মৃত্যু
এখন আমার সঙ্গে যেটা ঘটল, ডাক্তারি পরিভাষায় বলে
সোমাটিক মৃত্যু। এখনো আমার মস্তিষ্কের কোষগুলো
বেঁচে আছে। যদি জবানবন্দি নিতে পারো, এখনও কিছু সত্য
খুঁজে পাবে, যা এত দিনের সত্য সমূহের চেয়ে একটু বেশি।
ভর ও ভারহীনের রাজত্বে ঢুকে পড়েছি আমি। নিজের
ভেতর থেকে নিজেকে বার করে নিয়েছি। পড়ে আছে আমার
খোসা। খোলস ছাড়ার ব্যথা কিছু অনুভূত হবেই। কিন্তু
আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি, আমার ভেতরের হাজারো সাপ,
আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সাপেরা চলে গেলে আমি অভিশাপ মুক্ত।
কারণ, অকারণ যাই হোক, কেউ আর আমাকে বিব্রত করে না
বাড়ির কথা বলে; সব দরজা বন্ধ করেছি কি না, তালাচাবি
দিয়েছি কি না ভেতর বার। এখন কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না
দূরে ওই বাড়ির ছাদে, শীতের রোদে, কে মেলে বসেছে
তার চুল। কারণ এখন আমি আর কোনো তুমির জন্য কাঁদি না।
সব কান্না আমি উইল করে দিয়েছি তোমার নামে।
এখন আমার এই আমি-হীন শরীর খুব ঠান্ডা। কিন্তু সরীসৃপ নই।
মৃত্যুর আগে
বাড়ির চতুর্দিকের গাছেরা খুব নিজঝুম। যে অন্ধকার এ বাড়ির
চতুর্দিকে ছিল আমার আশ্রয় হয়ে, আড়াল হয়ে, আরাম হয়ে, সে
আজ তার নিজের অন্ধকার রূপ দেখে বিমূঢ়। বুকের ভেতর থেকে
উপড়ে বার করে নেওয়া হয়েছে সেই বিষগাছকে, যার চুম্বন
বিছের মতো। বাড়ির ছোট্ট উঠোনটা আজ মহাকাশের অন্তহীনতাকে
চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, তাচ্ছিল্য করছে।
জীব আর জড়ের পার্থক্য জানতাম প্রচুর। জীবনকে দিয়েছি
প্রাপ্যের অধিক ভালোবাসা। জড়কে নিষ্প্রাণ বলে উপেক্ষা
করেছি প্রতিদিন। এখন আমি নিজেই জড়, নিজেই জীব। জীবন
আর মৃত্যুর অদৃশ্য পরিমাণ ফারাক এখন আর দুস্তর নেই।
জীবনের সব ভ্রান্তিগুলো উঠে বসেছে সত্যের জামা গায়ে দিয়ে।
পোষা বেড়াল কেঁদে বেড়াচ্ছে। সাধের কুকুরটা মন খারাপ করে
শুয়ে আছে। আমি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, টের পাচ্ছে না। পুবে
পুকুরের জলে ঝপাং করে একটা শব্দ হলো, শুনলো না কেউ।
কোমা
এক নতুন ধরনের ঘুম আমার মধ্যে বিরাজ করছে।
এর জন্য
তোমরা বলছ আমি সংজ্ঞাহীন। ডাক্তারে একে বলছেন কোমা।
গুণে গুণে তিরিশ দিন হয়ে গেল আমি এই স্বপ্ন-সুখের মধু
পান করছি।
গত আশি বছরের জীবনে আমার প্রাপ্তি ছিল কাটা ঘায়ে
আর একবার চাবুক। বিষণ্ণ আকাশের নামে ঢিঢি, আর
