শুক্রবার, নভেম্বর ২২

চাল : সামিনা বিপাশা

0

মনা চাল চাবাচ্ছে৷ একমনে, একনাগাড়ে। একমুঠ শেষ হওয়ার আগেই আরেকমুঠ মুখে পুরছে। তিন বছরের বাচ্চার মুঠ যতটা, ওর ব্যস্ত ত্রস্ত অনভ্যস্ত মুঠে ততোটা চাল রাখতেও পারছে না। তবু একমুঠ মুখে পুরতেই আরেক মুঠ হাতে উঠছে। ঠিকমতো না গিলেই একের পর মুখে চালান দিচ্ছে। মায়ের ডাক শুনে আরো তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যায় মনার, ডাকের সাড়া না পেয়ে মারজান সমান তালে ডাক চালিয়ে যায়…মনারেএএএ, ওওও…ওম্মমমনাআআ, মনাআআ… মনু… মনোয়ার…।

হাঁক দিয়ে ডাকতে ডাকতেই মারজান চারিদিকে শকুনিতীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরায়, চরাচরের রৌদ্রজ্জ্বল দিনটা তারচেয়ে প্রখর মেজাজে ওর মাথার উপর চড়ে বসে। মারজানের মনটা ডাহুকের মতো ডুকরে ওঠে, সকালে ছেলেটা পান্তা চাইলেও দিতে পারেনি। তার উপর গত সন্ধ্যায় চাল খাওয়ার অপরাধে কী বিষম মারটাই না মেরেছে! ছেলেটা রাগ করে কোথায় গিয়ে বসে আছে ঠাহর করতে পারে না মারজান।

ভাতের জন্য মনাটা বড়ো পাগল, শুধু নুন দিয়েই এক থাল পান্তা খেয়ে উঠবে, আর ধান-চালের গন্ধ পেলে ন্যাওটা বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘোরে। মারজান মেয়ে বিয়ে দিয়েছিল গাঁয়ে থাকতেই। ওর মনার বয়সী এক ছেলে।

ভাতের জন্য মনাটা বড়ো পাগল, শুধু নুন দিয়েই এক থাল পান্তা খেয়ে উঠবে, আর ধান-চালের গন্ধ পেলে ন্যাওটা বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘোরে। মারজান মেয়ে বিয়ে দিয়েছিল গাঁয়ে থাকতেই। ওর মনার বয়সী এক ছেলে। মনাকে বাসায় রাখবে কে, তাই চাতালে না নিয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই মারজানের। আরেকটু ছোট বয়সে ধামাতে রেখেই কাজ করা যেতো, এখন তো টইটই করে ঘোরে, এমাথা ওমাথা কই কই যায়- আবার মায়ের আঁচলটা টেনে একটু চোখটা জুড়িয়ে যায়।

কিন্তু মনার আজ আর সে খেয়াল নেই। থাকবে কী করে, সকালবেলা ভাত চেয়েছিল, দিতে পারেনি মারজান। কী করে দেয়, ঘরে নুন নেই, চাল নেই, তেল নেই। এমনকি কুটোটি পর্যন্ত নেই। চাল গুদামে না ওঠা পর্যন্ত মহাজন কি দেবে কেজি দুয়েক! ভাত নেই তো মুড়ি খা দুটো। আড়তে আসার আগে গুড় মুড়ি সাধলো, পোলার কী ডাট। গরিবের পুতের এতো ডাট কিসের! অবশ্য ডাট তো হবেই, একে তো নদী সিকিস্তি তার উপর পাড়া খেদানিদের তাড়া খেয়ে জীবনের ময়দানে দৌড়ে টিকে থাকা অদম্য শক্তি মারজান। লাউয়ের ডগার মতো ঊর্ধ্বমুখী না বলে ভেতরে জলের খেলা নেই, মারজান একদমই মরিচ ফুলের আনত সৌন্দর্যের তেজ। ফুলের বীজমন্ত্রে ফলও সৌরদীপ্ত। মনার এতটুকু বয়সেই তা টের পাওয়া যায়।

