কাঁটা প্রজেক্ট নিয়ে কত কথাই না বলে এলাম ‘জার্নি অব কাঁটা’ গদ্যে। ছবি দেখার সময় স্ক্রিনে কি দেখা যাবে, তা শুধু বলিনি। পারিপার্শ্বিক ঘটনা, অনু-ঘটনা, উপ-ঘটনা, প্রতিঘটনা বলে যাচ্ছি। সব কি বলা হচ্ছে, যা যা ঘটেছে? তা কি হয় নাকি? আমি আমার চোখ দিয়ে যা দেখেছি, যা বুঝেছি, যা অনুভব করেছি, বলছি। সব তো আমার মনেও নেই। কাঁটার টিম মেম্বরদের প্রত্যেকের চোখে কাঁটা নির্মাণকালীন বাস্তবতা আলাদা আলদা হবে। তবে আমাদের মৌলিক বিষয়, কাঁটা। তা তো আলাদা নয়। এক। সেই এক কী? কাঁটা। প্রবাদে পড়েছি, ‘আমি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাই।’ কিন্তু আমাদের কাঁটা তো সেই কাঁটা নয়। আমাদের কাঁটা মনোজগতের কাঁটা। যে কাঁটা দেখা যায় না, দেখানোও যায় না। দেখা না গেলেও সেই কাঁটা বা মনোজগতের কাঁটা তুমুল বিদ্ধ করে আমাদের। যেমন, গলার কাঁটা। গলায় কাঁটা বেঁধে জানি, কিন্তু কথা প্রসঙ্গেও গলার কাঁটা একটা হয়তো কোনো অদৃশ্য কাঁটাকেই নির্ণয় করে থাকে।
শহীদুল জহির কোন কাঁটাকে মেনশন করে লিখলেন মনোজগতের কাঁটা? এই প্রশ্নের উত্তর তো শহীদুল জহির লিখেই গেছেন তাঁর গল্পের পটভূমিতে। তাহলে, ছবি বানানোর দায়বদ্ধতা নিয়ে আমি আছি উপস্থিত, সমবেত সকলের সামনে। দূরে যারা আছেন, তাদের সামনেও আমি উপস্থিত হতে যাচ্ছি, ছবি দেখানোর মাধ্যমেই। অতএব, মনোজগতের কাঁটার ভিজ্যুয়াল স্টোরি কেমন দাঁড়াল, কী হলো শেষ পর্যন্ত— এসব তো আপনাকে দেখে বিচার করতে হবে। কোর্ট-কাচারিতে চলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার, চাকরিধারী বিচারকের সংখ্যাও খুবই সীমিত। কিন্তু একটি ছবির বেলায়, আমি বলব কাঁটার বেলায় যতজন দর্শক দেখবেন ছবিটা, ততজনই বিচারক। সেই বিচারই শ্রেষ্ঠ বিচার। সেই বিচারের আশা নিয়ে কাঁটা অপেক্ষা করছে আপনার মুখোমুখি হওয়ার, আমি জানি। কাঁটার পুরো টিম জানে। কিন্তু একটি পিরিওডিক্যাল ছবি, তাও ৩টি আলাদা আলাদা সময়ের আলাদা ৩টি গল্প নিয়ে সাকুল্যে তা একটিই গল্প। সেই গল্পই কাঁটা। তাছাড়া ব্যয়বহুল এ ছবির প্রোডিউসার তো কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট না, কোনো কালোবাজারি কোটিপতি ব্যবসায়ীও নয়, আমি, আমি এই ছবির প্রোডিউসার। তাই নির্মাণ যাত্রাপথে থমকে দাঁড়ানো আছে আমার। কাজের গতি কোথাও শ্লথ হয়ে পড়েছে। নানান কারণেই তা ঘটে থাকে।
তবে এখন আমরা একটা নিবিড় নির্মাণ সমাপনীর দিকে আছি। ভালো ছবির দর্শকের মুখোমুখি হবো আমরা, সামান্য যে কিছু কাজ এখন সমাপ্তির দিকে, সেই সমাপ্তিও শেষ হবে কিছু দিনের মধ্যেই। এখন যদি বলেন, ডেট দেন। ডেট আমি কীভাবে দেবো? একদল মানুষ নিয়ে কাজ, এক কাড়ি টাকা নিয়ে কাজ। এত সহজ না তো! এ তো কবিতা বা স্ট্যাটাস লিখে তাৎক্ষণিক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিতে পারার মতো ব্যাপার না। এমন কি বাজারের আর ১০টা চলতি ছবির বাস্তবতাতেও কাঁটা নির্মিতি পাচ্ছে না। আমি দীর্ঘদিন কবিতা লিখে আসা লোক, আমি চারুকলায় পড়ালেখা করেছি একাডেমিক ভাবেই, আমার পড়াশোনা ও মানুষ-সমাজ-সময় পর্যবেক্ষণ ও করণীয় বোধ তো একান্তই আমার মগজ-মনন-ধাতুতে তৈরি, তাই আমার ছবিও সমকালীন বাজার-বাস্তবতার ছবির চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যের কিছু হওয়ার দাবি রাখে। সেই দাবি পুরণে আমি, কাঁটার নির্মাণ টিম, পোস্ট প্রোডাকশন টিম, কাঁটার গানের শিল্পীরা সবাই সদা তৎপর আছি ভালো কিছু করতে। এবং সব কিছুর বিচার আপনার চোখে, বোধে, কারণ, আপনি দর্শক। কোনো না কোনোভাবে আমি আপনার কাছে পৌঁছুতে চাচ্ছি বলেই ছবি তৈরি করছি। তারপর ছবি দেখে আপনি স্বাধীনভাবেই আপনার মন্তব্য প্রকাশ্যে জানিয়ে দিতে পারবেন। কোনো রাখঢাক রাখুক কেউ কাঁটা দেখে, তা আমি চাই না। এটা তো একটা শিল্পকলা নির্মিতি, রাখঢাক রেখে বললে তো আমি বুঝতে পারব না, যা ভেবেছি, ঠিক ভেবেছি কি না! যা করেছি, ঠিক করেছি কি না!
