নরকের গান
জল সরে সরে যায়
হৃদয় সেও ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ে
এই মুহূর্তে তীব্র আকাঙ্ক্ষা
পর মুহূর্তেই নিস্তরঙ্গ জলাশয়
জল কেটে কেটে পানা সরিয়ে
স্বচ্ছ মুখচ্ছবি
আয়নায় শত শত সাদা কফিন
গোলাপে ঢাকা মৃত্যুর শীতলতা
মারি হয়ে এসেছিলে তুমি
বুকে ছুরি বসিয়ে কেটে নিলে
আস্ত একটা হৃদপিণ্ড
তারপর থেকে জল ঝরছে
লাল জলে ভেসে গেলো বিছানা
এইসব গোপন কথা
কোনোদিন কেউ জানতে পারে না
স্নিগ্ধ হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে
নরকের গান
বারান্দার কোণে ঘুমিয়ে আছে
রিলকের একেকটা স্তবক
সেই কাল ঘুম আর ভাঙে নাই তার
কতদিন সে সূর্য দেখে না
রক্তে কমে এসেছে লোহিত কণিকা
তবু যখন তোমার হাত স্পর্শ করে
সেও হয়ে পড়ে একজন মায়াবাসী
খাড়ি কেটে সমুদ্রের জল সব ভর করে চোখে
একেকটা অস্তগামী পুকুর ভরে ওঠে
কুসুমিত আলোয়
হে পাষণ্ড হৃদয়হরণকারী
কি নামে ডাকবে আজ তাকে
সেতো এপিটাফে লেখা হয়ে আছে
নির্জন প্রান্তরে
মদ খাওয়ার পরে
মদ খাওয়ার সময়ে প্রথমে তোমার তিতা লাগে
বেশ কড়া তিতা
পানি মিশিয়ে খেলে কিছুটা কমে
সোডা, কোকে আরো কমে
তারপর একটু একটু করে মাথাটা হালকা হতে শুরু করে
হাত পায়ে লাইট অনুভূতি
ফুরফুরা হাঁটলে মনে হয় শরীরে ভর নাই
এরকম কিছুক্ষণ চলার পর
তোমার চুমু খেতে ইচ্ছে করে
কিন্তু যাকে খেতে চাও সে নাই
খসখস করে দুচারটা কবিতা লেখা
লেখাগুলো বেশ বাঁকা বাঁকা
অবশ্য আগেও খুব সোজা ছিল না
একা একটা ঘরে টিমটিমে আলো
দূরে বাঁশির শব্দ
সমুদ্রে প্রবল ঝড়
এসব ভাবতে ভাবতে তোমার মদ খাওয়ার রাত ভোর হয়ে যায়
মন খারাপ
মন খারাপের সময় তুমি চুপ করে বসে থাকো
কথা বলতে ইচ্ছে করে না
যদিও বলো মনে হয় প্রতিধ্বনি হচ্ছে—
চারপাশে লোকজন হাসছে, কথা বলছে
খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে
তুমি শুধু দেখতে থাকো…
শুধু ভাবতে থাকো
ভাবতে ভাবতে একবার নদীর কিনারে
আরেকবার তলদেশে
সেখান থেকে খুঁড়ে আনো পুরানো মনি-মানিক্য
এইসব মনি-মানিক্য তোমাকে আরো স্মৃতিকাতর করে তোলে
একটা ডিঙি নৌকায় ভাসতে ভাসতে মাঝ দরিয়ায়
সেখানে ছিপ ফেলে বসে থাকো
নদীতে ঘন কুয়াশা
মন খারাপের তীব্রতায়
নদীর পাটাতনে পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা,
মাসের পর মাস—
এক সময় কুয়াশা ভেদ করে রোদ ওঠে
প্রথমে মিষ্টি রোদ তারপর কড়া রোদ
একটু একটু করে রোদের তীব্রতা বাড়তে থাকে
চোখের পর্দা ভেদ করে ঢুকে পরে মগজের ভেতর
তুমি রোদ এড়াতে উল্টে শোও
পিঠ পুড়তে থাকে
শেষে তপ্ত শরীর নিয়ে জলে ঝাঁপ দাও
নদীর ঠান্ডা জলে অবগাহন
