রাত এসেছিল ধীরে
আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি মানবজাতির উপর থেকে; তাদের জীবন ও কর্মের দ্যোতনা আমাকে আর টানে না। কেউ একজন বলেছিল, দশটি বইয়ের চেয়ে একজন মানুষকে অধ্যয়ন করা নাকি ঢের ভালো। কিন্তু আমার বর্তমান অবস্থান জীবনের সেই মোড়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি বইও চাই না, মানুষও চাই না।
বই কিংবা মানুষ— তারা আমাকে কেবলই ভোগায়, যন্ত্রণা দেয়। তাদের কেউ কি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে, যেভাবে বলে রাত— গ্রীষ্মের রাত? যেভাবে বলে আকাশের তারকারাজি, অথবা স্নিগ্ধ বাতাস?
সেই রাত এসেছিল ধীরে, কোমলভাবে, যখন আমি শুয়ে ছিলাম ম্যাপল গাছের নিচে। সে এসেছিল দূরের উপত্যকা থেকে। চুপিসারে, সন্তর্পণে। ভেবেছিল, আমি বুঝি তার আগমন টেরই পাব না। নিকটবর্তী গাছগাছালির মুকুট পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, ধারণ করেছিল এক অভিন্ন কৃষ্ণবর্ণ। রাতের আদিপুরুষ তারাও। পূর্ব থেকে পশ্চিম, সবদিক থেকেই নেমে এসেছিল রাত। তারপর এমন একটা সময় উপনীত হয়েছিল, যখন আলোর উৎস বলতে ছিল কেবলই আকাশ। ম্যাপল গাছের পাতা, কিংবা অন্য সকল ফাঁকফোকর ভেদ করে, ঠিকরে বেরোচ্ছিল তারার আলো।
সেই রাত বড্ড বিষণ্ণ, এবং রহস্যমণ্ডিত।
মানুষের অবয়ব মানিয়ে গিয়েছিল অন্য সব অস্পৃশ্য, অসাড় বস্তুর সাথে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইঁদুরের মতো দ্রুতবেগে ধেয়ে এসেছিল আমার দিকে। পরখ করেছিল আমাকে।
মানুষের অবয়ব মানিয়ে গিয়েছিল অন্য সব অস্পৃশ্য, অসাড় বস্তুর সাথে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইঁদুরের মতো দ্রুতবেগে ধেয়ে এসেছিল আমার দিকে। পরখ করেছিল আমাকে। আমি অবশ্য তাতে কিছু মনে করিনি। ততক্ষণে আমার অস্তিত্বের সবটুকুই যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল রাতের মৌনমাধুর্যে।
ইতোমধ্যেই ঝিঁঝিঁ পোকারা শুরু করে দিয়েছিল তাদের তন্দ্রাসংগীত। কী বিচক্ষণই না তারা! তারা মানুষের মতো অনর্থক বকবক করে না। তারা আমাকে কেবলই বলেছিল, ‘ঘুমাও, ঘুমাও, ঘুমাও।’ ম্যাপল গাছের পাতায় ঢেউ তুলেছিল পবনদেব, ঠিক যেভাবে হৃদয় তরঙ্গায়িত হয় ভালোবাসার উষ্ণ ক্ষুদ্র শিহরণে।
কেন বোকারা তাদের ভারে ভারাক্রান্ত করে এই পৃথিবীকে! এমনই এক মানুষের কণ্ঠস্বর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল আমার ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তকে। সেই মানুষটি আজ এসেছিল আমাকে বাইবেল শেখাতে। তার গণ্ডদেশ লাল, চোখ দুটো উদ্ধত, আর তার হাবভাব-কথাবার্তাও কী বিচ্ছিরি, কর্কশ। গা ঘিনঘিন করছিল আমার তাকে দেখে ও শুনে। কী জানে সে খ্রিষ্টের ব্যাপারে? যে আহাম্মক জন্মেছে গতকাল আর মারা যাবে আগামীকাল, তার কাছ থেকে কেন আমাকে খ্রিষ্টের কথা শুনতে হবে? আমি বরং শুধোব ওই আকাশের তারাদের। কারণ, তারা তো তাঁকে দেখেছে।
অপ্রত্যাশিত