বিয়ে হলো সুবোধ-স্বপ্নার। নরসিংদী জেলার একটা গ্রামের মাটির বাড়িতে, উঠোনে কলা গাছ পুঁতে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ আর উলুধ্বনিতে বিয়ে হলো তাদের। আগের দিন রাতেই মারা গেছে কৃতি রঞ্জনের বাবা জ্যোতিরঞ্জন বসু। তাঁর মরদেহ রাখা হয়েছে মনোয়ারা হসপিটাল থেকে বারডেমে নিয়ে গিয়ে। সকালে আমরা এসেছি নরসিংদীতে। সারা দিন একটি মাটির রাস্তায় শুটিং করেছি। সন্ধ্যায় বিয়ে। সুবোধ-স্বপ্নার বিয়ে। যার বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে তিনি পলাশ থানা আওয়ামী মহিলা লীগের নেত্রী। হ্যাজাকের আলোয় বিয়ে। নারীদের সম্মিলিত গীতের সুরে বিয়ে। এই বিয়ের পরেই না তারা ঢাকায় চলে যায় এবং ভাড়াটিয়া হয়ে বসবাস শুরু করে ভূতের গলির আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। তারপর তাদের কী হয়? কী হয় তা দেখতেই তো কাঁটা দেখতে হবে আপনাকে।
আমেরিকান মেয়ে মালিয়া মোর, কাঁটা টিমে কয়েক দিন ছিল। মালিয়া নিজেও এডিটিং করে। মালিয়া আমার একটি ইন্টার্ভিউ করে ক্যামেরার সামনে, ভাঙা ভাঙা বাংলায় প্রশ্ন করছিল মালিয়া। আহ, নারিন্দার দিন ছিল আমদের এমন এক তরঙ্গে, ইচ্ছে করেলেই ওরকম তরঙ্গ আসে না। ওটা মিলে যায়। সে এক আধা জিপসি জীবন কাটানো দিন, কাঁটা নির্মাণকালীন দিন।
মহল্লার দুষ্টু ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। এরকম দুষ্টু ছেলেদের একটি দল কাজ করেছে কাঁটার স্ক্রিনে। তারা এমন একটা পাবলিক মব তৈরি করে ফেলবে যে, এক জোড়া নারীপুরুষকে হত্যা করে ফেলে সেই উত্তেজিত জনতা বা পাবলিক মব। সে এক ভয়ানক দৃশ্য। দৃশ্যটি বুঝিয়ে দিচ্ছি, দুষ্টু ছেলেরা শান্ত হয়ে আমার বুঝিয়ে দেওয়া শুনছে। কেন না, তাদের উপর বড়ো দায়িত্ব, তারা ভূতের গলিতে মানুষ হত্যা করবে আচমকা।
সিনেমা হলে চাকরি করে সুবোধ। ১৯৮৯-৯০ সালের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাব সুবোধ ও স্বপ্না বাস করে ভূতের গলিতে। সুবোধ বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। বউকে নিয়ে সে রিকশায় চড়ে। আদতে তারা গ্রামের মানুষ, সিনেমা হলের চাকরিরই সুবাদে সুবোধ ঢাকায় এসেছে বউকে নিয়ে। এবং একদিন, ভূতের গলিতে এক ভয়ানক পাবলিক মব বা উন্মত্ত জনতার রোষানলে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়।
আমরা দেখতে পাব, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভূতের গলিতে মহল্লাবাসিদের ভেতর নেমে আসে ভয়। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের বঙ্গীয় লোকাল কোলাবরেটর রাজাকারদের দোরাত্মে মহল্লাবসিরা অসহায় হয়ে পড়ে। এরকম অন্ধকার দিকনির্দেশনাহীন জীবন তারা আগে দ্যাখেনি। কী করবে, বুঝতে পারে না। সে সময়ে যে দম্পতি ভাড়াটিয়া হয়ে বাস করছিল ভূতের গলিতে, তারা এসেছিল সাতক্ষীরা থেকে। তাদের নামও সুবোধ-স্বপ্না। এবং যুদ্ধের মধ্যেই একদিন তারা মারা পড়ে।
