বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

নির্বাচিত দশ কবিতা : অমিতরূপ চক্রবর্তী

0

আর্তি


তোমাকে দেখলে মনে হয়, কোনোদিন তোমার শরীরে নীরব দীর্ঘাঙ্গ এক পুরুষ হেঁটে এসেছিল। তোমার যে এখন রহস্য ফুরোনো স্তন, বিভিন্ন উত্তাপে পুড়ে গুটিয়ে যাওয়া মাথার চুল অথবা সম্মুখে এই যে সময়োচিত আবরণ, এর আড়ালে রয়ে গ্যাছে নীরব দীর্ঘাঙ্গ কোনো পুরুষের মন্থর পায়ে হেঁটে আসার দাগ। আজ যে তুমি ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে তোমার আত্মার সঙ্গে খুনসুটি করো, স্নেহভরা চুম্বন দাও— সেই দীর্ঘাঙ্গ পুরুষের সামনে শিহরিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকোনি? সে তোমাকে নিজের ধোঁয়ার মধ্যে, নিজের গন্ধের মধ্যে উন্মুক্ত করেছিল। তার লৌহনির্মিত দুই হাত রাখা ছিল তোমার কাঁধে। আরও অজ্ঞাতে সে তার নিজের প্রস্ফুটিত অন্ধকার দিয়ে তোমার অন্ধকার স্পর্শ করেছিল। এখন তোমার রহস্য ফুরোনো স্তনে কখনো দিনান্তের বীতকাম রোদ পড়ে। তার ছায়া কিছুটা প্রলম্বিত হয়ে লেগে থাকে হয়তো দেওয়ালে অথবা হয়তো বালিশে বা হয়তো টান পড়া চাদরের কোনো ভাঁজে। তখন কেমন আশ্চর্য লাগে! আমার চোখের এ প্রান্তে এসে একবার নিজেকে তাকিয়ে দ্যাখো, দ্যাখো কেমন অতীতের পেতলের মূর্তি তুমি! তোমার রহস্য ফুরোনো স্তন, যারা এখন শুধুমাত্র জোয়ারের জল এসে এসে ভারী, তোমার গলার শিরা— যাদের শেকড় এখন কেবলই ধাতুদ্রব্য পাথর আর মাটিতে নামানো। আজ এই যে তুমি ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে নিজেরই আত্মার সঙ্গে খুনসুটি করো, স্নেহভরা চুম্বন নিয়ে তার পিছু পিছু ছোটো— মনে হয় এ যেন ভয়ংকর ঝড়ের পরে ইতিউতি চলকে ওঠা পাখিদের ডাক?

আমি কখনো সময়োচিত আবরণ সরিয়ে তোমার স্তনের কাছে যাই। দেখি সেখানে উঁচু ছাদের গির্জার মতো কী গুমোট পবিত্রতা! তোমার সুগোল কাঁধে খাপছাড়া কয়েকটি নিষ্পত্র গাছ। ভাবি দীর্ঘাঙ্গ পুরুষটির ঘামে রোমে তুমি কখনো নোনতা হয়ে গিয়েছিলে। তার ছটফটে বীর্য যাত্রা করেছিল। এ যেন বনান্তরালে যে আরেকটি বন থাকে তার মতো অথবা দৈত্যাকার চেহারার আড়ালে যে ভীরু, সলজ্জ একটি মানুষ লুকিয়ে থাকে— তার মতো বা যে শাসক শুধু অস্ত্র সাজিয়ে পেছনে নিজের দৈন্য রক্ষা করে তার মতো। আহা, দিনান্তের এই শেষ সুরেলা রোদটি এখন কেমন তোমার গালে, বাহুমূলে উড়ে এসে বসেছে! পৃথিবীর হিসেব থেকে একটি দিন চিরকালের মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে, ভাবো তো? আমার যে দৃষ্টি এই এখন তোমার দিকে স্থির, সেও তো খরচ হয়ে যাচ্ছে! এভাবেই তো কোনোদিন নীরব দীর্ঘাঙ্গ পুরুষটি তোমার দিকে উন্নত সূর্যকরোজ্জ্বল বীর্য নিয়ে হেঁটে এসেছিল! এখন শুধু সেই কবেকার ছন্দোময় পদচ্ছাপ ছাড়া আর কিছু আছে? ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে তুমি তোমার আত্মার সঙ্গে খুনসুটি করো, গায়ে গা ঠেকিয়ে তাকে আদর দাও, এই দৃশ্য রঙিন বিজ্ঞাপনের মতো ধান খেত, আলি জমি বা মুখে রং-মাখা শহর পেরিয়ে আরও আরও কোথাও উড়ে যায়। কিন্তু আমার চোখের এ প্রান্তে এসে একবার নিজেকে তাকিয়ে দ্যাখো, দ্যাখো কেমন অতীতের পেতলের মূর্তি তুমি! ছাগশিশুর মতো মাথা তুলে নিজেরই আত্মার সঙ্গে এমন খুনসুটি কেমন জরিসলমাহীন! ভেতরের সব ফোঁড়, সব সেলাই কেমন কাতর আর্তির মতো জ্বলজ্বল করছে!


