প্রাচীন লবণপুরী
শাকুর মজিদ
আমাদের শহর সসনোভিৎসে থেকে ২০-২৫ মিনিটের দূরত্বে ক্রাকভ শহর থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে মাটির নিচে এক অপার বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমরা পঞ্চপর্যটক ছুটেছি সে বিস্ময়কর প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার জন্য।
প্রায় ১১শ বছর আগে এই এলাকার মাটির নিচ থেকে খুঁড়ে লবণ বের করে আনতেন শ্রমিকেরা। আজও এখান থেকে লবণ তোলা হয়। তবে এই খনির (Wieliczka salt mine) একটা অংশ আজ পর্যটকদের দেখার বিষয়।
লবণ নিয়ে মাটির নিচের বিস্ময়কর পরিবেশের এই খনি এলাকাটি দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। ছিমছাম পরিবেশ। মূল জাদুঘরটির বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আমাদের দল তৈরী হয়ে যায় ১০৪৪ সালে আবিষ্কার হওয়া এই লবণ খনিকে নিজেদের মতো উপভোগ করা আয়োজনে।
লবণ নিয়ে মাটির নিচের বিস্ময়কর পরিবেশের এই খনি এলাকাটি দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। ছিমছাম পরিবেশ। মূল জাদুঘরটির বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আমাদের দল তৈরী হয়ে যায় ১০৪৪ সালে আবিষ্কার হওয়া এই লবণ খনিকে নিজেদের মতো উপভোগ করা আয়োজনে।
বাইরে পর্যটকদের ভিড় চোখে না পড়লেও ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে পর্যটকদের গিজগিজানি।
পোল্যান্ডের অন্যান্য পর্যটন এলাকার মতো এখানেও পাওয়া যায় বহু ভাষাভাষির টুরিস্ট গাইড। আমরাও ইংরেজি বলা একজন গাইডকে বেছে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করি।
আমাদের এখন যেতে হবে মাটির নিচে প্রায় আড়াইশো ফুট। এই খনিতে আমরা যে সুড়ঙ্গ পথ ধরে হাঁটছি এরকম প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের মতো অলিগলির সুড়ঙ্গ পথ আছে।
সুড়ঙ্গ পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ে কয়েকটি মূর্তি। এই মূর্তিগুলো সেইসব খনি শ্রমিকদের যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই সুড়ঙ্গ-পথগুলো তৈরি হয়েছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই খনিতে যা কিছু দৃশ্যমান, তার সবই লবণ দিয়ে বানানো। মাটির নিচের সুড়ঙ্গ পথকে যা কিছুই মাটির মতো দেখতে মনে হচ্ছে, তার সবই লবণ দিয়ে তৈরি। কেবল সুড়ঙ্গপথের মাটি আটকাবার জন্য কতগুলো পাইন গাছ দিয়ে শোর পাইলের মতো আটকানো হয়েছে লবণের স্তর।
এই সব সুড়ঙ্গপথের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখান থেকে সব সময় লবণ-পানি চোয়াতে থাকে। এই লবণ-পানি প্রবাহিত হবার কারণে পাইন গাছের গুড়ির মধ্যে গিয়ে গুড়িগুলোকে আরো শক্ত ও মজবুত করে। ফলে খুব সহজেই এই গাছের গুড়িগুলো নষ্ট হয় না। শত শত বছর ধরে এই গাছের গুড়িগুলো অক্ষত থাকে।
আমরা সুড়ঙ্গ পথের অলিগলি ধরে হাঁটতে থাকি। এক গলি ছেড়ে আরেক গলিতে ঢুকি।
