ট্রেনের ঝুলে থাকা সিঁড়ির তিন নম্বরটাতে ওঠার পরে আর এগোতে পারে না মণি। হাতল ধরে ঝুলে পিছনে তাকায়। তাকিয়ে থাকে স্টেশনে ঢোকার রাস্তাটার দিকে। যেন কী ফেলে চলে যাচ্ছে সে। লোকাল ট্রেন দাঁড়াবে অল্প সময়, যাত্রীদের মালপত্র ওঠানোর ব্যস্ততা, ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে নিরবিচ্ছিন্ন চ্যাঁচামেচি, কে যে চিৎকার দিয়ে কাকে ডাকছে তার কোনো হিসেব নেই। মণি থেমে যাওয়ায় সেখানে ছোটোখাটো একটা জটলা হয়ে যায়। কে যেন বলে, ‘আউগান না ক্যান, বাহে…’ ট্রেনের ভিতর থেকে মণির স্বামী, সোহেল বলে, ‘সিঁড়িত দাঁড়ে থাকলা যে! পিছনত মানুষ জমি গেইছে, আইসো তাড়াতাড়ি।’ মণি তারপরেও থমকে থাকে খানিকক্ষণ। বিয়ের দিন বাবার বাড়ি ছেড়ে ওই একই পীরগাছা স্টেশন থেকে স্বামীর সঙ্গে চলে যাবার সময়েও তার এরকম লাগেনি। সেদিন যেন কিছুতেই পা চলে না, বুক ফেটে ডাক বেরিয়ে আসতে চায়, ‘মউ’, স্বামীকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, মউ? মউ যে থাকি গেইল? উয়াক ছাড়ি এলা যাঁও ক্যাঙ্কা করি?
সেদিন যেন কিছুতেই পা চলে না, বুক ফেটে ডাক বেরিয়ে আসতে চায়, ‘মউ’, স্বামীকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, মউ? মউ যে থাকি গেইল? উয়াক ছাড়ি এলা যাঁও ক্যাঙ্কা করি?
স্যুটকেস জায়গা মতো রেখে সোহেল ফিরে আসে দরজায়। হাত টেনে প্রায় জড়িয়ে ধরে ভিতরে ঢোকাতে হয় মণিকে। মুখে আঁচল চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে সে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সোহেল মন্ত্র পড়িয়ে এনেছিল যেন রাস্তাঘাটে সে নিজেকে সামলায়। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্তে কোনো মন্ত্রই আর কাজে দেয় না। সিটে বসে একটু জোরেই ডুকরে ওঠে সে। সোহেল কাশ্মীরি শালটা ভালো করে জড়িয়ে দেয় তার গায়ে-মাথায়। কাজলবিহীন ফোলাফোলা চোখ আর টিপহীন কপালে মণির সরু মুখটার দিকে আর তাকাতে পারে না সে। হাতের ব্যাগের দিকে ইশারা করে বলে, ‘সোয়েটার নাগবে, মণি?’ মণি মাথা নাড়ে দুদিকে। কান্না চাপতে গিয়ে তার শরীর এমনিতেই ঘামঘাম। যদিও খুব শীত পড়েছিল সেবারে। টিনের বাড়িতে রাত কি দিন, বরাবর শীত জাঁকিয়ে বসত। আর তারই মধ্যে গলা চেপে ধরত আফসোস আর অপরাধবোধ। মণি সারাদিন বসে ভাবত, এই তো কয়েকটা দিন আগের কথা, কয়েকটা দিনের ঘটনাকে কি নতুন করে শুরু করানো যায় না? মাত্র একবার? তাহলে ওরকম ভুল সে আর করত না। মউকে কখনো চোখের আড়াল করত না। সোহেল বলেছিল এত শীত পড়েছে, এবার ঈদে না-হয় নাইবা গেল বাড়িতে। মণি শোনেনি। আচ্ছা, না এলে নিশ্চয় এইসব কিছুই