শুক্রবার, নভেম্বর ২২

নির্বাচিত দশ কবিতা : মজনু শাহ

0

জশু


নৃমুণ্ডমালা পরে এতক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছিল যে ঘোড়াটি প্রান্তরে,
তার মুখ থেকে এখন মৃত্যুগন্ধী ফেনা ঝরে পড়ছে।
গ্রামার চুলোয় দিয়ে, এই দৃশ্য দেখে দূর থেকে হেঁকে উঠলাম আমি,
জশু, তুমি বলো, শব্দবন্দি করার আগে আমি কি আবার
খুলে রাখব জড়িনক্সা করা এই আলখাল্লা?
আমার বইগুলো নিশ্চয় একদিন উড়তে উড়তে মিশে যাবে
মহাজাগতিক আবর্জনার সঙ্গে।
পৃথিবীতে পড়ে থাকবে শুধু নষ্ট ঘুম, নষ্ট কলম, আমার নষ্ট আঙুল—


সৌন্দর্যবোধ


সৌন্দর্যবোধ মরে গেলে একেকটা ফুল রাক্ষুসে জ্যামিতির বেশি নয়,
তখন অফুরন্ত পথ সাপের চামড়া দিয়ে মোড়া। কাটা মুণ্ডুগুলো
খেলার ঘুঁটি। চেনা ময়দান, একটা উল্টানো বই। কী বই এটা,
জগদ্বিখ্যাত সব গাড়লের? পাকা আতা ফল পড়ে আছে চতুর্দিকে,
তুমি চতুর লাফিয়ে পার হচ্ছ সেসব, আর সমস্ত পরিচিত মৃতেরা
দীর্ঘতম তোমার এই মার্বেল পাথরের বারান্দায় একে একে এসে বসছে
কারুকাজ করা চেয়ারে।

কোথায় আর যাবে তুমি এমন সূর্যহননের দিনে, এলাচ লবঙ্গ দারুচিনি
নিজ নিজ গন্ধ হারিয়ে হয়ে গেছে অন্যকিছু, এখন ছায়ার মাছ
ছায়ার বাঘ ফুটে উঠবে পথে।


অপর


সমস্ত পাতা হারিয়ে ফেলা কাঠগোলাপ গাছ, কেমন আছ তুমি?
ও আমার অকেজো গ্যাসবেলুন, কেমন আছ? এমন ধুলো-ওড়া স্বপ্ন
এমন কোনো নির্ঝর যেখানে একা বসেছিল ভাষামাধবী, ততদূর এলাম।
আমার বাড়ি নাই আর, আছে শুধু শব্দের হৃদয়! এক অনিশ্চিতের জগত
অসীম ভ্রমে হেঁটে দেখা। কোনো দারুস্পর্শ মৃত্যু আমাকে সৃষ্টি করে চলে,
ভাঙা জানালায় আছড়ে পড়া চাঁদ আজ আমার অপর।


শব্দ


শব্দই অস্তিত্ব তার, বীজ, গর্ভঘুম, মেঘমালা—
কোনো বন্দি বুলবুল যত ধ্বনি তোমাকে পাঠায়
কোনো নটরাজ এই দ্যাবাপৃথিবীর কেন্দ্র ফুঁড়ে
উঠেছে যখন, ভাবো, সব আদি শব্দ মৃত্যুঞ্জয়ী;
গ্রহান্তরে তারা উড়ে যেতে যেতে পাখিদের ভাষা।
অতি ধূসরতা যদি শব্দরঙ মেনে নিতে পার
যদি পুনর্বার চোখ মেলো এই গুহা-শহরের
মধ্যে ঢুকে, শুধু বিচ্ছুরণ, শুধু নৈঃশব্দ্য-প্রণয়,
তুমি তারই অপেক্ষায় বুড়ো হয়ে গেলে বাস্তবিক
হাঁটার দূরত্বে চাইলে ঝর্ণা, কোনো বিখ্যাত নির্বোধ
যেভাবে সংকল্প করে, যে-রূপে সম্ভোগ করে শব্দ;
সেই সুনির্মম পথ অপরূপ নিশিমানুষের।
ঝরাপাতার আসন বেছে নেয় গূঢ় কোনো ভাঁড়
আনারকলির মতো মরে যায় শব্দেরা তখন—


