পাওলির বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি কি একুশ হবে। গায়ের রঙ চাপা। খাড়া নাক। লম্বাটে চেহারা। চোখ দুটো বড় বড়। দেখলেই মনে হয় সব কিছুতেই অবাক সে। পাওলি নামটি তার বন্ধুদের দেওয়া। ভারতীয় অভিনেত্রী পাওলি দামের সঙ্গে নাকি তার বেশ মিল। পাওলির বাবা-মায়ের দেওয়া নাম বাসন্তী। কলকাতার পাওলি যে বছর শরীর দেখালো, সেই থেকে বাসন্তী হয়ে গেল পাওলি। বাসন্তী গেল মুছে। পথের মানুষের কাছে এখন সে ওই নামেই পরিচিত।
ওর আসল ঠিকানা কেউ জানে না। কোথা থেকে এসেছে, কোথায় ঘরবাড়ি— জানা নেই কারো। পাওলি নিজেও বলে না কাউকে। তবে, ও যখন নতুন এলো পথে, হাবভাব দেখে মনে হতো সম্ভ্রান্ত না হলেও ভালো কোনো ঘরের মেয়ে। অসৎ সঙ্গে বখে গেছে হয়তো। কিংবা অন্য কিছু। বিধিবিড়ম্বনায় অনেকের মতো আজ তার ঠাঁই হয়েছে পথে। পথে যারা থাকে কেউ কারো পরিচয় নিয়ে গা করে না। এসবে কোনো আগ্রহ নেই ওদের। দেখলে মনে হবে, বিধাতা ওদের পাঠিয়েছেন এই পথেই। অনিকেত করে। এসব নিয়ে ওদের কোনো আক্ষেপ নেই। পথই ওদের ঘরবাড়ি।
পাওলির ঠিকানা এখন শহরের ফুটওভার ব্রিজ। আজ বনানী তো কাল মহাখালী। পরশু ফার্মগেট, তারপর দিন পরীবাগ। এভাবেই ভবঘুরের মতো দিন কাটে তার। যাদের সঙ্গে তার দিন-রাত যাপন, সেই সঙ্গীরাও একই। ভেসে চলা জীবন।
পাওলিকে প্রথম দেখায় পাগলী বলে মনে করবে যে কেউ। পাগলীদের মতোই তার চলাফেরা, ওঠাবসা। ময়লায় কালো হয়ে যাওয়া হলদে সালোয়ার আর নীল কামিজ দেখলে মনে হবে কত যুগ ধরে পানি গড়ায়নি শরীরটাতে। চুলগুলো হয়ে আছে রুক্ষ তামাটে। তামার তারের মতো খাড়া থাকে সব সময়। মুখটা উজ্জ্বল ছিল বোঝা যায়। কালচে রঙ ধরেছে ধুলোর পরত জমে। ঠোঁটগুলো সিগারেটের ধোঁয়ায় পুড়ে কয়লা। এই বয়সে একটি মেয়ের শরীরে যে রমনীয়তা স্পষ্ট হয় পাওলির বেলায় তা বুঝি একটু বেশিই। বুকজোড়া কামিজ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার জো। উপরের পেট সিঁধিয়ে আছে পিঠের সাথে। তলপেটটা টোপলার মতো। জামার নিচে বালিশ গুঁজে রাখলে যেমন দেখায়। কামিজের বাঁ হাতাটা খাটো হয়ে গেছে ছিঁড়ে। তাতে বাহুর যেটুকু বেরিয়ে আছে, পেলব। পা দুটো ছিঁপছিঁপে। ধূলিবসনের আড়ালে ম্লান-কোমল দেহ চোখ এড়াবে না কারো।
পরীবাগের ফুটওভার ব্রিজের একপাশে লম্বা হয়ে প্রায়ই শুয়ে থাকতে দেখা যায় পাওলিকে। কখনো চাদরে পা-মাথা ঢেকে। কখনো সাপের মতো পড়ে থাকে কুন্ডুলি পাকিয়ে। আবার ভবঘুরে ছোকড়াগুলোর গোল আসনের মাঝে বৃন্তের মতো বসে থাকে পাওলি। একটা সিগারেট সবার হাত হয়ে ঘুরে ঘুরে শেষ হয় পাওলির ঠোঁটে। গাঁজাই চলে বেশি। গাঁজায় দম দিয়ে পুষে রাখে ধোঁয়া। নিমাই সাধনা। একে একে ঘিরে থাকা ছেলেগুলোর মুখে ধোঁয়া ছাড়ে পাওলি। ওরাও অমৃতের মতো তা শুষে নেয় ফুসফুসে। ফুসফুসে ধোয়া পুষে রেখে ধীরে ধীরে উগড়ে দেওয়াকে ওরা বলে নিমাই।
পাওলির ধোয়া শুষে নেওয়া, এ এক অন্যরকম খেলা ছোকড়াগুলোর কাছে। সিদ্ধির শলাকা ফুরালেও খেলা ফুরায় না। নেশায় বুদ ছেলেগুলো তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে টলতে টলতে চিমটি কাটে পাওলির শরীরে। শরীরটাকে আগুনের মতো ছুঁয়ে দেয় আচমকা। চোখ বুজে মুণি-ঋষির মতো ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকে পাওলি।