ঘটত না? ট্রেনের জানালার ধারের বরফশীতল স্টিলে গাল লাগিয়ে ভাবে মণি। ঈদের পরদিন সোহেল বলেছিল তার সঙ্গে চলে যেতে। মণি চায়নি। এত ভিড় ঠেলে আসা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে আরও কয়েকটা দিন না থাকলে উসুল হয়? আচ্ছা, সোহেলের সঙ্গে তখন চলে গেলেও তো এখন মউ তার কোলে থাকত! সোহেল মউকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল সেদিন, আর তার পরদিন বিকেলেই সব শেষ। দুপুরে ভাত খাওয়ার পরে যখন শরীর আরও বেশি শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল, মউকে নিয়ে মণি সোজা গিয়ে ঢুকেছিল লেপের তলায়। তারপর মউয়ের আগে নিজেরই চোখ লেগে গেল। কুয়াশার ঢাকনার নিচে বাড়ির সব ঘরেই তখন ভাতঘুমের জোয়ার। আর ঠিক সেই ফাঁকে কখন যে বাচ্চাটা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল বাড়ির পিছনের পুকুরের দিকে, কে জানে! পুকুরের পানি মধ্য শীতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পানি ছোঁবার আশায় হয়তো পিছলে সোজা গিয়ে পড়েছিল সেখানে। শেষ বিকেলে ভেসে থাকা ফ্রক ধরে কে যেন মাঝপুকুর থেকে টেনে এনেছিল ঠান্ডায় জমে যাওয়া ছোট্ট শরীরটা। এক ঘুম দিয়ে শোরগোলের ঠেলায় উঠে বসে মণি দেখল তার সব উজাড় হয়ে গেছে। শীতল টিনের ঘরের ওই একই বিছানায় শুয়ে ওইদিনের কি আগে-পরের ঘটনাগুলো কতবার করেই না ভেবেছে মণি! ভাবতে ভাবতে আর হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওই কনকনে শীতেই তার শরীরে ঘামের ধারা দেখা যেত। সপ্তাহখানেক ধরে চলল এসব, তারপর সোহেল একরকম জোর করেই তাকে নিয়ে রওনা দেয়।
ট্রেন চলার আগপর্যন্ত মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখে মণির দিকে। বিদায়ের সময়ে কান্নাকাটি দেখে বেশিরভাগ যাত্রী অভ্যস্ত। কিন্তু ট্রেন চলার বেশ পরেও যখন মণি সমানে চোখ মোছে, সামনের সিটের যাত্রী আর কৌতূহল রাখতে পারে না, ‘বাহে, তার কি কোনো সমস্যা?’
‘বাচ্চা মরি গেইছে’, বলতে গিয়ে সোহেলেরও গলা ধরে এলো।
‘কী কন, ক্যাঙ্কা করি? কত্তোটি বাচ্চা?’
‘সাড়ে চাইর বছর। পুকুরত ডুবি গেইছে।’
‘ক্যাঙ্কা করি ডুবিল? তোমরা কোন্ঠে আছিলেন, বাহে? বাপ-মা কেউ খেয়াল করনেন না ওট্টুক বাচ্চাক?’
তারপর চিৎকার করে বলে, মোর কী দোষ? মরার ঘুম আলছিল ক্যান তখন? ইচ্ছা করি কি মুই উয়াক চোউখের আড়াল করছিনু কোনোদিন?… অথচ কিছু না বলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মাথা কাত করে তাকিয়ে থাকে ধূসরের দিকে। সামনের সিটের লোকটির আক্ষেপ শেষ হয় না, ‘ইস, ছাওয়ালটা অ্যাঙ্কা করি মরিল! এই বয়সত চউখের আড়াল করা যায়?’
