শেষ পর্ব
• হেই আগেকার এককালে, এমুনই একপ্রকার দিন গেছে!
হেইটা হেইসোম আছিলো বৈশাখ মাস। গাঙ তহন আমাগো এই ভিটির তেনে, বহুত তফাতে! বৈশাখ মাইস্যা দিনে, হাইট্টা হাইট্টা গাঙপাড়ের দিগে যাইতে, আমার য্যান একেবারে দুই পহর বেইল লাইগা যায়! হেই আগেকার দিনে, আমার ছোটোকালে য্যান আরো বেশি বেইল লাগতো আমার!
তহন আমি খালি অল্প এট্টু মাথা-উচাইছি! উস্তাদে কইছে, বিমারের তেনে ভালা হইতেই বোলে বচ্ছর ঘুইরা গেছিলো আমার! সাইরা ওঠোনের পরে, তহন পেরায় দুই বচ্ছর পার হইয়া গেছে! তহন আন্দাজ আমার বয়স হইবো একেবারে দুই গণ্ডা বচ্ছর!
তহন আমি খালি অল্প এট্টু মাথা-উচাইছি! উস্তাদে কইছে, বিমারের তেনে ভালা হইতেই বোলে বচ্ছর ঘুইরা গেছিলো আমার! সাইরা ওঠোনের পরে, তহন পেরায় দুই বচ্ছর পার হইয়া গেছে! তহন আন্দাজ আমার বয়স হইবো একেবারে দুই গণ্ডা বচ্ছর!
বিমার-বালাই তেনে সাইরা আমি উঠছি তহন ঠিকই, কিন্তু আমার শইল্লের কাহিল দশা বোলে তহনও ঘোচে নাই! তহনও বোলে আমারে পোক্ত শক্ত দেহায়ই না! বরঞ্চ তহনও আমারে দেখলে মোনে হয় য্যান, আমি কেবলই ধুঁকতাছি!
একে শীতলা মায়ের দয়ায় জেরবেরা শইল! হেইর উপরে দিয়া হইলো গিয়া, জলে-ডোবা দেহ! কতোদিন গাঙে ভাইস্যা আছিলাম, সেইটা তো নিচ্চয় কইরা কেউই কইতে পারে না! আবার দেহো গা, ভোদভোদাইন্না জ্বরেও আমারে গেরাস কইরা নিছিলো!
এমুন তেমুন বিমার-বালাইয়ে ছ্যাত-ভ্যাতা দেহখান যে সাইরা ওঠছে! হেইটাই না সাত কপালের ভাগ্যি! অখন, দয়ালের হুকুম থাকলে, চ্যাগবেগা দেহখানে বল আইতে কতখোন!
হেই কালে তহন, একটা কদম ফেলতেও য্যান, আমার দেহ কাইপ্পা শ্যাষ অয়! বাঁশ পাতার লাহান য্যান কাঁপতে থাকে!
তেমুন দিনের বৈশাখ মাসের একদিন উস্তাদে করে কী, আমারে গাঙপাড়ে লইয়া যায়! লইয়া যায় একটা বিশেষ কর্ম সাধনের লেইগা!
কি হেই কর্ম?
না! আমারে নিকি গাঙের কিনারে বইয়া থাকতে হইবো! বিয়ান তেনে একবারে তিন সইন্ধা বেইল তরি, অইনে আমারে বইয়া থাকোন লাগবো!
ক্যান? এমুন ক্যান?
বিস্মরণ ঘোচানীর টোটকা যে এইটা! এইনে এমুন করোনই বিধি!
আমার জ্ঞাতি-গুষ্টির সহী হদিস পাওনের চিন্তায়, উস্তাদে হেইকালে পুরা জরা জরা! এইটা কাগো বাড়ির পুত! কোন মনিষ্যির এই সোনার টুকরাখান, এমনে গাঙে ভাইস্যা গেছে! হেরা হেগো পোলার সন্ধান কইরা কইরা, কোন আজাবটা না-জানি পাইতাছে!
অন্য আরেক বেপার হইয়া রয় নাই তো? এমুন নি হইছে যে, বাপে-মাওয়ে ইচ্ছা কইরাই হেগো পোলারে এমুন গাঙে ভাসাইয়া দিছে? হইতেও তো পারে, পোলার হায়াতের পিদিম নিবু নিবু দেইক্ষাই, এমুনটা করছে হেরা? গাঙে ভাসাইয়া দিছে!
মনিষ্যিরা কী অল্প দুক্ষে এমুনটা করে?
অল্প দুক্ষে করে না! আপনা জোনেরে বাঁচানের সগল আশা যহন শেষ হইয়া যায়, তহনই না মাইনষে এমুন জলে ভাসান্তী দিয়া দেয়!
তয়, সগল ব্যাধির বিমারীরে লইয়া তো লোকে এমুনটা করে না! কেবল না সর্প দংশনের মউতারে লইয়া লোকে এমুন করে? সর্পের বিষ নামান্তীর সগল আয়োজন-আঞ্জাম যহন বিফল হইয়া যায়, লোকে তহন নিজেগো মউতারে ভেলায় কইরা ভাসান্তী দিয়া দেয়!
তহনও লোকের অন্তর তেনে আশা ফুরায় না! যুদি বাঁচে তাগো মানুষটায়! লক্ষিন্দরে বাঁচছিলো না? যা থাকে আলা নসীবে! যুদি মউতার হায়াত থাকে, তাইলে ভেলাখানে কোনো না কোনো আদত গুণীনের ঘাটে গিয়া ভিড়বোই ভিড়বো! জানে হেয় বাইচ্চা ওঠবোই! নাইলে আর কী! মাটির সন্তানেরে পানিয়ে কোল দিয়া দিবো!
কিন্তুক, এই পোলার রকমখান তো এমুন না! হেরে তো সর্পে দংশন করে নাই! তাইলে হের জ্ঞাতিরা হেরে কোন কারোণে ভাসাইয়া দিবো?
আর ভেলায় কইরাও তো এরে ভাসান্তী দেয় নাই! দিলে, ভেলাখানে গেছে কই? পোলায় না হুদা পানি-ভাসা হইয়া আছিলো?
তাইলে এই ভেদেরে ভাঙোন কেমনে? তুমি জানো মালিক!