পাওলির ধোয়া শুষে নেওয়া, এ এক অন্যরকম খেলা ছোকড়াগুলোর কাছে। সিদ্ধির শলাকা ফুরালেও খেলা ফুরায় না। নেশায় বুদ ছেলেগুলো তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে টলতে টলতে চিমটি কাটে পাওলির শরীরে। শরীরটাকে আগুনের মতো ছুঁয়ে দেয় আচমকা। চোখ বুজে মুণি-ঋষির মতো ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকে পাওলি।
গালসিতে প্যাকপ্যাকে ঘা, হাতে পায়ে ঘা, নোংরা, ময়লামলিন বসনের ছেলেগুলো নেকড়ের মতো হামলে পড়ে একে অন্যের উপর। ছিনিয়ে নেয় শিকার। চোখ বুঝে থাকে পাওলি। ওদিকে চলতে থাকে নেকড়ে-শিকারি খেলা। পাওলি তার কিছুই দেখতে পায় না। চায়ও না দেখতে। নেকড়েগুলো সবই একই চরিত্রের। জাপটে ধরে কব্জা করে শিকারকে।
লাল চোখ দুটো মেলে তাকায় মাঝেসাজে। নিঃশব্দে শাসায় ছোকড়াগুলোকে। এতে যেন আরও লাই পায় তারা। আরও বেশি বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরে পাওলিকে। চুমো খায়। ছিনিয়ে নেয় একজন থেকে আরেকজন। কনুই দিয়ে আঘাত করে পাওলি। কাইকুই শব্দ করে। প্রতিবাদ জানায়। কাজ হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রচ্ছন্ন আনন্দে শব্দ করছে পাওলি। জোরালো প্রতিবাদ করছে না।
এর থেকে ওর বুকে, ওর থেকে এর বুকে লেপ্টে থাকে পাওলি। গালসিতে প্যাকপ্যাকে ঘা, হাতে পায়ে ঘা, নোংরা, ময়লামলিন বসনের ছেলেগুলো নেকড়ের মতো হামলে পড়ে একে অন্যের উপর। ছিনিয়ে নেয় শিকার। চোখ বুঝে থাকে পাওলি। ওদিকে চলতে থাকে নেকড়ে-শিকারি খেলা। পাওলি তার কিছুই দেখতে পায় না। চায়ও না দেখতে। নেকড়েগুলো সবই একই চরিত্রের। জাপটে ধরে কব্জা করে শিকারকে। হাত থেকে ফসকে গেলে দৌড়ে ধরে অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ে ফ্লাইওভারের সংসার। নিচ থেকে মানুষগুলো দেখে উৎসুক চোখে। কিছুই নেই। এটি সম্ভবত শহরের উঁচু ব্রিজ। তার ওপর নানান ব্যানার, ফেস্টুনে মোড়া থাকে দুই পাশ। নিচ থেকে তাকালে দেখা যায় না তেমন কিছু।
উপর দিয়ে যাদের যাতায়াত তারা আঁড়চোখে এসব দেখতে দেখতে পার হয়ে যান সোজা। নেশায় বুদ এই ছেলেগুলো সুযোগ পেলে ছিনতাইও করে। চকচকে ব্লেড কিংবা চাকু ধরে হাতিয়ে নেয় সব। শিরায় মাদকসেবীদের ছিনতাইয়ের অস্ত্র ব্যবহৃত সিরিঞ্জ। এদের কেউ বয়ে বেড়াচ্ছে এইডস, সিফিলিসসহ ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি। সিরিঞ্জের ঘাঁই খাওয়ার আগেই পকেট উজাড় করে নিরূপায় পথচারীরা। কেউ আবার দৌড়ে পালায়। গোড়ালি কিংবা হাঁটুর নিচের পেশিতে হাড় বের করা দগদগে ঘাঁয়ে দিনরাত পোড়া তেল মেখে ভিক্ষা করে এদের দুর্বলরা। দেখলে গা শিউরে ওঠে যে কারো। চামড়ার পর চর্বি, তারপর সাদা পর্দা, লাল মাংস তারপর হাড়। দেখা যায় পরতে পরতে পরতে পরতে। নীল মাছিগুলো ভোঁ ভোঁ করে এর পাশে। সুযোগ পেলে শুষে নেয় ঘাঁয়ে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা পুঁজ। একটু কেটে যাওয়া জায়গায় পানি লাগলে যেখানে স্বাভাবিক মানুষের প্রাণওষ্ঠাগত হয়, সেখানে এমন ক্যাতক্যাতে ঘাঁ নিয়ে এরা দিনের পর দিন কীভাবে বেঁচে থাকে তা বড় বিস্ময়ের।
ওভারব্রিজ দিয়ে যাতায়াতকারীদের সামনেই চলে পাওলি আর তার বন্ধুদের নেকড়ে-শিকারি খেলা। এসব দেখতে দেখতে চোখ সওয়া হয়ে গেছে মানুষেরও। পরীবাগ ব্রিজের দুপাশে ৯৮টি সিড়ি ভেঙে ওঠানামায় ক্লান্ত মানুষের কেউ কেউ দম নেয় দাঁড়িয়ে। এসব খেলা তাদের চোখ এড়ায় না। ছি! ছি! করতে করতে নেমে যায় তারা। কেউ ‘হেট, হেট’ করে ধমকে ওঠে। কিন্তু এসবে পাওলিদের কিছু আসে-যায় বলে মনে হয় না।
০২.