র্যান্ডাল যখন স্বল্প সময়ের জন্য তার হবু পরিণীতা ডরোথিয়াকে ছেড়ে যাচ্ছিল, ওই সময়টা ছিল খুবই বেদনাদায়ক। তাদের দু’জনের কাছেই মনে হতে থাকে, এই বিচ্ছেদ নিষ্ঠুর, অসহনীয়। বিদায়বেলায় দু’জনেই মেতে ওঠে চুমুর পর চুমুতে। মাঝে মাঝে আবার দীর্ঘশ্বাসও ফেলে। তারপর আবার শুরু করে চুমু। এই মেঘ-বিষাদের খেলা তারা অব্যাহত রাখে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত।
র্যান্ডালের ফেরার কথা ছিল মাসের শেষেই। মাঝখানের সময়টুকু দু’জনের মধ্যেই চলতে থাকে প্রাত্যহিক চিঠির আদান-প্রদান। সেই চিঠিজুড়ে থাকে তাদের তীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
কিন্তু মাস শেষেই র্যান্ডালের ফেরা হয় না। তাকে আটকে দেয় এক বিটকেল অসুখ। খুব ঠান্ডা লাগে তার। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বর। কে জানে, কীভাবে সে সংক্রমিত হয় এই অসুখে! তবে পুরোপুরি বিছানায় পড়ে যায় সে।
কিন্তু মাস শেষেই র্যান্ডালের ফেরা হয় না। তাকে আটকে দেয় এক বিটকেল অসুখ। খুব ঠান্ডা লাগে তার। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড জ্বর। কে জানে, কীভাবে সে সংক্রমিত হয় এই অসুখে! তবে পুরোপুরি বিছানায় পড়ে যায় সে।
সে আশা করেছিল, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বুঝি সে সেরে উঠবে। ফিরে যেতে পারবে তার প্রিয়তমার কাছে। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া ঠান্ডাটা এত সহজে মুক্তি দেয় না তাকে। চিরাচরিত চিকিৎসায় কোনো লাভই হয় না। তবে তার ডাক্তারও হাল ছেড়ে দিতে নারাজ। তিনি র্যান্ডালকে কথা দেন, কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে সে। করতে পারবে হাঁটাচলা।
এই পুরোটা সময়ই অধৈর্য ডরোথিয়ার কাটতে থাকে অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশে। বিধাতা যেন এক কঠিন শাস্তি দিচ্ছেন তাকে। যদি তার বাবা-মা রাজি হতেন, তবে সে নিশ্চয়ই ছুটে যেত তার ভালোবাসার মানুষটার কাছে। বসে থাকত তার শিয়রের পাশে।
দীর্ঘ সময় ধরে র্যান্ডাল এমন-কী নিজে নিজে চিঠিও লিখতে পারে না। কোনো একদিন হয়তো সে একটু ভালো বোধ করে। কিন্তু পরদিনই আবার এক তরতাজা ঠান্ডার ঝাপটা এসে কাবু করে দেয় তাকে। তাই দ্বিতীয় মাসটাও কেটে যায় ডরোথিয়ার সঙ্গে কোনো সরাসরি যোগাযোগ ছাড়াই। ইতোমধ্যে ডরোথিয়া পৌঁছে যায় তার সহ্যের শেষ সীমানায়।
তারপর একদিন এক চিঠি আসে র্যান্ডালের কাছ থেকে। বোঝা যায়, অনেক কষ্টেসৃষ্টে লেখা হয়েছে চিঠিটা। সেখানে র্যান্ডাল লিখেছে, একটা মৌসুম তাকে দক্ষিণে কাটাতে হবে। তবে সেখানে যাত্রা শুরুর আগে, একদিন, একটাবারের জন্য, সে তার নিজের বাড়িতে ফিরতে চায়। উদ্দেশ্য একটাই : নিজের সবথেকে কাছের মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরা, তাকে কাছে পাবার ক্লান্তিকর তৃষ্ণা মেটানো, তার ঠোঁটের অমৃত আস্বাদ করা। দীর্ঘদিনের রোগভোগে যে যন্ত্রণা সে সহ্য করেছে, তা সে ভুলতে চায় প্রেয়সীর ঠোঁটের মাঝে ডুবে গিয়ে।
