মৃত্যু এক অনুচ্চারিত সত্য, যা অনিবার্য অথচ জীবন তাকে স্বীকার করে কই? তাকে অস্বীকার করেই এগিয়ে যাওয়া… একটা কাঠের সেতু, ওপারটা ভোর, অন্য এক আলো, তবু কেমন যেন অস্পষ্ট। মা শেষ কদিন এই স্বপ্নটা দেখেই চমকে উঠত, ভোরের দিকে। আর, আমি কাছে পৌঁছলেই, আমার মুখটা ধরে খুব আদর, কিছু পর বলে উঠতেন—‘লক্ষ্মী হয়ে থাকিস বাবা’।
মৃত্যুর পরও মানুষের অস্তিত্ব থাকে। তাই কি? এ কথা ভাবতে ভাবতে আমরা মা’র ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াই। ‘আমরা’ মানে আমরা চার ভাইবোন আর টমি। বাইরে তখন বৃষ্টি আরও জোর হচ্ছে…
দাদা বলছিল জীবন হলো একটা আলোর মতো। মৃত্যু এসে সেই আলোকে শুষে নেয়। বুঝিনি ঠিক কী বলছিল দাদা। আত্মা বলে কি কিছু কোথাও আছে? বুঝি না আসলে, কেমন মনে হয় সিলেবাসের বাইরের বিষয়! মা’র ঘরে সকালে যখন ঢুকেছিলাম, একাই, বিছানা পাতা আছে যেমন রোজ থাকে। বালিশের ঠিক সামনে কিছু কাঠ চাঁপা ফুল রাখা। রেবাদির কাজ। মা’র ঠাকুর দেবতা যেখানে রাখা, সেখানে প্রদীপ জ্বলছে। আমি মা’র বিছানার নিচটা তুলে ধরি। একটা নীল পাসবুক। ব্যাংকের, পোস্ট অফিসের রেকারিং বই। কিছু হাবিজাবি কাগজের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো, একটা হলুদ পাট করা লম্বা কাগজ। ঠিকুজি। অরণ্য মুখার্জী, ভরদ্বাজ গোত্র। ওপরে আলপিন দিয়ে আঁটা সাদা একটা কাগজ। তাতে লেখা, আগামী অমাবস্যা তিথিতে ঘোর বিপদ। মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ ধারণ আবশ্যিক। অমাবস্যা কবে ছিল মনে করার চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। কস্মিনকালেও এসবের খোঁজ রাখতাম না। মা কেবল প্রতি অমাবস্যায় আমার জন্য পুজো দিত সেটা জানতাম। মা যে তার বাউন্ডুলে ছোটো ছেলেকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন থাকত তা জানতাম, এতটা জানতাম না। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বেরিয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে। যে কয়েকজন আত্মীয় পরিজনকে ফোন করার বড়দা-ই করবে জানতাম। ও নিয়ে আমার ভাবনা কম। বড়দা তারপরই ফোন করল, সন্ধেবেলা আসবে, ছোড়দি আর মেজদাকেও আসতে বলেছে। শ্রাদ্ধ শান্তি নিয়ে আলোচনা করার আছে।
মা যে তার বাউন্ডুলে ছোটো ছেলেকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন থাকত তা জানতাম, এতটা জানতাম না। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বেরিয়ে এসেছিলাম ঘর থেকে। যে কয়েকজন আত্মীয় পরিজনকে ফোন করার বড়দা-ই করবে জানতাম।