গুটি বসন্তের ছ্যাচা-খাইতে থাকা শইলটার কষ্ট আর জ্ঞাতিজোনেরা বরদাস্ত করতে পারে নাই? দিছে পোলারে গাঙে ভাসাইয়া? ভাসতে ভাসতে যুদি মর মর পোলাখানে, কোনো মোক্ষম কবিরাজের ঘাটে গিয়া ভিঁড়ে! কিসমতের গুণে কী না হইতে পারে? পোলাটায় যুদি এমনে আবার ফিরা-জনম পাইয়া যায়!
তয় এমুন নি হইতে পারে, গুটি বসন্তের ছ্যাচা-খাইতে থাকা শইলটার কষ্ট আর জ্ঞাতিজোনেরা বরদাস্ত করতে পারে নাই? দিছে পোলারে গাঙে ভাসাইয়া? ভাসতে ভাসতে যুদি মর মর পোলাখানে, কোনো মোক্ষম কবিরাজের ঘাটে গিয়া ভিঁড়ে! কিসমতের গুণে কী না হইতে পারে? পোলাটায় যুদি এমনে আবার ফিরা-জনম পাইয়া যায়!
হইতে পারে, এমুন ভাবনা কইরাই পোলার জ্ঞাতিরা, পোলাটারে গোর দেয় নাই! গোর না-দিয়া, লক্ষিন্দরের লাহান গাঙে ভাসাইয়া দিছে! হইতেও তো পারে, আইতে পন্থে তুফানের ছোলা লাইগ্গা, পোলাটার ভেলা ডুইব্বা গেছে গা!
গায়েবের মালিকে জানে, আইতে পন্থে এই বিমারীরে কী কী ছিদ্দত ভোগ করতে হইছে!
তয়, মউতা-লাগা পোলায় শেষতক কই আইয়া ঠেকছে? আইয়া ঠেকছে, ধন শেখের ঘাটায়! হেই পোলায় দেহো গা তো অখন, কেমুন সোন্দর জানে বাইচ্চা ওঠছে! হেয় মউতের দুয়ার তেনে ফিরত আইছে! মালিক মেহেরবান!
অখন তাইলে যাগো পুত, তাগো কাছে ফিরাইয়া দেওনের কাম না? এই আমানতরে আসোল মালিকের হাতে সোপর্দ না-করলে, ধন শেখে পরকালে গিয়া কী জব দিবো!
নিজের সগল আদি কথাই, এই পোলায় বিস্মরণ পাইছে! কিন্তু সুখতী গাঙে তো জাগনা আছে! হের বক্ষের তাবৎ মায়া দরদ বাস্না লইয়াই, হেয় জাগনা আছে! অই গাঙের মোকাবিলায় গিয়া বহো! তোমার সগল মুশকিলের আসান হইয়া যাইবো! সুখতী গাঙে না সগলকিছুর সাক্ষী!
হেই চিন্তা কইরা কইরা উস্তাদে আমারে গাঙপাড়ে লইয়া যায়! নিত্যি বিয়ান বেইলে আমারে অইনে নিয়া যাওয়া ধরে হেয়! তারবাদে আমারে একলা বহাইয়া দিয়া, হেয় তার কর্মে যায় গা!
এই যে আমি অহন যেমুনটা করতাছি! উস্তাদেও তহন এমুনই করতাছিলো!
আমি অহন কী করতাছি! নিত্যি বিয়ানেই হেই কন্যায় পানি-কাঞ্জি যা-ই-যেট্টুক মোখে দেওনের, দেয়! হেইর বাদে আমি হেরে লইয়া বাইরা আঙ্গিনার কিনারে যাই! জাবুন গাছের গুঁড়িতে হেয় ঠেস দিয়া, গাঙমুখী অইয়া বয়; আর আমি আমার কোষাখানেরে একটা লাম্বা ঠেলা দিয়া গাঙে ভাইস্যা পড়ি!
যামু আর কই? যাওনের জাগা বলতে তো আমার খালি আছে খড়া জালের জায়গাখান! বাঁশের খুঁটা-মুটা গিলি আছে! হেইনে গিয়া আমি একলা বইয়া থাকি! নাইলে খাড়া দিয়া থাকি! জালেরে পানির তলে নামাইয়া দিয়া, আমি কতখোন আসমানেরে দেহি! বিরান গোরস্থান হইয়া যাওয়া জোলাপাড়াটার দিগে কতখোন চাওন দিয়া থাকি! কতখোন করি কী, নয়া একখান জাল বুনানীর কর্ম করি!
আমাগো সংসারে একখান ঝাঁকি জাল নাই, এইটা ঠিক আছে! তয়, হেইটা নাই দেইক্ষাই যে অহন একটা জাল বুনান্তীর কর্ম শুরু কইরা দেওন লাগবো, বিষয়খান অমুন না! আদতে এইনে আমি পলান্তী দিয়া থাকতে আহি! উস্তাদের ঝিয়ে যেমুন দিন ভইরা খালি অহন খেতা সিলান্তী দিতে থাকে! খেতাই সিলান্তী দিতে থাকে হেয়! আমিও তেমুন মাছ ধরুন্তীর ছুতায়, বাড়ি ফালাইয়া, এই সু সু নিরালায় আইয়া খাড়া দিয়া থাকি! মাছ ধরাধরি ছুতামুতা দিয়া অর্ধেক বেইল শেষ করি! বাকি বেইলখান, জাল বুনুন্তীর কর্ম লইয়া, পার কইরা দিতে থাকি!
তয়, আমার পরিবারের কিসমতে তো এই সুবিধাখান নাই! হেরে বাইতই থাকোন লাগে! নাইলে হেই কন্যার ঠেকা-ঠোকা কে দেখবো? বুচি বিবিরেই তো হগলকিছু দেখতে অইবো! বাইত থাইক্কা থাইক্কাই উস্তাদের ঝিয়েরে, দীলের ভিতরের হগল আগুন-পানিরে সামলানী দিয়া রাখতে অয়!
কী অইলো আতকা আমাগো দোনোজোনের দীলে?
তেমুন গুরুতর কিছু অয় নাই! কিছু এট্টু কেমুন আগুন য্যান আমাগো পরানে লাগছে! হেই আগুনে ক্যান জানি নিবতেই চায় না! খালি জ্বলুন্তী দিয়াই থাকতাছে! এইটা কী বিষম ফেরের তলে পড়তে হইছে আমাগো, বিধি?