ডরোথিয়া সেই আবেগঘন চিঠি এতবার পড়ে যে, পড়তে পড়তে একসময় শতচ্ছিন্ন হয়ে যায় চিঠির পাতাটা। ঠিক যেভাবে বহুকালের পরিধানে ক্ষয়ে যায় জুতোর শুকতলা। শুধু কী তা-ই! গত কয়েক মাস ধরে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছে র্যান্ডালের প্রতিকৃতির সামনে। যে প্রতিকৃতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে এক নিখুঁত মানবের রূপ। এমন এক মানব, যে কিনা তার দেখা সুস্বাস্থ্য, শক্তিমত্তা ও পুরুষালি সৌন্দর্যের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন।
অবশ্য সে এটাও জানে যে, র্যান্ডালের বর্তমান বেশে অনেকটাই পরিবর্তন আসবে। এর জন্য র্যান্ডাল তাকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে। চিঠিতে এ-ও বলেছে যে, এবার সামনাসামনি দেখে ডরোথিয়া হয়তো তাকে চিনতেও পারবে না।
ডরোথিয়া নিজেও অনুমান করেছে, দীর্ঘদিন রোগে ভুগে র্যান্ডাল অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, শরীর ভেঙে গেছে তার। তাই সে ঠিক করেছে, র্যান্ডালকে দেখে মোটেই চমকাবে না। নিজের মুখে এমন কোনো বিস্ময় বা শোকের অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেবে না, যা র্যান্ডালকে কষ্ট দেয়। এসব ভেবেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকে সে। কবে আসবে র্যান্ডাল! কবে আসবে!
একসময় যাবতীয় প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটে। আসে র্যান্ডাল। সোফায় বসে। কেননা, টলমলে পায়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয় তার। সোফার এক কোণে বসে যেন সে ক্লান্তির সাগরে তলিয়ে যায়। ডরোথিয়াও বসে তার পাশে। র্যান্ডাল চেষ্টা করে মাথার পেছনে কুশন গুঁজে সোজা হয়ে বসতে।
একসময় যাবতীয় প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটে। আসে র্যান্ডাল। সোফায় বসে। কেননা, টলমলে পায়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয় তার। সোফার এক কোণে বসে যেন সে ক্লান্তির সাগরে তলিয়ে যায়। ডরোথিয়াও বসে তার পাশে। র্যান্ডাল চেষ্টা করে মাথার পেছনে কুশন গুঁজে সোজা হয়ে বসতে। চোখ বুজে, হাঁপাতে হাঁপাতে, সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি বিনিয়োগ করে ডরোথিয়াকে জড়িয়ে ধরতে। তবে সে চেষ্টাই সার। কোনোরকমে তাকে ঝুলে থাকতে হয় প্রেমিকার বাহুবন্ধনে।
ডরোথিয়া র্যান্ডালের দিকে চেয়ে থাকে ঠিক সেরকম অভিব্যক্তি নিয়ে, যেমন অভিব্যক্তি হয় আমাদের অদ্ভুতদর্শন কোনো মুখাবয়ব দেখে। সেই অভিব্যক্তিতে ভয় নেই, আছে অবিশ্বাস। এ তো সেই মানুষটা নয়, যাকে সে একদিন বিদায় বলেছিল, যাকে সে ভালোবেসেছিল, এবং যাকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার।
কী অস্বাভাবিক এক পরিবর্তনই না ঘটেছে র্যান্ডালের! নাকি এখন এই নতুন রূপের র্যান্ডালকে মন থেকে মেনে নিতে গিয়ে এক নারকীয় রূপান্তর ঘটছে ডরোথিয়ার নিজের হৃদয়ে?