টমিকে সামলানো যাচ্ছে না। কেন কে জানে। এদিকে এত প্রবল বৃষ্টি, উঠোন জুড়ে জল জমেছে, কাঠচাঁপা গাছটাই মূলত টার্গেট টমির। মা’র প্রিয় গাছ। মা যখন ফুল তুলত টমি ঘুরত মার পায়ে পায়ে। টমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছে? বাবা বলতেন জীবন আর মৃত্যু আসলে একটা সূক্ষ্ম দাগের তফাত, আর তেমন ফারাক কই! যেমন পুব বাংলা আর পশ্চিম বাংলা। ছিন্নমূল হয়ে বাবারা এসে ওঠেন এপারে। সে বড়ো কঠিন সময়। আমৃত্যু বাবা পূর্ব বাংলা ছেড়ে আসা দুঃখে পীড়িত হয়েছেন। শেষ দিকে জপ তপ, আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে ছিলেন। তাই হয়তো, মৃত্যু নিয়ে এমন কথা বলতেন।
এবার খুব শীত পড়েছে। সচরাচর এতটা পড়ে না। কাল রাতে প্রবল ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে যখন নদীতে নামলাম, ভোর হচ্ছে। বেহুদা বাউন্ডুলে আমি অত বুঝিও না। মাথাও কাজ করে না। লেট রাইজার। ভোর দেখি না বহু দিন। আজ কত দিন পর পুবের আকাশ ফরসা হতে দেখছিলাম…আঁধারের মাঝে লাল আবির মাখছে আকাশটা। তাকিয়ে ছিলাম এক মনে। বড়দাই বলল, অরু নিউমোনিয়া হবে, আগে শাল জড়া। জড়াইনি। ভালো কিছু দেখলেই মাকে বলার জন্য মনটা ছটফট করত। এমন একটা দৃশ্য দেখছি, আর মা নেই, ভাবতেই চোখে জল চলে এলো। ছোড়দি কখন এসে দাঁড়িয়ে ছিল নদীর ধারে। দেখি একটা সোয়েটার এগিয়ে দিয়ে বলছে, ভাই পরে নে শিগ্গির। পরলাম অগত্যা। আসলে তখনো অনেকটা অন্ধকার। অন্ধকার আমি ভয় পাই। আসলে আলো না থাকলে কিছুই করতে ইচ্ছে করত না। সে অর্থে কেউ আমায় আলোর সন্তান বলতেই পারে, আর বছর কয়েক আগে আমিও নিজেকে তাই বলতাম। কারণ আলোই এই বিস্তৃত অমৃতকুম্ভের উৎস। আর নিজেকে অমৃতের সন্তান হয়তো সকলেই কম বেশি ভাবে। জীবনে সব কিছুকে পজেটিভ দিক থেকে ভাবাটা মা আর মামার বাড়ির দিক থেকেই শিখেছিলাম। কারণ তাদের কখনো কোনো হীনম্মন্যতায় ভুগতে দেখিনি কখনো। তারা কথা বলত জোরে, গান গাইত জোরে, হিসি হাগু এমনকি বাতক্রিয়াও করত জোরে। যেন জানান দিয়ে যাও, আমি বেঁচে আছি।
বরং বাবা ছিলেন অনেকাংশেই এর বিপরীত, নিষ্প্রভ। বাবার গলা দিয়ে উঁচু গলায় শব্দ বেরিয়ে আসতে কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। কেবল ছোটো পিসি যেদিন মারা যান, সেদিন শেষ রাতে একটা গোঁ-গোঁ শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে তড়াক করে উঠে দেখি, বাবা তার পড়ার ডেস্কের সামনে বসে কাঁদছে, মাথা নিচু করে। কান্নার শব্দ চাপতে গিয়ে, গোঁ-গোঁ শব্দটা বেরিয়ে আসছে ভুলক্রমে। আলো জ্বালিয়ে বাবার কাঁধে হাত রাখতেই বাবা যৎপরোনাস্তি অস্বস্তি বোধ করতে থাকলেন। আর বহুবার বলার চেষ্টা করলেন কিছু হয়নি, তিনি ঠিক আছেন। পরে, অনেক পরে বুঝেছিলাম, বাবা হয়তো অন্ধকারের মানুষ ছিলেন, গোপনীয়তা পছন্দ করতেন। মা অবশ্য আমায়, আমাদের আলোর দিকেই ঠেলতে চেয়েছিলেন বরাবর। কিন্তু সময় তো এক ছন্দে বহমান নয়। কী যে হলো কে জানে! আজ শেষ রাতে নদী থেকে আমরা যখন হাঁটা শুরু করলাম বাড়ির দিকে—সামনে বড়দা আর ছোড়দি, মেজদা মাঝে। আর আমি অনেকটা পেছনে, পেছন পেছন তিন চারটে নেড়ি কুকুরও হাঁটছে। ওরাও কি শ্মশানযাত্রীই ছিল?
এক.
