ঈশায়ী ২০১৬
দিনমান অন্ধকার, দিনমান হাওয়ার শাসানি—
ক্যাথ্রিনের চাকা যেন সারাটা আকাশ—খালি ঘোরে,
বিদ্যুৎ চাবুক হয়ে আকাশে আকাশে আছড়ে পড়ে।
দিনমান হাহাকার, দিনমান ছায়ার গোঙানি।
ঝড়-ঝাপ্টা দিনরাত, গুমোট গুমোট ভাব ফাঁকে—
চলে যাচ্ছে দিনগুলি, চলমান নীতির প্রভাবে
বিশাল ঝাঁকুনি লাগে দ্যাখো গড় আয়ুর হিসাবে;
লাশের ওপরে বসে মৃত্যু ভাবে ‘মৃত্যু’ বলে কাকে!
জগতে এমন কালে জেগে ওঠে নীরব চিৎকার
নিয়ত দু’কানে বিষ বাণের মতোই এসে পড়ে।
হাত-পা সে কিছু নয়, গড়া হলো মগজ-পাহাড়
পাহাড় পর্ব্বত হবে, অস্ত্রের যোগান শুধু বাড়ে।
চাতালে টায়ার-সুইং একা দোলে প্রবল বাতাসে।
চাতালে টায়ার-সুইং একা দোলে প্রবল বাতাসে।
ভেসপারের স্মৃতি
হালকা সন্ধ্যায় আমি তার ভারী চোখ দেখতে পেলাম—
বললাম, ‘তোমার মুখেও একদিন গোধূলি নামবে;
লাল টিপ ডুবে যাবে।’
তারপর, তাকিয়ে দেখি অ্যাকুয়ারিয়ামের জলে ভেসে থাকা
সাদা বিকিনির তলে ঘোরাফেরা করছে রঙিন মাছের দল।
সে বললো, ‘জীবনে এমন সন্ধ্যা খুব একটা আসে না, তাই না?’
সাদা-কালো
তাকিয়ে থাকাকেই প্রার্থনার ভঙ্গি করে নিয়েছি। জানালার বাইরে চিরচেনা দিনগুলি; গোধূলি ঘনছাই—
বোবা ও বধির হতে হতে সহসা যার দেখা মিলেছিল, সে তো জলে, ধীর তমসায় মুছে যাওয়া আমারই প্রতিবিম্ব। আঁধারে কালো কালো গাছ, প্রতিবিম্বহীন, উদ্বাহু—আমাকে টেনেছিল ঐকতানে! এখন, মৃদু শীতে, আমি যা-কিছু ছেড়েছুঁড়ে আর যা-কিছুর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি পা, উভয়ই দেখি মোহময়—
বহুবর্ণিল বসন্ত চলেই আসছে—ফুল ও পাতার সম্মিলন দিয়ে নগ্ন ডালপালার অতুল বিন্যাসকে আড়াল করবে।
২.
আঁতকে উঠেছি বারবার; ছিল এক
তিমিঙ্গিল হাঙর
ধড়ের থেকে যার মাথার গতি বেশি!
মনে পড়ে,
থেকে থেকে নিঃসীম কুয়াশায়
আমার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া
আর বাকিটা সময়
ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
সামান্য আশ্রয় খুঁজে খুঁজে
মনে পড়ে,
আলোর বেগে ধেয়ে আসা মাথা
শব্দের বেগে ধেয়ে আসা ধড়।
৩.
নিজেকে দেখেছি অকারণ কান্নায়—সবই ধূসর-সাদা, ধূসর-কালো, ছাই।—
ছিলাম বিরল রক্তযূথের কেউ,
মুমূর্ষুতা ও বলিষ্ঠতার দিকে তাকিয়ে
দেওয়া-নেওয়া থেকে সমান দূরে
তবু অনেক কিছু এনেছি আর ধেয়ে আসে অনেক রং
ধূসর দিনগুলি থেকে; মিশে যায় এপারের দিনে!