র্যান্ডালের ত্বক এখন চটচটে ও জ্বরাগ্রস্ত, তার গণ্ডদেশে লালচে আভা। চোখ দুটো যেন গর্তে বসে গেছে। শরীরটা একদম চিমসে মেরে আছে। পরনের কাপড় হয়ে পড়েছে ঢিলে। যে ঠোঁট দুটো দিয়ে সে ডরোথিয়াকে ক্ষুধার্তের মতো চুমু খেয়েছে, এবং এখনো খেয়ে চলেছে, সেগুলো বীভৎস রকমের শুষ্ক ও দগ্ধ। আর তার নিঃশ্বাস? দূষিত ও উত্তপ্ত। তবে সেই উত্তাপের জন্য দায়ী ভালোবাসার উপচে-পড়া আবেগ নয়, নিছকই শরীরী পীড়া।
র্যান্ডালকে দেখে, স্পর্শ করে, ডরোথিয়ার ভেতরেও কিছু একটা যেন কাঁপতে থাকে, হতে থাকে সঙ্কুচিত। পূর্বের সকল আবেশই যেন ক্রমশ লীন হয়ে যায়। ডরোথিয়া ভাবে, এই রূপান্তর ঘটছে বুঝি তার হৃদয়ে। কিন্তু না, আসলে এই রূপান্তরের উৎপত্তিস্থল তার প্রেম, তার ভালোবাসা।
‘এভাবেই আমার আঙ্কেল আর্চিবল্ডের মৃত্যু হয়েছিল, বুঝেছ!’ র্যান্ডাল বলে। তার কণ্ঠে উপহাসের সংকেত। তবে একটু কথা বলতেই দম ফুরিয়ে আসছে তার। ‘আমার অবশ্য সেই ভয় নেই, নিঃসন্দেহে, যদি একবার আমি দক্ষিণে গিয়ে পৌঁছাতে পারি। তবে ডাক্তাররা এ ব্যাপারে মোটেই নিশ্চিত নন, যদি আমি সামনের শরৎ ও শীতে এখানেই থাকি।’
এরপর সে ডরোথিয়াকে জড়িয়ে ধরে তার বাহুতে। তার আচরণে ধরা পড়ে বেপরোয়া, উন্মত্ত ভাবাবেগ। এই উন্মাদনা আগেও ছিল তার স্বভাবে। তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানটা যেন একদমই আলাদা, অন্যরকম।
‘আমাদের আর দেরি করা উচিত হবে না, ডরোথিয়া,’ ফিসফিস করে বলে সে। ‘আমাদের আর এটা পরের জন্য ফেলে রাখা যাবে না। আমাদের এখনই বিয়ে করতে হবে। তারপর তুমি আমার সাথে আসবে, আমার সাথে থাকবে। হায় ঈশ্বর! আমার মনে হচ্ছে আমি যেন আর কখনোই তোমাকে আমার থেকে দূরে সরে যেতে না দিই, আমি যেন তোমাকে আমার বাহুতে জড়িয়ে ধরে রাখি চিরকাল, সারাদিন ও সারারাত, সবসময়!’
ডরোথিয়া চেষ্টা করে নিজেকে র্যান্ডালের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে। সে তার কাছে অনুনয় করে, এসব চিন্তা যেন আপাতত না করে। সে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, এই মুহূর্তে এগুলো স্রেফ অসম্ভব।
কিন্তু ডরোথিয়া চেষ্টা করে নিজেকে র্যান্ডালের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে। সে তার কাছে অনুনয় করে, এসব চিন্তা যেন আপাতত না করে। সে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, এই মুহূর্তে এগুলো স্রেফ অসম্ভব।
‘আমি গিয়ে কেবলই তোমার বোঝা বাড়াব, র্যান্ডাল। তুমি বরং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে আসো। এখনের চেয়ে অনেক বেশি তরতাজা হয়ে। তখন আমরা বিয়ে করব,’ ডরোথিয়া বলে র্যান্ডালকে। তবে নিজেকে সে বলে, ‘কখনোই না, কখনোই না, কখনোই না!’