খোনে খোনে এ কী অগ্নি দিয়া আমাগো দোনোজোনেরে দগ্ধাইয়া যাইতাছো তুমি? এইটা তোমার কেমুন লীলারে?
এই যে গাঙে-ভাসা কন্যাখানেরে তুমি মিলাইয়া দিছো! হেয় একদিন আমাগো থুইয়া যাইবো গা?
ক্যান, ক্যান? ক্যান রে দয়াল!
পইল্লার দিগে, কন্যাখানেরে জানে বাঁচাইয়া তোলোনের কর্ম লইয়া যহন থাকতে হইছিলো; তহন ঘটতাছিলো অন্য বিত্তান্ত! তহন কেবল মোনে হইতাছিলো, তুমি বিধি এইটা কেমুন জ্বালার তলে ফালাইলা! ক্যান আমাগো এমুন লৌড়ের পেরেশানী দিলা তুমি! এই আমরা টুণ্ডা দুইটা পেরানী! আমাগো শইল্লে নি এমুন খাবাজাবা লৌড়ালৌড়ি করোনের তাকদ আছে! এইটা তোমার তেমুন বিছার রে সাই!
হেইর বাদে, দিনে দিনে কন্যায় যতো না খাড়া হইয়া ওঠলো, ততো য্যান বিধিয়ে এট্টু এট্টু কইরা, আমাগো ভিতরে মায়া-বাঞ্ছার জাল ছড়াইয়া দেওন শুরু করলো!
হায় হায়! এই কন্যায় যাইবো গা? ক্যান যাইবো গা? আমাগো ফালাইয়া থুইয়া হেয় কই যাইবো? না না! হেয়, কোনোহানে যাইবো না! এইটাই হের চিরকাইল্লা ভিটি! হেয় না থাকলে, আমার মউতের কালে, আমার মোখে শেষ পানিটুক কে দিবো? হেইকালে বুচি বিবি কাইন্দা দুনিয়া ভাসাইবো, না আমার মোখে এক ঢোক পানি দিবো?
আমার এই চিত্তিয়ে এমুন বেবুজ কেমনে হয়? কোন পরানে আমরা অই কন্যার তেনে অমুনটা আশা করি? এইটা হয়? কাগো ঘরের কইলজার টুকরায় না-জানি, এইটা কই আইয়া রইছে! এক বস্ত্রে এক অচিন ঠাইয়ে থাকতে গিয়া, হের না-জানি কতো ছিদ্দত চলতাছে!
না হের কতা আমরা কিছু এট্টু বুঝি! না হেয় আমাগো কিছু বুজাইতে পারে! তাও হের মোখে কোনো আহা-তাহা নাই! অন্তরেও য্যান কোনো গোস্বা নাই! আমাগো এই টুটা-মুটা গরীবী ঘর-দুয়ার! হেইনে হেয় কেমনে দিন-গোজরান করতাছে? মালিক সাঁইয়ে জানে!
আহুক! হের সাকিন-কুষ্টি-নাম-গুষ্টি, হগলকিছুর কতাই হের স্মরণে আইয়া পড়ুক! মালিকে য্যান হেই রহমখান করে! ত্বরা কইরাই করে! হেরে বিদায় দেওনের পরে, আমাগো দীলের ভিতরে আর আমাগো জিন্দিগীতে, যা-হওনের হউক! ঠাটা পড়তে থাকলে, পড়ুক! আমাগো আবার এইটা একটা জিন্দিগী! আমরা দোনোজোনে আবার নিকি কোনো গোনায় ধরোনের মনিষ্যি!
মাবুদে অই কন্যারে সায়-শান্তিহালে হেগো বাইত ফিরুন্তীর পন্থ দেহাউক! হেরে মাবুদে বিস্মরণের গজব তেনে রেহাই দেউক! মাবুদ, এই রহমটা করো তুমি! কন্যাখানের কষ্টটা দুর কইরা দেও তুমি মালিক!
কন্যারে তো অহনকার কালে এই যে, বাড়ির বাইরা-আঙিনায় নিয়াই গাঙমুখী কইরা বহানো যাইতাছে! অদিগে আমার সোমে কী আছিলো? হেই কোন পাতরের পর পাতর পার অইয়া, তয় কিনা বৈশাখ মাইস্যা চিলতা গাঙ! উস্তাদে হেইনে আমারে তামানটা দিনের লেইগা বহাইয়া দিয়া, হের নিজ কর্মে যাইতো গা!
কন্যারে তো অহনকার কালে এই যে, বাড়ির বাইরা-আঙিনায় নিয়াই গাঙমুখী কইরা বহানো যাইতাছে! অদিগে আমার সোমে কী আছিলো? হেই কোন পাতরের পর পাতর পার অইয়া, তয় কিনা বৈশাখ মাইস্যা চিলতা গাঙ! উস্তাদে হেইনে আমারে তামানটা দিনের লেইগা বহাইয়া দিয়া, হের নিজ কর্মে যাইতো গা! সাইঞ্জাকালে আমারে একলা একলাই হাইট্টা হাইট্টা ভিটিত ফিরা আইতে অইতো! ঘসটাইয়া ঘসটাইয়া হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে— আমার পন্থ য্যান ফুরায় না ফুরায় না!
তহন ভিটিত উইট্টাও সারতাম না, দেখতাম জাবুন গাছের তলের আন্ধারে, হেরা দোনোজোনে আইয়া খাড়াইয়া রইছে! উস্তাদে আর উস্তাদ মায়ে! উস্তাদ মায়ে তহন আমারে একহাতে টান দিয়া কাছে নিয়া, আগে আমার হাতে একখান খোরা ধরাইয়া দিতো!
খোরভরা আছে কুসুম কুসুম গরম ফেন! বিরুই চাইলের ভাতের ফেন! হেইটা এক ঢোক মোখে দেওনের লগে লগেই য্যান পরানটা এক্কেরে ঝুরফুরা, ফিনফিনা হইয়া যাইতো!