ধান মাড়াইয়ের কাজ শুরু হলে মারজানের মেজাজটা বেশি খিচড়ে থাকে, রোদে পুড়ে পুড়ে শেষমেশ গা জ্বলে, কাজ সেরে পুকুরে ডুবে থাকলেও জুড়ায় না। এর মাঝে ছেলের নানা বায়না। এমন কোন দিন নেই যে বসে খাওয়া যায়। ছেলেটা চড়-থাপ্পড় কম খায় না। গরিবের ঘরে এই নিয়মেই সবাই বড় হয়। নিয়মের ব্যতয় ঘটলেও ঘটতে পারে যদি বাপের কুদৃষ্টি কোন নারী বা জুয়ার আসরে না পড়ে ঘর-সন্তানদের দিকেই থাকে। মারজানের কপালে তেমনটা জুটেনি, লোকটার জুয়া খেলার এমনি নেশা টাকা শেষ হয়ে গেলেও বসে খেলাটাই দেখে। রাতভর বাজারে থাকে, খেলতে না পারলেও দেখে মন ভরায়! কোন কোনদিন মনার বাপ ঘরে আসে, কিন্তু বাপ ছেলের সম্পর্ক কোনোদিনই ঘন জ্বালের খেজুরের রস হয়ে মুড়ির মোয়ায় শক্ত করে লেপটে থাকে না। মনাটাও তাই ছাড়া গরুর মতোই বড় হচ্ছে। মারজান মাঝেমাঝে অবাক হয়ে ভাবে কীসব দিন ও একা একাই পার করেছে!

সময়ের এক মাস আগে জন্মালো সাথে জন্ডিস নিয়ে। মনা তখন প্রায় মরতে বসেছে। মারজানের হাড় জিরজিরে শরীরে ঝুলে পড়া স্তন ক’দিন জোরসে টেনে কিছুই না পেয়ে ছেলে মুখ ঘুরিয়ে নিতো। তারপর চালের গুড়ি পানিতে জ্বাল দিয়ে সাত-আট’টা মাস চালিয়ে দুটো ডাল-ভাতই দিতে শুরু করেছিল, কিন্তু ছেলের পেটে সয় না। দুধ কিনে খাওয়ায় সে জো কি আছে! বাপ একদিন ঘরে থাকে তো আরেকদিন থাকে না, শেষমেশ মারজানই একদিনই স্বামীকে তাড়ায়। একটা পেট অন্তত কমে তাতে, হিসেব মিলিয়ে দেখে সেই চালে মনার একদিন তো পার হয়। কিন্তু ছেলেকে খাওয়াই বা কী, যা খায় তাই বমি করবে নয় পায়খানা। ডাক্তার কবিরাজ সাধ্যে যা কুলায় সবার দ্বারেই ধর্না দেওয়া তখন প্রায় শেষ, মনাও যাই যাই করছে৷ হঠাৎই মারজান খবর পেল সদরের রাস্তায় যে মিশন সেখানকার খিঁচুড়ি খাওয়ালে রোগবালাই সারে। তারা রোজ সকালে কাঙালি ভোজ করায়, আগপিছ ভেবে আর সময় নেয় না মারজান, ছেলেকে কোলে নিয়ে রোজ সকালে খিচুড়ি আনতে চলে যায়, যা দিতো মনা এবেলা-ওবেলা খেতো। কী তাজ্জব কাণ্ড কদিন বাদে মনা সত্যিই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মারজান বোঝে না কীসে ছেলের রোগমুক্তি হলো, তবে ক’টা টাকা জমলে বাবার দরগায় সিন্নি দিতে ভোলেনি। তখন চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে, পিঠা-পুলি বানিয়ে, এমনকি ক’দিন ঘানিও টেনে কিছু টাকা জমলে তাই ঝেড়েকুড়ে সোজা মাজারে। খিস্টানের খেয়ে মাজারে সিন্নি, সেই কী অধর্ম হলো কী না কে জানে! এদিকে মারজানের এই ভক্তিতে ওর প্রতি লোকের অভক্তি কমলো না কিছুই।

কী তাজ্জব কাণ্ড কদিন বাদে মনা সত্যিই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মারজান বোঝে না কীসে ছেলের রোগমুক্তি হলো, তবে ক’টা টাকা জমলে বাবার দরগায় সিন্নি দিতে ভোলেনি। তখন চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে, পিঠা-পুলি বানিয়ে, এমনকি ক’দিন ঘানিও টেনে কিছু টাকা জমলে তাই ঝেড়েকুড়ে সোজা মাজারে।

মনা সবে হাঁটতে শুরু করে দুয়ার খুলেছে, সে কী! পাড়ার লোক সব পথে দাঁড়াল। মুসলমানের পুতে খিস্টানের মিশনে যায়! সিন্নি খায়! জাতের আর রইলো কী! জাত-কুলের হিসাব না রেখে মনার মা কী করে এমন কাণ্ডটা করলো ভেবে না পেয়ে পাড়ার লোক নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়!