ছোড়দি সাবিত্রীদিকে ডাকল, সাবুদি টমির বোধহয় খিদে পেয়েছে, বিস্কুট দাও তো ক’টা। ছোড়দি বিস্কুট দিল। টমি ফিরেও তাকাল না। ও যেন কাকে দেখেছে। কাল শেষ রাতে মা যখন পুড়ে যাচ্ছিল, কেন জানি না থর থর করে কাঁপছিলাম। একটু দূরে সুর তুলে কাঁদছে আর এক মৃতর পরিবার। ফুল মালাগুলো সরিয়ে রাখতে বলল ডোমেরা। পুরুত ঘি মাখাতে বলছে লোকটার মুখে হাতে পায়ে, এবার হাতে প্যাঁকাটি নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দু তিনবার ঠুকে নিল নিয়ে লোকটার মুখে। উফফ! কী ভয়াবহ দৃশ্য! আমি করিনি। না, বলেছি। পারব না। যে মা চুমু দিত কপালে সেই মুখে আগুন কি করে দেবো? অসম্ভব। ধর্ম ভালো কি মন্দ, তা বলবে পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞরা। ধর্মের এই কুৎসিত কদর্যতা মেনে নেওয়া মুশকিল! শ্মশানে ডেডবডির লম্বা কিউ ছিল। তবু কী করে যেন মার পোড়ানো শেষ হয়ে গেল খুব অল্প সময়েই। নাভি দিল সরা’য় চিমটে করে। ওপরে আর একটা সরা চাপিয়ে নিলাম। জল ঢেলে মার চিতাভস্মে নিয়ে চললাম নদীর দিকে। জলে ভাসল নাভি। আমরা চার সন্তান সন্ততি তাকিয়ে রয়েছি, মার অনন্ত যাত্রার দিকে। হঠাৎ কী হলো কে জানে, আমি শুনলাম মা ডাকছেন, ‘বাবু, আমায় ফেলে যাচ্ছিস?’ আমি নামতে যাচ্ছিলাম নদীতে। ছোড়দি টেনে রাখল আমায়। চোখ পাকিয়ে বলল, ‘বাবু মা আমাদের বাড়িতে, এই আনন্দ যজ্ঞে কিছু দিন বসবাস করলেন। যেতে দিতেই হয়, সে তুই চাস আর না চাস।’ ‘আনন্দ’ কথাটা ভেবেই কেমন যেন মনে হলো, আনন্দই তো? যেন স্টেশনে ছাড়তে এসেছি, এবার মা যাবেন অন্য কোথাও… অন্য স্টেশন…বাবা সেখানে মাকে রিসিভ করবে বলে অপেক্ষা করছে। আমরা কেবল নির্বাক সাক্ষী, হাঁ করে তাকিয়ে ট্রেনটার চলে যাওয়া দেখছি… বৃষ্টির আজ কোনো কমার লক্ষণই নেই। বেড়েই চলেছে। সাথে বাড়ছে টমির তর্জন গর্জন।
যে মা চুমু দিত কপালে সেই মুখে আগুন কি করে দেবো? অসম্ভব। ধর্ম ভালো কি মন্দ, তা বলবে পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞরা। ধর্মের এই কুৎসিত কদর্যতা মেনে নেওয়া মুশকিল! শ্মশানে ডেডবডির লম্বা কিউ ছিল। তবু কী করে যেন মার পোড়ানো শেষ হয়ে গেল খুব অল্প সময়েই। নাভি দিল সরা’য় চিমটে করে। ওপরে আর একটা সরা চাপিয়ে নিলাম। জল ঢেলে মার চিতাভস্মে নিয়ে চললাম নদীর দিকে। জলে ভাসল নাভি।
মেজদা খুব বিরক্ত টমির আচরণে। বলছে চেন দিয়ে বাঁধতে। পেটকে চেন দিয়ে বাঁধার আমাদের বাড়িতে তেমন চল নেই। আর বিরক্ত তো মাও ছিল তার মেজো ছেলের আচরণে, তাকে কই বাঁধা হয়নি তো! ‘বাড়ি’ বাড়ি হয় তখন, যখন তাতে আলোর আনাগোনা থাকে অপ্রতুল। আলো মানে আসলে ভালোবাসাও, সেটাও বুঝি পরে। যখন টমিকে আজ বিকেলে দেখলাম ঝিম মেরে বসে আছে, অথচ সামনে বিস্কুট পড়ে আছে, এমনকি আরশোলা, তাও উঠছে না!
দুই.