এরপর নেমে আসে দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। ফের চোখ বন্ধ করে র্যান্ডাল।
‘আরো একটা কারণ রয়েছে, ডরোথিয়া,’ পুনরায় মুখ খোলে সে। এরপর আবার থেমে যায়। মনে হয় যেন সে ইতস্তত করছে, ভয় পাচ্ছে মনের কথা বলতে। ‘আমি একদম… মানে প্রায় নিশ্চিত… আমি সুস্থ হয়ে উঠব। কিন্তু, কী জানো, লক্ষ্মীটি? এমনকী সবচেয়ে শক্তিশালী যারা, তারাও জীবনের উপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারে না। মৃত্যুর কথা কে-ই বা আগে থেকে বলতে পারে! যদি খারাপ কিছু ঘটেই যায়, আমি চাই যেন আমার সবকিছুর অধিকারিণী তুমি হও। আমার যা কিছু রয়েছে, সব যেন তুমিই পাও। এবং একমাত্র বিয়েই পারে সেটা নিশ্চিত করতে। এখন আমি আবার অসুস্থ বোধ করছি।’ হাসি দিয়ে নিজের কথা শেষ করতে চায় সে। কিন্তু কাশির দমকে তা সম্ভব হয় না। এমন কাশি শুরু হয় যে মনে হতে থাকে তার শরীর থেকে প্রাণবায়ু বুঝি এখনই বের হয়ে যাবে। বাইরে তার একজন অ্যাটেনডেন্ট দাঁড়িয়ে ছিল। তার অবস্থার অবনতি টের পেয়ে সে ছুটে আসে।
ডরোথিয়া জানালা থেকে দেখতে পায়, লোকটার কাঁধে ভর দিয়ে র্যান্ডাল ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তার গাড়ির দিকে। এবং গাড়িতে উঠে ঠিক সেভাবেই নিজের আসনে নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে, যেমনটা সে বসে ছিল ঘণ্টাখানেক আগে, ডরোথিয়ার সোফায়।
ডরোথিয়া নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেয় যে এই মুহূর্তে আশেপাশে কেউ নেই, যে তাকে কথা বলতে বাধ্য করবে। দীর্ঘসময় ধরে সে বসে থাকে জানালার পাশে। দেখে মনে হয়, সে যেন ঠিক সেদিক পানেই চেয়ে রয়েছে, যেখানে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিল র্যান্ডালের বাহন। অনেকক্ষণ পর, ম্যান্টেলের উপর রাখা ঘড়িটা যখন ঘণ্টার জানান দেয়, সম্বিৎ ফিরে পায় সে। বুঝতে পারে, খুব শীঘ্রই বাড়িতে অন্যান্য মানুষদের আগমন ঘটবে, যারা তাকে বাধ্য করবে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, মনের ভাব প্রকাশ করতে।
পনেরো মিনিট বাদে ডরোথিয়া তার হাউজ গাউন পালটে নেয়। চড়ে বসে নিজের হুইলে। এরপর এমনভাবে পালাতে থাকে, যেন স্বয়ং মৃত্যুদূত তার পিছু নিয়েছে।
সে গতি বাড়াতে থাকে চেনা পথ ধরে, যে পথ দেখে মনে হয় সেটা তৈরি হয়েছে যন্ত্রের বাইরে অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তি দিয়ে। ঠিক সেরকমই কোনো তাড়নায় আলোকিত হয় তার দুই নয়ন, আগুন জ্বলে ওঠে তার চোখে-মুখে, বেঁকে যায় তার নমনীয় শরীর। এই সবকিছুর যেন একটাই উদ্দেশ্য : দ্রুততম পলায়ন।
কতক্ষণ ধরে, কতদূর সে গেল? জানে না। এ ব্যাপারে তার কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই। তার পায়ের নিচের মাটি এখন অপরিচিত হয়ে উঠছে। এখন সে চলছে এক রুক্ষ, উঁচুনিচু পথ ধরে, যে পথের ধারের নদীর উপর উড়তে থাকা পাখিরা নির্ভীক। এ পথে সে মানবসভ্যতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। এখানে রয়েছে প্রাচীন, অনাবাদী জমি। রয়েছে ছোটোখাটো জঙ্গল। গাছগুলো থেকে অলস সৌন্দর্যে নুইয়ে পড়ছে মোটা মোটা ডালপালা। পথের উপর ফেলছে নিজেদের ছায়া। বাতাসজুড়ে বুনো সুবাস। কানে বাজে পোকামাকড়ের গুঞ্জনধ্বনি। এখানে আকাশ, মেঘ আর স্নিগ্ধ বাতাসের স্পন্দন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