মারজান মোষ নয়, নিতান্তই রুগ্ন-দুস্থ মা। কিন্তু লোকে পড়ি মরি করে তেড়ে এলো! মা-ঝিরা ঝাটা হাতে নিলো। পাড়ার লোকেদের সেই অশালীন অসভ্যতা ধোপে টিকলো না। কী করে টিকবে, মারজানের এখনো দিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে। বাজান ঘাটে গিয়ে সেদিন তড়িঘড়ি ফিরে এলো। এসেই বললো, সবাই শহরের দিকে চলে যা। রাত্রে কেউ ঘরে থাকবি না। মারজান কিছুই বুঝলো না। শুধু মায়ের পেছনে পেছনে চাচীদের বাড়িতে রওনা দিলো। মা’ও কিরকম পানের বাটা ছাড়া কিছুই নিলো না। বাজান ঠিকই টের পেয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস বড়ো গোঁয়ার, যতক্ষণ না ভাঙে ততক্ষণ নিজের মত মতোই চলে। বানের জলের সাথে বাবার মনটা যুদ্ধই করছিল। বানের পানি নামার আগেই বাবা একরাতে চলেই গেলেন।

বানের পানি যখন মারজানের বাপ-দাদার বসতভিটে, ফসলী জমি খেয়ে নিয়েছে তখনই ও পাষাণ বেঁধেছে বুকে, চোখের জল গালেই শুকিয়েছে, এবার তো ঘরই ছাড়তে হলো, তাও অন্যের। মনাটাও ঝরঝরে হয়ে গেছে, মনার মা’ও গাঙ পাড়ি দিবে মনস্থির করে ফেললো সেই রাতেই। কিন্তু কী জানি, ধানের নেশাটা ওরও প্রবল। পাশের গাঁয়ে গা ঢাকা দিলো, তখন ফসল তোলার মৌসুম। কাজ জুটলো চাতালে, এইতো গেল বছরের কথা, সেই থেকে এই।

আউশেরই কয়েক জাতের ফলন হয়েছে। আউশের আবার পানির জন্য চঞ্চল কিশোরী মন বলে আবাদে ইরি-বোরোর দখলদারিত্ব বেড়েছে। বৃষ্টিটা কম ছিল বলে মহাজন চিন্তায় পড়ে গেল, চিটা হয়ে গিয়ে না জানি মণকে মণ ধান নষ্ট হয়। অবশ্য এক্কেবারে জৈষ্ঠ্যের শেষে জোরসে বৃষ্টি এলে পড়ে গোড়াটা তাজাই হয়ে উঠলো। ধানগুলো নিজে বেঁচে গিয়ে এবারের মতো বাঁচিয়ে দিলো, মহাজন, মারজান ছাড়াও আরও অনেককেই। ছুমন্তরের মতো মাজরা, পামরি, ঘাসফড়িংরাও কুপোকাত হয়ে গেল অনায়াসেই। দৈব ঘটার বিস্ময় নিয়ে চাতালে এলো মারজান। ধান কাটা হলে পরে মারিয়ে শুকিয়ে ধানের পেট থেকে চাল বিয়োতে ডাক পড়লো ওদের। মারজানের সাথে জনা চারেক বউ-বেটি, সবাই মিলে প্রায় দশ কানি জমির ধান মাড়াইয়ের কাজ শুরু করেছে, অন্যবারের তুলনায় ফলন ভালো বলে দম ফেলার ফুরসৎ নেই। চারজনে মিলে পনেরজনের কাজ সারছে, রাত আর দিনের তাই কোনো তফাত নাই, তাও মহাজনরা হাসে না। দিন শেষে নাক-মুখ খিঁচিয়েই পয়সা তুলে দেয় হাতে। গত দুই দিন ধরে নানা অজুহাতে মজুরি দেয়নি, মারজানের ঘরেও তাই বিরানভূমি। বাড়ি ছাড়া হয়ে তেমন কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি মারজানকে, দিনও শাসন মেনে বাগে চলে এসেছিল ওর। সবই ঠিক ছিল, শুধু অভাবটাই দিনরাতের হিসেব ভুলে পিছনে লেগে থাকে। এমন সংসার হালের বলদের মতো পিটিয়ে চালাতে হয়, গতি দেখলে বোঝার উপায় নেই ভারবাহীর কী কষ্ট। মারজানের দিনগুলোও আজকাল আর চলতে চায় না, দুই ডানায় ভর করে কতক্ষণই বা চলা যায়, চিলও তো উড়ে উড়ে ডানা ঝাপটায়।