গানহীন পাখিদের ভিড়ে


কমলা রঙের এক ভাষার অধীন তুমি আছ,
এই দগ্ধবনে যত পথ ফিরেছে তোমার দিকে
তারা অন্য কোনো ভাষা, অন্য মাধুর্যের ধূলি মেখে
অনন্তে শায়িত। কবে সাক্ষ্য দেবে চূড়ান্ত নশ্বর
সেইদিকে পেতে রাখা রক্তচোখ বুজে আসে ক্রমে।
দারু, দ্রাক্ষা, দুধ আর বাগর্থের লোভে কোনোদিন
হাঁটি নি তোমার দিকে। গানহীন পাখিদের ভিড়ে
রয়ে গেছি, তবু কোন্ অবসরে আসক্তি জেগেছে
শব্দে, যেন বোবা পার্শ্বচর ভ্রম থেকে উঠে ফের
বেদনার উপযোগী মৃগয়ার স্বপ্নে গেল ডুবে।
তোমার ভাষার বর্ম প্রতিধ্বনিময় পাষাণের
তোমার ভাষার ধূলি ঋষিবিড়ালের সারা গায়ে,
তবু এই দগ্ধবনে এসে দেখো সমস্ত মুকুল
ঝরে পড়ছে মৃত ঘাসে আর আমাদের ইস্তেহারে।


উপক্রমণিকা


A Poem is never finished, only abandoned
—Paul Valery

আজ আমার সকল সৃষ্টিছাড়া পঙক্তির গায়ে বিকেলের ম্লান স্বর্ণচ্ছায়া এসে পড়ুক, কিম্বা তার পাশে জ্বলে উঠুক শুকনো  তার স্তূপ। ব্যাধ ফিরে এসে দেখবে, ছাই উড়ছে শুধু।

কতটুকু সত্য কাছাকাছি আসে আনন্দের? তীর্থ-বিতাড়িতদের বলি, ভাঙা বেহালার মধ্যে আমার সমস্ত পাপ ঠেসে ভরাতে চেয়েছি।

এখন ফিরে আসুক সেইসব পাখিরাও, মৌরিজঙ্গল ছেড়ে, একদিন যারা উড়েছিল সাগরের পথে।

ভয়াবহ স্তব্ধ কোনো রাতে, জেনেছ, প্রতিটি চুম্বনের পর, এই কুহকী অস্তিত্বের ভার কিছুটা কমে আসে। ঝুটিওয়ালা মোরগ আর বীণা—এই ছিল আমাদের অন্তিম সম্পদ।

কেন তবে হারিয়ে যাও জেব্রাদের উন্মাদ-দৌড় শুরু হলে! একটু দাঁড়াও যদি, দেখতে পাবে, মৃত পাতা মৃত ফুল ছড়ানো পথের কিনারে, ভোরবেলা দীর্ঘ কোনো গাছের গা বেয়ে কীভাবে একটি নিঃসঙ্গ শিশির মিশে যায় মৃত্তিকায়, ধীরে।

দেখ আরও, আমাদের জলপাইগাছে মাঝে মাঝে কিছু অচেনা পাখি এসে বসে, যাদের সহস্র বছর আগে বা পরের দার্শনিক বলে ভ্রম হয়।


আমার ভাষা


আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়, জেব্রা যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা করে। বহু খুঁজে, পেয়েছি পেজমার্কার, একটি উজ্জ্বল বিয়োগচিহ্ন আর ডালিম ফুলের ছায়া। বন্ধ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে, লিখতে শুরু করি। একদিকে অসানোগ্রাফির ক্লাশ, অন্যদিকে তোমার সঙ্গে সাঁতার কাটার ইচ্ছে। তাসের ঘরে এলেই প্রশ্ন করো, আমি কি তুলোরাশির জাতক? ঘর অন্ধকার করে শুধাই, তুমি কি কাননবালা? প্রশ্নেরা আজ হাসির কারাগার যেন। তোমার শরীর থেকে তখন ঘাসের গন্ধ আসে। জানালা খুলে দেই অতঃপর শান্ত হাতে। পাখিবাজার থেকে ফেরে লাঞ্ছিত লোকজন, নক্ষত্রের আলো আসে আমাদের তাসের ঘরে।