একটি গলির বাঁক ঘুরেই একটি মূর্তির সামনে এসে গাইড থেমে যান। আমাদের কাছে এই মূর্তিটিকে পরিচিত মনে হয়। আরে এতো কোপারনিকাস! কিছুদিন আগেই তো তাঁর জন্মবাটি ঘুরে এলাম তরুন শহর। নিকোলাস কোপারনিকাস আছেন পোল্যান্ডের সর্বত্রই। ১৯৭৩ সালে কোপারনিকাসের জন্মের পাঁচশততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে এই লবণ খনিতে তাঁর এই মূর্তিটি বানানো হয়। এই মূর্তিটি এডিবল লবণ দিয়ে তৈরি। এটি খাটি লবণ। কারণ এর মধ্যে ৯৫ ভাগই লবণ, বাকী পাঁচ ভাগ অন্যান্য উপাদান। এই জায়গাগুলো সব সময় শুষ্ক রাখতে হয়। না হলে লবণ গলে মূর্তিও গলে যাবে। ভেন্টিলেশন এবং এয়ারকন্ডিশনিং-এর মাধ্যমে হিউমেডিটি সব সময় একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা হয়। এ জন্যে এ জায়গাটুকুর তাপমাত্র সবসময় ১৪ থেকে ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
কোপারনিকাসের মূর্তি দেখা শেষ করে আমরা সুড়ঙ্গের অলিগলি ধরে সামনে হাঁটতে থাকি।
আমাদের এই হাঁটা পথ ওয়ানওয়ে। আমাদের উল্টা দিক থেকে কেউ কখনো পাস করে যায় না। আমরা কী তবে ক্রমাগত নিচের দিকেই নামছি? মনে হয় তাই। যে পথ দিয়ে হাঁটছি তা কিছুটা ঢালু, এবং সুড়ঙ্গ পথ। কিছুদূর পর পর দেয়ালের পাশ দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে রাখা আছে। এইটুকুই আমাদের ভরসা। একটা জায়গায় এসে দেখি এখানে দেয়ালের গায়ে গাছের গুড়ি নেই। কিন্তু সুড়ঙ্গের দেয়ালের গা ঘেমে পানি ঝরছে। এটি আসলে লবণেরই দেয়াল। দেখলে মনে হবে যেন পাথরের দেয়াল।
আমাদের সাঈদ ভাই গাইডের কথা বিশ্বাস করতে চান না। দেয়াল থেকে কয়েক কণা লবণ তুলে সাথে সাথে জিবে লাগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হসেন। শাকুর, একদম অরিজিনাল। টেস্ট করবি? আমার সাহস হয় না। আমি ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত।
আমরা হাঁটতে থাকি গাইডের পিছে পিছে। একটি জায়গায় কয়েকটি মূর্তি দিয়ে একটি দৃশ্য বানানো হয়েছে।
এক রাজকুমারী একটি উপহার গ্রহণ করছেন। এই রাজকুমারীর নাম কিঙ্গার। হাঙ্গেরির রাজা চতুর্থ বেলা রাণী মারিয়ার কন্যা কিঙ্গার। রাজকুমারী কিঙ্গারের সাথে বিয়ে হয় ক্রাকভের রাজা ডিউক বলিস্লোভের। রাজকুমারী তার বাবার কাছে বিয়ের উপহার হিসেবে হাঙ্গেরি মারামুর্স লবণ খনিটি চান। কিন্তু তার বাবা লবণ খনিটি দিতে অস্বীকৃতি জানান, তখন রাজকুমারী তার বিয়ের আংটি ছুড়ে ফেলে দেন।
এক রাজকুমারী একটি উপহার গ্রহণ করছেন। এই রাজকুমারীর নাম কিঙ্গার। হাঙ্গেরির রাজা চতুর্থ বেলা রাণী মারিয়ার কন্যা কিঙ্গার। রাজকুমারী কিঙ্গারের সাথে বিয়ে হয় ক্রাকভের রাজা ডিউক বলিস্লোভের। রাজকুমারী তার বাবার কাছে বিয়ের উপহার হিসেবে হাঙ্গেরি মারামুর্স লবণ খনিটি চান। কিন্তু তার বাবা লবণ খনিটি দিতে অস্বীকৃতি জানান, তখন রাজকুমারী তার বিয়ের আংটি ছুড়ে ফেলে দেন।