মা’র ছবির সামনে বসে থাকতে থাকতে মাথা নিচু হয়ে আসছিল আমার। তখনো কী কারণে যেন আকাশের মুখ ভার। শীত ঋতুটি এমনি ভালো, কিন্তু শীতের বিকেলজুড়ে বৃষ্টি হলে মন কেমন করে। সেই যে শ্মশান থেকে ফিরেছি, তারপরই আর আলো ফোটেনি তেমন করে। আকাশ খুব লাল। কিছুপর ঝড়, তারপর এক নাগাড়ে ঝুম বৃষ্টি। সকাল কখন পেরিয়ে দুপুর হয়ে বিকেল ছুঁলো জানিও না। মাথা ব্যথা প্রবল। জ্বর আসছে হয়তোবা। শীত শীত করে খুব। মা’র ঘরের মধ্যে বসেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। দেখি ছোড়দি ডাকছে। ছোড়দি কাছেই থাকে। দুই সন্তানের জননী। আমার থেকে প্রায় বছর ছয়ের বড়ো। স্বামীর সাথে বনিবনা কম। কিন্তু তা বলে অর্থাভাব নেই। ধড়মড় করে উঠে বসতে গিয়ে মাথা চক্কর মারল। ফের বসে পড়লাম। ছোড়দি বকল, কী দরকার ওঠার। ধমক খেয়ে ফের বসলাম। ছোড়দি মা’র শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুকাল। বাইরে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। ছোড়দি নিজের বাড়িতে ফোন করে রান্নার লোককে কী সব ইনস্ট্রাকশন দিল। দেখি বড়দা ভিজে নেয়ে ঢুকছে, ছোড়দি উঠে গিয়ে বড়দাকে টাওয়েল দিল। বড়দা জামাটা বাইরে মেলে এসে বসল মা’র ঘরেই। বড়দা আমার থেকে প্রায় আঠারো বছরের বড়ো। কাজ করে সরকারি অডিট সার্ভিসে। ওয়েল সেটলড্। ফ্ল্যাট কিনে দক্ষিণে চলে গেছে অনেক দিন। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়েছে সদ্য। বড়দা ধুপ জ্বেলে দিল ঘরে। সাবিত্রীদি, আমাদের বাড়িতে অনেক দিন। মার যখন চল্লিশ, সাবিত্রীদির এ বাড়িতে আসা—‘চা খাবে তো তোমরা, দুধ না লিকার?’ পেছন থেকে মেজদা এসে বলছে—আমারও করো এক কাপ। মেজদা ছোড়দির থেকে প্রায় তিন বছরের বড়ো। প্রাইভেট কোম্পানিতে উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। প্রায়ই বিদেশ যায়। বউ অসামান্যা রূপসী। মার সাথে কখনোই বনিবনা হয়নি। কিন্তু মনটা ভালো। মেজদার একটিই পুত্র। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিটেক করছে। মেজদা বসল ঘরের জানলার উঁচু ধাপটায়। ছোড়দি বলল, মৃত্যু খুব স্বার্থপর দৈত্যের মতো। তার বাগানে আর সকলের প্রবেশ নিষেধ। যদি এন্ট্রি ওপেন হতো, তাহলে আমি একটু কথা বলে আসতাম। আর তো কেউ নেই, যার সাথে কথা বলব, সব কথা বলা যায়।
খানিক থামল। আবার শুরু করল, মার অনেক দুঃখ ছিল জানিস বাবু। বড়দা মুখ তুলল। কিছু বলেনি। মেজদা নিচু গলায় বলল, যেমন? বড়দা বলল, স্নেহ নিম্নগামী। মা-বাবা তার সন্তানদের স্নেহ ভালোবাসায় ভরিয়েই রাখে। সন্তানরা আর সে কথা কতটা বোঝে! মেজদা রেগে গেল। বলল, আই বেগ টু ডিফার। মা-বাবা কখনো সন্তান কি রিটার্ন দেবে ভেবে কিছু করে না। তারপরই বলল, ঠিক আছে আজ তাহলে মাকে নিয়েই কথা হোক। না, অসম্মতি কেউ দেখায়নি। টমিও এসে আমার পাশে বসল।
তিন.