পায়ে এসে ঠোকর দেয় মাংসাশী মাছেরা
জল কেটে কেটে তীরে এসে ওঠো
আবার গা এলিয়ে শুয়ে পড়ো
ততক্ষণে মন খারাপ রোদে শুকিয়ে ড্রাই ফিশে পরিণত হয়েছে
বাড়ি ফিরে পেঁয়াজ আর সর্ষের তেল দিয়ে
ড্রাই ফিশ রান্না করে খাও
আর ল্যাপটপে চলতে থাকে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ
শরবিদ্ধ ধনেশ
ডানাভাঙা গাঙচিল পড়ে আছি কণ্টকময় উপকূলে। লোনা নয় বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন এক অবর্ণনীয় দশা। দশাকাল প্রাপ্তি হয় কতবার? কতশত বার? মনে থাকে না। মনে গড়ে না । পড়ে পড়ে ঘুমাই অবেলায়। চারদিকে ঘন কুয়াশা। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। ব্রিজের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলে তুমি। একমুখী ব্রিজ। আমিও একমুখী। সূর্যমুখী ফুল ঝোলে চৌকো বারান্দায়। সে ফুলও গন্ধহীন। এজন্যই কি তোমার মনও আজ কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে? হাওয়ায় সে ঝাঁঝালো গন্ধ মিলিয়ে যেতেই উল্টো পথে আবার তুমি। স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। ঝাপসা মতো। করতোয়ার তীর ধরে হাঁটা পথ। সেখানে বারবার রিকশা থামিয়ে আকণ্ঠ পান করো। ঘামে জবজবে ভেজা হয়ে টার্কিশ রুমাল দিয়ে মুখ মুছে ত্রি-চক্রযান। তোমার মুখটা আজ খুব মলিন লাগছে। ইনসমনিয়ার রাত কাটিয়ে সকালের আলো ফুটতেই নেশায় চুরচুর। হঠাৎ রিকশা থামিয়ে হনহন হেঁটে যাচ্ছ কোথায়? চারদিক বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। একরকম দেখতে ঘর সব। ছাদহীন এই ঘর, এখানে নীল পলিথিন মোড়া হয়ে কী করছ তুমি? চোখে-মুখে মলিন একটা ছাপ। কড়া রোদ ঝলসাচ্ছে। এই ঘরে ঘুমাও তুমি। কড়া ঘুম। এই ঘুম আর ভাঙেনি তোমার। কতকাল আজ ব্রিজের মুখে দাঁড়িয়ে। শলাকাদ- হয়ে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাই। জ্বলে পুড়ে নাই হয়ে যাই। এইখানে অশ্বডিম্ব খাড়া রয় সাড়ে বত্রিশ ঘণ্টা। সিজারিয়ান বেবির মস্তিষ্ক ঝোলে শ্বাপদ রাতে। এখানে আমিও ঘুম যাই। যেতে যেতে অজস্র কাল জেগে রই। জেগে জেগে রই মমির খোলসে। অসিরিস কোনো এক লালা গলে এই পারে আসে যায়। ঐ পারে ঘুমাও তুমি। আমরাও বিছানায় কাদা হয়ে নিঁদ যাই। যেতে যেতে কোনো কথা আর বলবার নাই। কথা আর নাই ।
সিকিয়া ঝোরা
১.
বইছে তাজা খুন। নজদের বুকচেরা নির্জনতায়
ভেতরে মরুঝড়, বাইরেটা শান্ত
ছেঁড়া পুস্তক, আজটেকদের মুখোশ।
সিকোয়া ঝোরা তোমার চোখ যেন আমি হই
আর আমার হৃদয় তুমি
একই রাস্তার সন্ধিস্থলে আমাদের যেন দেখা হয়, নির্জনে…
২.