বিল্লা, রানা, রতন। বয়সে তিনজনই কাছাকাছি। ত্রিশের কোটায়। ক্ষয়েক্ষুয়ে যা দাঁড়িয়েছে তাতে শরীরের কাঠামোও এক। গালদুটো ভেঙে ঢুকে গেছে প্রায় ভেতরে। বিল্লার কদবেলের মতো গোল মুখ। বালুতে ভরাট কোনো মাঠে যেমন গুচ্ছ ঘাস জন্মায়, তার গালের এখানে সেখানে তেমন গুচ্ছ দাড়ি। গোঁফগুলো সজারুর কাটার মতো খাড়া খাড়া। রতনের না গোল, না লম্বা মুখ ভর্তি দাড়ি। গোঁফে-দাড়িতে ঢাকা মুখ। রানার লম্বাটে মুখটায় দাড়ি গোঁফের কোনো বালাই নেই। কোথাও হালকা পশম সোনালী আভার মতো। সবাই ডাকে রানা মাকুন্দা। চুলগুলো উসকো-খুসকো। নেশায় সারাক্ষণ বুদ হয়ে থাকা এই তরুণদের চোখ দুটি সব সময় লালচে হলুদ। মণি দুটো যেন সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসবে কোঠর থেকে।
ময়লা টি-শার্ট শরীরটাকে আড়াল করলেও হাড় জিরজিরে ভাবটা ঠিকই ফুঁটে ওঠে। হাত-পাগুলো লিকলিকে। কারো পরনে ময়লা, ছেঁড়া ট্রাউজার, কারো পরনে লুঙ্গি। ছোপ ছোপ দাগ আর ময়লায় কালো। এই তিন তরুণকে পাশাপাশি দাঁড় করালে কখনো কখনো একই রকম মনে হয়। বিল্লাকে তফাত করা যায় ডান গাল আর জুলফির মাঝামাঝি তেলতেলে কাটা চিহ্নে। একবার কোন এক সেলুনের কারিগরের বুকপকেটে থাবা দিয়ে চেয়েছিল পালাতে। নাপিত দৌড়ে ধরে ঘ্যাচাং করে খুর চালিয়ে দিয়েছিল গালে। সেই থেকে ছিনতাই করতে গেলেই ওর মনে পড়ে যায় সেই খুরে কাটা কাঁচা ক্ষতের কথা। তখন আর সাহস হয় না।
রানা, বিল্লা, রতনের মধ্যে আরেকটা মিল আছে। তারা তিনজনই পছন্দ করে পাওলিকে। পাওলির বন্ধু বলতে ওরাই। তিন ভবঘুরে তরুণ। চাকের আশেপাশে মৌমাছি যেমন উড়ে বেড়ায়, ডানা না থাকলেও এদের অবস্থাও তাই। রানা-পাওলিরা পৃথিবীগ্রহে বাস করলেও কল্পনায় পড়ে থাকে নেশার গ্রহে।
রানা, বিল্লা, রতনের মধ্যে আরেকটা মিল আছে। তারা তিনজনই পছন্দ করে পাওলিকে। পাওলির বন্ধু বলতে ওরাই। তিন ভবঘুরে তরুণ। চাকের আশেপাশে মৌমাছি যেমন উড়ে বেড়ায়, ডানা না থাকলেও এদের অবস্থাও তাই। রানা-পাওলিরা পৃথিবীগ্রহে বাস করলেও কল্পনায় পড়ে থাকে নেশার গ্রহে। নেশার জন্য কখনো তারা টোকাই, কখনো ছিনতাইকারী, কখনো ছিঁচকে চোর। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলেও এরা কারো কাছে হাত পাতে না। কেবল নেশায় গলা চুলকালে, মুখে নোনাজল এলে, মুখ তেঁতো হয়ে গেলে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ে। আর কিছু না পারলে ভিক্ষা করে পথের পাশে।
‘স্যার ভাত খামু। কয়ডা টেকা দেন, ও স্যার, স্যার।’
মরা মাছের মতো ঘোলাটে চোখ দুটো দেখে কারো বোঝার বাকি থাকে না, এদের কীসের ক্ষুধা। তারপরও দু-একজনের দয়া হয় না, তা না। গালসি বেয়ে লালা ঝরা মুখটার দিকে তাকিয়ে বের করে দেন পাঁচ-দশ টাকা। সেই দানের পয়সায় ওদের নেশার মান কোনোমতে রক্ষে হয়।
ইদানীং মানিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে বিল্লার। ওরা বলে ঘাঁও মানিক। বাঁ-পায়ের হাঁটুর নিচে এক বিঘত ঘাঁ। গামছা দিয়ে ঢেকে রাখা। পা ফুলে কোলবালিশ। দেখতে বিরাট মুগুরের মতো। ভবঘুরেদের মধ্যে মানিক নামে আরও একটা ছেলে আছে। দুই মানিককে আলাদা করে চিনতে একজনকে ওরা ডাকে ঘাঁও মানিক, আরেকজন ট্যারা মানিক। দ্বিতীয় মানিকের ডান চোখটা ট্যারা।
ভবঘুরে তল্লাটে ঘাঁও মানিকের আয়-ইনকাম ভালো। অন্যদের চেয়ে নেশাও করে বেশি। ট্যারে সব সময় সুই থাকে। গাজা-তামাক তার হাতের ময়লা। পায়ের ক্যাতক্যাতে ঘাঁ দেখিয়ে দিনে একবেলা ভিক্ষা করলে দুবেলা নেশা করতে পারে রাজার হালে। মানিক বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ঘেঁষা আজিজে যাওয়ার রাস্তাটায় ভিক্ষা করতে বসলে বিল্লাও বসে তার পাশে। মানিকের কিছু বলতে হয় না। বিল্লাই বলে।
‘স্যার আমার ভাইটারে চিকিস্সা করামু, কয়ডা টেকা দেন স্যার। দেখেন স্যার, আমরা ভাইটার পা পইচ্যা যাইতাছে, দেখেন স্যার, চিকিস্সা করামু স্যার, ও স্যার…।’
বিল্লার মাঝে মাঝে আপসোস হয়, তারও যদি এমন একটা পুঁজ গড়ানো স্যাতস্যাতে ঘাঁ থাকত! তাহলে আয়-ইনকাম খারাপ হতো না। তখন মানিকের সঙ্গে থাকত না। বসতে পারতো একাই। নেশা করতে ঘাঁও মানিকের দয়ায় দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। কিন্তু সাহসে কুলায় না। ভালো শরীর কেটেকুটে এমন ঘাঁ বানানো তো সহজ কম্ম নয়!