বড়দা আবার ধুপ জ্বালিয়ে দিলে পর, ছোড়দি শুরু করল মেয়ের কাছেই মা মুখ খোলে। আমি বাড়ি আসলেই মা বলত মেজদার কথা। মা, মেজদাকে খুব ভালোবাসত। এই যে মেজদা এ দেশ ও দেশ ঘুরে বেড়ায়, ফিরে এসে একবার দেখা করুক, এটা কিন্তু মার খুব ন্যূনতম প্রত্যাশা। মেজদা কিন্তু কখনোই তা করত না। আত্মীয় স্বজন ভাবত মেজদার বউ নিয়ে বুঝি মা অসন্তুষ্ট। একদমই মা তা ছিল না। রিঙ্কি জানে, মা তাকে কতটা ভালোবাসত। মার সাথে তার কথাও হত প্রায়ই ফোনে। অবশ্য মেজদা তো ভালো চাকরির সাথে অর্জন করেছে অনেক বদগুণও। সেগুলোও রিঙ্কি মা’কে বলত। সে যাই হোক মেজদা কিন্তু মার জন্য ফিলটুকুও করত না। অথচ আমার মনে আছে মা তার জন্য নিজের গয়না বন্ধক দিয়ে টাকা দিয়েছিল মেজদার ফ্ল্যাট কেনার সময়। আমি একমাত্র মেয়ে, আমার বেলা মা একছড়া হার, দুটো কানের দুল দিয়ে বলেছিল, আর তো নেই। কী করব বল! এ নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে কম গঞ্জনা শুনিনি। তা নিয়ে আমি কিছু বলিনি মা’কে কখনোই। বলিনি, আমার আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল, মা রাজি হয়নি। আর একটু পড়লে, আমিও আজ হয়তো স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করতাম। বরের কাছে সম্মান বিকিয়ে হাত পাততে হতো না। আর হ্যাঁ বাড়ি আসলেই মা বলত, মেজটা এত ব্যস্ত, একবার মার সাথে দেখা করার সময় ও পায় না! সরি মেজদা, কিছু মনে করিস না। মা আজ নেই। বলে ফেললাম।
আমার আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল, মা রাজি হয়নি। আর একটু পড়লে, আমিও আজ হয়তো স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করতাম। বরের কাছে সম্মান বিকিয়ে হাত পাততে হতো না। আর হ্যাঁ বাড়ি আসলেই মা বলত, মেজটা এত ব্যস্ত, একবার মার সাথে দেখা করার সময় ও পায় না! সরি মেজদা, কিছু মনে করিস না।
সাবিত্রীদি চা দিয়ে গেছে। সাথে সেঁকা পাপড়। আর বিস্কুট। মেজদা একটু উত্তেজিত। শুরু করল, ‘দেখ নীতা, মা আমায় ভালোবাসত, না তোকে আমি জানি না। আমি বরাবরই বাড়ির সান্নিধ্য কমই পেয়েছি। আজ আমি যা, তাতে আমার বাবা বা মায়ের তেমন কোনো কন্ট্রিবিউশন ছিল কি না জানি না। আমি সেলফমেড ম্যান। বাবা মারা যায় যখন, খুব অর্থ কষ্ট, বড়দা এমকম করে সিএ পড়ছে। ছোটো তুই তখন মাত্র পনেরো, আর বাবু ন’বছর। তোর অত খেয়াল নেই। বাবা কী টাকা রেখে গেছে মৃত্যুর সময় আমরা কেউই জানতাম না। মা স্বাধীনচেতা মহিলা ছিলেন। লেখাপড়া জানত। তবু, মা সোয়েটার বুনত। যা টাকা পেত, বড়দার পড়ায় দিত। আমি কিন্তু ক’বছর মাত্র পরই যখন বিজনেসে ভর্তি হলাম মা হাত উলটে দেখিয়ে দিয়েছিল তার কিছু নেই। বড়দা জানত, তুইও জানতিস। আমি টিউশন পড়িয়ে আমার পড়ার খরচ জোটাতাম। হ্যাঁ, রিঙ্কি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চেয়েছিল। কারণ সেও স্বাধীনচেতা। তা বলে মার প্রতি তারও অশ্রদ্ধা ছিল না। আমার ধারণা বড়ো বউদি বা তোর বরের থেকে মার সাথে রিঙ্কির যোগ ছিল বেশি। বাকি আমার বদগুণ নিয়ে রিঙ্কি মাকে কী বলত, তা এখন আলোচনার কথা নয়। তাই সে কথা বলব না।’