আজ রাতে আকাশে মেঘ
চাঁদের শরীর ধোঁয়ায় ঢাকা
কবরগুলো খুলে যাচ্ছে
পথে কালো বিড়াল
আজ রাত তোমাকে একা করে দিল
তুমিও দিলে নিজেকে
যতই চোখে কাজল মাখ
ধুয়ে যাবে নোনা জলে
আজ রাত কথা বলছে না
তুমিও নীরব
চন্দ্রমল্লিকার গোলাপি শরীর
উষ্ণ ঠোঁটে
বিস্মৃতির মৃত্যু
এখানে অনেক নিকষিত রাত। সবুজ ঘাসের গালিচা, বৃক্ষের কালো শরীর সারি সারি।
তোমরা অনেকে শহরে, অনেকে শহরের বিপরীতে। বৃষ্টির পর্দা ঘরের দেওয়াল।
তোমাদের জিভ টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে, চুল ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মন্দির গাত্রে। তোমাদের কোনো দ্বাররক্ষী নেই, সহবাসের সঙ্গী নেই। তোমাদের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কুড়াল দিয়ে কাটা হয়েছে পায়ের গোড়ালি আর হৃদপিণ্ডে গাঁথা হয়েছে বিষাক্ত কাঁটা। এসব নিয়েও তুমি ঘুমিয়ে আছ। স্বপ্নে জয়তুন ফল, মরুভূমির গরম বালুতে পড়ন্ত বেলার ছায়া, একঝাঁক সোনালি ডানার চিল। তোমার মনে গায়ত্রীমন্ত্র, প্রজাপতি দেবতা। এখানে অনেক সোনাঝুরি, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, কলাগাছ সারি সারি।
প্রেমিকের চোখে অগাধ জলরাশি।
শ্যাওলার আস্তরণ সরিয়ে সরিয়ে তোমাকে খুঁজে নিচ্ছে সারসের ঠোঁট, কোমল স্তনে এঁকে দিচ্ছে
প্রস্তরের ছাপ।
এখানে অনেক নীল জল, ফুলের পাপড়ি। বিস্মৃতির মৃত্যু তোমার শরীরে শরীরে। এখানে অনেক নিকষিত রাত অপেক্ষায় ভোর হবে বলে।
ফটোগ্রাফের চোখে জল
ফটোগ্রাফে ধুলো জমে গেছে
বাইরে মুষল বৃষ্টি
হাসপাতালের করিডোরে মানিপ্ল্যান্ট, পাম ট্রি সারি সারি
এখানে একদিন বহু লোক ছিল, লোকালয় ছিল
গ্রাম, কচুরিভরা বিল, তিতপুটি, রয়না
আজ সব চিহ্ন মুছে গেছে
বড় বড় স্কাইস্ক্র্যাপারের ভিড়ে
তোমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে
এক বিন্দু অমিয়জল তোমার চোখে
রাতের পর রাত কেটেছে বুড়িগঙ্গার অবগাহনে
বড় বড় জাহাজ, গয়না নৌকা
কলকাতাগামী প্যাসেঞ্জার, হিন্দি, উর্দু, মারাঠি, বাংলা
কত তাদের মুখের বুলি
কেউ হিসাব রাখতে পারে না
একটার বুকে অন্যটি জমে
একটার শরীরে অন্যটির গন্ধ
ভাষা কি কোনোদিন একটা ছিল?
মানুষ?
কে তারে বানাইছে বন্ধনী চিহ্ন দিয়ে?
ঘেরাটোপ দেওয়া ঘরে কেউ কি কোনোদিন আটকা ছিল?
