই আবছা আলোয় দেখা যায় দাদু হতভম্বের মতো ঘরের বিছানায় বসে আছেন। তার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

 

০৩.
সকাল হতে হতে বাড়ির অন্য ঘরের মানুষদেরও আর বুঝতে বাকি থাকে না ঘটনা কী ঘটছে। দালানে ঘুমানো বড়োকাকা-ছোটোকাকা নাকি প্রথমে ভেবেছিল বাড়িতে চোর এসেছে। তারাও দরজার ফুটো দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে। অন্য ঘরে বাপি-মামণিও।

সকালে যখন সকলেই উঠে বাইরে বের হয়। বড়োদাদুর ঘরের বারান্দায় তখন পাঁচথুপির মোকছেদ কাকা বসে বসে ম্যাসওয়াক করছেন। পেছনে তার বউ-বাচ্চারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দাদুকে দেখে এগিয়ে আসেন।

‘আদাব, কাহা।’

‘ক্যা রে বাপুরে, তুমি কোইন থিকা?’

‘কাহা, আপনের ভাই তো আমার কাছে বেইচা থুইয়া গেছে। কাইলকাই পার হয়া গেছে। ভয় পাইতেছিল। পরে আমিই নিয়া বর্ডার পার কইরা দিয়া আচ্চি।’ কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, ‘আপনে কুনু চিন্তা কইরেন না কাহা। আমি যদ্দিন বাঁইচা আছি আপনেগোরে কুনু অসুবিধা হবো না। আমি তো আপনের বেটার মতোই।’

যেন বহু দিনের অবদমিত বাসনার পর্দা খুলে গেছে আজ। তছনছ করে ফেলছে চারপাশ। দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশীদের কেউ কেউ পাশে এসে বসছে। দাদুকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তাদের কারো কারো চোখ কাজিবাড়ির পুকুরের মতো জলে টলমল করে উঠছে।

এক কান দুই কান করে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে বিপিন বাবুর চলে যাওয়ার কথা। যেন একটা বইয়ের দীর্ঘ পরিচ্ছদের পৃষ্ঠা আজ খুলে গেছে। যে বাড়িতে বাইরের মানুষের প্রবেশ ছিল নিয়ন্ত্রিত, সেদিন যেন অত্রাঞ্চলের সবগুলো গ্রাম ভেঙে পড়ে বাবুবাড়ির ভাঙন দেখতে। স্রোতের মতো মানুষ আসছে, বাড়ির এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বের হচ্ছে। কেউ কেউ যাওয়ার সময় হাতের সামনে যা পাচ্ছে নিয়ে যাচ্ছে। আজ বলার কেউ নেই। যেন বহু দিনের অবদমিত বাসনার পর্দা খুলে গেছে আজ। তছনছ করে ফেলছে চারপাশ। দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশীদের কেউ কেউ পাশে এসে বসছে। দাদুকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তাদের কারো কারো চোখ কাজিবাড়ির পুকুরের মতো জলে টলমল করে উঠছে। দেখছে আর বিলাপ করছে। কেউ-বা সহমর্মীতা জানাতে বড়োদাদুরা কতটা খারাপ মানুষ ছিলেন, সবিস্তারের সেসব বলছে।

বাবুবাড়ির বউ-ঝিদের বাইরের মানুষ কোনো দিন এমন লক্ষণরেখার ভেতর থেকে দেখে নাই। তাদের চুল ভেজে নাই আজ। তাদের চুলো জ্বলে নাই।

 

০৪.
আমাদের এককালে যে জমিদারিটা ছিল তা কেবল গল্পেই শুনেছি। কাচারি ঘরের সামনে দিয়ে কেউ ছাতা মাথায় যেত না। কেউ জুতা পায়ে আমাদের বাড়ি অতিক্রম করত না। হাটে গেলে দোকানিরা কেউ টাকা নিতে চাইত না। অবিশ্বাস করিনি। কারণ অবশিষ্ট যতটুকু আমার নিজের চোখে দেখা সেটাও তো কম কিছু ছিল না। হাটে গেলে, এই সেদিনও, কোনো দোকান থেকে কিছু কিনলে বলত, ‘বাবু নিয়া যাও। বড়ো বাবুর থিকা দাম নিমুনি।’ বড়োদাদুর সঙ্গে গ্রামের কোনো সালিশে গেলে মজিবর ডাক্তার, হবিবর মেম্বার আর বড়োদাদুর মতো আমাকেও চেয়ারেই বসতে দিত। বাড়ির বউ-ঝিরা আদর করে গাছের পাকা ফলটা, জমিতে চাষ করা মিষ্টিকুমড়া বা জাংলার লাউটা ফেরার সময় ভ্যানে তুলে দিত।