বৃষ্টিটা জোর হলো। বাইরে জল জমেছে। মা’র চলে যাওয়াটা কি আকাশও টের পেয়েছে। প্রকৃতিও কি তার সাথে সহবাস করা মানুষকে মিস করে! এই যে মৃত্যু, হয়তো আনটাইমলি নয়, তবু একজনের ‘না’ হয়ে যাওয়াই তো। প্রকৃতি যদি অনুভূতি সম্পন্ন হয়, মিস করার কথা। আমার খুব সিগারেট খেতে মন চাইছিল। বলতে যাচ্ছিলাম, একটু বাইরে থেকে আসছি। বড়দা বুঝতে পেরে বলল, ‘তুই অ্যাডাল্ট। সিগারেট খেতে বাইরে যাস না। এখানেই খা।’ আমি সিগারেট ধরালাম অগত্যা। বড়দা এবার মুখ খুলল, ‘মেজো ঠিক বলেছে। মার প্রথম সন্তান হিসেবে, স্নেহ বল বা বাৎসল্য আমার প্রতি অনেকটাই ছিল। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তার বড়ো ছেলে কেউকেটা হোক। বাবার মৃত্যুর পর, সে কথা মা নিজেই আমায় জানিয়েছিল। মা আমার কষ্ট কখনো সহ্য করতে পারত না। এখানে একটা কথা বলা জরুরি। বাবা কিন্তু সরকারি চাকরি করেও পয়সা রাখতে পারেনি। কাকে দিত পয়সা, কী করত জানি না। মা কখনো ভাঙত না। কিন্তু পরে জেনেছিলাম বাবার পিসতুতো বোন অল্পবয়সি বিধবা নীরু পিসির প্রতি বাবার কেমন জানি মায়া দয়া ছিল। তার পরিবারকে বাবাই টানত। এ নিয়ে বাবা-মার ঝগড়াঝাঁটিও কম হয়নি। অবশ্য ঝগড়া বলা ভুল, বাবা কিছুই বলত না। মা বলে যেত একতরফা। আর হ্যাঁ, বাবুকে নিয়ে মার দুশ্চিন্তার কোনো অবধি ছিল না। সব থেকে ছোটো ও। কিন্তু মদ, গাঁজা, এমনকি ড্রাগের নেশাও… মা কেবল কাঁদত। বলত বড়ো কিছু কর। আমি কী করব? প্রত্যেকের বয়স হয়েছে। যার যার মতো করেই বড়ো হয় সবাই। মা বলত, বাবুকে বললেই সে নাকি বলত কবিতা লিখলে এসব করতে হয়। আমার সত্যি জানা নেই সব কবিই গাঁজা মদে চুর হয়ে থাকে কি না। মা আর শেষের দিকে পারতও না, বলে বলে হতাশ! উদিতা, বাবুর বউ চলে গেল বাবুকে ছেড়ে, আমি তার কোনো দোষ দেখি না। স্বামীর তো কিছু মিনিমাম রেসপনসিবিলিটি থাকে, ও কি’ই বা তার জন্য করত? মার থেকে টাকাও নিত অহরহ। পরে উদিতা চলে গেলে ওর চেঞ্জ এলো। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। মা কিন্তু তার অপত্য স্নেহ দিয়ে বাবুকে নষ্টই করেছে। মাকে এ নিয়ে বলতে গেলেই বলত, এবার চলে গেলেই বাঁচি বড়ো। আর বলিস না। অনেক পেলাম তোদের সংসারে থেকে, বলে কাঁদত।’
বড়দা চোখের জল মুছছে। ছোড়দিও। এমনকি মেজদাও। ছোড়দি বলল, ‘বাবু, তুই কিছু বলবি?’ আমি কিই বা বলব। খুব শীত করে, তবু বললাম, ‘আমি শুনছিলাম মা’র কথা তোমাদের মুখে। আমি অনেক দোষে দোষী বটেই। কিন্তু আমার মনে পড়ছে আমার গান শিখতে যাওয়া, যেতাম না, তবু মা জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে যেত। কবিতা লিখতে শেখা বা আবৃত্তি, মা’ই তো সব। বাংলা কবিতার প্রতি আমার যে প্রেম, তা মা’র জন্যই। হ্যাঁ, মা আমায় নিয়ে অনেক কষ্টতে থাকত। আর উদিতার চলে যাওয়া, বা অন্য কোনো কিছুর জন্যই মা কোনোভাবেই দায়ী নয়। মেজদা আর ছোড়দি যেভাবে মাকে দুষল, আমার কিছুই বলার নেই। বরং মাকে দেখেছি দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে। যা শেখার জিনিস। আমার সাঁইত্রিশের জীবনে এত সেলফ ডিগনিফায়েড কাউকেই আমি দেখিনি। এমনকি কাল মারা যাবার আগেও শেষ টয়লেটটাও নিজেই বাথরুমে গিয়ে করেছিল। আমি ধরতে গেলে বলেছিল, বাবু, ঈশ্বর বলে একজন আছেন, তিনি দুই পা, আর মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিয়েছেন, অন্যের ওপর নির্ভরতা মানুষের পদস্খলনের কারণ! জানি, আমি কখনো মাকে ভালো রাখতে পারিনি, ভালো লাগার মতো, গর্ব করার মতো কোনো কাজও করিনি। মাকে দিতেও পারিনি কিছুই।’
ছোড়দি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘অরু তুই না, আমরা কেউই কিছু মাকে দিতে পারিনি। এমনকি বাবাও। হয়তো বাবার কাছেই প্রত্যাশা ছিল, আর কারোর কাছে নয়। আর মা নেওয়ার লোকও ছিল না।’
চার.