নিজেকে কিছুটা আনন্দিত, নৃত্যোন্মুখ দেখে আমারই ভালো লাগছে।
প্রাণায়াম রিপ্রাইজ
চোখ বন্ধ করো, মুখ উপরে তোলো
ভাবো নীলে নাক ঠেকেছে—নীলের গন্ধ নাও; তোমার ফুসফুস ভরে যাচ্ছে ঐশ্বর্যময় নীলে। আহা! শান্ত-গভীর আকাশ, তাপহীন সূর্যের আলো, তোমার চারপাশে হাওয়ায় অগণন স্বয়ম্ভূ পালক, সাদা পালক, আলোমাখা, আলোমাখা! তোমার উদার নিশ্বাস আর প্রসারিত দুই হাত—নিজ কণ্ঠের প্রতি আগ্রহী হও— গান শোনো গান—স্বরচিত, সর্বোপরি নিজের কণ্ঠস্বর শোনো।—এ ভীষণ কার্যকর।—এ হলো এক গ্লাস ঠান্ডা পানি শীতল সম্পর্কের মাঝখানে। মনে করো ফাঁকা মাঠ; সঙ্গোপনে সবুজে ছেয়ে গেল। কোমল-উড্ডীন-ধাবমান সবুজ, তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে রসালো সবুজ, অমল-উজ্জ্বল অন্তর্দৃষ্টি স্বচ্ছ করা সবুজ!—
নিশ্বাস নাও গভীর ভাবে ……. এবং নিশ্বাস ছাড়ো
নিশ্বাস নাও …………. …………নিশ্বাস ছাড়ো
নিশ্বাস নাও …………. …………নিশ্বাস ছাড়ো
গভীর নিশ্বাস নিতে থাকো ধীরে ধীরে। প্রতিটি নিশ্বাস বহুবর্ণিল প্রশান্তিকে ভিতরে টানছে—প্রতিটি নিশ্বাস তোমার অবসন্ন মাংসপেশীতে পৌঁছে দিচ্ছে সঙ্গীত। বলো, ‘প্রশান্তি, আমি তোমার অধিকার রাখি, আমার ভালো লাগছে এইসব অনুভূতি।’
দ্যাখো, বনের প্রান্তে এক ঘোরানো সিঁড়ি, শীর্ষ যার অভ্রভেদী। সিঁড়ির শীর্ষে তুমি। নিচে ফুলেল স্বস্তি; ধীরে ধীরে নামতে হবে। পা দাও পারস্য-গোলাপি ধাপে, দ্যাখো সে তোমার স্পর্শে সবুজ। পা বাড়াও; পা দাও গাঢ় বেগুনি ধাপে, দ্যাখো সেও সবুজ। প্রতিটি পদক্ষেপ তোমাকে প্রশান্তির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে— প্রতিটি পদক্ষেপ প্রশান্তির দিকে, প্রতিবার টেনে নেয়া নিশ্বাস গাঢ় থেকে গাঢ়তর সুগন্ধের দিকে। কত আরামদায়ক, কত নিরাপদ এই নেমে যাওয়া! জীবন এক হিরণ্ময় প্রজাপতি হয়ে ঘুরছে তোমার চতুর্দিকে। সামান্য দূরে, ভেজা বালুপ্রাঙ্গণ ডাকছে তোমাকে
তাকিয়ে দ্যাখো, সূর্য ডুবছে ধীরে ধীরে, সূর্য-ডোবা দ্যাখো—এ হলো প্রশান্তির জন্য এক শান্তিপূর্ণ কৌশল। বিড়বিড় করে বলো, ‘সহজ হবো, আমি সহজ হবো, বহুব্যক্তিত্বময়তার সংকট দূর হোক, খাক হতে চাওয়া এক অসুস্থতা, অসুস্থতা দূর হোক।’ নিশ্বাস নাও, নিশ্বাস ছাড়ো—প্রতিবার ছেড়ে দেয়া নিশ্বাসের সাথে শেষ ক্লান্তিটুকু বেরিয়ে যাচ্ছে…
খয়েরি-সাদা; সুফিনৃত্যের ভঙ্গিতে হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়া ফুলের মতো করে প্রশান্তি নামছে তোমার অন্তরে। নির্জন বেলাভূমিতে পাতার আসন পাতা—তুমি বসে আছো—মুখে দূর-অস্তাচলের আলো, মুখে লেগে আছে হাসি।
দ্যাখো দ্যাখো, তোমার সারাটা দিন নতুন সম্মিলনে: নীল আর সবুজ তোমার আত্নার স্বচ্ছতার সাথে এক অমর্ত্য অনুপাতে একাকার হয়ে যাচ্ছে, অ্যাকোয়ামেরিন! অ্যাকোয়ামেরিন! প্রশান্ত জলরাশি; তুমি জলের উপর মগ্ন— ডুবে যেতে না যেতেই সূর্য উঠে এসেছে; অনুভব করো তাকে—প্রশস্ততাকে ধরে প্রশান্তির দিকে, প্রশান্তিকে ধরে মহাশান্তির দিকে, তুমি মহাশান্তির দিকে তুমি…
ধীরে ধীরে চোখ মেলো ,ধীরে ধীরে খোলো চোখ।