দাম্পত্য


যখন তুমি মেয়েমানুষ থেকে দূরে আছ, পড়তে পার চিহ্নবিজ্ঞান, চাঁদের নিচে ডিগবাজি খেতে পার কিছুক্ষণ বা বানাতে পার চাবুক। আসলে তোমার জন্যে কোথাও অপেক্ষা করে আছে কাঠবেড়ালি, তার বগলে এ বছরের রাশিফলের বই, আর অন্য হাতে সেক্স-পিস্তল।

যখন তুমি পুরুষমানুষ থেকে দূরে আছ, খাও যত ইচ্ছে পপকর্ণ, নিজের ভয়ংকর গোপন কথাগুলো নিজেকেই আরেকবার শোনাও ফিসফিস করে। একখানা জ্যান্ত কবিতার বই সঙ্গে রেখ, তোমার দিকে এগিয়ে আসা বিচ্ছুগুলো পিটিয়ে মারার জন্য ওটা লাগবে। খবরদার, ভুলেও বেড়াল কোলে নিও না, যা দিনকাল পড়েছে, স্তনে আঁচড় দেবার ঘটনা গত পরশুও ঘটেছে ভূতের গলিতে। এ সময় ইউক্লিডের উপপাদ্যগুলো মনে আছে কিনা, সেটা আঙুল দিয়ে লিখে দেখতে পার বালিতে।


ভুতুড়ে মাঠে


আবার এসেছি সেই ভুতুড়ে মাঠে। কিছুক্ষণ বসব।
আমের মুকুল ঝরেছে অনেক। গাধার পিঠে যিনি এখন মাঠ
পেরোলেন, উনি যিশুর সাঙ্গাত নন। তার পিছে খুব নিস্পৃহ ভঙ্গিতে
হেঁটে গেল এক অচেনা বৌদ্ধ শ্রমণ। আমি তার ভিক্ষাপাত্র
হতে পারতাম। বা তাকে অনুসরণ করা কোনো পাখি।
কারো গানহারা এক পাখি হতে পারতাম যদি সন্ধেবেলা!
দশ পাল্লা ঘুম জেগে উঠছে আমার ভিতরে।


বুদ্ধুরাম


তুমি কোন‌ কাননের বুদ্ধুরাম, গোলাপব্যাখ্যার কেরানি!
আকাশপথে যেতে যেতে ব্রাহ্মণী কাইট তোমাকে ভ্রুকুটি করে,
এখানে সবাই সবাইকে মিথ্যে বলছে ড্যাম স্মার্ট ভঙ্গিতে;
তুমিও বলো দু-একটা সত্যবিভ্রম যখন ঘূর্ণি ওঠে আর
উইন্ডমিলের ডানা খুলে পড়ে বিহ্বল কাশবনে।
দেখো হে বুদ্ধুরাম, উল্টোপিঠে চাঁদ লুকিয়ে ফেলে একরত্তি মেঘ
কী ভীষণ ধারালো, খড়ের বিছানায় শুয়ে আলস্যময় কাটিয়েছ সারাদিন
এখন একবার চুপি চুপি দেখে এসো নটীর পুজো—
ভয়-মেশানো সিঁড়ি, পাষাণ আর মায়াচুর পথ তোমাকে ডাকে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম : ২৬ মার্চ ১৯৭০। প্রকাশিত কবিতার বই : ‘আনকা মেঘের জীবনী’ (১৯৯৯), ‘লীলাচূর্ণ’ (২০০৫), ‘মধু ও মশলার বনে’ ( ২০০৬), ‘জেব্রামাস্টার’ (২০১১), ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’ (২০১৪), ‘আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া’ (২০১৫) এবং ‘বাল্মীকির কুটির’ (২০১৮)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।