সোহেল চুপ করে থাকে। কিন্তু লোকটার কথায় যেন বিদ্যুৎ লাগে মণির গায়ে। কান্না থামিয়ে মুখের উপরে চাপা দেওয়া আঁচলটা নিয়ে চোখ নাক মুছে নেয় খুব করে। তারপর উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে। খেতগুলোতে ধান কেটে নেওয়ার পরে গোড়াগুলো জেগে আছে শুধু, কোথাও কোথাও কিছু গরু সেই শুকনো গোড়াটা ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। যতদূর চোখ যায় সবুজের চিহ্ন নেই। পুরো প্রকৃতি মিলে যেন মণির বিষণ্ণতায় সায় দিয়ে যায়। বিকেলের দিকে কুয়াশা এসে গলা টিপে ধরেছে আকাশের; আর পৃথিবীকে বাদামি থেকে ধূসর করে দিচ্ছে। মণির ইচ্ছে করে সেই ঘন ধোঁয়ার মতো আকাশের মধ্যে একটা বড়ো ফুটো করে ফেলে, তারপর চিৎকার করে বলে, মোর কী দোষ? মরার ঘুম আলছিল ক্যান তখন? ইচ্ছা করি কি মুই উয়াক চোউখের আড়াল করছিনু কোনোদিন?… অথচ কিছু না বলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মাথা কাত করে তাকিয়ে থাকে ধূসরের দিকে। সামনের সিটের লোকটির আক্ষেপ শেষ হয় না, ‘ইস, ছাওয়ালটা অ্যাঙ্কা করি মরিল! এই বয়সত চউখের আড়াল করা যায়?’ তারপর কবে কোথায় বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে বাচ্চার কতরকম বিপদ হয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে থাকে সে। ট্রেনের শব্দটা মাঝেমধ্যে বাড়ে, লোকটার তীরের মতো কথাগুলো মণির গায়ে লাগার আগেই কখনো বাঁচিয়ে দেয় দয়ালু ট্রেনটা।
রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে তখন মণির শরীরে, যেন একটা কোনো চাঞ্চল্যকর কাহিনি ফুরিয়ে যাবার পরের নিস্ক্রিয়তা ঘায়েল করে ফেলে। তাই জানালার শীতল অস্তিত্ব সহজেই ঘুম পাড়িয়ে দেয় তাকে। ঘুম ভাঙে ট্রেনের ধাক্কায়। চোখ মেলে দেখে, খোলাহাটী স্টেশনে ট্রেন থামল। প্রায় চলেই এসেছে, ভাবে মণি। সোহেল বলে, ‘পানি খাবা, মণি?’ প্ল্যাটফর্মের একমাত্র দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওইখান থেকি পানি আনি? নাইলে চা?’ সোহেল উত্তরের অপেক্ষা না করেই রওনা দেয়। সামনের সিটের লোকটা হয়তো আফসোস করতে করতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে; জামাকাপড় এলোমেলো, পাঞ্জাবি উঠে আছে নাভির উপরে, মুখ হা, যেন আফসোস ফুরায়নি তার তখনো। মণির কাছে কুৎসিত লাগে। চোখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকালে সেখানেও একই রকমের বীভৎসতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এক রাজাকারের সহায়তায় এই খোলাহাটীতে তিন শ জনকে এক সঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলেছিল পাক আর্মিরা; আস্ত দুটো ট্রেন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বাবার সঙ্গে এই স্টেশন পার হবার সময়ে কয়েকবার গল্পটা শুনেছে মণি। পুড়ে কালো হয়ে থাকা দোমড়ানো মোচড়ানো ট্রেনের স্তূপ দেখিয়ে বাবা গল্পটা বলত। স্টেশনের এক ধারে ভাঙাচোরা লোহার স্তূপটা অনড় হয়ে পড়ে থাকে বছরের পর বছর, স্বাধীনতার বারো বছর পরেও সেদিকে তাকালে মণির আত্মা কেঁপে ওঠে। ধ্বংসস্তূপের ফাঁকফোকরে যেন থমকে থাকে আগুন আর শত মানুষের কান্নার আওয়াজ।