তহন কিন্তুক উস্তাদে একবারও কিছুই জিগাইতো না! পিছের কতা আমার স্মরণে আইছে? নাকি আহে নাই! এট্টুও আহে নাই? অমুন কুট্টি পোলাপাইনটারে একবারও জিগাইতো না যে, এই সাইঞ্জার কালে একলা একলা হাইট্টা আইতে আমার ডর করছে নিকি? কিচ্ছু না! আমার তহন অনেক বাস্না হইতো! বাস্না হইতো, অই কতাটা উস্তাদে একবার জিগাউক আমারে! নাইলে জিগাউক, কিছু আমার স্মরণে আইছে? না, আহে নাই?
এই অহনকার কালেও কইলাম আমি, কন্যারে একবারও কিছুই জিগাই না! এট্টু কিচ্ছুও জিগাই না! আদতে জিগানের কিছু নাই তো এইনে! কোনো কতা হেরে স্মরণে আইছে কিনা, হেই সম্বাদ হের মোখ তেনে তো পাওন লাগবো না! হেই কতা জানান্তী দেওনের লেইগা তো কড়িরা তিনজোনেই আছে!
ঘরের ভিতরের বায়ু কোণে; কালা পাত্থরের একখান জলপিঁড়ার উপরে, বেতের চুপড়িখানে পইড়া রইছে! হেই কোন আগেকার দিন তেনেই পইড়া রইছে! আর, চুপড়ির ভিতরে কড়িরা থির দেহে বইয়া রইছে! হেরা অমনে নিত্থির পইড়া রইছে ঠিকই! কিন্তু দরকারের সোমে হেরা অথির অইতে দেরী করবো না!
এই এত্তাটুক এত্তাটুক তিনটা কড়ি! কিন্তুক হেগিলিয়ে যে কী সাদার সাদা! হেগিলিরে দেখলে একেকবার মোনে হয় য্যান এরা কড়ি না! কড়ি না! এরা জষ্টি মাইস্যা চান্নি! ফকফক্কা সাদা চান্নি! আবার মোনে অয়, কিয়ের চান্নি? চান্নি না চান্নি না! চক্ষেরা য্যান বিয়াইন্না বেইলের লাউফুলগো দেখতাছে! কচি-মুলাম, সাদা লাউফুল!
গুপ্তি কোনো সত্য-বার্তা দেওনের খোন যুহন আহে, তহন বোলে কড়ি তিনটায় আচানক কারবার করে! হেরা তহন কীপ্রকারে জানি আপনা তেনেই চুপড়ির ঢাকনা সরাইয়া, বাইর অইয়া আহে! বাইর অইয়া একদম হেরা মাটিতে নাইম্মা আহে! হেইরবাদে কড়ি তিনখানে আগু-পিছু হইয়া নৈরীত কোণের দিকে মোখ দিয়া রাখে!
এমুনই বোলে ঘটে! হেই আমার সোমেও বোলে এইটাই হইছিলো! হেই যহন তাবৎ পূর্বকথা আমারে স্মরণে আইছিলো, তহনও অমুনই ঘটছিলো! জায়গার কড়ি জায়গায় না-থাইক্কা, মাটিত নাইম্মা আইছিলো! আর হেরা নৈরীত কোণ বরাবরি মোখ দিয়া থুইছিলো!
অখন তাইলে এই কন্যার কালেও তো তেমুনটাই ঘটবো! নাইলে আর কী? সেই কারোণেই উস্তাদের ঝিয়ে চুপড়ির দিগেই চউখ দিয়া থুইছে! কিন্তুক কড়ির লড়ালড়ির কোনো লক্ষণ দেহা যায় নাই অহনও! এতোদিনের মিদে কড়ির গুণ কড়িতেই আছে? না, হেইটা পুরা নষ্ট হইয়া গেছে গা! হেই সম্বাদ মালিক সাঁইয়ে জানে! এতো জনমের মিদে তো আর কড়িরে কোনো কর্মে লাগতে হয় নাই!
হেই যে, হেদিন! বৈশাখ মাস তহন একেবারে শেষ হয় হয়! তহনকার একদিনে, আমি তো চিলতা, ঠায়ঠান্ডা নদীখানের দিগে মোখ দিয়া বহা! আসমানে আর পাতরে পাতরে হইলদা রঙের সাইঞ্জা বেইল নামি নামি করতাছে তহন! চৌদিগে সুমুর-সুম নিঝুমি! কেউরে কোনোদিগে দেহা যায় না! কোনোদিগে একটা কোনো গরু-বাছুর-কী বকরির একটা কোনো ডাকসুদ্ধা নাই! মাতার উপরে কোনো চিল-কাউয়ারও একটা কোনো রাও নাই তহন!
অমুন সোমে অইলো কী, আতকার মিদে ঠায়ঠান্ডা সুখতী গাঙে, বিষম বিষম তরঙ্গ ওঠা ধরলো! আরে বাপ্পুইস রে! যাহা-তাহা তরঙ্গ নি! অতি আজদাহা তরঙ্গ! আরে দেহো রে, হেই তরঙ্গে কী করতাছে! আজব একটা কারবার বান্ধাইতাছে! বিরাট লম্ফ লম্ফ দিয়া তরঙ্গে করতাছে কী; অত্তাটুক পোলা পচা মিয়ারে ভিজাইয়া এক্কেরে জুবজুবা কইরা দিতাছে!
গাঙে তরঙ্গের উপরে তরঙ্গ জাগনা দিতাছে! অদিগে পচা মিয়ার চক্ষের সামোন দিয়া, কী জানি কীসব বিত্তান্ত বিবরণ ভাইস্যা-লউড়াইয়া যাইতাছে! সেয় পষ্ট কইরা এইগিলি কী দেখতাছে! দেখতাছে যে, কোন এক দূরের দূর মুল্লুকে জানি মাইনষেরা খালি কান্দতাছে! বেটা-মাতারি, পোলা বুড়া, ডাঙর গুঁড়াগাড়া— হগলতে কেমুন জানি হরদিশা হইয়া হইয়া, বেধুম কান্দন দিতাছে!
য্যান সেই মুল্লুকের ভিটিবাড়িরা কান্দতাছে! গাছের পাতা লতারা কান্দতাছে! আর য্যান, হগলতের ঘরের ভিতরের তেনে খালি গোঙানীর আওয়াজ আইতাছে! ঝুম গোঙানী! হেই গোঙানীর আবছা আওয়াজটুক কানে পাইয়াই তো পচা মিয়ার শইল্লে কাঁটা দিয়া দিয়া ওঠতাছে!