দিঘলকান্দির এই গোপাল ভবনে দুই দাদুর সংসারে ভাই-বোন মিলিয়ে বাবা-কাকারা বারো জন। দাদু-ঠাকুমা, কাজের মানুষ আর তৃতীয় প্রজন্মের আমরা মিলে সংখ্যাটা প্রায় তিরিশের মতো। সারা বছর উৎসব লেগেই থাকত।

সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন পলান-টু খেলতাম, আমরা লুকাতাম সদ্য সন্ধ্যা দিয়ে জমের ঘটে শান্ত হয়ে বসা ঠাকুমার আড়ালে; কিংবা তুলসী বেদীর পাশে যে ঝাপড়া কাঠমালতী গাছ, তার আড়ালে; কিংবা উঠোনের নারকেল গাছের আড়ালে। নিয়তির লিখন কি না জানি না, আমিই কেন যেন বেশিরভাগ সময় চোর হতাম। নিঃশব্দে পা টিপে টিপে প্রথম জনকে ধরতেই আরেকজন এসে আমার মাথা ছুঁয়ে দিত। তখন আবার চোর।

পুরো কার্তিক মাস জুড়ে নাম-কির্তন হতো। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন নবান্ন উৎসবে পুরো গ্রাম জুড়ে হতো নগরকির্তন। পুরো পাড়া সেদিন এক হয়ে উঠত। কেরু, বক্কার ভাই, জাহাঙ্গীর, খোকন, মানিক, শুবল, নব, গৌরাঙ্গ… সকলের কোমরেই বড়ো চাদর আর সঙ্গে একটা বড়ো কৌটা। চাদরের আরেক প্রান্ত ধরার জন্য সেদিন দুজন মিলে একেক দলে ভাগ হয়ে যেত। কির্তন শেষে প্রতি বাড়িতে যে হরিলুট ছিটানো হতো, তা ধরার জন্য চাদর ধরে আঙিনায় বসে পড়ত সকলে। ছিটানো হরিলুট এসে জমতো চাদরে। যেন থেকে থেকেই বাতাসা আর কদমার দৈববৃষ্টি নামছে এই গ্রামে।

বড়োদাদুর কির্তনের সুর একটু একটু করে আমাদের বাড়ি অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ত পুরো পাড়ায়। তা শুনে হয়তো পাশের বাড়ি সেজাব সেখ বা আফছার পরামানিক বা করমআলী কাকা এসে অন্যদের সাথে বিছানো চটের এক কোনায় বসতেন। কির্তনের কোনো কোনো পদে যখন আবেগ উছলে উঠত, দেখতাম, সকলের চোখই জলে ভরা। এখানে সকল বিভেদ একটা বিন্দুতে এসে মিলে যেত।

ভালো পদাবলী গাইতেন বলে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জায়গা থেকে কির্তনের ডাক আসত বড়োদাদুর। যাওয়ার আগে কোনো কোনো দিন পদাবলী কির্তনের আসর বসত বাড়িতে। অনেকটা রিহার্সেলের মতো। বাড়ির বৌ-ঝিরা তো থাকতই। আসর শুরু হওয়ার আগে আমরা দলবেঁধে কিচ্ছুক্ষণ খোল করতাল নিয়ে আনন্দ করতাম। আমি হয়তো খোল বাজাতাম, শিবু কাকা করতাল, আপাল দাদা আর রামপ্রসাদ হয়তো পাছদোহারের মতো কির্তনীয়ার ছেড়ে দেওয়া সুর টেনে নিত আর সিদ্ধিকাকা কির্তনীয়ার মতো করে রং-ঢং করত কিছুক্ষণ। তাই দেখে ছোটোঠাকুমা ঠাট্টা ছুড়ে দিতেন কখনও কখনও। রাত ধীরে ধীরে গভীর হতো। বড়োদাদুর কির্তনের সুর একটু একটু করে আমাদের বাড়ি অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ত পুরো পাড়ায়। তা শুনে হয়তো পাশের বাড়ি সেজাব সেখ বা আফছার পরামানিক বা করমআলী কাকা এসে অন্যদের সাথে বিছানো চটের এক কোনায় বসতেন। কির্তনের কোনো কোনো পদে যখন আবেগ উছলে উঠত, দেখতাম, সকলের চোখই জলে ভরা। এখানে সকল বিভেদ একটা বিন্দুতে এসে মিলে যেত।