বিয়ের পরে রাজকুমারী ক্রাকভ এলে এই উইলিস্কিতে বেড়াতে আসেন। বেড়াতে এসে তিনি এই জায়গাটি দেখিয়ে শ্রমিকদের আদেশ দেন এই জায়গাটা খোড়ার জন্য। খনি শ্রমিকেরা অল্প একটু খোড়ার পরেই পেয়ে যান এই লবণ খনি। আরও আশ্চর্যের বিষয় এখানেই এই লবণ খনির উপরিভাগে পাওয়া যায় সেই আংটি যেটি কিঙ্গার ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল হাঙ্গেরিতে।
সেই কাহিনিরই খণ্ডচিত্র এখানে মুর্তি আকারে বানিয়ে রাখা হয়েছে লবণ দিয়ে। এই মুর্তিগুলো বানানো হয়েছে ১৯৬৭ সালে।
এই কাহিনি সত্য কি মিথ্যা আমি জানি না। কিন্তু এখানকার লোকমুখে এমন কথা চালু আছে। আমাদের গাইডও বলে বসেন, পৃথিবীতে অনেক কাকতালীয় ঘটনা আছে যা আসলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমরা বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝামাঝি দুলতে থাকি, আর মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করি আমাদের গাইডের কথা।
এই লবণ খনির ভেতরটুকু গাইড ছাড়া দেখার উপায় নেই, নিয়মও নেই। টিকেটের সাথে যে গাইড ফ্রি পাওয়া যায়, তিনি ২০-৩০ জনের একপাল টুরিস্ট নিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে খনির ভেতর ঢোকেন। আমাদের দরকার এক্সক্লুসিভ গাইড। যাকে শ্যুট করা হবে ক্যামেরায় এবং যিনি ভালো ইংরেজিও বলতে পারবেন। সে জন্য বাড়তি পয়সা দিয়ে ৫ সদস্যের টিমের জন্য ২ ঘন্টার জন্য যে গাইড ভাড়া করেছি তার সার্বক্ষণিক পরামর্শে আমাদের এই পথ চলা।
আমরা হাঁটতে থাকি খনির সুড়ঙ্গপথের অলিগলি ধরে। আমরা চলে আসি আরেকটি প্রকোষ্ঠে। এটি ভস্মীভূত প্রকোষ্ঠ। ১৭০০ সালের দিকে এই প্রকোষ্ঠটি পুড়ে গিয়েছিল।
খনির খনন কাজ চলতে চলতেই এইসব অলিগলি এবং প্রকোষ্ঠগুলো তৈরি হয়েছে। মাটির এই অভ্যন্তরভাগে অনেক উপাদানের সাথে থাকে মিথেন গ্যাসও। মিথেন গ্যাস যেহেতু অক্সিজেনের থেকে হালকা সে কারণে মিথেন গ্যাস ওপরের দিকে সিলিংয়ের সাথে জমাট আকারে ভাসতে থাকে। শ্রমিকরা অন্ধকারে কাজ করার জন্য কুপি বাতির মতো এক ধরনের বাতি ব্যবহার করত। বাতি নিয়ে যখনই তারা এরকম কোনো প্রকোষ্ঠে ঢুকত তখন তাদের কুপি বাতির আগুন অক্সিজেন আর মিথেন গ্যাসের বিক্রিয়ায় বিস্ফোরণ ঘটত এবং সে বিস্ফোরণে মারা যেত অনেক শ্রমিক।
সেকারণে যেসব শ্রমিক সাহসী ছিল তারা ভেজা জামা কাপড় পরে হাতে লম্বা লাঠির আগায় আগুন নিয়ে মিথেন গ্যাস পোড়াতে পোড়াতে সামনে এগোতো, বাকীরা তাদের অনুসরণ করত।
এই জিনিসগুলোই এখানে মূর্তি আকারে বানিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হবে একদম সেই রকম পরিবেশ। আর এসবই করা হয়েছে লবণ দিয়ে।
আমরা আবারও গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরি করা সুড়ঙ্গ পথের ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। পুরো খনি এলাকাতে মোট সুড়ঙ্গ পথের দৈর্ঘ্য প্রায় তিনশ কিলোমিটার। তার মধ্যে এরকম গাছের গুড়ি দিয়ে পাইলিং করা সুড়ঙ্গ পথের দৈর্ঘ্য প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। প্রায় দুই আড়াইশ বছর পর-পর এই গাছের গুড়িগুলো পরিবর্তন করা হয়।