এই সব তোমাদের নতুন কথা
যত জাত বাড়ে তত ভাঙন
ঠিক তোমার কলজেটা কয়েকশো টুকরা হয়ে গেছে
একটা ভো চিৎকার দিয়ে তুমি চলে গেলে
তারপর ধু ধু প্রান্তর
হীরক রাজা-রানী কথা কয়
হীরকের দেশে ফলে অকালকুষ্মাণ্ড
তারই উজানে সাঁতরে বেড়ায় কোটি কোটি নতুন ফানুস
একতারা, দোতারা সাতটি তারা বাঁধা বাটাধারী শরীর
তুমি তাকে মুখে নিয়ে জেগে থাকো অনন্ত রাত
তোমার শরীরে উল্কি, মাটির গন্ধ
সময় বয়ে যায়
সেতারের গায়ে ধুলো জমে
স্কাইস্ক্র্যাপারের গায়ে ধুলো জমে
মানুষের গায়ে ধুলো জমে
ধুলো সরিয়ে তুলে নাও
এক একটা স্থলপদ্ম, সোনামুখী সুঁই
ফটোগ্রাফ চোখে তাকিয়ে থাকে
নিরন্তর ডুব সাঁতার
গয়নার বিলে মেহগনির কালো শরীর
ফটোগ্রাফের চোখে জল
কালো কাক
কাক এক শাশ্বত পাখি
তার কালো রেশম শরীরে
গাঁথা আছে কালের নীরবতা
যে সকল ধ্বংস ও হত্যা
ঘৃণা ও ভালবাসা
প্রতিটি পাতার মনে
প্রতিটি রাতের আঁধারে
সব লিখে রাখা আর্কোটাইপে
কাকের কালো শরীর সব শুষে নিয়েছে
একজন কালের সাক্ষী
তাকে তোমরা অবজ্ঞা করছো
ধুর ছাই বলে তাড়াচ্ছো
সভ্যতা একেই বলে
কালো কাক তবু নির্জনে
বয়ে নিয়ে চলেছে
ধূসর আর সবুজের বার্তা
জলে ডোবা চাঁদ
১
গোধূলি ম্লান হয়ে আসছে
ইঁদুরেরা গর্তে লুকালো
সব পাখি, সরীসৃপ
বাড়িতে বাড়িতে বিজলি বাতি
চাঁদ আজ আকাশ জুড়ে
ছাদের ব্যালকনিতে নয়নতারা
তোমার মন আজ বিষন্ন
চায়ে ডুবিয়ে নোনতা বিস্কুট
খাঁচার পাখিরা কিচির-মিচির ডাকছে
চাঁদ ডুবে গেলো
জলে ডোবা চাঁদ
রাতের দ্বিপ্রহর শুরু হলো
গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঘন্টা বাজছে
২
চাঁদ ডুবে গেলো
কুয়োর জলে ডোবা চাঁদ
কত দিন নদীতে যাই না
পাহাড়ে সমুদ্রে
একটা প্রস্তরখণ্ড ভেসে যাচ্ছে বাতাসে
বাতাস এখানে ভারি
শিউলির কমলা ঠোঁট
ঝরে পড়ছে চাতালের ওপারে
চাঁদ আজ ডুবে গেলো
তুমি ছুঁতে পারলে না আজকের চাঁদ
পুরানো দিনের মতো
পুরানো দিনের মতো চারপাশ
একটা কাঁচের পর্দা সরে গেলো
বরফে আচ্ছাদিত পর্দা
মন্দিরে ঘন্টা বাজছে
এক ঝাঁক সারস ডানা মেলছে
জায়গাটা তোমার চেনা
কিন্তু সব যেন বদলে গেছে
রাস্তায় সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে
একদল লোক ঠেলাঠেলি করে নিয়ে যাচ্ছে হাবলের টেলিস্কোপ
লালন সাঁইয়ের মতো দেখতে একজন পাশ দিয়ে চলে গেল
একটা সাদা ফুলের তীব্র গন্ধ
কামিনী নাকি হাস্নাহেনা?
এখানে তো অসংখ্য রক্তজবা
কোথাও কি একটা বেদনা লুকিয়ে আছে?
কোথাও কি মিলনের আকাঙ্ক্ষা?
সব সরে সরে যাচ্ছে
ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে সমস্ত আকাশ
তুমি হেঁটে চলেছ কুয়াশা ভেদ করে
বরফ দিয়ে ঘেরা পর্দা
সব ভেঙে পড়েছে মাথার উপরে
এখানে কোনো ছাদ নেই
ধু ধু মরীচিকা
ওপারে যাবার অদৃশ্য সেতু এক
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। প্রকাশিত কবিতার বই ছয়টি, গল্পগ্রন্থ দুইটি, একটি নভেলা সংকলন। এছাড়া পিয়াস মজিদের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর’ (অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। তিনি কিছুদিন নৃবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েব ম্যাগাজিন, জার্নাল ও দৈনিক পত্রিকায় লেখেন।