রেলের কামরায় হঠাৎ তীব্র চ্যাঁচামেচি শুরু হয়। মনে হয় অনেক মানুষ মিলে ধাতব টুকরোর কিছু বস্তা ওঠাচ্ছে, ঠিকঠাকমতো ওঠানো নিয়ে গ্যাঞ্জামও কম হচ্ছে না। এ-ও মণির চেনা শব্দ। ধাতব টুকরোয় ভরা বস্তাগুলো ট্রেনের গায়ে এদিকওদিক লেগে ঘটাং ঘটাং আওয়াজ হচ্ছে। কিছু লোক থাকে, পোড়া ট্রেনের ধ্বংসস্তূপ থেকে লোহার টুকরো জড়ো করে বস্তায় ভরে। তারপর বস্তাগুলো ট্রেনে উঠিয়ে একদিকে বদরগঞ্জ অথবা আরেকদিকে পার্বতীপুরে নিয়ে কামারের দোকানে বিক্রি করে, বাবা মণিকে বলেছিল। কামারেরা সেই লোহায় নতুন অন্য জিনিসের আকৃতি দেয়, কেউ আর ধরতে পারে না লোহার উৎস। রেলওয়ের লোকদের চোখে পড়লে অবশ্য ধরে নিয়ে যায় তাদের। মণি জানে না তারপর তাদের কী হয়, কিন্তু যতবার দেখেছে মনে হয়েছে একটা উত্তেজনাকর খেলা হচ্ছে, কারো চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু করার এবং ধরা পড়া না-পড়ার আশঙ্কায় দুতিনটা স্টেশন পেরিয়ে যাবার খেলা। খেলার শেষ দানে, পার্বতীপুরে বস্তাসমেত নেমে যাবার সময়ে ছেঁড়া-ময়লা শাড়ি পরা মেয়ে আর বেশিরভাগ খালি গায়ের ছেলের দলটার সবার মুখেই থাকে নিশ্চিন্ত হাসি।
জানালা দিয়ে গ্লাসে পানি আর কাপে চা মণির হাতে আগেভাগে ধরিয়ে দিলেও বস্তা ওঠানোর ধস্তাধস্তিতে সোহেল কামরায় ঢুকতে পারে না। ট্রেন চলতে শুরু করলে কোনোরকমে উঠে আসে সে। জানালার বাইরে দোকানের ছেলেটা ট্রেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়ায়, শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ তার হাতে চালান করে মণি। আরেকটু গতি বাড়লে লাল পোশাকের এক কুলি পাশে পাশে দৌড়ায়, বাতাসে তার চিৎকার ভেঙে ভেঙে যায়, তবু যেটুকু বোঝা যায়, ‘পার্বতীপুরের পুলিশোক খবর দিসে, বাহে। ধরবার নাগি অটে বসি আছে, তোমরা নামি যান, নামি যান।’ প্ল্যাটফর্ম শেষ হলেও লোকটা মাটিতে নেমে ট্রেনের পাশে পাশে দৌড়ায় আর একই কথা বলে যেতে থাকে। বিয়ের আগে বাবার সঙ্গে যাতায়াতের সময়কার মতোই উত্তেজনা লাগে মণির। সিট থেকে ঝুঁকে দলটাকে দেখে নেয় সে। দুই দরজার সোজাসুজি মেঝের উপরে বসে আছে তারা। একইরকম মুখের মানুষগুলো, একই ধরনের শব্দহীন ক্রোধ যেন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে তাদের চোখে-মুখে। কাছেধারের নিজ এলাকা ছেড়ে আসা কিছু আদিবাসীও তাদের সঙ্গে জুটে যায় কখনো। এরকম লোকেরাই যখন বাড়ি বয়ে নানান রঙের চুড়িভর্তি ডালা নিয়ে উপস্থিত হয়, বাড়ির মেয়েরা বেরিয়ে