অনুচর


কী অকল্পনীয় সুন্দর তোমার বাড়ি! এখনো কাছাকাছি হাওয়ার মধ্যে নতুন রঙের গন্ধ, লোহার কারুকাজ তৈরির গন্ধ, চুন-বালির গন্ধ। ভেতরে অদৃশ্য হবার কী ছোট ছোট ঘর! ধরো, আমি যদি কোনোদিন ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো তোমাকে তাড়া করে ছুটে আসি, হঠাৎ তুমি কোথায় অদৃশ্য হলে খুঁজেই পাব না। আমার সামনে পড়ে থাকবে কেবল একটি থমথমে সুদৃশ্য আলোবাতাসরহিত বারান্দা। ওপরে যাবার সিঁড়ির থামে কয়েকটি অপলক ফুলের টব। তাতে অদ্ভুত সাদা ধোঁয়ার মতো ফুল ধরেছে। থাকবে অসংখ্য সামুদ্রিক পাথর আর মায়াবী দৈত্যের মতো নিশ্চুপ সব দেওয়াল ছাদের নিঃশ্বাস। আমার ভেতর থেকে তখন মুহূর্তে ক্ষুধার্ত নেকড়েটি হারিয়ে যাবে এবং সহসাই, সহসাই যেন জলে ভেজা অতি বিপন্ন একটি মানুষ হয়ে যাব আমি। যার তখন নিজের সংসারের কথা মনে পড়ছে। ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়ছে। চিরবঞ্চিত স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে। সীমানার দেওয়ালে আগ বাড়িয়ে ঝুলে থাকা সন্ধ্যামালতির কথা মনে পড়ছে। ফর্সা শৌচাগারের ঘুলঘুলি দিয়ে যে বাইরের অবাধ আকাশ দেখা যায়— তার কথা মনে পড়ছে। শ্মশানের কথা মনে পড়ছে। আগুনকে জ্বলতে দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসা বন্ধুদের সম্ভাব্য কথাবার্তা, টিটকিরি মনে পড়ছে। এসব উপেক্ষা করে নিবিষ্টমনে বয়ে চলা জলের কুলকুল মনে পড়ছে

মরে যাবার আগে কুটো-তৃণ আঁকড়ে ধরার মতো আমি নিকটেই যে ঘরটি, তার অন্দরে উঁকি দেব। জলে ভেজা বিপন্ন শালিখ শালিখ চেহারার মানুষেরা যেভাবে উঁকি দেবে, অবিকল সেভাবে। দেখব একটি নিরীহ বিছানা। মাথার কাছে অপ্রশস্ত একটি টেবিলে কয়েকখণ্ড বই। হয়তো-বা বহুদিনের বাসি একটি কাচের গ্লাস। ঘর-লাগোয়া বাথরুমের দরজায় আনন্দিত ডলফিন। চট করে মনে হবে আমার, উন্মাদ বা বিকৃত মানুষের মতো মনে হবে আনন্দিত ডলফিনের পেছনে তুমি বসে পেচ্ছাপ কর। এই বিছানায় তোমার ঊরুসন্ধি ফুঁড়ে ফেলা হয়। এই চাদরে হয়তো স্বাস্থ্যবান বীর্য বা তোমার পরাজিত ঝোলের দাগ কোনোদিনের আবছা বা প্রস্তরীভূত হয়ে আছে। ওই দেয়ালঘড়ি তোমার নগ্ন স্তনকে ফুটো হয়ে চুপসে যেতে দেখেছে। মাথার এই অপ্রশস্ত টেবিলও হয়তো কখনো কোনো ভয়ংকর আঘাতে থরথরিয়ে কেঁপে উঠেছে। এই যে ফুল— আঁকা সুদৃশ্য মেঝে, তাতে হয়তো উড়ে, ছিটকে এসে পড়েছিল তোমার গোঁয়ার প্যান্টি। ভোরের সূচনায় যতক্ষণ না শিষ দিয়ে ডেকে উঠছে কোনো পাখি, ততক্ষণ সেটা ওখানেই ছিল। উৎপাটিত, কুঁকড়ে-মুকড়ে যাওয়া। আমার তখন ফের একবার নিজের সংসারের কথা মনে পড়বে। ছেলেমেয়েদের জটিল, দুরূহ মুখ মনে পড়বে। কালো দোহারা চেহারার চিরবঞ্চিত স্ত্রীর কথা মনে পড়বে


আলোর হলুদকে ঘিরে ঘিরে


আমাদের আঙুলগুলি মুখোমুখি বসে থাকবে, অথচ কেউ কাউকে আত্মসাৎ করতে এগিয়ে আসবে না। আলোর হলুদকে ঘিরে ঘিরে, ব্যতিব্যস্ত করে উড়ন্ত পোকাদের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, এই গলদঘর্ম এই লোহার আঁকশি দিয়ে টানা জীবনের এখানেই তো শেষ। আমি সাদা-কালো সময়ের মতো কেউ হলে এ-সময় টরেটক্কা বাজিয়ে উঠে বাইরে যেতাম। আমি জানি যদিও বাইরে রাস্তা নেই, আলসেয় রাখা কয়েকটি বাহারি ফুল অবধিই আমার সীমানা। তবুও যেতাম। যেন তোমাকে বোঝাতে চাইতাম দ্যাখো, আমি কী অভেদ্য, গ্রহ-নক্ষত্রের থেকেও লম্বা দোহারা এক মানুষ। তোমার আয়ত নিশ্চল চোখে আমার যে বিম্ব গঠিত হত, তাকে দেখে মনে হত যেন কোমরে তলোয়ার ঝোলানো কালপুরুষ। তোমার পলক তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে এসে নিজের শীর্ষের ওপরে থিতু হবে। তুমি জানবে কোথাও আর কিছু করার নেই আমাদের। আমিও জানব রক্ত-মাংসের তো এমনই পরিশেষ। এইটুকু বাদে আর যা সব, সব উপছে ওঠা সোনালি রঙের। বহুদূরের প্রশান্ত, অতি প্রশান্ত হাওয়া। দূর জলে তে—চোখা কয়েকটি নৌকো আর তার আলো। ওই আলোর ওপারে কারা? দেহে-মনে সুখী না দুঃখিত— আমরা জানি না। তোমার গর্ভ-আসা চোখদুটি নিজের শীর্ষে থিতু। আমি তেমনই এক প্রজ্ঞাবান, যাকে স্পর্শ করে, ছুঁয়ে যেতে যেতে বিচলিত হাওয়া মাথায়— বাহুতে থু থু দিচ্ছে

কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলে আমি মচ শব্দ করে ফিরে হয়তো আবার তোমার মুখোমুখিই বসতাম। এমনই তো সাধারন রীতি। আবার আমার আঙুলগুলি সাজিয়ে রাখতাম তোমার স্থির আঙুলগুলির কাছাকাছি। নিজেকে অলক্ষ্যে নাড়িয়ে স্বচ্ছন্দ করে নিতাম এই অ্যাতোক্ষণ বিষ পিঁপড়ের মতো আমাকে কামড়ে ধরে থাকা অন্তর্বাস। নতুনতর তো কোনো কথাই নেই, শুধু ছিন্নভিন্ন, অসম আকৃতির কিছু শব্দ, বাক্যের অংশত ছাড়া। তবে সেও হয়তো সে মুহূর্তে দুর্লভ। তাই আবার তোমার দিকে গাঢ় চোখেই তাকাতাম। তোমার চুলের স্রোতে কয়েকটি রূপোলি স্রোত। তোমার কপালের রেখায় চকচকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তোমার চিবুকের কাছে সদ্য অঙ্কুরিত একটি গোল তাঁবুর মতো গোটা। আমার হয়তো-বা একটু কৌতুকও হতো। হয়তো-বা একটি অশালীন ঠাট্টার কথা বা লোকে যেমন বলে তেমন একটি অসভ্য স্মৃতির কথা তোমায় মনে করিয়ে একটু কটু আনন্দ পেতাম। হয় না? যাত্রাশেষের দিকে এসে প্রমত্ত জাহাজগুলি ঠোকা খেয়ে কেঁপে ওঠে না? ফুরিয়ে যাবার আগে বহু লিখিত প্রদীপ? ধরো, তেমন, তেমনই। আমি মচ করে ঘুরে দাঁড়াব এবং কয়েক পা হেঁটে এসে ঘটিয়ে ফেলব অ্যাতোক্ষণ যা বললাম সেসব। তোমার জলগর্ভ চোখদুটি অলীক কোনো শিখায় লেগে জ্বলজ্বল করবে, আমি বয়স্ক কামুকের মতো একটি পায়ে ক্রমাগত তোমাকে খুঁজে পেতে চাইব


স্বজন


কেমন যেন একটা গুমোট আজ আমাদের ঘিরে। চোখ না ঘুরিয়েই আমরা বুঝতে পারি কে কোথায় কতদূরে গাঢ় নৈঃশব্দ্য হয়ে আছি। এই ক্রমশ আবছা হতে থাকা দিনটির বাতাসে সেই নৈঃশব্দ্যের পাতাগুলি কেমন অমলিনভাবে দুলছে। কোনো কোনো দিন যেন এমনই হয়। মনে হয় গোটা শরীর যেন চক্ষুষ্মান। কত জোনাকির সমারোহ যেন শরীরে কীভাবে উড়ে এসেছে। এমন সময় খুব আকাশে তাকাতে ইচ্ছে করে। মনে হয় আহ্, কোনো দৈবনির্দেশে এই ছাদ বা চালের টোপর যদি দৃষ্টিপথ থেকে সরে যেত! জ্বলজ্বল করে উঠত শুধু নক্ষত্রের মালা পরা রাতের নগ্ন আকাশ! কোথাও দেখা যেত বালি খাদানে নামা লরির আলোর মতো প্রভা। সেটাই হয়তো জীবনের চিহ্ন। যে জীবনে অনেক, কাতারে কাতারে মানুষ। তাদের ঘরবাড়ির গন্ধ। পায়ু জরায়ু জঠর সব চিৎকার করছে। নখ গাল পিঠের জড়ুল সব চিৎকার করছে। ছিপছিপে ফুলের গাছ, পথবাতি বা ঘাসের হলুদ চিৎকার করছে। দু-একটা পলকা অপরাধ তো আজ আমার হাতে হয়েইছে। তোমার হাতেও কি হয় না? কারও আঠা আঠা কান্তিময় চুল কি মনে পড়ে না? কচি ধানের শীষ-আসা দুই বাহুর কথা? আমি জানি পড়ে। টিভিতে যে ভয়াবহ বিজ্ঞাপন হয় বা কণ্ঠার নীচে কোথাও যে বহুদূর অবধি নুড়িপাথর, পাড়ে উঠে গাছের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া যে-রাস্তা চিকচিক করে— তারই কারণে। তবে কী জানো, এমন পার্থিবে নৈঃশব্দ্যেরও একটা আয়ু আছে। ধোয়া-ওঠা চায়ের মতো সেও চুমুকে চুমুকে ফুরিয়ে যায়