মাগ্গো মা! দেহো কেমুন ডর লাগতাছে পচা মিয়ার! য্যান অইটা গোঙানী না! য্যান অইনের মুল্লুকের লোকসগলের গলায় গলায় বড়শি বিন্ধা গেছে! কেমুন গিলটাইতাছে কেমুন গোঙাইতাছে, অইনের লোকেরা! সগল, সগল ভিটিতেই!
কী বিষয়! কী বিষয়?
অই ত্তো দেহো, হেই মুল্লুকের পন্থ দিয়া অইটা কেটায় হাইট্টা যাইতাছে! অইটা দেহো একটা মাতারি! হেই মাতারির মাথা উদলা! মাতায় হের কাপোড় নাই! আর দেহো, হেই মাথায় একটা চুলও য্যান নাই! মাতাভরা খালি চউখ! খালি চউখ!
হেই চউখেরা কেবল তিলবিল তিলবিল কইরা কইরা একেকদিগে চাইতাছে! আর অমনেই একেকদিগের মুল্লুকে মাইনষের কান্দন জাগনা দিতাছে! দিকে দিকে কেবল গোঙানী-খিলজানী জাগনা দিতাছে!
অহো অহো! পচা মিয়ায় তো অই মাতারিরে চিনে! চিনে তো! অইটা হইলো শীতলা বিবি! হেয় হাইট্টা হাইট্টা কোনদিগে যায়?কোনদিগে? করমে করমে হেয় যেই গেরামে গিয়া খাড়াইলো, হেইনে য্যান পচা মিয়ারে হাঁটতে-ফিরতে দেহা যায়! অইটাই ত্তো পচা মিয়াগো বসতভিটি!
অইটা কোন মুল্লুকে? কোনখানে? দেহো তো! হেই বিষয়খান বোজোনের কোনো উপায় নি আছে! খালি দেহা যায়, অইত্তো পচা মিয়ায় নিম বিরিক্ষির ছেমায় ছেমায় ডাংগুটি খেলতাছে! অইত্তো নিজেগো ভিটির তামানখানের গাছ ধইরা ধইরা হেয় খালি ঝইল খাইতাছে! একলা একলাই ঝইল খাইতাছে!
হেইরবাদে অইটা কী হইলো? হেইরবাদে য্যান এট্টুর মিদেই পচা মিয়ার তামানটা শইল্লে, শীতলা বিবির দয়া দেহা দিলো! একটা পাতা মাটিত ঝইরা পড়তে যতখোন লাগে, ততখোনের মিদেই দেহো কী হইয়া গেলো! গেরামের সগল বাইত, তামানগিলি ভিটিতে, দয়ার উপরে দয়া আইয়া খাড়া হইলো!
ওহো রে! ওহো রে! অইনে অহন দেহো দেহো, কে কারে দেইক্ষা রাখে! আর তহন কে কারে যতন করে! কেউর দিগে ফিরা চাওনের একটা কেউ য্যান নাই! যারা শীতলা বিবির দয়ার তেনে রেহাই পাইছে, হেরা লোটা-ঘটি সব ফালাইয়া গেরাম ছাইড়া ছাইড়া যাইতাছে গা! তরাসে কাঁপানী দিতে দিতে হেরা পলাইতাছে! যেই দিগে চউখ যায়, হেইদিগে পলান্তী দিতাছে!
লোকের ঘরের মিদে, অই ত্তো দেহো কী দেহা যাইতাছে! ওহো রে! শীতলা বিবি দয়া পাওয়া মনিষ্যিগিলি কেবল কাতরাইতাছে! আর খালি, পানি পানি কইরা ফোঁপাইতাছে! তাগো মোখে এট্টু পানি দেয়, এমুন একটা কোনোজোন কোনোদিগে নাই!
যারা ভালা আছিলো, হেরা না কোনসোম পলাইয়া গেছে গা!
এমুন দিনে, অইটা দেহো তো; কী জানি একটা বেপার হইতে দেখা যাইতাছে!
ছুমঝুম মউতাপুরীর পন্থ দিয়া আরেকটা মাতারিরে য্যান চলতে দেহা যাইতাছে! হেরে ধুইক্কা ধুইক্কা হাঁটতে দেহা যাইতাছে!
নিজেগো বাড়ির গাছ-গরানের ছেমা দিয়া দিয়া অই ত্তো আগ্গাইলো সেয়! হেইরপরে আর ছেমা নাই! মাতার উপরে খোলখোবা, গবগবা রইদ! আর হের পাওয়ের নিচে ফাটা-চৌচির পাতর! পাতরের তপ্ত মাটিত পাও রাখোনের কোনো জো-ভাও নাই! তাও মাতারিয়ে হাঁটোন রদ করে না!
জোরতে হাঁটোনের চেষ্টাটা আছে হের, কিন্তু হেইটা করোনের তেমুন একটা উপায় তার নাই! কেমনে সেয় জোরতে হাঁটে! হের কোলে আছে হের অসুইক্ষা পোলাটায়! পোলার সর্ব অঙ্গে শীতলা মাওয়ের দয়া এক্কেরে, ফুইট্টা বাইর অইছে! একটা সুইচ রাখে, এমুন একটা ফাঁকা জায়গা নাই হেই অঙ্গে! খালি আছে গুঁটি! বসন্তের গুঁটি!
বিষ-ব্যাদনা-টনটনানীয়ে পোলাটার এট্টুও হুঁশ নাই! হেই জরাবরা দেহখানরে লইয়া হের মাওয়ে, এই গড়গড়া রইদ মাতায় নিয়া, কই যায়? ক্যান যায়? এইটা কেমুন গজইব্বা, বেহুইশ্যা কারবার! কই যাইবো মাতারিয়ে?
যাইবো আট্টু তফাতের এক গেরামে! গাঙপাড়ের হেই গেরামে, হের বাপের বাড়ি! বাপের গেরামে মাও বাপে বাইচ্চা নাই! হেইনে একজোন কবিরাজ আছে! আন্ধা হেই কবিরাজে, তুরুত নিদান দেওনের বিদ্যা জানে! হেই কবিরাজরে দিয়া, একবার শেষ চেষ্টা করাইবো এই মায়ে! পোলার শইল্লের বিষ-যাতনা এট্টু কমান্তী দেওন যায়! যুদি এট্টু কোনোপ্রকারে এই মরমরটারে বাঁচান্তী দেওন যায়!