আসে, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে তাদের সঙ্গে। কিন্তু এই কাজে এদের দেখলে তারা নাক সিটকাবেই। মণি জানে, একটা কোনো কারণ নিশ্চয় থাকে যার জন্যে একজন বাড়ি বাড়ি ঘুরে গল্পগুজব করে মুড়ি বা চুড়ি বিক্রি না করে কামারের কাছে লোহা বিক্রির জন্য চুরি করতে আসে। আর এই তুমুল শীতেও কী ফিনফিনে কাপড় তাদের পরনে! দরজার পাশে কিছুক্ষণ আগে এলিয়ে থাকা দুটো লোক আর তিনটা মেয়ের মধ্যে তখন চাপা গুঞ্জন। মণি তাকিয়ে থাকে। বস্তার বাঁধন খোলার জন্য হাত বাড়ায় একজন, পাশের দুজন বাধা দেয়, তাদের হয়তো অন্য পরিকল্পনা আছে। অন্য দুজন বস্তা খোলাকেই সমর্থন করে, দ্রুত খুলতে থাকে রশির প্যাঁচ। তাদের এই সিদ্ধান্তহীনতার ভিতরে মণি দেখে দলের সাঁওতাল মেয়েটার বুকের কাছে কী যেন নড়ে ওঠে, ছোটো একটা হাতের মতো দেখায়। মণির মনে পড়ে, জন্মানোর পরপর ঘুমন্ত মউ সামান্য শব্দে কেঁপে উঠে আঙুলগুলো ছড়িয়ে হাতদুটোকে কেমন তারার মতো করে ফেলত। হ্যাঁ, মেয়েটার কোলে একটা তারাই দেখা যায়। ভালো করে দেখার জন্য সিটের ধারের দিকে চলে আসে সে। মেয়েটার কোলে জীর্ণ শাড়িতে বাঁধা কচি একটা বাচ্চা। মণি চমকে ওঠে, ওইটুকু বাচ্চা বুকে ঝুলিয়ে এই দুর্ধর্ষ কাজে এসেছে সে!
ঘন কুয়াশার কাছে প্রায় ডুবে যাওয়া সূর্য ততক্ষণে হার মেনেছে প্রায়। আবছা অন্ধকারে বোঝা যায় না ট্রেন কতদূর এগোল। তারই মধ্যে দলটির একজন চিৎকার করে ওঠে, ‘সিগন্যাল আপ, সিগন্যাল আপ’। মণি বুঝতে পারে তাদের মধ্যে উত্তেজনা সামান্য কমে এসেছিল সিগন্যাল ডাউন থাকবে, এই আশায়। কিন্তু লোকটির চিৎকার শোনামাত্র হইহুল্লোড় লেগে যায়। কামরার দরজা খুলে দ্রুতহাতে বস্তা থেকে লোহার টুকরোগুলো নিচে ছুড়তে থাকে তারা। বড়ো টুকরোগুলো মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ধুপধাপ শব্দ হয়, নুড়ি পাথর ছিটকে যায় এদিকওদিকে, কিছু হয়তো ট্রেনের গায়েও লাগে। আর ছোটো টুকরোগুলো রেলের চাকায় লেগে তীব্র ধাতব শব্দ হয়। কামরার দরজা খোলাতে হিমশীতল বাতাসে ভিতরের সবাই আড়ষ্ট হয়ে যায়। কেউ কেউ আপত্তি করে, ধমকে বলে দরজা লাগাতে।
তার কাজকর্ম দেখলে মোটেও মনে হয় না নিজের শরীর ছাড়া অন্য কোনো ভার সে বহন করছে কিংবা সে কথা তার মনেও আছে। ছোটো চোখের কালো মুখটা ট্রেনের ছাদে লাগানো বাতির টিমটিমে আলোয় চকচকে দেখায়। নড়াচড়া আর উত্তেজনায় মসৃণ চামড়ায় ঘাম জমে তেলতেলে মনে হয়। প্রতিবার বস্তা থেকে টুকরো নিয়ে দরজার দিকে ছুটে যাবার পর থেকে মণি তার ফিরে আসা দেখার প্রতীক্ষায় থাকে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা, অগুনতি টুকরো সমানে দরজা দিয়ে বাইরে পড়তে থাকে। ট্রেনের গতিও কেন যেন খানিকটা বেড়ে যায় তখন। লোহার টুকরো আর দ্রুত ঘুরতে থাকা চাকার ঘর্ষণে অন্ধকারে আগুনের ফুলকি দেখা যায়। মানুষগুলোর