গাইডের বকবকানি শুনতে শুনতেই আমরা উনবিংশ শতকে যে সুড়ঙ্গ এলাকা থেকে লবণ তোলা হয়েছে সেরকম একটি সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে পড়ি। লম্বা একটা এলাকা জুড়ে অনেকগুলো মূর্তি। যেন উনিশ শতকের কোনো এক দিনে বেশ কিছু খনি শ্রমিক কাজ করতে করতে এক সময় স্থির হয়ে গেছেন এবং আজ, এই দুই হাজার এগারো সাল পর্যন্ত তারা স্থিরই আছেন। সেই অবয়ব, সেই পরিবেশ।
একজন খনি-শ্রমিক লবণের পিপা ভরছেন। অন্য একজন শ্রমিক অপেক্ষা করছেন তার ঠেলাগাড়িটি নিয়ে। সে এই পিপাটি ঠেলে নিয়ে যাবেন একটু দূরে অপেক্ষমান ঘোড়ার গাড়িটির কাছে। সেখান থেকে এটি চলে যাবে কপিকলের কাছে।
একজন খনি-শ্রমিক লবণের পিপা ভরছেন। অন্য একজন শ্রমিক অপেক্ষা করছেন তার ঠেলাগাড়িটি নিয়ে। সে এই পিপাটি ঠেলে নিয়ে যাবেন একটু দূরে অপেক্ষমান ঘোড়ার গাড়িটির কাছে। সেখান থেকে এটি চলে যাবে কপিকলের কাছে।
এর ঠিক পাশেই মধ্যযুগের পোল্যান্ডের একটি গ্রামের খণ্ডচিত্র। সেখানে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে কীভাবে লবণ সংগ্রহ করা হতো তার একটি নমুনা বানিয়ে রাখা হয়েছে ত্রিমাত্রিক আঁকারে লবণের মূর্তি দিয়ে। সমুদ্রের পানি ধরে মাটির পাত্রে জ্বালিয়ে লবণ বানানো হচ্ছে।
এই প্রকোষ্ঠটি পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই বড়োসড় একটা প্রকোষ্ঠ। এখানে পাওয়া গিয়েছিল স্তরীভূত লোহিত লবণ। এই চেম্বারে ঢুকতেই রাজা ‘কিজিমির দি গ্রেট’ এর মূর্তি।
১৩৬৮ সালে রাজা কিজিমির খনির সবধরনের কাজকর্মের একটা সুনির্দিষ্ট প্রণালী বের করে সেটিকে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন। ফলে খনির আয় বেড়ে যায়। এবং সেটি রাজকোষে জমা হতে থাকে। পরে এই টাকা খনি গবেষণা কাজে ব্যয় হয়।
আরেকটু সামনে গেলেই একটা কপিকলের স্থাপনা। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে কী করে মানুষজন নিচে থেকে লবণ ওপরে টেনে তুলত, তার প্রয়োগ দেখানো আছে এই মুরালের মাধ্যমে। বলাই বাহুল্য, এর সব কিছুই লবণ দিয়ে তৈরি।
একটি ঘূর্ণন যন্ত্রের সাথে ঘোড়া জুড়ে দেওয়া হতো। ঘোড়া ঘুরত, সাথে সাথে কপিকলও ঘুরত। কপিকল ঘোরার ফলে একদিকে দড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপরের দিকে উঠে যেত। এই দড়ির মাথায় বেঁধে দেওয়া হতো লবণের পিপা। ফলে লবণের পিপাগুলো ভূভাগের উপরে উঠে যেত। আর কপিকলের অন্য মাথায় ঠিক এর বিপরীত কাজ হতো। সেখানে দড়ির প্যাঁচ খুলে খুলে দড়িটি ভূভাগের উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসত। তখন দড়ির মাথায় বেঁধে দেওয়া হতো পাইন গাছের গুড়ি। আর সে গুড়ি দিয়েই খনি অভ্যন্তরের ধ্বস রোধ করা হতো। যার নমুনা আমরা দেখছি প্রতি পদে পদে।
আঁকাবাঁকা সিঁড়ি মাড়িয়ে একটু নিচে নামতেই আরেকটি চেম্বার। এখানে আরেকটি কপিকল। এই কপিকলটি ঘোরাতো মানুষে। খনি অভ্যন্তরে তখনও ঘোড়ার চল শুরু হয়নি। তখন মানুষই এই কষ্টসাধ্য কাজটি করত। আর এখন পর্যটকেরা নিজেরা ঘুরিয়েই সে যুগে খনি শ্রমিকেরা কতটা পরিশ্রম করত তার স্বাদ নিতে চান।