০৩.
পাওলিটা আজকাল খুব বেশি এদিক-সেদিক যায় না। রাতদিন পরে থাকে পরীবাগ ব্রিজের ওপর। বিল্লা ব্যস্ত মানিকের সঙ্গে। সারাদিন ওর সঙ্গে থাকলে একবেলা আধপেটা ভাত, কখনো কলারুটি জোটে। আর সন্ধ্যায় নেশার একটা ভালো বন্দোবস্ত হয়। বিল্লা তাতেই খুশি। রতন ঘুরে বেড়ায় কারওয়ান বাজার দিয়ে। ঘুরঘুর করে ফলের আড়তের আশেপাশে। ফেলে দেওয়া আধাপঁচা ফল কুড়ায়। দুপুর রোদে ক্লান্ত সবার মতো বিশ্রাম নেয় রতনও। আড়তের ছাউনির নিচে। বস্তাগুলোর স্তুপের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকে। আদতে বিশ্রাম একটা ছুঁতো। সেলুনের মেঝে থেকে কুড়িয়ে আনা ব্লেডটা সুযোগ বুঝে বস্তার তলায় চালালে হরহর করে গড়িয়ে আসে চালতা, বেল আর আমড়া, পেয়ারা। সেগুলো নিজের ঝোলায় ভরে নিয়ে কেটে পড়ে। তার বান্ধা কাস্টমার আছে। কারওয়ান বাজারেই। ভ্যানে করে যারা কেটে আমড়া, পেয়ারা বিক্রি করে তারাই তার কাস্টমার। কেবল ইধারকা মাল ওধার করতে পারলেই নগদ টাকা। সেই টাকার অর্ধেক দিয়ে জনতা টাওয়ারের সামনের খসরু কাকার দোকান থেকে এক প্লেট ভাত, আলুভর্তা আর পাতলা ডালে ঠা-া হয় পেটের ছুঁচোটা। বাকি অর্ধেক টাকা নিয়ে আড়তের ওপাশে রেললাইনের ধারে ঝুঁপড়িগুলোর দুয়ারে গেলেই মিলে যায় মেওয়া। মইরম খালার সঙ্গে তার বেশ খাতির। খালার তামাকটা ভালো। উদুম নেশা হয়। পোটলায় দাম বেশি নয়ে পাঁচ টাকা। তাতেও সমস্যা নেই। দুটি স্টিক ফুল হয়, একটা হয় হাফ। সারাদিনের আহার। দুটি একসঙ্গে সাবার করে রতন পরে পরে ঘুমায়। পরনের লুঙ্গিটা বাতাসে মাথার কাছে উঠলেও টের পাওয়া যায় না। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। আরাম হয়।
বিল্লা, রতন যে যার মতো ঘুরে বেড়ায়। রানা আর কোথাও যায় না। পরে থাকে পাওলির আশেপাশে। ঘুমের ভান করে। পাওলি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে সুযোগ নেয় রানা। চাদরের নিচে হাত রাখে পাওলির বুকে। কখনো সেই হাত পিঁপড়ের মতো বেয়ে বেড়ায় সারা শরীরে। সুরসুরি লাগলে মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ঝামটা দিয়ে ওঠে পাওলি। ‘যাহ্! সর এইখানথে।’ পিঁপড়ে-হাতটাকে ঢলে দিতে মনে চায়। হাতটা ধরেও। তাকায় হালকা চোখ মেলে। গালসিটা ঝুলিয়ে দেয় রানা। কাতর ভঙ্গিতে চেষ্টা করে হাসতে। যা বোঝার বুঝে নেয় পাওলি। তারপর পিঁপড়েটাকে আর ঢলে মারে না। পিঁপড়েটাও আশকারা পেয়ে যা খুশি তাই করে। ওপর থেকে মনে হয় কেমন নড়েচড়ে উঠছে চাদরটা। ঠিক আলাদিনের জাদুর পাটির মতো উড়ে যাবে এখনই। আবার মনে হয় একটা সমুদ্রকে ঢেকে রাখা হয়েছে চাদর দিয়ে। একের পর এক আসছে ঢেউ। আছড়ে পড়ছে তীরে। ঢেউগুলো বেরিয়ে যেতে চাইছে চাদর ফুঁড়ে। সমুদ্রের এই উত্তাল ঢেউয়ের খেলা চলতে থাকে দিনেদুপুরেও। চাদরের নিচে লালচে অন্ধকারে। আশেপাশে কে আছে, কারা আছে, কারা পা চালিয়ে যাচ্ছে— এসবে কোনো তোয়াক্কে নেই সমুদ্রবিলাসীদের কাছে।
০৪.