নিজেগো গেরামের কোনো একটা ঘরেও তো আর একটা কোনো জ্যাতা মনিষ্যি নাই! তাইলে হেইনে কার ভরসায় এই পোলারে লইয়া থাকবো, এই একলা ছেড়ীয়ে! পোলার বাপে কয়দিন আগেই গত হইছে! বাদবাকি আছিলো এই পোলার বাপের মা দাদী, আর বাপের ভাইগুলানে! হেরা সগলতে কোন এক ফাঁকে জানি, এই মা-পুতেরে ফালাইয়া থুইয়া ভিটি ছাড়ছে!
তাইলে অখন এই মায়ে, কোন ভরসায় হেই আন্ধার পুরে থাকে! পুতের যুদি হায়াত না-থাকে, হেইটা পরে বিচার করবো নে এই মাওয়ে! অখন আগে মাওয়ে দেখবো, সেয় তার পুতের মোখে এক ঝিনাই কবিরাজি-বনাজী দাওয়াই দিতে পারে কি না!
তাইলে অখন এই মায়ে, কোন ভরসায় হেই আন্ধার পুরে থাকে! পুতের যুদি হায়াত না-থাকে, হেইটা পরে বিচার করবো নে এই মাওয়ে! অখন আগে মাওয়ে দেখবো, সেয় তার পুতের মোখে এক ঝিনাই কবিরাজি-বনাজী দাওয়াই দিতে পারে কি না! হেই দাওয়াই পাইলে তার পুতে কী চউখ না মেইল্লা থাকবো? তহন মাবুদে এট্টু রহম না-কইরা পারবো?
ধুঁকতে ধুঁকতে এক সোমে হেই মায়ে, অইত্তো দেহো, হের বাপেগো গাওয়ের মোখে গিয়া খাড়ায়! হায় হায়! হেইনে য্যান মাইনষে আর মানুষ নাই! সড়কি, বল্লম, ট্যাটা হাতে নিয়া নিয়া য্যান হেরা একক জোনে পিয়াদা রাক্ষোস দজ্জাল হইয়া গেছে গা!
ইয়া দয়াল! এমুন ক্যান? এমুন ক্যান?
হেই গেরামঅলারা অহন নিজেগো গেরামেরে পাহারা দিতাছে! দিগে দিগে সকল গেরামেই শীতলা বিবিয়ে, নাইলে হের বইন ওলা বিবিয়ে আইয়া আসন নিছেই! কোনোদিগের কোনো গেরামই আর, হেগো দোনো বইনের দয়ার তেনে নিস্তার পায় নাই!
খালি কেমনে জানি এই ছোটো গাওখানেই রেহাই পাইয়া গেছে! তাইলে এই গেরামেরে অখন, রক্ষা দেওনের কী উপায়? উপায় একটাই! ভিন কোনো গেরামের, একটা কোনোজোনেরেও, এইনে পাও দিতে দেওন যাইবো না! কেউই য্যান কোনোদিগ দিয়া এই গেরামে পাও দিতে না পারে! খবরদার! তাইলেই খালি নিজেগো বাঁচোনের উপায় আছে! নাইলে নাই!
তাইলে এই মাতারির কোলে এইটা কী?
হায় হায়! দেখছো নি সব্বনাশ! গুটি বসন্তে মর-মরুইন্না পোলারে নি লইয়া আইছে হেয়? করছে কী করছে কী! খেদা! খেদা এইটারে!
আরে সব্বনাশরে!
এই মাতারিয়ে যে মাইনষেরই ঝি, হেইটার পরমান কী? শীতলা বিবিয়েই যে এমুন মাইনষের-ঝিয়ের ছুরুত ভাও ধইরা আইয়া হাজির হয় নাই, সেইটা কওন যায়? না না!
দয়াল, রহম করো! রহম করো!
অক্ষণ এই ভাও ধরুনীরে খেদান্তী দেও রে! তগনগদ খেদাও এইটারে! জলদি জলদি! যা যা! আলাই-বালাই! মুইড়া পিছা খাইয়া দুর অইয়া যা!
গেরামের মোখে অই মাতারিরে লইয়া যহন এমন তেমন চলতাছে, হেই সোমে গেরামের ভিতর তেনে তুফানের ছোলার লাহান একখান সম্বাদ আইয়া ঝাপোট মারে! কঠিন ঝাপোট!
কী চাও? না! গেরামের এক ভিটিতে একজোনের ভেদ-দাস্ত আরাম্ভ হইছে!
কী কয়! কী কয় এইটা! আতকার উপরে অক্ষণেই এমুনটা, কেমনে অয়? কেমনে?
কেমনে আবার? এই যে এই শনিয়ে, হেইটা লইয়া আইছে! এই মাতারিয়ে তো আদতেই তাইলে মনিষ্যি না! হায় হায়! মনিষ্যি না তো এইটায়! এইটা তো মনিষ্যির ভেক ধইরা ওলা বিবিয়ে আইয়া খাড়া দিছে! হায় হায়! জলদি লৌড়ানী দে এই ডাকিনীরে! অক্ষণ খেদা! অক্ষণ খেদানী দে! দুর দুর! দুর অ আপদ, দুর অ!
গেরামের ড্যাকড়া পোলাগিলি, ট্যাঁটা উচান্তী দিয়া, অই ডাকিনীরে ধাওয়া দেওয়া শুরু করে!
মাবুদ গো! মাবুদ! এই মাওয়ে নিজে মরলে, মরবো! কিন্তুক হের পোলাটার দেহে যে, অহনও জানখানে জাগনা দিয়া আছে! অহনও যে আশা আছে! নিজের পোলাটারে বাঁছানের আরেকটা চেষ্টা নিবো না অভাইগ্যা মায়ে! নিবো তো! যতখোন মাওয়ের শইল্লে মাওয়ের পরানটা আছে, ততখোন মাওয়ে চেষ্টা দিয়া যাইবোই!