এই কপিকলের পাশেই একটি শোকেস। আধুনিক সাজ-পোশাকে সজ্জিত কতগুলো নারী-পুরুষ। এরাও আসলে পর্যটক। এই পর্যটকেরাই প্রথম এই খনি অভ্যন্তরে বেড়াতে এসেছিল। সে কারণে লবণ দিয়ে তাদের ত্রিমাত্রিক আকৃতি দিয়ে এই শোকেসে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে এই পর্যটক দলটি এসেছিল। আর তাদের এই মূর্তিটি বানানো হয়েছে এই সেদিন ১৯৭০ সালে। এই পর্যটক দলটি যে পর্যটনের সূচনা করেছিল সে ধারা আজও অব্যাহত আছে এই খনিটিতে। গ্রীষ্মের সময় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ পর্যটক এই খনিটি ঘুরে দেখে যান।
আমরা খনি অভ্যন্তরের সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচে নামতে থাকি। এখান থেকে শুরু হয়েছে পানির রাজ্য। খনিজ লবণ আরোহণ করতে করতে এইসব যায়গায় ভূ-গর্ভস্থ পানি জমত। ফলে লবণ আরোহণ করতে সমস্যা হতো অনেক। আবার অনেক সময় পানির তোড়ে ভেসে গেছে অনেক খনি শ্রমিক। সে কারণে সে সময় এই রকম পানি নিষ্কাশন যন্ত্র তৈরি করেছিল খনি শ্রমিকরা। ৩০০ বছর আগে তৈরি সে পানি নিষ্কাশন যন্ত্রটি আজো সচল আছে। একটা চাকায় চেইনের মাঝে মাঝে এই রকম চামড়ার ব্যাগ। চাকাটা ঘুরলে চামড়ার ব্যাগ পানি ভর্তি হয়ে ওপরে উঠে যেত। ওপরে উঠে একটা পিপার মধ্যে পানি খালি করে প্রায় দুশ ফুট ওপরে পানি তোলা হতো। তার সবই এখন লবণের মূর্তি।
আমরা হাঁটতে থাকি লবণের সুড়ঙ্গ পথ ধরে। ডানে বামে যেদিকেই তাকাই লবণের দেয়াল। আমাদের গাইড ঘোষণা দিলেন এখন আমরা মাটির নিচে প্রায় ১৮০ ফুট তলায় অবস্থান করছি। এর এই ১৮০ ফুট নিচের চেম্বারে বিশাল এক ক্যাথেড্রাল। পুরো পোল্যান্ড জুড়েই দু’কদম পরে পরে গির্জা। সে সংস্কৃতি থেকে বাদ পড়েনি এই খনি অভ্যন্তরও।
প্রায় চার-পাঁচশ বছর আগেই খনি শ্রমিকরা তাদের উপাসনার জন্য খনির উপাসনালয় বানিয়েছিল। সে জন্যই দেয়াল গাত্রে ছোট্ট শিশু কোলে মা মেরী, ক্রসবিদ্ধ যিশু, হর হামেশাই চোখে পড়ে।
প্রায় চার-পাঁচশ বছর আগেই খনি শ্রমিকরা তাদের উপাসনার জন্য খনির উপাসনালয় বানিয়েছিল। সে জন্যই দেয়াল গাত্রে ছোট্ট শিশু কোলে মা মেরী, ক্রসবিদ্ধ যিশু, হর হামেশাই চোখে পড়ে।
আমরা এসব ছাড়িয়ে চলে আসি একটি গির্জায়। একটি সেন্ট কিঙ্গার চ্যাপেল। ওপর থেকে দেখলে এটাকে বড়োসড় হলঘরের মতো দেখায়। এই গির্জাটি দৈর্ঘে ১৫০ ফুট, প্রস্থে ৬০ ফুট। মেঝে থেকে এর ছাদের উচ্চতাও অনেক, প্রায় তিন তলার সমান। এটি ছিল সবুজ লবণের খনি। ১৮৯৫ সালে এখানে এই গির্জা তৈরির কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৬৩ সালে। এই গির্জাটি তৈরি করতে গিয়ে এখান থেকে প্রায় ২০ হাজার টন লবণ সরাতে হয়েছে।
হাঙ্গেরির রাজকুমারী সেন্ট কিঙ্গারের স্মরণে এই গির্জাটি নির্মাণ করা হয় বলে এর নাম সেন্ট কিঙ্গার চ্যাপেল। পোপ দ্বিতীয় জন পল যখন পোল্যান্ড সফরে আসেন তখন তিনি কিঙ্গারসকে সেন্ট উপাধিতে ভুষিত করেছিলেন। এই গির্জাটিতে মোট পাঁচটি এ রকম ঝাড় বাতি আছে। প্রতিটি ঝাড় বাতিতে দুই হাজারটি ক্রিস্টালের টুকরো বসানো। আর এই ক্রিস্টালের টুকরোগুলো সবই লবণ দিয়ে বানানো।