কতজনের সঙ্গেই শুয়েছে পাওলি। সবার তুলনায় সে একটু বেশিই আশকারা দেয় রানাকে। নেশা-ভানেও পরিমিতবোধ আছে রানার। যে কারণে শরীরের কলকব্জা এখনো মোটামুটি ভালো। রানা কখনো পিঁপড়ের ভূমিকায়, কখনো গাছির ভূমিকায় ভালো যায়। ভালো গাছ বাইতে পারে। তরতর করে উঠে যায়। বাতাবি নেবুর গাছ। কাঠ ঠোঁকরার খোড়ল। এতে এখন বসন্তবাউরির বাসা। সেই বাসায় হাত দিয়ে ধরে আনতে চায় টকটকে লাল সিঁদুরে মুকুট পরা পাখির ছানাটাকে। সে যতই ছানাটাকে ধরতে চায়, ছানাটা তখনই ভেতরে ঢুকে যায়। কুট-উ-রুক, কুট-উ-রুক ডাকে। এতে গাছ আর গাছি দুজনেই পায় অব্যক্ত সুখ।
রানা আর পাওলির সম্পর্কটা নিবিড় হয়ে ওঠে দিন দিন। পাওলির মতো ভবঘুরে তরুণী তো আর কম নেই। একেকটা ফুটওভার ব্রিজে এক বা একাধিক পাওলি আছে। তবু রানার পছন্দ পরীবাগের পাওলিকেই।
রানা আর পাওলির সম্পর্কটা নিবিড় হয়ে ওঠে দিন দিন। পাওলির মতো ভবঘুরে তরুণী তো আর কম নেই। একেকটা ফুটওভার ব্রিজে এক বা একাধিক পাওলি আছে। তবু রানার পছন্দ পরীবাগের পাওলিকেই। পাওলি নিজেও আলাদা চোখে দেখে রানাকে। রানার সঙ্গে মিশে সে যে আনন্দ পায়, অন্য কারো বেলায় তা হয় না। কিন্তু ভবঘুরেদের কোনো বাছবিছার থাকে না। থাকতেও হয় না। পাওলি এ কথা জানে। রানা ছাড়াও মাঝেসাজে আনাড়ি গাছিদেরও হাউশ মেটাতে হয় পাওলিকে। জোরজবস্তিতে নেবু গাছটার অবস্থা তখন যাচ্ছেতাই হয়। নেশায় বুদ পাওলির প্রতিবাদের ভাষা-শক্তি দুটোই দুর্বল হয়ে পড়ে রক্তশূন্যতার রোগীর মতো। রানা ধারে-কাছে থাকলে হুংকার তোলে হিংস্র বাঘের মতো। খিস্তি-খেউর তো আছেই। লড়াই হয় বাঘে হায়নায়। রক্তারক্তি হয়। রাতের অন্ধকারে ছোকড়াগুলো হয়ে ওঠে খুনে স্বভাবের। কাঁপতে থাকে কঠিন ইস্পাতের ফুটওভার ব্রিজ। ঝংকার তোলে ধুপধাপ, টনটন, ঝনঝন শব্দ। কয়েকজোড়া পায়ের উন্মাদনার শব্দে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েই নিচ দিয়ে পথ পার হয়। মেট্রোরেলের কাজের কারণে ঘিরে রাখা আছে রাস্তার বুক। নিচ দিয়ে পথ পার হতে হলে যেতে হয় সাবেক রূপসী বাংলার মোড়ে। রাতবিরাতে একটু বেশি ঘোরা হলেও তাতেই নিরাপদ বোধ করে পথচারিরা। পাছায় উঁচু হয়ে থাকা ওয়ালেট আর পকেটের মুঠোফোনটা রক্ষায় এইটুকু কষ্ট করতে তাদের আপত্তি নেই। পথটা পার হয়ে যাওয়ার পর ফুটওভারের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ছেড়ে অনেকে আবার খিস্তি করে ঝাঁজ মেটায়। ‘শালা বাইনচোদের দল।’
পাওলি উবু হয়ে এমনভাবে বসে আছে যে তার চুলোগুলো বটের লতার মতো মাটিতে ঝুলে আছে। রতন সেই লতায় হাত চালিয়ে পাওলিকে আদর করছিল।
০৫.
হঠাৎ করেই একদিন পাওলিটা উধাও হয়ে গেল পরীবাগের ব্রিজ থেকে। ততদিনে বিল্লাটার ঘাড়ে উঁকি দিয়েছে ছয় ইঞ্চি আয়তনের একটা থকথকে ঘাঁ। এর পেছনে কৃতিত্বটা আসলে রতনের। কারওয়ান বাজারে ফলের বস্তা কাটার ভাঙা ব্লেডের কারিশমা। পাওলিটা উধাও হওয়ার দিন পনেরো আগে একরাতে বেদম নেশা করে বিল্লা, রতন, পাওলি। রানাটা সেদিন ছিল না। কোথাও গিয়েছিল। নেশা যখন সারা শরীরে জেঁকে বসেছে, তখন রতন পাওলিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। পাওলি উবু হয়ে এমনভাবে বসে আছে যে তার চুলোগুলো বটের লতার মতো মাটিতে ঝুলে আছে। রতন সেই লতায় হাত চালিয়ে পাওলিকে আদর করছিল। অদূরেই ছিল বিল্লা। নেশায় তিরিক্ষি হয়ে থাকা মস্তিষ্কে কী হলো কে জানে, টলটলতে উঠে এসে ছিনিয়ে নিতে চাইল পাওলিকে। রতনের কাছে পরাস্থ হয়ে ছিঁটকে পড়ল দূরে। খুলিটা গিয়ে ব্রিজের রেলিংয়ে লাগলে টনাত করে উঠল। আঘাতের জায়গাটায় হাত দিয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বিল্লাটা বেশকিছু সময় মরার মতো পরে রইল সেখানে। রতনের সেদিকে চোখ নেই। সে আছে পাওলিপাড়ায়। একটা পলিমারের আটার বস্তা বিছানো শয্যায় ততক্ষণে মেয়েটিকে বিছিয়ে দিয়েছে রতন। শীতের রাত। কুয়াশায় পথগুলোর মুখে ছিঁপি আঁটার মতো বন্ধ হয়ে আছে। সন্ধ্যায় শাহবাগ মোড়ে কিছু তরুণ একটা মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে কম্বল বিতরণ করছিল। কম্বলের জন্য মানুষগুলো গাড়িটাকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল যে, সাদা রংয়ের মাইক্রোটাকে আর দেখা যাচ্ছিল