আমাদের এ সপ্তাহের ‘শনিবারের আড্ডা’ নির্ধারিত সময়েই শুরু হয়। তবে আহমাদ মাযহার ঘরে ঢুকেই জানালেন, আজ আমাদের আড্ডাবাজদের কেউ কেউ বিপাকে পড়েছেন, আসতে পারবেন না। নসরত শাহ একটি জরুরি কাজে আটকা পড়েছেন, তানভীর রাব্বানী নিউ জার্সিতে একটা পারিবারিক কাজে আটকা। তাই আমরা দুজনেই আড্ডা শুরু করি, কিছুক্ষণ পর কবি এবিএম সালেহউদ্দিন এসে উপস্থিত হন। তাই আড্ডাটা ছিল তিনজনের। আড্ডায় বন্ধুদের আধিক্য হলে তার যেমন একটা ভিন্ন সৌন্দর্য থাকে, আবার একেবারে স্বল্পসংখ্যক সদস্য থাকলেও অন্যরকম সৌন্দর্য দেখা যায়। প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি সময় আগে কবি সৈয়দ শহীদের বইয়ের দোকান ‘অনন্যা’য় প্রতিদিন বিকেলে, বা কখনও কখনও দুপুরে গিয়ে দেখতাম শুধু শহীদ একা। আমি আর শহীদ দুজনে আড্ডা শুরু করতাম, বাকিরা কখন আসবে, এই হতাশা-মিশ্রিত প্রশ্ন শুনে শহীদ হাসতেন। বলতেন, ‘আপনার না চিল্লাইলে ভালো লাগে না?’ কিন্তু বিষয়টা আসলে তা নয়, আমি আর শহীদ দুজনেই ভীষণ বিষণ্ণ মানুষ। দুজনে আড্ডা দিলে দেখতাম আমাদের ব্যক্তিগত এবং সমাজ-জীবনের হাজারটা বেদনাদায়ক বিষয় নিয়েই আমরা কথা বলতাম। আমার ভেতর তাও কিছুটা স্বপ্ন আর আশা দোলা দিত, কিন্তু শহীদ আজন্ম নৈরাশ্যপীড়িত মানুষ। কোনো কিছুতেই আলো দেখতে পেতেন না। সে সময় থেকে তিরিশ বা পঞ্চাশ বছর পর আমাদের সাহিত্য বা রাজনীতির চেহারাটা কী দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে বেশ স্বচ্ছ, কিন্তু বেদনাদায়ক ধারণা তাঁর ছিল, তাই প্রকাশ করতেন। যেকোনো বিষয়ে এমন হতাশ হলে আমি যদি মৃদু প্রতিবাদ করতাম, শহীদের সেই তির্যক মন্তব্য, ‘আপনি এই বাঙালি মুসলমানদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পান? আপনি ভাই পারেনও যত সব উদ্ভট স্বপ্ন দেখতে!’ বিষণ্ণতা ছেয়ে থাকত আমাদের কথাবার্তায়! জ্যাকসন হাইটসের ৩৭ এভেনিউর কোণার দোকান থেকে অথবা রুজভেল্ট এভেনিউর ‘ডানকিন ডোনাট’ থেকে কাপের পর কাপ কফি আর মাঝে মাঝে তাঁর প্রিয় ক্রোসানট আনতেন শহীদ। ক্রোসানট-কফিতে কী আর বিষণ্ণতা কাটে!
যেকোনো বিষয়ে এমন হতাশ হলে আমি যদি মৃদু প্রতিবাদ করতাম, শহীদের সেই তির্যক মন্তব্য, ‘আপনি এই বাঙালি মুসলমানদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পান? আপনি ভাই পারেনও যত সব উদ্ভট স্বপ্ন দেখতে!’ বিষণ্ণতা ছেয়ে থাকত আমাদের কথাবার্তায়!
এভাবেই কেটে যেত অনেকটা সময়, সন্ধ্যার দিকে আদনান সৈয়দ, শিবলী আজাদ আর অর্ণব এলে ঘরটা একেবারে ঝলমল করে উঠত শিল্প-বিষয়ক কলকাকলিতে। শিবলীর দুর্দান্ত সব বই আর লেখকদের নিয়ে আলোচনা, অর্ণবের কলকাতার লেখকদের নিয়ে ভাবনা, আর আদনানের হাজারটা বিদেশি সাহিত্যিকদের বিষয়ে মন্তব্য আমি আর শহীদ মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, আমার আর শহীদের বিষণ্ণতা অনেকটা কাটত! দেশ থেকে মাত্র ক’বছর এসেছি, হাজার হাজার প্রিয় বই হাতের কাছে, কেনার সামর্থ্যের মধ্যে। শুধু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর বই পড়াই কাজ সারাদিন রাত ধরে। এর চেয়ে স্বপ্নের জীবন আর কী হতে পারে! যদিও জীবন বিষয়ে বুদ্ধিমান বন্ধুরা ‘অনন্যা’র আড্ডা গোষ্ঠীকে কিছুটা বখে যাওয়া দেশ-পালানো বোহেমিয়ান মানুষ ভাবতেন, আর নিজেরা টাকা কামানোর হাজারটা ফিকিরে মজে থাকতেন, মার্কিন দেশ তো টাকারই দেশ, যারা চালাক চতুরভাবে তা ধরতে জানে। আমি আর শহীদ দুজনেই আস্ত গাধা এ বিষয়ে! আজ কয়েক দশক ধরে ‘অনন্যা’র এই প্রিয় মানুষগুলোকে কী যে মিস করি!