মাওয়ে তহন পোলারে শক্ত কইরা জাবড়ানী দিয়া লইয়া গাঙের দিকে লৌড় দেয়! অইনে গেলে কী হইবো, হেয় জানে না! তাও হেয় হেদিগেই লৌড় দেয়! হেরে অমনে লৌড় দিতে দেইক্ষাই, গেরামের হগলতের ধন্দ ঘুইচ্চা যায়! এইটা যে ওলা বিবিয়েই আইয়া দেহা দিছে, হেইটা নিয়া আর কেউইর ভান্তি থাকে না!
লৌড়ান্তী দিতে থাকা অই বালাইরে, এমনে এমনেই পলান্তী দিতে দেওন যায় নিকি! এক্কেরে না! বালাই বিবিরে ধাওয়া করতে থাকা জুয়ান পোলাগো কে একজোনে তহন করে কী, কোরেধে ঘিন্নায় হেয় হের ট্যাঁটাখান ফিক্কা মারে! ডাকিনীরে মাইরা নিজ গেরামেরে বাঁচান্তী দেওনের কর্ম তো যাহাতাহা ছোয়াবের কর্ম না! হেইটা সেয় না-করে কীপ্রকারে!
আলা তহন, আতকার উপরে পিঠে ট্যাঁটা বিন্ধোনের কারোণেই হউক; নাইলে পাও ফসকাইয়া যাওনের কারোণেই হউক, উঁছা খাড়া পাড় তেনে, হেই মাওয়ে ঝটকা দিয়া গাঙের মিদে পইড়া যায়! অই ত্তো! পচা মিয়ায় হেরে পউড়া যাইতে দেখতাছে! অই ত্তো!
কিন্তুক, হেইটা কোন গেরাম? কোনহানে আছে হেই মুল্লুক? কাগো বাড়ির কে আছিলো হেয়? অই মাওয়ে? কেটায় হেয়? কেটায়? কার কোলের ভিতরে অমুন ওমে আছিলো পচা মিয়ায়? কার কোলের ভিতরে? পচা মিয়ায় হেইসবের কোনো সন্ধান জানে না!
দরদরাইন্না পানিতে আন্ধা দুই চউখ নিয়া পচা মিয়ায় হেদিন উস্তাদের ভিটিতে ফিরতি আওনের পন্থ আর বিছরাইয়া পায় না! এইনে উষ্টা খায়, হেইনে গোত্তা খায়! তারবাদে একসোম দেহে, কেমনে জানি উস্তাদে আইয়া অরে কোলে জাবড়াইয়া লইতাছে!
হেই একদিন, চুপড়ির কড়ি তিনটায় মাটিতে নাইম্মা, নৈরীত কোণা বরাবরি থির হইয়া আছিলো!
• ঘরের কোণে বাত্তি জ্বলে তিনসন্ধ্যার বেলা!
আউজকা কিছুর মিদে কিছু না, অই ত্তো দেহো কড়ি তিনখানে মাটিত নাইম্মা, কেমুন নৈরীত কোন বরাবরি থির পইড়া রইছে! তাইলে তো হেই কন্যায় হের সগল বিস্মরণ তেনে নিষ্কিতি পাইছে! মাওলা! অহন তাইলে হেরে আমাগো বিদায় দেওন লাগবো? আহ্! কেমনে পরানে পাষাণ বান্ধমু আমরা দোনোজোনে! পাষাণ ফাইট্টা যে দরদের নহর উথলাইয়া আইতাছে! হেরে যে কইলজার ভিতরে জাবড়ানী দিয়া থুইতে বাস্না হইতাছে রে দয়াল!
গুষ্টির একটা বাত্তিরে অঞ্চলের ভিতরে নেওনের শখ আছিলো উস্তাদ-মায়ের! বহুত শখ! কোনোদিন হেয় হেই কতাটা মোখে আইন্না, বেক্ত করে নাই! কিন্তুক ভাবে-ঠারে কী আর হেইটা অপ্রকাশ থাকছে! থাকে নাই! কী একটা নামও য্যান হের মোখের আগায় লড়তো-ফিরতো! কী নামটা জানি?
‘কি গো উস্তাদের-ঝি! আপনের তো মোনে থাকোনের কতা হেইটা?’ আমি আমার পরিবাররে জিগাই।
‘আর নাম! নাম দিয়া কী হইবো! হুদাহুদি জ্বালা বাড়ান্তী!’ সেয় গলা ঝাঝাইয়া জব দিতে চায়! কিন্তু হেই গলার কান্দনে জমিন ভিজতে থাকে! থাউক থাউক! আর কিছু আমাগো মোনে আওন লাগবো না! আমরা টুণ্ডা-লুলা দুইজোনে যেমুন ধুকন্তী আছিলাম, তেমুন ধুকন্তী থাকমু তো? হেইটাই সই!
অখন, কন্যায় খালি হের সাকিন-কুষ্টির কথা আমাগো কইয়া দেউক! আমরা যেমনে পারি বাপ-মাওয়ের কইলজার ধনেরে, হেগো কোলে দিয়া আমু!
• আচ্ছা! এটা কী! এটা কী!
আমি না-হয় জগত-সংসারের ক্রুয়েল্টি দেখে দেখে কেঁদে ভাসাচ্ছি; কিন্তু অই দুজনের প্রবলেমটা কী? এমন ঘোর সন্ধ্যার সময়ে, তারা কেনো ভেতরের-উঠানে, এইভাবে ছেতরে পড়ে আছে! আবার দেখো কাঁদছেও! হোয়াটস রং উইথ দেম? কী হয়েছে! কী? ভাবছে কী তারা? আমি সবকিছু রিকল করে উঠতে পেরেছি? এমনটাই ভাবছে তো? উউফ! নো ওয়ে রে বাবা!
কিচ্ছু মনে আসেনি আমার! কী আমার নাম, আমার মনে আসেনি! কোথায় ছিলাম আমি, সেটাও তো আসেনি! শুধু অন্য কিছু বিষয়, উড়ে উড়ে এসেছে! আমার দিকে এসেছে! সেসব কী আমারই কথা? না, সুখতী গাঙ আমাকে কিছু গল্প শোনালো? কী জানি!
আর প্লেসের অ্যাড্রেস আমার মনে এলেই বা কী! আমি বুঝি ওইখানে, আবার আমাকে নিয়ে যাবো? কোনোদিন বুঝি আর? হা হা! নেভার! নো! নো ওয়ে!