না। একটা পিঁপড়ে যেভাবে কোনো খাবারকে আকড়ে ধরে তেমন। সেই পিঁপড়ের ভিড় ঠেলে রতন পিঁপড়েও একটা কম্বল কেড়ে নিতে পেরেছিল। কম্বলটা এখন পাওলি আর তার শরীরে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। আস্তে আস্তে যখন সেই উষ্ণতা আরও গভীর হলো, ভেতরের দেহদুটি যখন আরও ঘন হয়ে আসল, এককেজি দুধকে জ্বাল করতে করতে একপোয়া করলে যেমন ননী আর পানিগুলো মিশে একাকার হয়ে যায়— তখন কে যেন হেঁচকা টানে কম্বলটা টেনে সরিয়ে ফেললে ছিঁটকে পড়ল রতন। পরক্ষণে শুয়োরের মতো গোঁৎ গোঁৎ শব্দ করে কোমড়ের ভাঙা ব্লেডটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাগ কাটল বিল্লার ঘাড়ে। বিকট চিৎকারে নাভির নিচে হাত রেখে কুকড়ে যাওয়া পাওলিটা চোখ মেলে তাকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল মাত্র। রক্তে লাল হয়ে গেল পরীবাগ ফুটওভার ব্রিজ। বিল্লার গায়ের জামাটা রক্তে চুপসে গেল। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে একটা সময় পড়ে রইল মরার মতো। ওই রাতেই রতন নিখোঁজ হলো। রতনের সেই ব্লেডের দাগ বিল্লার জন্য সাপেবর হলো এক অর্থে। দিন দশেকের মধ্যে ফুলে ঢোল হলো জায়গাটা। পথচারীদের কারো একজনের দেখে মায়া হয়েছিল। কিনে দিয়েছির কিছু ওষুধপত্তর। ব্যথা কমলেও ক্ষত সাড়েনি। কাটা জায়গাটা পেঁকে গেছে। সেখান থেকে হলদে আঠালো রস গড়ায়। কাঁঠাল গাছের গায়ে চাকু দিয়ে আঁচড় কাটলে যেমন বিন্দু বিন্দু জমে থাকে সাদা আঠা, বিল্লার ঘাঁ-টাও হয়েছে তেমন।
০৬.
বিল্লা এখন আর মানিকের সঙ্গে যায় না। ব্রিজ থেকেও নামে না। নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে মানুষ যেখানে দম নেয়, সেখানে বাঁ ঘাড়টা কাত করে বসে থাকে। মুখে কিছু বলে না। কাঁদে। ব্যথায় কাঁদে, নাকি অসহায়ত্বের কথা মনে করে কাঁদে বোঝা যায় না। পাঁকা ঘাঁ-টা দেখে শরীরে কাঁটা দেবে যে কারো। অস্বস্তিতে রি রি করে শরীর। দয়া হয় মানুষের। দান করে। ঘাঁও মানিকের চেয়ে বিল্লার আয়-ইনকাম ইদানীং বেশ ভালো। তার একটা নতুন সহকারী জুটেছে। ময়না। বয়স খুব বেশি না। চোদ্দ কি পনের হবে। রোগা-পাতলা শরীর। এখনো কৈশোরের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। সে দিনরাত বিল্লার আশেপাশেই থাকে। ও যখন ভিক্ষা করে পাশে বসে থাকে তখন। দিন দিন কেমন অসাড় হয়ে আসছে বিল্লার ডানপাশটা। হাত তুলতে পারে না। কষ্ট হয়। ময়নাটা তার ডানহাতের কাজে আসছে। মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয়। ঘাঁয়ে মাছি বসলে তাড়ায়। ময়নার মুখের দিকে তাকালে মায়া হয় বিল্লার। মেয়েটির আসলেই মায়াময় মুখ। ময়নাকে সে কথা দিয়েছে, ভিক্ষা করে কিছু টাকা জমাতে পারলে চিকিৎসা করে ভালো হবে। বিয়ে করবে তাকে। কথাগুলো শুনে ময়না লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। লজ্জা ঢাকতে হাত বুলিয়ে দেয় বিল্লার অর্ধ-অসাড় পিঠে। ভাবখানা এমন যে, সে তার হবু স্বামীর সেবায় নিয়োজিত। এর চেয়ে আর আনন্দের কী আছে!
০৭.
পাওলিটা কোথায় গেছে কেউ জানে না। কেউ জানার চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয় না। কেবল রানা ছাড়া। পাওলি উধাওয়ের পর থেকে কেমন উন্মাদের মতো হয়ে গেছে রানা। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে পাগলের মতো চেয়ে থাকে পথের দিকে। একটার পর একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যায়। পাওলিকে খোঁজে রানা। পায় না। ঢাকার প্রতিটি ফুটওভার ব্রিজে খুঁজে খুঁজে হয়রান সে। সেই বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত হয়ে বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, তেজগাঁও, বাংলামোটর, মিরপুর—খুঁজতে বাকি রাখেনি কোথাও। এখন দিনরাত পরে থাকে পরীবাগে। কখনো নেশা করে, কখনো নেশা ছাড়াই। উসকো-খুসকো চুলের ফাঁকে ফাঁকে ময়লা-ধুলোর আস্তর পড়েছে। রানা শুয়ে শুয়ে কাঁদে। বিল্লা আছে ময়নাকে নিয়ে। ওরা কিছু খেলে রানাকে ডেকে নেয়। নেশা করলেও ভাগ দেয়। ওটুকুই। পাওলির নিরুদ্দেশের কারণে রানার যে এই অবস্থা, তার কিছুটা আঁচ করতে পারে বিল্লা। মশকরার ঢঙে সে পাওলির কথা তোলে। ‘কীরে ব্যাটা পাওলির দেওয়ানা! পাইলি খুঁইজা?’