মেশিনে কফি বানিয়ে আমি আর মাযহার বসতেই মাযহার নিজেকে অতোটা ‘ভালো মানুষ‘ যে নন সে-দাবি তুলেই বলতে থাকেন কেন ভালো মানুষরা সমাজের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর! ভালো মানুষ নন, মাযহারের এই দাবি খণ্ডন করার কোনো ইচ্ছাই আমার মাঝে জাগল না। কারণ অনেকদিন আগে পড়া রাসেলের একটি প্রবন্ধ মনে পড়ল। বসে বসে মাযহারের এই দাবির পক্ষে যুক্তিগুলো শুনতে থাকলাম আর ভাবলাম, তাহলে ওঁর যুক্তির সঙ্গে রাসেলের যুক্তির সাদৃশ্য আছে কিনা। মনে হল রাসেলের প্রবন্ধটা মাযহারের চোখে না পড়লেও যুক্তির কিছুটা সাদৃশ্য আছে। প্রথমে ভাবলাম সম্ভবত মশকরা করছেন, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টা নিয়ে তিনি গভীর চিন্তা উদ্রেককারী কথাবার্তা শুরু করলেন। আমি শুধু শ্রোতা, মনোযোগ দিয়ে শুনছি। এর মধ্যে মাযহার একবার আমার দিকেও তীর ছুঁড়লেন এই বলে যে, ‘এভাবে সন্ন্যাসীর জীবন আপনার আসলে পালানো জীবন। আমি চাই ফাংশনাল জীবন, মানে কার্যকর জীবন। সমাজের নানা কাজে, নানা বিষয়ে যোগ দিয়ে নিজের বক্তব্য ঘোষণা করব, ব্যর্থ হলে ক্ষতি নেই! আপনার মতো অকার্যকর ভূমিকায় আমি থাকতে রাজী না!’ আমি একটু নীরব রইলাম। কারণ আমি তো খুব বেশি অকার্যকর মানুষ নই, তবে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সঙ্গে আমি জীবনে জড়িত হতে রাজী নই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস একজন আধুনিক’ মানুষ ‘জনতার জঘন্য মিতালি’ মেনে নিতে পারে না, যদি তাঁর বোধ তাঁকে রুচিশীল রাখে! আর সংগঠন মানেই তো জনগণের ভীর আর ধূর্ততা। মাযহারের সঙ্গে এখানে আমার পার্থক্য, তবুও আমি নীরবে ওঁর যুক্তিগুলো শুনছিলাম!
মাযহারের কথার সঙ্গে মিল পেলাম বার্ট্রান্ড রাসেলের ১৯২৬ সালে লেখা একটি প্রবন্ধ The Harm that Good Men Do, শিরোনামের প্রবন্ধটির। সত্তর সালে তখন মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি, তেপ্পান্ন বছর আগে। শওকত ওসমান স্যার মাথার মধ্যে রাসেল ঢুকিয়ে দিলেন। আমি কলেজ লাইব্রেরি আর নিউ মার্কেট থেকে রাসেলের সব বই একটা করে সংগ্রহ করি আর দিনে ও রাতে সারাক্ষণ পড়ি। আমি একটা ঘোরের মধ্যে কাটাই কয়েক মাস। রাসেলের ক্ষীণকায় জনপ্রিয় সব বই আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে যায়। তেমনি একটি প্রবন্ধের বইতে আমি এই লেখাটা পাই, প্রথমে পড়ে ভেবেছি রাসেল সাটায়ার করছেন। খুব দীর্ঘ নয়। সাত আট পাতার প্রবন্ধ। বিলেতের দার্শনিক লেখক জেরেমি ব্যানথামের একটি লেখাকে উল্লেখ করে ইতিহাস থেকে তুলে ধরেন যাদেরকে সমাজ ‘ভালো মানুষ’ বলে জানে তারা কী ভীষণ ক্ষতি করে সমাজকে। বিশেষ করে কবিদের কথা লেখেন রাসেল, দেখা যায় অধিকাংশ ইতিহাসের বিখ্যাত কবিগণ সবচেয়ে ভালো কবিতা লেখেন যখন তিনি অনেকটাই দুশ্চরিত্র মানুষ হিশেবে সমাজে পরিচিত। রাসেলের এই লেখাটা আজও মনে পড়লে বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কবির কথা আমার মনে পড়ে। দরিদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না মানুষটার, কিন্তু দারিদ্র্যের মধ্যেও ভালো কবিতা