আহ্, কোনো দৈবনির্দেশে এই ছাদ বা চালের টোপর যদি সরে যেত! আকাশে তারার পেছনে আমাদের কত প্রিয়জন থাকে! তাদের সঙ্গে যদি একবার সংযোগ হয়! আহা, কত কী দেখানোর আছে ওদের! এই একটু লম্বা গলার সাদা হাঁসের মতো বাড়িটি, এই যে একটা চকমকে বাড়ির গা ঘেঁষে আসা বিদ্যুতের তার, এই যে আজ্ঞাবহ জলের প্রতীক্ষা— এইসব, এইসব। এই যে তুমি আর একটু পরেই নৈঃশব্দ্য ফেলে উঠে যাবে, ভুউউস করে জ্বলে উঠবে নীলাভ শিখায় ওভেন— এইসবই তো। এই যে ফুটন্ত হাঁড়ির জলে কত দুষ্প্রাপ্য ফুল দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যাবে, এই যে থালা-বাসনের দৌরাত্ম্যে কত অঙ্গাভরণ খসে যাবে বা নমিতমুখ হয়ে থাকার কারণে কত তুষারপাত দেখাই হবে না— সেসবও কি নয়? তারার আড়ালে আমাদের কত প্রিয়জনেরা থাকে ভাবো! কত প্রিয়জন, যারা তোমাকে ঝলমলে সকালের মতো দেখেছিল। যারা তোমাকে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে প্রথম দাম্পত্য শিখিয়েছিল। আহ্! কী অদ্ভুত একটা কথা এই দাম্পত্য! যেন সেই কবিতায় বলা পারস্য গালিচা। কত পদচ্ছাপ! কখনো মানুষের, কখনো জন্তুর। কত রক্ত! কখনো আঙুলের, কখনো যোনির। এই যে ক্রমশ আবছা হতে থাকা দিনটি, এও কি আমাদের প্রিয়জন? এও কি তারার পেছনে গিয়ে আমৃত্যু আমাদের চুপ করে লক্ষ্য করবে? হয়তো করবে বা হয়তো করবে না। তবে আমরা তো আমৃত্যু এমনই থাকব। উত্তুঙ্গ ভাতের পাহাড় ভেঙে আবার সেই পুরোনো, থলথলে প্রায়ান্ধ বিছানা


সাঁওতাল


রঙিন কাগজ-মোড়া মুখে তুমি আজ খুব ব্যস্ত হয়ে আছ। হতে পারে আজ হয়তো তোমার কোনো দুর্লভ আনন্দের দিন। তোমার সঘন পায়ের চাপে, মুক্তোর মতো ঘামে, হাসির দ্যুতিতে বার বার কেঁপে উঠছে এই শূন্যে তৈরি ঘর। জানালায় দাঁড়ালে দেখা যায় নীচে কত লোক-লৌকিকতার আঁকাবাঁকা রেখা। মরচে-ধরে যাওয়া পথঘাট, কোথাও কোনো একটা ব্যর্থ কালভার্ট। আমি জানি না আজ তোমার ঠিক কোন আনন্দের দিনটি। অভ্যাসমতো কবর সরিয়ে উঠে দেখলাম বাইরের সময়াতীত রোদ। অলীক বুলবুলির মতো সে একটি অলীক খেতে নেমেছে। কেন যে আমার মাথার চুল প্রতিদিন রুষ্ট হয়ে কপালে আটকে থাকে! দু-হাতে ওদের আমি সরিয়ে দিলাম। একদলা হাওয়া নিজের পাঁজরে জঠরে টেনে নিতে নিতে বুঝলাম, আজ আমার সব শব্দ অপ্রয়োজনীয়। আজ আমি ঘরেরই কোথাও কোনো কোণে কাঠের সাঁওতাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। হয়তো একটা শিকারের মতো ভঙ্গিতে। আমি তোমাকে এরই মধ্যে দেখেছি মুহূর্তকয়েক। তখনই দেখেছি রঙিন কাগজের ফাঁক চুইয়ে ঘামই হয়তো গড়িয়ে পড়ছে তোমার। স্তনের গোঙানি শুনে মনে হল, তাদের শেকড় ছিঁড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে। শাড়ি মনে হল অভিসন্ধি করছে এক লহমায় খসে পড়ার জন্য। আমি জানি এভাবে বেশ প্রতিশোধ নেওয়া যায়

কাঠের মূর্তিতে তো আমাকে যেতেই হবে। হাতে জলখাবারটুকু খাওয়ার জন্য যেটুকু সময়। এই শূন্যে তৈরি ঘর মুহুর্মুহু দুলছে। কখনো তোমার পায়ের শব্দকে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড কোনো পাথরের চাঙর ভেঙে পড়ার আওয়াজের মতো। রক্ত-মাংসের মানুষেরই তো কৌতুহল থাকে। আমারও তাই কৌতুহল হচ্ছে জানতে, আজ তোমার কোন দুর্লভ আনন্দের দিনটি। অবশ্য আমি মুখের রেখা অচঞ্চল রেখেছি। রুষ্ট চুলগুলো কোনোদিনই কিছুই বোঝেনি, তারা এখন পশ্চিমে সরীসৃপ হয়ে আছে। ঘরে যে বাড়তি উত্তাপ, তাতে মনে হল আজ লোকজনেরা আমন্ত্রিত হয়ে আসবে। সবারই মুখ রঙিন কাগজে-মোড়া, হাতে হয়তো অলীক শূল! সে-সময় নীচের যে আঁকাবাঁকা লোক-লৌকিকতার জগৎ, সেখান থেকে তাকালে দেখা যাবে শূন্যের এই ঘর কী এক ভয়-ধরানো আগুনে জ্বলছে। সেই আগুনের কুণ্ড থেকে পোড়া বাক্স, চেয়ার, জামাকাপড় খসে খসে পড়ছে। পোড়া নারকোল মালইয়ের মতো কোন্ সব মানুষের মাথা, হাত-পায়ের টুকরোও পড়ছে। নীচের লোক-লৌকিকতায় যেসব মানুষ তারা হয়তো জটলায় দাঁড়িয়ে এইসব দেখবে। তারপর ঘরে ফিরে আয়োজন করবে এক সরল ঘুমের। ঠিক তখন এই ঘরের কোনো এক কোনায় আমি কাঠের সাঁওতাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শরীরে চকচকে ত্বক, তাতে এক শিকারের ভঙ্গি

সবাই মুগ্ধ হয়ে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে আর তোমাকে ঈর্ষান্বিত গলায় খয়েরি চুলের আড়াল থেকে বলছে ‘কী সুন্দর, আহা, কী সুন্দর!’