পাওলিটা কোথায় গেছে কেউ জানে না। কেউ জানার চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয় না। কেবল রানা ছাড়া। পাওলি উধাওয়ের পর থেকে কেমন উন্মাদের মতো হয়ে গেছে রানা। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে পাগলের মতো চেয়ে থাকে পথের দিকে। একটার পর একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যায়। পাওলিকে খোঁজে রানা। পায় না।
রানা উত্তর দেয় না। মাথা নাড়ে ডানা-বাঁয়ে।
‘কই কই খুঁজলি যে পাইলি না?’
রানা অসহায় ভঙ্গিতে তাকায়।
‘সত্যি কইরা কতো তুই কি পাওলির ভাতার?’
‘কথা ঠিক কইরা ক বিল্লা। ক্যান ভাতার হইলে তর কী সমস্যা?’ রানা এবার মুখ খোলে।
খিলখিল করে হেসে ওঠে বিল্লা। ‘দ্যাখ গিয়া রতন হালারপুতের লগে ভাগছে।’ পরক্ষণে রাগে চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে ওর। ‘ওই চোদনার ছায়া যদি একবার পাই—’।
রতনের কোনো খোঁজ আজও মেলেনি। একদিন নাকি ওকে কে দেখেছে শাহবাগে। কাঁধে টোকাইয়ের ঝোলা। পথের ধার দিয়ে সিগারেটের খোল, পেপসি, সেভেনআপের বোতল কুড়াচ্ছে। কখনো কারো ফেলে দেওয়া খাবারের অংশ তুলে নিয়ে ঝেরেঝুরে দিচ্ছে মুখে। বিল্লাকে খবরটা দিয়েছিল ট্যারা মানিক। রতনকে দেখে নাকি দৌড়ে গিয়েছিল মানিক। রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাস যখন দুজনের মাঝে আড়াল হয়ে দাঁড়াল, সেই ফাঁকে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল রতন। অনেক খুঁজেছে সে। শাহবাগ থেকে মৎসভবন পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছে। পায়নি রতনকে।
০৮.
পাওলি উধাও হওয়ার বছর খানেক পরের কথা। ততদিনেও পাওলির শোক ভুলতে পারেনি রানা। পাওলির ছায়া এখনো তাকে ঘিরে আছে। পাওলিকে পাওয়ার আশা সে একরকম ছেড়ে দিয়েছে বটে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে খুঁজে ফিরছে ঠিকই। হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। কোথায় যায়, কেউ জানে না। শহরের এমন কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই যেখানে সে পাওলির সন্ধান করেনি। ব্রিজগুলোতে এতো মেয়ে, কিশোরী, তরুণী, মধ্যবয়সী— কাউকেই চোখে ধরে না তার। মনে ধরা তো দূরের কথা। ফার্মগেট ওভারব্রিজে বিজলী নামে এক তরুণী দু-একবার মিশতে চেয়েছিল ওর সঙ্গে। কয়েকবার জোর করে বিজলী বুকের ওপর টেনেও নিয়েছিল ওকে। কিন্তু রানার ধ্বজ জাগেনি। বিজলী ওর বুকে মুষ্ঠিপাকিয়ে একটা কিল বসিয়ে বলেছিল, ‘হিজলা কোনহান কার। যা ভাগ।’
হাল ছেড়ে দিয়ে রানা যখন দিকভ্রান্তের মতো এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তার গন্তব্যহীন পা দুটো একদিন গিয়ে থিতু হলো সাতরাস্তায়। তেজগাঁওয়ে। তখন ঘড়িতে রাত এগারোটার খানিক বেশি। পলিটেকনিক্যালের সামনের ওই ফুটওভার ব্রিজটা দিনের বেলায় কিছুটা ব্যবহার হলেও রাতেরবেলা প্রায় সুনশান। খুব একটা মানুষের আনাগোনা হয় না ব্রিজটাতে। কী মনে করে ক্লান্ত দেহে অন্যমনস্কের মতো সিঁড়ির ধাপগুলো একের পর এক ভাঙতে লাগল রানা।
একটা গুমোট বাতাস পাক খাচ্ছে জায়গাটায়। গোল হয়ে উড়ছে ধুলো। একসঙ্গে সব মিছিল করার মতো দুলে উঠছে গাছের পাতাগুলো। সাতরাস্তার এই পথটা সারারাতই কমবেশি ব্যস্ত। একের পর এক গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে শো শো শব্দ করে। পথচারী কম। ফুটপাতের ল্যাম্প পোস্টগুলোর আলো এসেছে ক্ষীণ হয়ে। কোনো কোনোটার বাতি গেছে কেটে। অন্ধকার নিরিবিলি ফুটপাতে রাতে পথচারী খুব একটা দেখা যায় না। দুজন-তিনজনের দল হঠাৎ হঠাৎ আসে। আবার চলেও যায় দ্রুত পায়ে।