সেই গোপাল ভবন যেন আজ বিধবা হয়ে গেল। তার অঙ্গ থেকে সকল শোভা, রং, আনন্দ আর আহ্লাদ মুছে গেল। যেন এক স্বস্তঃস্ফূর্ত দীর্ঘশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ।

অথচ এসবের কোনো কিছুই না-ও ঘটতে পারত। যদি যুদ্ধের সময় ওপারে যে বাড়িটা করা হয়েছিল খোকা দাদুর মতো তার মায়া ছেড়ে এরা কেউ এ দেশে না ফিরত। ওখানে বাড়িটা তিন দাদুর নামেই করা হয়েছিল। দেশের টানে এরা ফিরলেও খোকা দাদুর আর মন টানে নাই। শুনেছি খোকা দাদুর ওদেশে এখন খুব নাম হয়েছে। টাকাও হয়েছে অনেক। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। নাতি-নাতনীতে ভরা সংসার।

সেদিন সেই সংকুচিত; ভাঙনমুখরিত সন্ধ্যায় সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার পরে বারান্দায় দাদুর পাশে চুপচাপ বসে ছিলাম। চারপাশের কোলাহল যখন একটু একটু করে কমে আসছিল, কথায় কথায় বলেছিলাম, ‘ফিরছিলা ক্যান দাদু? ওইখানে থাইকা গেলেই তো ভালো হইতো। তিন ভাই একসাথে থাকতে পারতা!’

দাদুর যেন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললেন, ‘ভাইরে, এই ভিটাতই আমার জন্ম। এহানেই আমার নাড়ি পোতা। নাড়ীর টান বড়ো টান রে ভাই। এহানকার আলো-বাতাসে বড়ো হইছি। ঘুম থিকা ওঠার পর এই মানুষগুলার মুখ দেখলে মনে হয় আমার নিজের মানুষ। এসব ছাইড়া ওহানে কোন দুঃখে থাকমু, ক তো ভাই?’

এসব গভীর কথা বোঝার বয়স আমার তখনও হয়নি। আমি তখন হারানো সঙ্গীদের জন্য, তাদের সান্নিধ্যের জন্য ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছি। ইশ, রোজ বিকেলে তাদের সঙ্গে আর খেলা হবে না! মন চাইলেও তাদের কাছে আর যাওয়া হবে না! ডাক্তার কাকার সাইকেলটা এখন মোকসেদ কাকার দখলে। চাইলেও আর চালাতে পারব না!

আমি আমতা আমতা করে আবার জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা দাদু, আমরা এখন ওখানে গেলে কি সেই বাড়িতে আমরাও ভাগ পাব?’

‘তাই কি আর হয় রে ভাই? ভোগ যার ভিটা তার।’— দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ম্লান মুখে দাদু বলেছিলেন।

সন্ধ্যা গড়িয়ে একটু একটু করে রাত নামছে। দালান ঘরের চালের উপর এসে পড়া বেলগাছের মরা ডালের ফাঁক দিয়ে, চিলেকোঠা আর গোপাল ভবনের চূড়ার মাঝ দিয়ে পুবের আকাশটা দেখা যাচ্ছে। শুক্লপক্ষের এই আকাশটা আজ যেন গভীর শোকে কাতর হয়ে আছে। দীর্ঘদিন চিলেকোঠায় বাস করা লক্ষ্মীপেঁচাগুলো আজ আর ডাকছে না। ওরা কি উড়ে গেছে?

 

০৫.
বাড়ির মধ্যে নতুন মানুষ এলো। নতুন খেলার সাথি জুটল। রানি আপা, জ্যোৎস্না, খনা, সীমা—পুরোনোদের মধ্যে রইল আপাল দাদা, রামপ্রসাদ, শিবুকাকা, লিপি, শিউলি… বড়োদাদুরা স্মৃতি হতে শুরু করল। সব কিছু নতুন করে স্বাভাবিক হতে শুরু করল। মাঝে মাঝে বাড়ির উঠনে বা তুলসীতলায় মাংসের টুকরো পড়ে থাকলেও আমরা আর গায়ে লাগাতাম না। কিংবা সন্ধ্যাপূজার সময় ঘণ্টা বাজালে জ্যোৎস্না যখন এসে বলত, ‘দাদী, এল্লা আস্তে বাজান। পইড়বার বচ্চি’ ঠাকুমা তখন আস্তে করে বাজাতেন বা থামিয়ে দিতেন। উলুধ্বনি করা কমিয়ে দিলেন। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে শুরু করলাম।