মৃত


নীল আলোর মতো বুনো ফুল ফুটে আছে আমাদের ত্বকে। আমাদের ত্বক বহুদিনের। তার আড়ালে আমাদের বহুদিনের হাত- পা, মুখের করোটি। মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে, এরইমধ্যে সবকিছু কেমন বহুদিনের হয়ে গেল! ভোরবেলা জানালার ওপারে যে কাঠ কাঠ আলো— সেও বহুদিনের। তেলতেলে দুষ্কৃতীর মতো একটা রাত গেছে কাল। তাই অপলক দুটি দেহ বিছানায় পড়ে আছে। যেন-বা ঈশ্বরের বইবার আগের ক্রুশকাঠ। কীরকম কাঠের পাত্র পরিষ্কার মতো শব্দে পাখি ডাকছে কোথাও। আমাদেরই পাখি হয়তো। আমাদের মতো তারও একটি অনিন্দিত ভোর, জানালার ওপারে ঈষৎ নরম কাঠ কাঠ আলো। আমি দেখি তুমি জানালার ওপারে তাকিয়ে আছো। সাদা কাঠ কাঠ আলোর মধ্যে। চোখের নীচে শুকিয়ে যাওয়া একটি নদীর দাগ। জানি না তখন কেন আমার মনে হয় যেন একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দেশে আমরা বাস করছি। জানালার বাইরে এই যে কাঠ কাঠ আলো— তা যুদ্ধের, সংখ্যাতীত মৃত্যুর নিষ্পাপ গুমোট। কেন জানি না মনে হয়! কেন জানি না মনে হয়! ঈশ্বর যতক্ষণ না তাঁর ঘাড়ে আমাদের তুলে নিচ্ছেন, ততক্ষণ এমন শৃঙ্খলাহীন অনর্গল ভাবনাই হয়তো স্বাভাবিক। তোমার ভেতর থেকে ঠাণ্ডা হয়ে আসা একজোড়া পা বা আমার আয়ু ফুরিয়ে লুটিয়ে পড়া মিশমিশে কালো শুঁয়োপোকার মতো হাত

সাঁজোয়া গাড়িরা কতদূরে? এখনো অবধি কোথাও ওদের ভারী ভারী হস্তিযূথের মতো শব্দ নেই। কাঠের পাত্র পরিষ্কার করার মতো শব্দে সেই পাখিটা এখনো ডাকছে থেকে থেকে। অবশ্য এখন তার পাশ দিয়ে বেশ ধারালো, ঢেউ তোলা শব্দে অন্য একটি পাখিও ডেকে উঠছে। আমার কোনোভাবে তোমার হৃদয়ের পাশে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করে, এইমুহূর্তে তুমি ঠিক কী ভাবছ? আদৌ কি কিছু ভাবছ, না ভাবছ না? অদৃশ্য কিছু মাছি ভনভন করছে তোমার চোখেমুখে গলায় স্তনের ওপরে। ঠিক যেমন মরে গেলে হয়, তেমন। বহুদিন হয়ে গেলে মৃত্যুও তেমন সশব্দ কিছু নয়। এমন, যেন অলক্ষ্যে জল জমাট বেঁধে বরফ হয়ে গেল। সুদর্শন সৈনিকেরা হাতে কালাশনিকভ নিয়ে যখন টহলে আসবে, তোমাকে বুটে ঠেলে উপুর করে দিয়ে অট্টহাস্য করবে ‘দ্যাখো কেমন মৃত, কেমন মৃত’ বলে। তাদের হাতের মাংসে নীল শিরা, ঠোঁটে ছাই ছাই স্বাদ। এই ঘটনাটি ঠিক ক’জন জানবে? কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দেশে এসব খবর জানার মতো কোনও মানুষ কি অবশিষ্ট থাকে? এই যে দোল খেয়ে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়া বৈদ্যুতিন তার বা না-খোলা কিছু কিছু অস্ফুট জানালা— এরা থাকে? কাঠের পাত্র পরিষ্কার করার মতো শব্দে যে পাখি ডাকে— তেমন পাখি বা ঈশ্বরের বইবার পূর্বে এমন বিছানার নশ্বর ক্রুশকাঠ?

নীল আলোর মতো বুনো ফুল ফুটে আছে আমাদের ত্বকে। কী তুচ্ছ অথচ সুন্দর! তেতে উঠতে মেলে দেওয়া কোনো নিরীহ, স্বচ্ছ ব্রা-র মতো


মাকড়সা


আমার অন্ধকার জল জমে থাকা দুইচোখে তুমি ফুঁ দাও। যেন আটকে পড়া কোনো নৌকাকে সাহায্য করছ, এগিয়ে দিচ্ছ ওর অভীষ্ট পাড়ের দিকে। আমি অন্ধকার জল জমা দুইচোখ দু’হাতে একটু সরিয়ে দেখি তোমার তেলতেলে ঘনিয়ে আসা মুখ। দিগন্তে গাছের সারি। সিঁথির অলকচূর্ণ ছুঁয়ে চিল উড়ে যাচ্ছে। চোখের পাতায় গঙ্গাফড়িং-এর মতো নিশ্চুপ রোদ বসে আছে। আকাশে তাকিয়ে দেখি অসংখ্য চিঠি উড়ছে। সব চিঠির মুখ খোলা। যেন ভুলে যাওয়া, ছিঁড়ে যাওয়া গরম ইস্ত্রি চেপে টান করা হাফ– হাতা জামাগুলো। তুমি ফুঁ দাও। তোমার মুখ থেকে সিরাপ ও মিষ্টির লাল গন্ধ আমার দিকে ভেসে আসে। এ তোমার ভেতরের গন্ধ। স্তনের পেছনের গন্ধ অথবা ফুসফুসের দেওয়ালে ঝুলে থাকা বুনো লতানো ফুলের গন্ধ। একটি দরজার তামার হাতল আমার মনে পড়ে। যেটা আমি ঘোরাতে পারিনি। শুধু হাত রেখে তড়িৎপৃষ্ট হয়ে গিয়েছি মাত্র। আমার অন্ধকার জল জমে থাকা চোখে তুমি ফুঁ দাও। আমার পায়ের প্রান্ত অবধি শিরশির করে ওঠে