পুরো গির্জার দেয়াল জুড়ে নানা ধরনের অলংকরণের কাজ আর দেয়ালচিত্র। এই অলংকরণ এবং দেয়ালচিত্রগুলো করা হয়েছে ৬৮ বছর ধরে। ওপরের সিড়ি দিয়ে নামতেই দেয়ালের গায়ে খোদাই করে বানানো আছে রাজা কিরামিজ দি গ্রেটের মূর্তি।
এরপর থেকে শুরু হয়েছে খনি শ্রমিকদের মূর্তি। এই মূর্তিগুলোর কোনো কোনোটি বানানো হয়েছে সলিড আবার কোনো কোনোটির মাঝখানে ফাঁপা। মাঝে একটি আলোর উৎস দিয়ে মূর্তিটিকে আলোকোজ্জ্বল করা হয়েছে রাজকুমারী কিঙ্গারের এই মূতিটির মতো। বলার প্রয়োজন নেই, এর সবই লবণ দিয়ে বানানো।
গির্জার একদিকের দেয়ালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির দ্য লাস্ট সাফারের ত্রিমাত্রীক রূপ। যিশু তার ভক্তদের নিয়ে রাতের খাবার খাচ্ছেন। এক কোণে ক্রুশবিদ্ধ যিশু।
আর গির্জাটির পুরো ৩০ হাজার বর্গফুট আয়তনের পুরোটাই ঢেকে দেওয়া হয়েছে লবণের তৈরি এই ঝকঝকে তকতকে টাইলস দিয়ে। এই গির্জাটিতে প্রতি রবিবার নিয়মিত উপাসনা হয়। অনেক অভিজাত পরিবার এখানে বিয়ের আয়োজনও করে থাকেন।
গির্জা থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি সুড়ঙ্গ পথ ধরে। একটা সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে উঠতে থাকি। এখানে আমরা যে পিলারগুলো দেখছি এগুলো লবণ শিলার এক একটি পিলার।
এই লবণ শিলার পিলারগুলোকে এখন পাইন গাছের গুড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাতে করে কোনো সময় বড়ো ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। এই পাইনের গুড়িগুলোকে লবণের প্রলেপ দিয়ে প্লাস্টার করা।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে পিলারগুলোকে খুব ভালো করে দেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে অল্প একটু উপরে উঠলেই একটি বড়োসড় পরিসর। পর্যটকেরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এখানে বসে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতে পারেন। বিশ্রামের সময় হাল্কা কিছু খেয়েও নিতে পারেন। সে ব্যবস্থাও রাখা আছে এখানে।
মাটির দুই আড়াইশ ফুট নিচে দিয়ে দেড় দুই ঘন্টার হাঁটাহাঁটি করতে হলে শুধু লবণ খনি দেখালে মানুষকে ঠান্ডা করা যাবে না।
পকেটের পয়সা খরচ করে টিকেট কেটে ঢোকার পর, পর্যটকেরাও যাতে মনে করেন—পয়সা উসুল—তখনই স্বার্থক হবে পর্যটন কর্তৃপক্ষ। এটা হয় উইন-উইন ডীল। এখানে হয়েছেও তাই। লবণ দিয়ে মানুষের মূর্তি বানানো যায়। এই মূর্তি ২-৪টা দেখার পর আর দেখতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু এর সাথে যদি পোল্যান্ডের ইতিহাসকে কোনোভাবে জড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই স্বার্থক হয়। এক্ষেত্রে এরা স্বার্থকই।