অনিমেষ আইচ একজন নির্মাতা, কাঁটা ছবিতে বড়ো একটা ক্যারেক্টরে কাজ করেছে। শুটিংয়ের বাইরে অনেক দিন বা রাত অনিমেষ চলে আসত নারিন্দায়, কাঁটা ক্যাম্পে। একদিন রান্না করতে বসে গেল অনিমেষ। একটা আড্ডাবাজি হলো। অনিমেষ কাঁটাতে অভিনয় করলেও, নির্মাতা হিসেবে কাঁটা নির্মাণ করেছে এর আগেই, টেলিভিশনের জন্য। কথায় কথায় কথা ওঠে চারুকলার, অনিমেষ এলেই। দীপন’দা আছেন কাঁটা সেটে, আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে। একদিন দেখি, অনিমেষের শরীরে খুব কালারফুল একটা পাঞ্জাবি, আমি একজন সহকারীকে বললাম, ‘পাঞ্জাবি খুলে ওই নরমাল জামা পরাও ওকে। অনিমেষকে ১৯৮৯-৯০ সালে নিয়ে যাও। হাতের মোবাইল ফোন নিয়ে নাও। কেন না, ১৯৮৯-৯০ সালে মোবাইল ফোন কী জিনিস, তা কারোর ধারণাতেও ছিল না। তাই যদি হয়, সেই সময়ের একটা চরিত্র সেটে মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা সহ্য হয়?’
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ভূতের গলি, ভিজে যাচ্ছে আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি। ঘর থেকে নেমে এসেছে নতুন বউ, বউয়ের নাম স্বপ্নারানী দাস। সে কেন বৃষ্টির মধ্যে ঘর ছেড়ে উঠোনে এলো, সে কেন উঠোনে হঠাৎ পড়ে গেল, সে কেন কাঁদছিল বৃষ্টির দিনে—নানান প্রশ্ন প্রশ্ন হিসেবে জার্নি অব কাঁটা পড়তে পড়তে মনে আসতে পারে, কিন্তু কাঁটা ছবিটা না দেখলে তো আর সে সব জানা যাবে না।
বিভিন্ন চিপাচাপা গলিতে কখনো রিকশায় চড়ে, কখনো হেঁটে হেঁটেও আমরা শুটিং করে গেছি। যা-ই করেছি আনন্দ নিয়ে করেছি। আনন্দ নিয়ে করেছি? হ্যাঁ, প্রচণ্ড কাজের ব্যস্ততার চাপ থাকা সত্ত্বেও শুটিং ইউনিটে আনন্দ থাকে। নারিন্দায় আমরা ছিলাম মানে হচ্ছে এক আনন্দনগরে ছিলাম। এখন, সেই নারিন্দা থেকে অনেক দূরে এসে বুঝতে পারি, ওরকম আনন্দ আর সহজে আসবে না। আমার একার কেন, কাঁটা প্রোডাকশন টিমের কারোরই আসবে না।
বিভিন্ন থিয়েটার ইউনিট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া ডিপার্টমেন্টসহ অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রায় দেড়শ ছাত্রছাত্রী কাঁটাতে যুক্ত থেকেছে তখন। ২০ জন করেছে পাকিস্তানি সৈন্য। সিনেমা হলের অডিয়েন্স হয়েছে প্রায় একশো তিরিশ জন। ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক ফিল্ম এডিটর জুনায়েদ হালিমের কাছে কাঁটা টিম কৃতজ্ঞ এই ব্যাপারে। শিক্ষক বন্ধু সেলিম মোজাহারের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। জুনায়েদ হালিম কাঁটাতে একটি ক্যারেক্টার করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের মেশামেশি অনেক বছরের। পরস্পরকে বুঝতে পারি হয়তো। সিনেমা হলের দর্শক হিসেবে আজাদ ম্যানশনে শুটিংয়ের সময় সাধারণ কিছু অডিয়েন্সও আমরা পেয়েছি। হলের স্টাফদের অভিনয় করিয়েছি দর্শক চরিত্রে। যা মনে চায়, তাই করিয়েছি। এখন কথা হলো, মনে কী চায়?
মন যা চাচ্ছে, কাঁটা ছবিটা আপনারা দ্যাখেন। আপনি যখন কাঁটা দেখবেন, পাশেই, আড়চোখে আমি আপনার চোখ দেখতে থাকব। দেখব, কাঁটা আপনার চোখে ফুটল কতটা? অর্থাৎ আপনার কাজ ছবি দেখা, আমার কাজ আপনাকে দেখা। ঠিক আছে?
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২০
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৪
কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।