তোমার একটি হতের আঙুল আমার বুকের ওপরে রাখা। আঙুলগুলো আগের মতো লম্বা হয়ে সাপের মতো হয়ে যায় না এখন। শুধু যন্ত্রচালিত পোকার মতো রক্তাভ পেট নিয়ে বসে থাকে। আমার চোখের অন্ধকার জল ছোট ছোট কচুরিপানা ফোটায়। হয়তো লজ্জা ঢাকে। অক্ষম মুখ ঘুরিয়ে নামিয়ে লুকিয়ে ফেলে। হঠাৎ আগুনে পুড়ে যাওয়া, শুধু রিবার ও ভগ্ন দেওয়াল টিকে থাকা শহরের মতো এই আমার খটখটে শরীর, পাথুরে রাস্তা লোহার অ্যাঙ্গেল থেকে সন্ধের মুখে জ্বলে ওঠা বাতির গন্ধ আর প্রবালশিরার মতো দোকানের আঁশ— সব শূন্য টিনের কৌটোর মতো ওড়ে। এমনই এক পোড়া শহরের ভগ্নে তোমার হাত রাখা। আঙুলগুলো রাখা। ধাতব পোকার মতো— শুকিয়ে আসা চটচটে রক্তের খোঁজে। নাইলন সুতোয় বোনা নীল একটা জালের খোঁজে। আকাশে অসংখ্য জামা। হয়তো ওরা এই পোড়া শহরের উৎক্ষিপ্ত মানুষ। কাত হয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে দেখছে একটি প্রকাণ্ড স্ত্রী মাকড়সা পুড়ে যাওয়া, কালো পুরুষ শহরটিকে গিলে খাবার আগে কেমন কামার্ত পরির মতো আদর করছে


পুষ্পক


এই জ্বলন্ত রোদ তোমাকে আমাকে অনুসরণ করছে। যে অন্ধকারটুকু আমরা সামলে রেখেছি চেতনা অতিক্রম করে আরও দূরে কোথাও— তার লোভে এই জ্বলন্ত রোদের চোখ ঝকমক করে। যেখানেই যাচ্ছি আমরা টের পাচ্ছি খুব কাছেই ওৎ পেতে আছে জ্বলন্ত রোদ। এখন আমরা ঠিক সেই উচ্চতায়, যখন সংসার আলগা হয়ে, দু’টুকরো হয়ে কোনোরকমে এ ওকে আঁকড়ে ঝুলে থাকে। আমরা এখন ঠিক সেই উচ্চতায়। সরু একটা পাহাড়ি পথে। এই সময় আমরা কোনো ভাষা ব্যবহার করি না। যে ভাষায় মানুষের আসমুদ্র হিমাচলকে মথিত করে ফেলা যায়, সহসাই ফুল ফোটানো যায়, দূরদূরান্ত অবধি আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়— তেমন কোনো পেটে ডিম আসা ভাষা। শুধু দৃষ্টি বিনিময় করি এবং চড়াইয়ের দিকে হাঁটতে থাকি। এই যে আমি এখন সারা শরীরে গলে পড়া মোম নিয়ে বসে আছি— আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি বুনো লতাপাতায় বসে আমার দিকে তীব্র চোখ রেখেছে জ্বলন্ত রোদ। তুমি এইমাত্র ঘামের টুকরো টুকরো পাত হাওয়ার মধ্যে রেখে যে কোথাও অন্তর্হিত হলে— তোমার এই গতিবিধিতেও তীব্র নজর রেখেছে জ্বলন্ত রোদ। আজ আমাদের ভীষণ আটপৌরে একটা দিন। যেসব দিন শুরু হয় আকাশের কোনায় কোনায় উথলে ওঠা সাদা মেঘ দিয়ে, কালচে হয়ে যাওয়া রক্তের মতো চা দিয়ে, কিংবদন্তীই হয়তো হয়ে ওঠা কোনো বিস্কুট দিয়ে। তারপর দুপুরের সেই খাবার, যা ভাঙলে দেখা যায় শ’য়ে শ’য়ে নরকঙ্কাল পড়ে আছে। এমনই একটি দিন আমাদের আজ। যার তিনভাগ দখল করে চিরদিনই থাকে পিছল কুমিরের মতো এক ঘুম