এই প্রকৃতির কোলে সে এখন একা, একদম একা। ঐকতানে হৃৎস্পন্দন হচ্ছে তার। সে এখানে থামে। ঘাসের উপর ছড়িয়ে দেয় শরীর। তার প্রতিটা পেশি, প্রতিটা স্নায়ু, প্রতিটা তন্তু যেন নিজেদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে, গায়ে মাখে বিশ্রান্তির আশ্চর্য উপাদেয় অনুভূতি।
এই প্রকৃতির কোলে সে এখন একা, একদম একা। ঐকতানে হৃৎস্পন্দন হচ্ছে তার। সে এখানে থামে। ঘাসের উপর ছড়িয়ে দেয় শরীর। তার প্রতিটা পেশি, প্রতিটা স্নায়ু, প্রতিটা তন্তু যেন নিজেদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে, গায়ে মাখে বিশ্রান্তির আশ্চর্য উপাদেয় অনুভূতি। তার গোটা শরীরজুড়ে প্রবাহিত হয় সেই আরামের রেশ।
র্যান্ডালকে বিদায় বলার পর থেকে সে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি মুখ থেকে। কিন্তু এখন সে সন্ধি গড়ে তোলে কম্পমান গাছের পাতা, অথবা হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে চলা পোকামাকড়, কিংবা মাথার উপরের ওই বিশাল আকাশের সাথে, যার দিকে সে এখন একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে।
‘কক্ষনো না!’ ফিসফিস করে বলে সে, ‘তার হাজার টাকার বিনিময়েও না! কক্ষনো না, কক্ষনো না! তার লাখ টাকার বিনিময়েও না!’
কেট শপ্যাঁর জন্ম ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের সেইন্ট লুইস, মিজৌরিতে। তার জন্মগত নাম ক্যাথরিন ও’ফ্লাহার্টি। তিনি মূলত ছোটোগল্প ও উপন্যাস রচনা করতেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ‘দ্য অ্যাওয়েকনিং’। উপন্যাসটি ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তার ‘দ্য স্টোরি অভ অ্যান আওয়ার’ (১৮৯৪) ছোটোগল্পটিও প্রচণ্ড জনপ্রিয়। অনেক স্কলারদের দৃষ্টিতে তিনি বিবেচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের ক্যাথলিক প্রতিবেশ থেকে উঠে আসা নারীবাদী লেখিকাদের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে। ১৯০৪ সালের ২২ আগস্ট মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ‘রাত এসেছিল ধীরে’ গল্পটি শপ্যাঁর ১৮৯৪ সালের ২৪ জুলাই রচিত ‘দ্য নাইট কেইম স্লোলি’ গল্প হতে অনূদিত। গল্পটি ১৮৯৫ সালের জুলাই মাসে ‘মুডস’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়, ‘অ্যা স্ক্র্যাপ অ্যান্ড অ্যা স্কেচ’ শিরোনামের অধীনে। আর ‘অপ্রত্যাশিত’ গল্পটির মূল হলো ‘দ্য আনএক্সপেক্টেড’। গল্পটি রচিত হয় ১৮৯৫ সালের ১৮ জুলাই, এবং প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ‘ভোগ’ ম্যাগাজিন, এবং একই বছরের ২ নভেম্বর, ‘সেইন্ট লুইস লাইফ’-এ।
জন্ম বাগেরহাটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত। লিখতে ভালো লাগে।