এলোমেলো চলাফেরার মধ্যেও মণির চোখ বারবার যায় বুকে বাচ্চা ঝুলিয়ে রাখা সাঁওতাল মেয়েটার দিকেই। সিট থেকে একটু ঝুঁকলেই কখনো হাঁটু গেড়ে বস্তা থেকে লোহার টুকরো নিতে, কখনো ছুটে গিয়ে দরজা দিয়ে ছুড়ে ফেলতে দেখা যায় তাকে। তার কাজকর্ম দেখলে মোটেও মনে হয় না নিজের শরীর ছাড়া অন্য কোনো ভার সে বহন করছে কিংবা সে কথা তার মনেও আছে। ছোটো চোখের কালো মুখটা ট্রেনের ছাদে লাগানো বাতির টিমটিমে আলোয় চকচকে দেখায়। নড়াচড়া আর উত্তেজনায় মসৃণ চামড়ায় ঘাম জমে তেলতেলে মনে হয়। প্রতিবার বস্তা থেকে টুকরো নিয়ে দরজার দিকে ছুটে যাবার পর থেকে মণি তার ফিরে আসা দেখার প্রতীক্ষায় থাকে। কিন্তু একবার কেন যেন সে ফিরে আসে না, আনুমানিক সময় চলে যায়, তার ফেরার বদলে হয়তো তারই চিৎকার শোনা যায়। হু হু বাতাস আর ট্রেনের ঝিকঝিক কিংবা লোহার টুকরো পতনের ঘটাং ঘটাং শব্দ, সবকিছুকে চিরে মেয়েটার গগণবিদারী কান্নাটাই প্রধান হয়ে ওঠে তখন। মণি এক দৌড় লাগায় কামরার দরজার দিকে। সোহেল তাকে ধরতে গিয়েও আটকাতে ব্যর্থ হয়। পিছনে দৌড়ে যায় সে আর মণি তার দিকে ফিরে বলে, ‘চেন টানি ধরো, ট্রেন থামাও’ তারপর গিয়ে জাপটে ধরে দরজায় ঝুঁকে থাকা সাঁওতাল মেয়েটাকে। কেউ মণিকে বলে দেয় না কিন্তু সে না দেখেও জেনে যায় যে লোহার টুকরো ছুড়তে গিয়ে বুকে বাঁধা বাচ্চাটা ছিটকে পড়ে গেছে দুর্ভাগা মেয়েটার।
ততক্ষণে কামরার যাত্রীরাও কৌতূহল মেটাতে এগিয়ে আসে। মণির বাচ্চা মরে যাওয়ায় আফসোস করতে থাকা লোকটা এগিয়ে এসে বলে, ‘ভালো হইছে। চুরি ছাড়া আর কোনো কাম পান নাই তোমরা? এলা শিক্ষা হইল?’ সাঁওতাল মেয়েটা তার কথা শুনতে পায় না হয়তো, অন্ধকারের মধ্যেই বিড়ালের মতো দৃষ্টি দিয়ে বাইরে কিছু খুঁজতে থাকে। কয়েকবার লাফিয়েও পড়তে চায়। মণি তাকে আটকে রাখে। দলের বাকিরা থমকে যায়, বাকি লোহার টুকরো খোলা বস্তায় পড়েই থাকে মেঝেতে। ট্রেনের গতি কমতে কমতে প্রায় থামার উপক্রম তখন। খানিকটা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামে তারা। তাদের সঙ্গে মণিও। কনকনে শীতের রাতে বাতাসের ঝাপটা কেটে উলটোদিকে দৌড়াতে থাকে সবাই। কতক্ষণ দৌড়ায় কেউ জানে না। কিছু যাত্রী টর্চ নিয়ে তাদের পিছনে ধাওয়া করে। ঘুরঘুটি অন্ধকার আর কুয়াশায় কাটাওলা শুকনো ঝোপঝাড়ে তারা হন্যে হয়ে একটি কচি প্রাণ খুঁজতে থাকে। কেউ কেউ দৌড়াতে দৌড়াতেই পাশের জনের কাছে জানতে চায়, ‘কী পলছে, বাহে? কী খোঁজেন তোমরা?’ উদভ্রান্ত মানুষের ভিড় অন্ধকারে একখানে এসে হোঁচট খায়। কিছু লোহার টুকরো ইতস্তত পড়ে থাকতে দেখা যায় সেখানে। সেই জায়গাটাকে কেন্দ্র করে চারদিকে খুঁজতে থাকে সবাই। কেউ কেউ টর্চের আলোয় ট্রেনের চাকায় রক্তের দাগ খোঁজে, রেল লাইন পরীক্ষা করে, লাইনের গা ঘেঁষে পড়ে থাকা নুড়ি পাথরের সারির আনাচে কানাচে খুঁজতে থাকে কেউ। সাঁওতাল মেয়েটার খেয়াল সেদিকে নেই, আগুপিছু খেয়াল না করে সে কেবল ঝোপঝাড়ে ঢুকে পড়ে, কাটায় তার হাত-পা ছিঁড়ে যায়, ঘাম মোছার মতো করে আরেক হাত দিয়ে রক্তের ধারা মুছে ফেলে সে অগ্রসর হতে থাকে। তাকে অনুসরণ করে বহু মানুষ, অন্ধকারে শুকনো ঝোঁপে একটা আলোড়ন লেগে যায়। তারই মধ্যে থেকে একজনের চিৎকার শোনা যায়, ‘এই যে, এইখানত আইসেন, বাহে’ রক্তাক্ত এক দলা মাংসপিণ্ডের মতো কিছু একটার উপরে টর্চের আলোটা তাক করে রাখে লোকটা। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেখানে। অল্পবয়েসি চকচকে গালওলা মেয়েটি সেই মাংসপিণ্ডের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত অসুরের মতো শক্তি দিয়ে সামনের মানুষদের সরায়; পরম মমতায় কোলে তুলে নেয় ধুলা আর রক্তে কাদা কাদা হয়ে থাকা শিশুটিকে। তারপর মাটিতে বসে পড়ে মৃত বাচ্চাটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। কুয়াশা আর গাঢ় অন্ধকারের জোটপাকানো আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। তার চিৎকারে সমস্ত চরাচর কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। ভিড় ঠেলে মণি হঠাৎ সেখানে পৌঁছে; ঝুঁকে দুই হাতে মেয়েটার ঘাড় চেপে ধরে, ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘এই কামোত ক্যান আনছিলেন উয়াক তোমরা? বাড়িত রাখি আসেন নাই ক্যান? ক্যান মারি ফেলাইনেন?’ বলেই সশব্দে কেঁদে ওঠে মণি। কাঁদতে কাঁদতে সাঁওতাল মেয়েটার পাশেই ধপ করে বসে পড়ে। মেয়েটা হয়তো এক মুহূর্তের জন্য বোকা বোকা হয়ে যায়, তারপর বলে, ‘বাড়ি নাই, কেউ নাই যে, বু, কার ঠে রাখি আসিম? উপায় থাকিলে এই কাম করা নাগে হামাক?’ কিন্তু মণির আক্রোশ যায় না। ট্রেনের কামরার সেই লোকটার মতোই আফসোস করতে থাকে সে। তারপর সাঁওতাল মেয়েটাকে বকাবকি করতে করতে একসময় তুমুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। মেয়েটার অনাবৃত ঘাড় জড়িয়ে ধরে নিজের পাটভাঙা গরদের শাড়িটা রক্ত আর ধুলায় মাখিয়ে ফেলে মণি।
দুজনের কান্নার শব্দ আলাদা করা যায় না, একইরকমের হাহাকার মিশে থাকে তাতে। তীব্র শীতের কুয়াশা ফুঁড়ে শ’খানেক মানুষ চারদিকে জড়ো হয়ে দুই নারীর অভিন্ন আর্তনাদ দেখতে থাকে।
জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর, নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়। কল্পকাহিনি (গল্প, উপন্যাস, সায়েন্সফিকশন), অনুবাদ মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৩। উল্লেখযোগ্য বই, ‘প্রতিচ্ছায়া’, ‘দিনগত কপটতা’, ‘কোলাহল থামার পরে’। অনুবাদ করেছেন উইলিয়াম ফকনার, নাদিন গোর্ডিমার, আইজ্যাক আসিমভসহ আরও অনেকের। ‘কোলাহল থামার পরে’ বইটির জন্য ২০২১ সালে পেয়েছেন জেমকন সাহিত্য পুরস্কার।