কেবল গুপ্তঘাতকের মতো আমাদের অনুসরণকারী এই জ্বলন্ত রোদটাই আজকের আমাদের এই দিনটায় যা কিছু অনন্য। সে তীব্র চোখ রেখেছে আমাদের প্রায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর আন্দোলনের ওপরে। আমাদের একটি দেওয়ালে জটাজুটধারী ঈশ্বরের মতো একটি ঘড়ি। তার কাঁটাগুলো ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে হার্ডেল পেরিয়ে ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছেই। এই দৃশ্য আজ যেমন আমি দেখছি, আমার বসে বসে মরে যাওয়া পূর্বপুরুষেরাও দেখেছেন। এইমাত্র একঝলক আমি বাইরে তাকালাম। পাহাড়ের ঢালে আরেকটি অন্য পাহাড়ের ঢাল নেমে মিশেছে। এই মাসটি শেষ হবে আরও দু’সপ্তাহ পর। আরও দু’সপ্তাহ পর। তার আগে কত বছর শেষ হয়ে যাবে। কত ঘর পুড়ে যাবে! কত স্বভূম, কত যোজন যোজন বিস্তৃত অরণ্য! তুমি আমি এরইমধ্যে কোনো একদিন হয়তো কামের স্বার্থে দুটো জ্যোৎস্নাবিদ্ধ কঙ্কাল হয়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়াব। জানালার বাইরে তখন সেই প্রলয়— যা কাতারে কাতারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষেরা টের পায় না। পাজামার খোল থেকে পা বের করে হয়তো অন্য পায়ের মশা উড়িয়ে দেয়। পাশে স্ত্রী সন্তান পোশাকের ভেতরে উসখুস করে। আমরা মুখোমুখি দাঁড়াব। তখনো ভাষা খুঁজে পাব না। যে ভাষায় মানুষের আসমুদ্র হিমাচলকে মথিত করে ফেলা যায়, সহসাই ফুল ফোটানো যায়, দূরদূরান্ত অবধি আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়— তেমন কোনো পেটে ডিম আসা ভাষা। শুধু চোখের কোটর থেকে জোনাকির মতো আলো বিনিময় হবে। এইজন্যেই কি এই জ্বলন্ত রোদ আমাদের এভাবে অনুসরণ করে? কাউকে জানায় আমাদের গতিবিধি?


বিহঙ্গপুরুষ


তোমার মুখর ঠোঁটের পাশ দিয়ে আমি দেখতে পেলাম ওপারে টেবিলে রাঙা উলের কভারে ঢাকা দেওয়া একটি অচেনা মানুষের হৃৎপিন্ড বিরতি দিয়ে দিয়ে তোমাকে ডাকছে। আমি চোখের পাতা মুদিয়ে বলতে পারি তুমি এখন ঢলঢলে একটি পোশাক পরে আছ। গলার কাছেও সেই পোশাকের খানিকটা শুধু অভ্যাসের বশে ফেলে রাখা। তার কিছুটা দ্যুতি তোমার বয়স্ক চিবুকে। পোশাকের ভেতরে তোমার যে শরীর, তা মোমের। মোমেরই স্তন, তার টিলার ওপরে সহস্র পাপড়ির ফুল বা তোমার মোমেই তৈরি নিতম্ব। মোমের আয়ত পিঠ বা মোমেরই প্রতিষ্ঠিত ঊরু। প্রতিহিংসা ফিরে গিয়ে সেখানে শুধু রঙিন পাথর-ঝিনুক স্মৃতিফলকের মতো রেখে গেছে। তোমার মুখগহ্বরের গন্ধ কত কাঁটাতার, কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমাকে স্পর্শ করছিল। তোমার দাঁতের সারি সারি মুক্তো, তোমার লালাভ জিভের নড়াচড়া আমাকে স্পর্শ করছিল। তুমি বলছিলে ‘ এই তো গত কয়েকমাস আগে আমরা উল্টোপিঠের দেশ থেকে ঘুরে এলাম। তুমি ভাবতে পারবে না সে কী আশ্চর্য সুন্দর দেশ। বিচ রোডের পাশ দিয়ে আরেকটি ছবির মতো রাস্তা। সাদা সাদা সামুদ্রিক পাখিরা সব উড়ছে। কখনো হঠাৎ মনে হবে যেন তুমি বোধহয় স্বপ্ন দেখছ! ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর নাকে, মস্তিষ্কে অন্য আরেক টাটকা আলোর ঘ্রাণ’

এ-কথার মধ্যে উপদ্রুত কিছু নেই। কোথাও কোনো কামগন্ধ নেই অথচ আমার পুরুষাঙ্গ পাথর হয়ে ওঠে। তার মধ্যে দপদপ করে শিরা, আলস্যের স্তর পরা রক্ত। আমি তোমার ঢলঢলে পোশাক সরিয়ে সামান্য স্পর্শ করি তোমার মোমের স্তন। দেখি এক পুষ্পময় হাসি ছাড়া ওরা আর দ্বিতীয় কিছুই বলে না। প্রতিহিংসা ফিরে গেলে অ্যাতোটা উদার সমুদ্রবক্ষ জীবনে, মাংসের আড়ালে আসে? হঠাৎ নগ্ন হয়ে ছন্দিত বসবার ঘরে ঢোকার মতো আমি বিমূক, আরও বিমূক হয়ে যাচ্ছিলাম। বিমূঢ়, বিমূঢ়ও হয়তো বলা যায়। সেই মুহূর্তে আকাশে ছড়িয়ে পড়া পাত্র পাত্র আঠা। সেই মুহূর্তে ময়দানবের মতো নিজেকে ঠাঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলি ভীষণ, ভীষণতর ম্লান। সেই মুহূর্তে গাছপালার দেহে হাওয়া নেই, আছে অশরীরী আঙুলের টান। তুমি বলতে থাক ‘একদিন একা একটা বেঞ্চে বসে আমার খুব এ-পিঠের দেশটার জন্য কষ্ট হচ্ছিল। এখানে প্রতিদিন কত হানাহানি ঘটে। ছনের বেড়া, গামছার ঝুল সরিয়ে ঘরে রোদ ঢোকে। দেবতারও আগে মোড়লের দরজা-জানালা অনর্গল করা হয়। শিশুরা বেঁচে থাকে পেট ভরা কৃমি নিয়ে, খোস-পাঁচড়া নিয়ে। কী ভীষণ তফাৎ, কী ভীষণ অবুঝ এ-পিঠের দেশটা!’ এসব বলছ যখন, তখনই অন্য টেবিলে রাঙা উলে চাপা দেওয়া একটি হৃৎপিন্ড বিরতি দিয়ে দিয়ে তোমাকে ডাকছে