আর প্লেসের অ্যাড্রেস আমার মনে এলেই বা কী! আমি বুঝি ওইখানে, আবার আমাকে নিয়ে যাবো? কোনোদিন বুঝি আর? হা হা! নেভার! নো! নো ওয়ে!
ওয়েল! আমি এখানে না-থাকলে, এই চঙ্গটাকে কে সরাবে? কে আনবে? পচা মিয়া আর কতো? এখন থেকে আমি! বরাবরের জন্য আমিই!
আরো যা-সব কিছু আছে, আমি তার সবটা শিখে নেবো! অই কথা বলার রকমটাকে শিখে নেবো! কাপড় পরে ওঠাটাকে! রান্ধনঘরের দুয়ারমুখী এক কোণে, ধানী লঙ্কার চারাদের ফলিয়ে তোলার জাদুটাকে তো নিশ্চয়ই! এই এখন থেকেই! একটু একটু করে করে, একদম শিখে নেবো!
এইখানে রয়ে যাবো আমি! কোষা নাওখানা বেয়ে বেয়ে, রোজ ভোরের কালে, খড়াজালটাকে তুলতে নামাতে চলে যাবো! বাঁশের ঘেরের ওপরে দাঁড়ায়ে থেকে থেকে, জলের মধ্যে জলের মিশে যাওয়াকে দেখবো! বাকিটা আয়ুষ্কাল, শুধু ওইই! শুধু ওইই করে যেতে চাই আমি!
তবে সবকিছুর আগে একটা জিনিস শুধু আমাকে পরিষ্কার করে জেনে নিতে হবে! শুধু একটা বিষয়— জেনে নেয়া আমার চাইই!
ভরা সন্ধ্যার উঠানে তখন, আমিও গিয়ে তাদের দুজনের পাশে বসে পড়ি! ‘হায় হায়! দেখছো নি! এমুন তিনসন্ধ্যা কালে নি কোনোজোনে এমুন মাটিত আইয়া বহে! এমুন করে না এমুন করে না! আর তো কোনো একটা বস্ত্র নাই গো ঝি! আপনের কাপোড়খান না ময়লা হইয়া যাইতাছে!’ বুচি বিবি মাতম তুলে দেয়!
তুলুক! একটা কেউ যেনো এমন মাতম তোলার জন্য পাশে থাকে! বরাবর থাকে! আমার মন এই কথা বলতে থাকে তো, কিন্তু মুখ শোনায় অন্য কথা!
‘কিন্তুক আমার অহন বহুত ভোক লাগছে! পুরা দিন কিছু খাইছি? কন? তাইলে কহন খাইতে দিবেন আউজকা? রানছেন কিছু?’ আমি বুচি বিবিকে বলি! ওমা! আমার কথা শুনে এইবার তার আরো কতো যে কান্না! এতো যে কেনো কাঁদে এই মানুষটা! আচ্ছা হয়েছে! এবার চুপ! একদম চুপ!
আমি তাকে জাবড়ে ধরে দাঁড় করাই! তারপর জাবড়ে ধরেই, নিয়ে যাই ঘরের ভেতরে! অনেক হয়েছে তার, লাঠি ধরে ধরে হাঁটা! এবার একটুখানি আমাকে জাবড়ে ধরেও হাঁটুক তো!
বুচি বিবি আপাতত থাকুক আমার জন্য সালুন আর ভাত বাড়ার কাজে! একটু পরে আমিও গিয়ে তার সাথে হাত লাগাবো! তার আগে, এখন, সন্ধ্যার এই সাদাটে অন্ধকারে আমি পচা মিয়ার সামনা-সামনি একটু শুধু দাঁড়াই! ছোট্ট একটা তথ্য এখন আমাকে জেনে নিতে হবে! ওটা না-জানলেও কোনো সমস্যা নেই! তাও ওটা জানার জন্য, আমার অল্প একটু ইচ্ছা হচ্ছে!
‘আপনে কইতে পারেন, এইটা কতো সাল? সালের হিসাব-কিতাব আপনের আর মোনে আছে কিছু?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করি!
‘কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ খেয়ালে আছে গো মা!’
‘আমারে তাইলে কন তো, এইটা অহন কতো সাল?’ সালটা জানার জন্য আমার এমন উতলা লাগে কেনো? খামোখা খামোখা!
‘হিজরি সনের কতা পেচাইয়া গেছে গা! সঠিক কইতে পারি না! তয়, বাংলা সনেরে বিস্মরণ হই নাইক্কা মা!’
বাংলা সন?
হ্যাঁ হ্যাঁ! মনে আছে তো আমার! আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে বাংলা সন তো ছিলোই! খুব একটা কাজে লাগতো না, কিন্তু ছিলো তো! আচ্ছা, তবে সেটার কথাই শুনি!
‘কন! হেইটাই কন তো বাবা!’ আমি তাকে বলি!
‘এইটা অখন মা, হইলো গিয়া এগারো শতক আষ্টনব্বই সন যাইতাছে! ১১৯৮ বাংলা সন যায়!’
১১৯৮ বাংলা সন? ১১৯৮! কী বলে এটা? না না! সেটা কী করে হবে!
আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে তো তখন ছিলো বাংলা চৌদ্দ শো সালের কতো যেনো! হ্যাঁ তো! চৌদ্দ শো সাতাশ, বা অমন একটা কিছু ছিলো সেখানে! সত্যিই অমন কিছু একটা ছিলো! না না! আমি একদম ভুল করছি না!
জায়গার নাম বা আমার নামটা— আমার মনে আসেনি ঠিকই, কিন্তু খুচড়া-খাচড়া এই বিষয়গুলো তো মনে আসছেই! ওটা তো চৌদ্দ শো সাতাশই যেনো ছিলো! আমি নিশ্চিত নিশ্চিত নিশ্চিত!
তাহলে ১১৯৮-এ তবে কেমন করে আমি? কীভাবে? কীভাবে কী?
আমি কে তবে? কে!
আমি কী তবে মৃত? মৃত নাকি আমি?
নাকি আমি আগে আদতে কোথাও ছিলাম না!
• ‘নিত্য যে নদী বহে’ ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
• ‘নিত্য যে নদী বহে’ ২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
• ‘নিত্য যে নদী বহে’ ৩য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।
আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!