মনাকে খুঁজতে খুঁজতে চাতালের শেষ মাথায় চলে এসেছে মারজান। রাগ বাড়তে শুরু করে ওর, ছেলেকেই খুঁজবে না কুড়ো ঝাড়ার কাজে যাবে। ঠ্যাডা ছেলেটারে আজ কীরকম মারবে ভাবতে ভাবতেই আবার ডাকে, তবু ছেলের সাড়া নেই। হঠাৎই পেছনের জংলার ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ কানে আসে, দিনদুপুরে ছেলেটারে শিয়ালে কামড়ালো নাকি ঠাহর করতে পারে না। শুধু আওয়াজের দিকে পা বাড়ায়।

মনাকে যখন মারজান দেখতে পেল তখন মনা নিশ্চল ঠায় দাঁড়িয়ে, দূর থেকে দেখে মনে হয় দুপুরের ছায়া গলে দেহটা মাটিতে মিশে পড়বে। ভেতরে পেঁচা ডাকে, মনটা পোড়ায়। মনার মুখটা এমন কেন? মারজান দৌড়ে ছেলেকে গিয়ে ধরে। লুটিয়ে পড়ে মনা মায়ের বুকে মিশে যায়। মারজান ব্যাকুল হয়ে মাথায় বুকে হাত বুলায়, ঝাঁকিয়ে নেয় মনার শরীরটা। মনা চুপ, রাও করে না। মারজান বুঝে ওঠে না কেন সাড়া নেই, দম থাকা মানুষ থম ধরে থাকে কেন?

দম আটকে আসতে চাইছে মনার- চোখ মুখ লাল। চোখের তারায় নিভে যাওয়া আলো মায়ের মুখখানি ছুঁয়ে দিতে আবারও তাকায়। মনা ঢোক গিলতে চায় পেরে ওঠে না, চাল উগড়ে দিতে চায়, তাও পারে না! আলজিভ কন্ঠনালী সব আটকে গেছে আধ চিবুনো চালে। শ্বাসনালীর মধ্যেও চাল।

মারজান টের পায় মনার বিস্ফারিত চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিন্দু বিন্দু ঘামে পুরো শরীর ভেজা। লোমকূপের কোণে কোণে শীতল পায়ে মৃত্যুর অব্যর্থ ডাক। দম আটকে আসতে চাইছে মনার- চোখ মুখ লাল। চোখের তারায় নিভে যাওয়া আলো মায়ের মুখখানি ছুঁয়ে দিতে আবারও তাকায়। মনা ঢোক গিলতে চায় পেরে ওঠে না, চাল উগড়ে দিতে চায়, তাও পারে না! আলজিভ কন্ঠনালী সব আটকে গেছে আধ চিবুনো চালে। শ্বাসনালীর মধ্যেও চাল। ও মনা বাপধন বাইর করে দে চাল, বাপ তুই ক্যান এতোডি চাল খাইতে গেলি! বাপডি আমি বাইর করে দিচ্ছি, তুই বমি কর, কর বাজান! চালের নেশায় চালেই মরবি নিহি ব্যাটা। বাপ, বাপ আমার, আমার কি সব্বোনাশ হইলো, মারজান ক্ষিপ্র হাতে মাটিতে কোদাল চালানোর মতো মনার মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে চাল বের করতে চায় কিন্তু আটকে থাকা চাল আরও ঠেসে যায়, মনার ভারী শ্বাস হালকা হতে হতে নাই হয়ে যায়!

মনা দম নিয়ে সুদূরে যাত্রা করে, আর সেই থেকে দম আটকাতে থাকে মারজানের।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

সামিনা বিপাশা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জের হাটখান গ্রামের সন্তান। জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৮৭। একাধারে কবিতা এবং ছোটগল্প লিখেন। তার প্রকাশিত কবিতার বই ‘খেয়ালের খেলাঘর’ ও ‘শোনো কথা কয় মনপাখি’। প্রকাশিত গল্পের বই ‘কারাভোগীর জবানবন্দি ও অন্যান্য গল্প’। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের ষষ্ঠ ব্যাচে ছিলেন। কলেজের শিক্ষক ও এনজিও কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন বেশ কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্যচর্চাতেই মনোনিবেশ করেছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।