আগের দিন বিকেলেও গোল্লাছুট খেলার সময় আপাল দাদা আমাকে তার দলে নিয়েছিল। কই, একটাবারও তো বলল না! আপাল দাদা আর কোনো দিন গোল্লাছুট খেলার সময় আমাকে দলে নেবে না! মাঠে মাঠে ভীষণ বাতাস বইলেও বাবা-মায়ের মারের ভয়কে তোয়াক্কা না করে রামপ্রসাদ এসে আর বলবে না, ‘চল ভাই গুড্ডি উড়াই।

মাস ছয়েক পরে একদিন সাকলে উঠে হঠাৎ শুনি বাঞ্ছা জ্যাঠাও চলে গেছে। বাবা-মার সাথে আপাল দাদা আর রামপ্রসাদও চলে গেছে। ইসমাইল কাকা এসে দখল নিয়েছে বাঞ্ছা জ্যাঠার বাড়ি। আগের দিন বিকেলেও গোল্লাছুট খেলার সময় আপাল দাদা আমাকে তার দলে নিয়েছিল। কই, একটাবারও তো বলল না! আপাল দাদা আর কোনো দিন গোল্লাছুট খেলার সময় আমাকে দলে নেবে না! মাঠে মাঠে ভীষণ বাতাস বইলেও বাবা-মায়ের মারের ভয়কে তোয়াক্কা না করে রামপ্রসাদ এসে আর বলবে না, ‘চল ভাই গুড্ডি উড়াই।’

বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে গেল। যেন আমার গুড্ডিটা সুতো কেটে অনেক অনেক আকাশ পেড়িয়ে অন্য আকাশে উড়ে গেছে। আর কোনো দিন ফিরবে না।

এরপর প্রায় প্রতিদিন সকালেই কোনো না কোনো ঘরের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ আসতে শুরু করল। পুরো পাড়ায় সেই নিয়ে শুরু হয় হৈ হৈ রব। জঙ্গল ছেড়ে কোনো বন্য প্রাণী লোকালয়ে চলে এলে যেমন পুরো গ্রাম একজোট হয়ে প্রাণীটাকে তাড়াতে লেগে পড়ে, এখানেও দৃশ্যটা প্রায় একইরকম। ছেড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে যে যা পারে হাতে করে নিয়ে যায়। যা মুখে আস তাই বলতে থাকে কেউ কেউ।

ঠাকুমার ইচ্ছে ছিল খুব। দাদু আর বাপি রাজি হয় নাই। দাদুর এক কথা, মরলে এখানেই। ‘নিয়তির উপর কি কারো হাত আছে?’—দাদু বলতেন। আমরা নিয়তিকে মেনে নিয়েছিলাম।

তুলসি বেদীর পাশের কাঠমালতী গাছটা এরপর ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে শুরু করল। বেলগাছের মরা ডালটা অকস্মাৎ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল একদিন। বাড়ির একটা অংশ শ্যাওলায় ঢেকে গেল। গোপাল ভবনের পুরোনো সেই রূপ ঐশ্বর্য্য একেবারে বদলে গেল কিছু দিনের মধ্যে। অচেনা হয়ে গেল পরিচিত মানুষগুলোও। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত হলো, গোপাল ভবনের আমাদের অংশটুকু বিক্রি করে থানা শহরে গিয়ে বাড়ি কেনা হবে। আমাকে ভর্তি করানো হবে জেলা শহরের কোনো নামকরা স্কুলে।

 

০৬.
এই শরতে—আটাশ বছর আগে ছেড়ে আসা দিঘলকান্দি গ্রাম আর গোপাল ভবনে আবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। এখানে এখনও সন্ধ্যা নামে। খেয়াঘাটের ওপারে বটগাছটাকে এখন মনে হয় ক্লান্ত বিষণ্ন বড়োদাদু। নদীটাও আগের মতো নেই। গোপাল ভবন এখন পুরোপুরিই জঙ্গলে পরিনত হয়েছে। ফিরে আসার আগে আগে বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালাম। বড়োদাদু চলে যাওয়ার আগে যেমন তাকিয়েছিলেন শেষবারের মতো। দেখলাম শেষ বিকেলের আলোয় বাড়িটা হলুদ ফুলের মতো ফুটে উঠেছে। যেন ক্যান্সারে আক্রান্ত আমার মায়ের সূর্যমুখী চোখ। কেবল তাকিয়ে থাকা ছাড়া যে ভুলে গেছে সন্তানের নাম, স্বামীর মমতা, সংসারের পিছুটান। যেন ভুলে গেছে একজীবনের সমস্ত পরিচয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।