বনের প্রান্তে ক্যারাভ্যান
বনের প্রান্তে, কালো আকাশের তলে
আগুন জ্বালিয়ে বসে বসে দুইজনে
গল্প করবো—বিজন সে-অঞ্চলে
ঘুমিয়ে পড়বো শেষ রাতে, ক্যারাভ্যানে।
ঘুমানোর আগে: তারার অনেক নিচে
বাষ্প উঠবে ঠেলে কেটলির ঢাকা;
হবে টুংটাং শব্দ কাপ-পিরিচে;
অগ্নিশিখারা উদগ্রীব, আঁকাবাঁকা।
কমলা আলোয় ক্যারাভ্যান যাবে ভরে—
কাচে কাচে তার মনোজ্ঞ হয়ে ওঠা;
ডালপালাগুলি বাতাসে উঠবে নড়ে—
ক্যারাভ্যানে এসে পড়বে পাতাও ক’টা।
তখনও শীতের শক্তি জাগেনি পুরো—
হেমন্তকাল কমলা পাতায় ভরা;
তবু ঠান্ডায় আমার-যে জড়োসড়ো
চাদরে শরীর মুড়িয়েছি আগাগোড়া।
যখন আমরা পৌঁছে গিয়েছি বনে
সূর্য তখন ডুবেই গিয়েছে প্রায়;
প্রাক সন্ধ্যায় প্রেম আমাদের মনে
রাঙা হয়ে গেছে সূর্যের লালিমায়।—
অনেক দিনের সঞ্চিত ব্যথাগুলি
দেখবো হঠাৎ বদলেছে বৈভবে;
কুঁড়ির সমান গোপন ভাষ্যাবলি
পাপড়ি তাদের মেলেছে সগৌরবে।
ক্ষিপ্র সন্ধ্যা গড়ালে, গভীর রাতে
তোমার শরীর অ্যারোমার আস্তানা;
করতে হয় যা, একা নয় একসাথে,
তাই তো করবো— হবে আরও জানাশোনা।
ঘুম ভেঙে আমি দেখবো সকালবেলা
কয়েকটি পাখি— খাচ্ছে খাবার তারা—
খইয়ের কৌটা পড়েই থাকলো খোলা!
আপেলের ঝুড়ি মেপল পাতায় ভরা।
চোখ
মা আমার, এই দেশে একবার তুমি এসো
বাবাকে নিয়ে
অসংখ্য চেরির ফাঁক দিয়ে
একবার সূর্যোদয় দেখো;
দেখো:
কীভাবে দুপুরে একজন গর্ভবতী ডেফোডিলের সামনে শুয়ে হাসে।
কীভাবে ঝুলন্ত পাখির বাসায় এক কাঠবেড়ালি নিশ্চুপ বসে থাকে।
কীভাবে বালক শিলমাছ একা একা বালির ওপরে থাকে শুয়ে ।
তোমাদের কোনোদিন দেখা হলো না সমুদ্র ও পর্ব্বতমালা!
তোমাদের কথা মনে হলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে
বোলো না আমিই তোমাদের চোখ বিশাল দুনিয়াজুড়ে।
নীলফামারী
সবুজ তামাক-ক্ষেতের পিছে বাঁশঝাড়, তার পিছে সূর্য ওঠে। যদি আগাও আরও উত্তরে, তাহলেই তো নীলফামারী। তুমি দেখবে ঐ জেলা শহরে ঢুকে, তুমি অবাক হবে, যদি বাসে করে যেতে যেতে প্রতিটি জেলার মানুষের আচরণ পরখ করতে থাকো, মনোযোগ দিয়ে। দেখবে ধীর থেকে ধীরতর হচ্ছে মানুষগুলি—এবং নীলফামারী, সব থেকে ধীর মানুষদের জেলা, এক কালে ছিল মহকুমা; দেখবে সবাই এলোমেলো, জবুথবু, সময়জ্ঞানহীন। যদি আরও আগাও, ডোমার হয়ে চিলাহাটী— এত আঁকাবাঁকা রাস্তা পৃথিবীর কোনো সমতলে খুঁজে পাবে না। এরাই বানিয়েছে, কারণ এরা সময়জ্ঞানহীন, জবুথবু, কাচা তামাক-পাতার মতো বাতাসে স্থির, বিড়ির মুথা আর সিগারেটের তুলা ছ্যাবড়া করে ফ্যালে, সুপারি গাছে লতিয়ে ওঠা পানের মতো উচ্ছ্বাসে; এরা ক্রমাগত চাবায় পান, মজায় কাচা সুপারি মাটিতে পুঁতে। এদের ভাষাও তেমন; এরা প্রতি মুহূর্তে ভাষাকে নাচাতে, ঘোরাতে, প্যাঁচাতে আর চাবাতে ভালোবাসে অভিব্যক্তির পর অভিব্যক্তি এঁকে।
হাওয়াকল
বাসন্তী এই পপির ক্ষেতে তুমিই সঙ্গী
থেকে থেকে হাওয়ায় দোলা পর্দা-সমান দেহভঙ্গি
দেখতে থাকি অবিরত
ঘাড় উঁচিয়ে, দু’এন্টেনা খাড়া করা ঘাসফড়িংয়ের মতো।
প্রথম কবে দেখেছিলাম
ফিলিতে হায় বৃষ্টি হলো কত!