বাইরে বৃষ্টি একইভাবে পড়ছে, মেজদা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, ‘বাবু দেখ, মার খাটটা কি নড়ছে?’
আমি তাকানোর আগে দেখলাম টমি ঘেউ ঘেউ করছে, আর খাটটার গায়ে গা ঘষছে। ও কি কিছু বলতে চায়? মার শেষ সন্তান হয়তো ওই…বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে বাসন পড়ার শব্দ হলে ছুটে গেলাম। সাবিত্রী মাসি কেমন থম মেরে বসে, বলল, তোমার মা এসেছিল, মনে হলো। বলল, সাবু ছেলেমেয়েগুলোকে দেখ একটু। কী জানি হয়তো মনের ভুল!
কানে এলো স্পষ্ট মা বলছেন, ‘বাবু আমি যাইনি, এই বাড়ি ঘর টমি, সাবু এসব তো মায়ার বন্ধন। এ ছেড়ে কি এত সহজে যাওয়া যায়!’ আমি, অস্ফুটে বললাম, ‘তুমি কই?’ মা উত্তর করল, ‘এই তো বাগানে, কামিনী ফুল গাছের নিচে।’
জীবন কি প্রকৃত এক সুগন্ধ? ছেড়ে গেলে পড়ে থাকে পচা গন্ধওয়ালা একটা অবয়ব? বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়তো প্রতিদিন মৃত্যু ঘটে, কত ইচ্ছে, আশার মৃত্যু নিয়েই তো এগোতে হয়। কানে এলো স্পষ্ট মা বলছেন, ‘বাবু আমি যাইনি, এই বাড়ি ঘর টমি, সাবু এসব তো মায়ার বন্ধন। এ ছেড়ে কি এত সহজে যাওয়া যায়!’ আমি, অস্ফুটে বললাম, ‘তুমি কই?’ মা উত্তর করল, ‘এই তো বাগানে, কামিনী ফুল গাছের নিচে।’ দৌড়ে যেতে যাচ্ছিলাম, মেজদা খপাৎ করে হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল, ‘বাবু যাবি না। দাঁড়া।’
আমরা চারজন আর টমি বাইরের পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি, এতক্ষণ প্রবল চিৎকার চেঁচামেচির পর টমি এই থামল। বৃষ্টি ধরে আসছে এবার। মেজদা আর ছোড়দি বেরুল, বড়দা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরোনোর আগে বলল—
‘বাসাংসি জীর্ণানি!’
আমি ওদের চলে যাওয়া দেখছি…
অনেক ফুল পড়ে রয়েছে কামিনী গাছটার নিচে।
দূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে, ফুল ফুটিয়ে গেল শতশত, আমার প্রাণের পরে…
আকাশ থেকে নেমে আসা জলে মিশছে, আমার গাল বেয়ে নেমে আসা লবণাক্ত জল, যেভাবে মেশে…
জন্ম-১৯৭০। বিজ্ঞানে স্নাতক, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাইয় স্নাততকোত্তর। ‘ঐহিক’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। পেয়েছেন একাডেমি পুরস্কার-২০১৫, প্রকাশিত বই : তিতিরের নৌকো যাত্রা, হ্যালুসিনেটেড অক্ষরমালা ও নিঝুমপুরের না রূপকথা