সে হয়তো তোমার কোনো বিহঙ্গপুরুষ


উড়ন্ত পাতার মতো দিনগুলি


কেমন উড়ন্ত পাতার মতো দিনগুলি গেল। এখন থমথমে চরাচরে কয়েকটা গাছ, ছেঁড়া চটি, পরস্পর পরস্পরকে হিংস্র আনন্দে ফুঁড়ে ফুঁড়ে নীলাভ জলের দিকে ছুটে যাওয়া পদচিহ্ন আছে। আর কিছু নেই। নেই বলা হয়তো ভুল— আছে গালের পাশে ঝুলে পড়া একগাছি চুলের মতো কতবড়ো মৌন আকাশ! তার গায়ে সীসের পাথর, আবছা ধূসর ঢেউ। পাথরের সংঘাতে কিছু ঢেউ ভেঙে চক্রাকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন যেখানে দেখবে, পাথরের মতো সব নিশ্চল মানুষ। হিংসা বা ক্রোধের অতীত। শব্দ বা চিৎকারের অতীত। পিঠে ঘামের বিন্দু, নরম প্রশান্ত শিরদাঁড়া। ভীষণ মরমে মরে-যাওয়া যোনি অথবা লিঙ্গ। দৈব পুষ্পের মতো আত্মায় বা এঁটো থালায় বয়ে-যাওয়া হাত। খড়খড়ে, পায়ে বিষাক্ত নূপুর পরা উড়ন্ত পাতার মতো দিনগুলি যাইহোক গেল। এখন কিছুদিন ভালো থাকব তুমি আমি বা আরো দুর্লক্ষ্য কেউ। পুটুশের ঝোপে অদ্ভুত ফুল ফুটবে। ধূর্ত প্রজাপতি উড়ে আসবে তার গায়ে। রাতের যে অংশে বারান্দা থাকে, খাটো সিঁড়ি থাকে, লোমশ কুকুরের গায়ের মতো ঘন অন্ধকার থাকে— সেখানে চাঁদ পড়ে থাকবে হেলে। কোনো ভাবনায় হঠাৎ হাসি পেলে হাসব অথবা ছোট ছোট কীটপতঙ্গ হয়ে পাক খেয়ে বেড়াব নিজেরই চারপাশে বা খুব পুরোনো, বুজে আসা কোনো ক্ষতে, দাহে। আলগা পেটের পাশে পড়ে থাকবে আরো একটি আলগা শীতল পেট কিন্তু কেউই কাউকে উত্যক্ত করবে না। কোথাও একটা হিম মোমের শিখা জ্বলে থাকবে এইসব মুহূর্তে, এইসব অতল মুহূর্তে। বাঘের মতো ভীষণ স্থির চোখে সেই আলো পাহারা দেবে আমাদের রক্তমাংস অবধি, শিরা বা গ্রন্থির কম্পন অবধি

আমরা এইভাবে অন্তত কিছুদিন ভালো থাকব। ভোরে যে সূর্য উঠবে তাকে দেখে মনে হবে কী অগোছালো, কী উদাসীনভাবে লাল! পিপাসাবিদ্ধ হয়ে কখনো আমি তোমার জগতে গেলে দাঁড়াব বেশ, বেশ দূরে। যেহেতু আর উড়ন্ত পাতার মতো দিনগুলি নেই, যেহেতু আয়নায় অস্বচ্ছতার পরত জমেছে, তাই আমাদের মধ্যে কোনো বাঁক থাকবে না। কোনো আড়ালও থাকবে না। সংকীর্ণ খাড়াই থাকবে না, এমনকী পায়ে-চলা পথটিও থাকবে না। আমি মৃতদেহের মতো লক্ষ্য করব তোমার মাথার আনতি। পিঠের ঘাম অথবা প্রচ্ছন্ন নরম শিরদাঁড়া। লক্ষ্য করব কী ফর্সা তোমার সবটুকু ত্বক! কী দ্যুতি তোমার গুমটি-ভাঙা কাঁধে। তুমি হয়তো আমার খসখস টের পাবে। তোমার দৈব পুষ্পের মতো একটি হাত তখন হয়তো সাবানের ফাঁপা ফাঁপা ফেনার মধ্যে অদৃশ্য। তোমার আঙুল হয়তো দ্বিধায় জড়োসরো। তবু তুমি একটিবার নিজের মধ্যে লুকিয়ে ভাববে উড়ন্ত পাতার মতো দিনগুলি শেষ। সভ্যতার বদলে লিঙ্গের রাজত্ব শেষ। জলকণার মতো শিহরের মাথায় কটু, তেজস্ক্রিয় বীর্যের প্রভুত্ব শেষ। তুমি ভাববে। তোমার অস্ফুট জড়োসরো আঙুল ভাববে। তোমার অলক্ষ্যে তোমার পিঠে যে ঘামের বিন্দু, তারাও ভাববে। মুখ না ঘুরিয়েও তুমি ঠিকই বুঝবে একটি মৃতদেহ তোমার পেছনে কেমন লাজুক সৈন্যের মতো কোনোরকম অলংকার ছাড়াই এসে দাঁড়িয়েছে। ধারে-কাছে কোনো বাঁকই আর নেই। ওৎ পাতার মতো কোনো আড়ালও নেই। নেই খাড়াই বা পায়ে-চলা পথও। তোমার একটু মুচকি হাসি পাবে তখন। গালের পাশে ঝুলে পড়া একগাছি চুলের মতো কতবড়ো মৌন আকাশ তাতে নড়ে উঠবে একটু। যেন সে বুঝল

চকিতে তোমাকে বুঝল। সফল দেশীকোত্তমের মতো তোমাকে বুঝল

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জের সুভাষপল্লিতে থাকেন। কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির শুরু। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।