ঝরলো পানি ছাতার চতুর্দিকে
বাদলা দিনে ছাতার তলে তুমি উপদ্রুত।—
তাই কি আজকে দেখতে হচ্ছে ক্ষেতের থেকে ওই অগুণতি পপি
তোমার শরীর ছুঁয়ে কেবল শূন্যে উঠে যায়
সূর্য ডোবার আগে অন্য রঙের মহড়ায়?
ভাবি, একটি হাওয়াকল কী করে তার নিজস্ব খেলায়
পেকে আসা সূর্যটাকে পাখায় পাখায় ঘোরায়!
ভাষা
মেঘগুলি বিকালের আলোয়
রুপারং থেকে সোনারঙে বদলে গেছে;
সোনারং থেকে রুবি-লাল হয়ে উঠছে যেন দিনান্তের আলোয়।
যা হতে চাইলাম আমি
দিন দিন সে-রকমই হলাম—লতাগুল্মে ছেয়ে থাকা ছাউনি—
পরিত্যক্ত বলেই সুন্দর।
ভিতরের আলো
ভাসা-ভাসা থেকে ধীরে স্পষ্টরূপে ভাষা দিতে চায়।
গাজিবোর পাশে
কত কিছুই কল্পনা করি কালে-কালে
পরে দেখি অনেক কিছুই আছে তারা আমার পায়ের তলে
আমার দৃষ্টিসীমায়।—
দূরের বাংলায়, কোন সে হেমন্তে, হায়,
কল্পনা করেছি আমি কমলা-হলুদ
লাখ লাখ অযুত-নিযুত
পাতা-ভরা গাছেদের প্রতিবিম্ব শাখা নদীর পানিতে
যেনবা গলিত রংধনু, আশ্চর্য রঙিন ঋতুতে! —
তেমন কয়েকটি গাছে
দুই প্রান্ত ঢাকা পড়ে আছে
এমন একটি ব্রিজ পেরিয়ে দেখেছি শাখা নদীটির তীরে
হৈমন্তী গাছের ভিড়ে
জলটুঙির মতন এক ছোট্ট গাজিবো! —
ভাবিনি কখনো পাবো
এ জীবনে তাকে
ধূমল ভাগ্যের কোনো এক বাঁকে!
এ পাওয়ার সাথে বাড়তি যে পাওয়া—
এক দৃশ্য, বনবিড়ালের কঠিন থাবার নিচে একটি পাখির নিস্তেজ হয়ে যাওয়া
গাজিবোর পাশে!
কতক্ষণ আর শান্ত থাকা যায় শুধু নিজেকেই ভালোবেসে!
দিকে দিকে কী করুণ অবলুপ্তি!
মানুষের মুক্তিই কি জগতের মুক্তি?
সীমাহীন যন্ত্রণাভোগের সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নেয় সব প্রাণী
কী জানি
কী তার মানে!
হৈমন্তী গাছের ভিড়ে এইখানে
অনেক আনন্দ নিয়ে হাসে আমার অবুঝ ছেলে।—
নিজ সন্তানের মুখ আর নিজ মমতার দিকে একাগ্রে তাকালে
বুঝি আমি
থাকুক বা না-থাকুক অন্তর্যামী
জীবনের সুস্থির-গভীর এক মানে আছে।—
কোনো একদিন নিজ অস্তিত্বের ভিতর হয়তো সে মানে আমি পাবো
যেন সে গাজিবো;
চারপাশ ছেয়ে যাবে জীর্ণতার মৌনী উৎসারণে
মৃত্যুপূর্ব কোনো ক্ষণে।
জন্ম: অক্টোবর, ১৯৮৩ ইং, নীলফামারি। বর্তমান নিবাস: নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত কবিতার বই: কাঠঠোকরার ঘরদোর (২০১৫), ধুপছায়াকাল (২০১৮), গোধূলির প্যানোরামা (২০২০)। সম্পাদনা : ওয়েবম্যাগ নকটার্ন (যৌথ)।