পিলুসুদস্কির এই মূর্তি ছাড়িয়ে একটু সামনে গেলেই একটি বড়োসড় প্রকোষ্ঠ। এখানে পাশাপাশি দুটো বিশাল আকারের সবুজ লবণের ব্লকের খনন কাজ শেষ হলে ১৮৩০ সালে দুটো প্রকোষ্ঠকে একটা টানেল দিয়ে যোগ করা হয়। পরে লবণ পানি দিয়ে ভরে দিয়ে বানানো হয় একটি খাল। এটা করা হয় পর্যটকদের নৌভ্রমণের জন্য। পর্যটকেরা এক প্রকোষ্ঠ থেকে আরেক প্রকোষ্ঠে যেতে পারেন এই সরু টানেলের ভিতর দিয়ে। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় অনেক পর্যটক টানেলের মধ্যে আটকা পড়েন এবং মারা যান। তারপর থেকে এখানে নৌকাভ্রমণ বন্ধ। এখানে এই মূর্তিটি সেইন্ট জন নিপোমিউসেনের। তিনি সে সময় অনেক পর্যটককে উদ্ধার করেছিলেন। তার সেই সাহসী কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তার মূর্তিটিও এখানে বানিয়ে রাখা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানের চৌবাচ্চায় যে পানি দেখা যাচ্ছে, এ পানিতে নাকি কেউ ডুবে মরতে পারে না। পানির ঘনত্ব এমনই যে তাকে সারাক্ষণ ভাসিয়ে রাখবে পানির ওপর।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানের চৌবাচ্চায় যে পানি দেখা যাচ্ছে, এ পানিতে নাকি কেউ ডুবে মরতে পারে না। পানির ঘনত্ব এমনই যে তাকে সারাক্ষণ ভাসিয়ে রাখবে পানির ওপর।
সুড়ঙ্গ পথ ধরে অল্প একটু হেঁটেই আমরা পৌঁছে যাই একটি বড়োসড় হলঘরে। এখানে এসেই পর্যটকদের যাত্রা শেষ হয়।
খনি অভ্যন্তরের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ পথের আমরা মাত্র ২ কিলোমিটারের মতো হেঁটেছি। এই দুই কিলোমিটারের মধ্যে যে কর্মযজ্ঞ দেখে ফেলেছি তাতেই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না। দরকার নেই তিনশ কিলোমিটার হাঁটার।
আমরা চলে আসি এলিভেটর স্টেশনে। এখানে চারটি এলিভেটর এক্সপ্রেস নিরবিচ্ছন্নভাবে পর্যটকদের ভূপৃষ্টের ওপরে তোলার কাজ করছে।
আমরাও উঠে পড়ি একটিতে। মাত্র নয় সেকেন্ডেই আমরা পৌঁছে যাই গ্রাউন্ডফ্লোরে।
দুই ঘন্টার সফর শেষ। এবার এখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পোল্যান্ডের প্রাচীন রাজধানী ক্রাকভ। ৫শ বছর আগে যদিও এই ক্রাকভ হরিয়েছে তার রাজধানীর মর্যাদা, তবুও এতিহ্য আর অলংকারের কিছুই নাকি খোয়ায়নি এই শহর। কেমন আছে ক্রাকভ, তা দেখার জন্য আমাদের হাতে ভরা এক দুপুর, বিকেল এবং বাদবাকী সন্ধ্যাটুকু। আমরা ছুটি ক্রাকভের দিকে।
ধারাবাহিকটির অন্য পর্বগুলো পড়ুন :
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০১
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০২
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৩
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৪
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৫
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৬
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৭
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৮
পোল্যান্ড : লেস ওয়ালেসার দেশ ।। পর্ব-০৯
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫। তিনি একজন বাংলাদেশি স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনি ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।