ফুটওভার ব্রিজের ওপাশটায় একটা তেলের পাম্প। রাত দশটার পর পাম্পের একটা অংশ বন্ধ হয়ে যায়। অন্য পাশটি খোলা থাকে সীমিতাকারে। পাম্পের আলো এসে আলো করে রাখে ফুটওভার ব্রিজটার পশ্চিম পাশ। পুব পাশটা অন্ধকার। সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ ভেঙে বসে পড়ল রানা। ধুলোগুলো গোল হয়ে চরকির মতো পাক খাচ্ছে বাতাসে। সেই বাউকুড়ানির দিকে চেয়ে থাকে রানা। একা একাই বাউকুড়ানি মধ্যে সিঁধিয়ে যাচ্ছে পথের সব আবর্জনা। সিগারেট, চিপসের খালি প্যাকেট, ছেঁড়া নেকড়া কত কী! হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে গাছগুলো দুলে উঠলে সেই শিরশিরে হাওয়া এসে লাগছে রানার গায়ে। শিহরন তুলছে দেহে। শীত আসে আসে ভাব।
অগ্রহায়ণের শেষাশেষি এই সময়টায় বেশ ঠান্ডা পড়ে শেষরাতে। শরীরের তাপ বাড়ানোর জন্য পকেট থেকে একটা কুকড়ে যাওয়া সিগারেট বের করল রানা। সিগারেটটা তিন আঙুলে আলতো করে সোজা করে রাখল ঠোঁটে। ম্যাচের কাঠি ঘষা দিতে যাবে এমন সময় ব্রিজের ওপর থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠের হাসি রিনঝিন করে উঠল চুড়ির আওয়াজের মতো।
অগ্রহায়ণের শেষাশেষি এই সময়টায় বেশ ঠান্ডা পড়ে শেষরাতে। শরীরের তাপ বাড়ানোর জন্য পকেট থেকে একটা কুকড়ে যাওয়া সিগারেট বের করল রানা। সিগারেটটা তিন আঙুলে আলতো করে সোজা করে রাখল ঠোঁটে। ম্যাচের কাঠি ঘষা দিতে যাবে এমন সময় ব্রিজের ওপর থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠের হাসি রিনঝিন করে উঠল চুড়ির আওয়াজের মতো। ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরে তাকালো রানা। ব্রিজের দুপাশ বিজ্ঞাপন-ব্যানারে ঢাকা। বাইরে থেকে তাকালে ওপরের কিছুই দেখা যায় না। শোভা বাড়াতে প্লাস্টিকের টবগুলোতে লাগানো ফুল গাছগুলো আড়ালে পড়ে গেছে। আলো, পানি, বাতাসের অভাবে মরেও গেছে সেই কবে।
হাসির শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। কান পেতে থাকল রানা। তার মনে হলো ভুল শুনেছে। দূরের কোনো শব্দ বুঝি ভেসে এসেছে বাতাসে। ফের কাঠিটা ঠুকে ধরালো সিগারেটটা। লম্বা একটা টানে ধোঁয়া পুষে রাখল বুকে। একটু একটু করে সেই ধোয়া যখন উগড়ে দিচ্ছিল, তখন আবারও সেই কাঁচের চুড়ি ভাঙার শব্দ।
সিগারেটটা ঠোঁটে চেপেই বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে সিঁড়ির ধাপগুলো ভাঙতে থাকল রানা। যতই ওপরে ওঠে একটা দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত খচখচানির শব্দ আসে কানে। ওপরে ওঠার শেষ ধাপটায় দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিল গলা। আধো আলো, আধো অন্ধকারে সে দেখতে পায়— একটা কালো ষাড়ের মতো শরীর হাঁটু ভেঙে আরেকটা শরীরকে আড়াল করে আছে। আড়ালে থাকা শরীরটাই থেকে থেকে হেসে উঠছে। হামাগুড়ি দিয়ে আরও কাছে গেল রানা। শরীর দুটো তখন খুব ঘনিষ্ট হয়ে আছে। উপরের কালো ষাড়টা নিচু হলে হালকা আলো এসে পড়ল নিচের থাকা মুখটায়। সেই আলোয় মুহূর্তেই খুব পরিচিত একটা চেহারা ভেসে উঠল রানার চোখে। থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। একটু একটু করে সরে আসলো পেছনে। শরীরের কাঁপন আরও বাড়ছে তার। ব্রিজের একপাশের রেলিংটা আকড়ে ধরে চেষ্টা করল খানিকটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে।
রেলিংয়ের গায়ে লোহার খাচায় মরে শুকিয়ে যাওয়া গাছসহ টবগুলো ঝুলে আছে। অবচেতন মনে তার একটা টব খুলে হাতে নিল রানা। টবটাকে এমনভাবে আকড়ে ধরল যে বাহুর পেশীগুলো জমে উঠল বরফের মতো। ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো দৌড়ে গেল সে। টবটাকে আছড়ে দিল কালো ষাড়টার মাথা বরাবর। লক্ষ্যবস্তু মুহূর্তেই গেল ফসকে। দৈবক্রমে মাথাটা সরে গেলে টবটা ভাঙল নিচে শুয়ে থাকা মেয়েটির মুখে।
গল্পকার। জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। পেশায় সাংবাদিক। ঢাকা টাইমস ও সাপ্তাহিক এই সময় পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক। প্রকাশিত উপন্যাস : ‘জলপাই রঙের দিনরাত’, ‘বসন্ত রোদন’। গল্পগ্রন্থ : ‘বজলু জানে লাশের পরিচয়’, ‘দরজার ওপাশে ভোর’, ‘দানামাঝির বউ’। জীবনীগ্রন্থ: ‘আমাদের বঙ্গবন্ধু’। সম্পাদনা : ‘তিন যোদ্ধার মুখোমুখি’, ‘আলাপের সুবাসে সনজীদা খাতুন’, ‘স্বকৃত নোমানের কথামালা : গহিনের দাগ’।