ক্যানভাসের উপর বাদুড় বিষয়ক প্রবন্ধের পণ্ডিতি। উত্তেজকের
অধীনে ছিল আমার স্নায়ুতন্ত্র। ময়ূরপুচ্ছের ঢলানি কিংবা
রামধনুর ভিবজিওর যুবতীর ঘাড়ে গলায় যতই খেলা দেখাক
আমাকে আর ফেলতে পারবে না মুগ্ধতার ফাঁদে।
তোমাদের যা-কিছু সম্পদ আমাকে ভিখারী করেছিল আমারই
বুকের মধ্যে, চোখের কর্নিয়ায়, সেসব এখানে প্রচুর, অগাধ,
অথৈ। এবং আমাকে পেতে চেয়ে তারাই ভিখারী।
অন্য এক ভুবনে রয়েছি এখন, অন্য এক ভবন। আমি, তুমি,
ওরা, তারা— কেউ নেই। অসংখ্য আর অসীমের শূন্যও
সামান্য হওয়ার ম্যাজিক কেবল।
অচেতনের চেতন
রাত্রে ঘুমের মধ্যে ছিলাম। ঘুম আমাকে ছেড়ে ঘুরতে
গিয়েছিল কোথাও। প্রচুর জল ছুটে আসছিল আমার
বুকে। কে যেন তাদের আটকে রেখেছিল এত দিন।
পৃথিবীর সব জল আজ মুক্ত। আমাকে ভালোবাসবার
জন্য পাগল। জলের সঙ্গে আমি অভেদ হয়ে আছি।
আমিও জল। এবার ভাসিয়ে দেবো পাথর-সন্ন্যাস।
দরজায় লোহার কড়াগুলো বরফের মতো গলে পড়ছে।
লোহার গায়ে লোহা লাগিয়ে যারা তস্করের থেকে
নিশ্চিত ছিল, তাদের সমস্ত প্রাসাদ উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে।
আমি দেখছি, তারা দেখতে পাচ্ছে না। ঘুম বুঝি তাদের কাছেই
গেছে ভালোবাসার মায়ারূপে।
আকাশের নক্ষত্ররা এসেছে দলবেঁধে। তারা আমার
দেখা পেতে চায়। কথা বলতে চায়। কেউ কেউ তো
আমার কাছে আলোও চাইতে এসেছে। আমি তাদের
কাউকে বিমুখ করব না। আমাকে পাওয়ার তৃপ্তিতে ওরা
উজ্জ্বলতর ক্রমশ।
স্ট্রোক
গাছে তখনো পলাশ এবং গোলাপ দুজনেই ছিল।
সতিন-সতিন ভাব, সই-সই ভাব। অদূরে মহেশ্বর
ডমরু হাতে, গলায় বাসুকির সোহাগ। একটি সজীব
বাঘ সামনে হেঁটে যাচ্ছে তার সঙ্গে, নগ্নতা আড়াল করে।
যত হাঁটছে, রাস্তা তত দীর্ঘ হচ্ছে। ক্লান্তি এসে সাহস দেখায়
চ্যালেঞ্জের। জটা ভারী হয়ে আসে। চাঁদের জ্যোৎস্না অসহ।
সম্পূর্ণ অচেনা এক মহেশ্বরের উপস্থিতি টের পায় দেবাদিদেব।
হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করে, হাঁটা পথ ছোটো হয়ে আসছে
ক্রমশ, দুদিকের টান ছেড়ে দেওয়া ইলাস্টিকের মতো।
ছোটো হতে হতে সেটা তার পায়ের তালুতে ঢুকে গেল।
ব্ল্যাকহোল যেভাবে সব গিলে নেয় বলে শুনেছে সে। তবে কি
তারই পায়ের নিচে সেই কালো তিল?
অচৈতন্য মহাদেব পড়ে থাকে রাস্তায়। ত্রস্তপদে আসা একটি
অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসে স্ট্রেচার। তুলে নেয়।
সাইরেন বাজিয়ে ছোটে হসপিটাল। স্টেথোবাদী ডাক্তারে
তাকে পরীক্ষা করে বলেন— স্ট্রোক।