লিখেছেন, কিন্তু পরে দেখা যায় মানুষটা সমাজের নিকৃষ্ট কিছু কাজ করে, নিজের আখের গোছায়। স্কুলের শেষ উপাধিটিও তাঁর ছিল না, কিন্তু জাতির পিতার দাক্ষিণ্য ও দয়ায় একটি প্রথম শ্রেণীর চাকুরী পায়, যদিও তাঁর দয়ার প্রতি অকৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে অনেক মিথ্যাচারও করে পরে। সময় গড়ায়, এরপর দ্বিতীয় আরেক সেনাশাসকের পদলেহন করে গুলশানে বাস করার ক্ষমতা বা সংগতি অর্জন করে। ঢাকা শহরে একাধিক বাসস্থানের মালিক হয়, কিন্তু ততদিনে তাঁর প্রথম যৌবনের কাব্যক্ষমতা লোপ পায়। রাসেল তাঁর প্রবন্ধটিতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিষয়ে তেমনি কিছু বাক্য লেখেন। তরুণ বয়সে ফরাসী বিপ্লব সমর্থন করে, বিপ্লবীদের সঙ্গে কাঁধ মেলায়, কিন্তু প্রবীণ বয়সে যা হবার তাই হন, রক্ষণশীল রাজনীতির নৈকট্য লাভ করে।
মাযহার সমাজের ‘ভালো মানুষের’ যে সংজ্ঞা দেন তা প্রায় রাসেলের দেওয়া সংজ্ঞার মতই। ‘ভালো মানুষরা’ সিগারেট বা মদ খায় না, মানুষের সঙ্গে কোনো কটু ভাষায় কথা বলে না, কখনই এমন কিছু করে না যাকে ইমমরাল বা আনএথিকেল বলা যেতে পারে। কিন্তু রাসেল বোঝানোর চেষ্টা করেন এই এথিকেল বা মরাল বিষয়টি যে উদ্দেশ্য নিয়ে সমাজ থেকে উৎসারিত তা প্রশ্নবিদ্ধ।
মাযহারের সমাজ ও ‘ভালো মানুষ’-এর দীর্ঘ ব্যাখ্যা চলার সময়ই কবি এবি এম সালেহউদ্দিন অনেক খাবার নিয়ে উপস্থিত। সালেহকে বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও প্রতিবারই তিনি খাবার নিয়ে আসেন। আমার ধারনা সালেহ সম্ভবত যে পারিবারিক শিষ্টাচার নিয়মিত পালন করেন তাঁর মধ্যেই এই অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে। কিছুটা খেতে খেতে আড্ডা চলছে। মাযহারকে সালেহ ও আমি আমাদের এখনকার ঢাকার সাহিত্য বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করি। বিশেষ করে উপন্যাস ও ছোটোগল্প বিষয়ে। মাযহার কথা শুরু করতেই কবি শামস আল মমীন ঢাকা থেকে টেলিফোনে আড্ডায় ভারচুয়ালি যোগ দেন প্রতি সপ্তাহের মত। মমীন ভাই প্রথমেই প্রশ্ন করেন কী বিষয়ে বক্তৃতা চলছে। মাযহার বিষয়টা জানান, আজকের সময়ের ঢাকার সাহিত্য। মাযহার তরুণদের লেখা সম্পর্কে বলার আগে আমাদের কথাসাহিত্যের গুণাগুণ, বিশেষ করে পঞ্চাশ এবং ষাটের লেখকদের কয়েকজনের লেখা সম্পর্কে মতামত দেন। আমার সাপ্লিমেন্টারী প্রশ্ন ছিল আমাদের ষাটের বা একটু আগের কথাশিল্পীদের, বিশেষ করে শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ বেশ কয়েকজনের লেখা সম্পর্কে বাজারে যে উঁচু খ্যাতি, আসলে কি তাঁদের সব লেখা সেই মানের কিনা! আমি শওকত আলী এবং ইলিয়াস ভাইয়ের কিছু লেখা সম্পর্কে প্রশ্ন রাখি, যেমন ‘চিলে কোঠার সেপাই’ উপন্যাসের চরিত্র আনোয়ার নিয়ে, বা এই একই নামে ‘উৎসব’ গল্পের চরিত্রটি বিষয়ে। মাযহার মনে করেন ‘চিলেকোঠার’ আনোয়ার অনেকটাই কষ্টকল্পিত ও বানিয়ে ‘সৃষ্ট চরিত্র’। এছাড়া শওকত আলীর কিছু ভালো লেখা থাকার পরও তাঁর অনেক লেখায় রাজনীতি লেখার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে কিছুটা ব্যাহত করেছে।
শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ বেশ কয়েকজনের লেখা সম্পর্কে বাজারে যে উঁচু খ্যাতি, আসলে কি তাঁদের সব লেখা সেই মানের কিনা! আমি শওকত আলী এবং ইলিয়াস ভাইয়ের কিছু লেখা সম্পর্কে প্রশ্ন রাখি, যেমন ‘চিলে কোঠার সেপাই’ উপন্যাসের চরিত্র আনোয়ার নিয়ে, বা এই একই নামে ‘উৎসব’ গল্পের চরিত্রটি বিষয়ে। মাযহার মনে করেন ‘চিলেকোঠার’ আনোয়ার অনেকটাই কষ্টকল্পিত ও বানিয়ে ‘সৃষ্ট চরিত্র’।
আসলে আমাদের সে সময়ের কথাশিল্পীদের যতটা বড়ো মনে করা হয়, ততটা হয়তো নয়, যদি তাঁদের লেখা সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পীদের লেখার সঙ্গে তুলনা করা হয়। তবে মাযহারের বক্তব্য হল শওকত ওসমানের লেখা অনেকদিক থেকে ব্যতিক্রম। কারণ তিনি এবং আবু রুশদ বা আবু ইসহাক মুসলিম সমাজের অনেক নিগড় ভাঙার চেষ্টা করেছেন এবং অনেকখানি সফলও হয়েছেন। সেসব উদাহরণ দিতে গিয়েই মাযহার নতুন করে বেগম রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করেন, যা সময় থেকে অনেক এগিয়ে থাকা লেখা। আমি একটা তুলনামূলক ভাবনার কথা বলেছি, আজকালকার তরুণ লেখকদের লেখার উল্লেখ করে। শুধু তরুণরাই নন, বরং অনেক তরুণী লেখক তরুণদের চেয়ে বেশি ভালো লেখেন বলে আমার মনে হয়েছে। আমি সবার লেখা পড়ার সুযোগ পাইনি, কিন্তু সেগুপ্তা শারমিন, ইসরাত তানিয়াসহ কয়েকজন তরুণী গল্প লেখেন, বা সাবেরা তাবাসসুম, সাকিরা পারভীন কবিতা লেখেন, তা তাঁদের সমকালীন তরুণ কথাশিল্পী ও কবিদের লেখার চেয়ে বেশি ভালো লাগে কেন! এর জবাবে মাযহার দেন, এছাড়া তিনি আমার ভালোলাগার কারণ হিশেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। সেটি হল, আজকালকার এসব তরুণী কথাশিল্পীরা তাঁদের জীবনসংগ্রামের কথা অনেক সৎভাবে চিত্রিত করার সাহস রাখেন। এঁদের ভাষা ও গল্পের বা উপন্যাসের নির্মিতিও সম্পূর্ণ আলাদা। এঁদের চরিত্র নির্মাণে বা চরিত্রদের মনোজগৎ সৃষ্টিতে যে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অনুপুঙ্খ ছবি দেখা যায় তা তাঁদের সমকালীন তরুণ লেখক বন্ধুদের লেখায় কম। কথাটি ভেবে দেখার মত। আমি যদিও সবার লেখা হাতের কাছে পাই না, যা পাই তা গোগ্রাসে পড়ি, কিন্তু অনেক উল্লেখযোগ্য তরুণ তরুণীর লেখা আমি সহজে সংগ্রহ করতে পারি না। তাই আমি যে দুয়েকজনের লেখা পাই তাঁদের লেখা পড়ে ভালো লাগার কথা জানালাম, আমার বিচার সার্বিক বিচার নয়, কারণ আমার ধারণা অনেক ভালো তরুণ কবি বা কথাশিল্পীর লেখা আমি পড়তে পারিনি। তাই আমার মন্তব্য এক পেশে হতে পারে। তবে আমাদের কয়েকজন কথাশিল্পীর লেখা নিয়ে আমি ‘কথাশিল্পের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা’ নামে একটি গ্রন্থ লেখার গবেষণা কাজ করছি অনেকদিন ধরে, সেটাতে আমি প্রয়োজনীয় সবার লেখা পড়ে অন্তর্ভুক্ত করবো। আমাদের সমকালীন কবি মুজিবুল হক কবির, পুলক হাসান, সিদ্ধার্থ হক, ফরিদ কবির, তুষার দাশের লেখার আমি নিয়মিত পাঠক। গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা আমার ভালো লাগে। এমনকি তাঁর কবিতা বিষয়ক গদ্যও ভালো লাগে, যেমন আমার প্রিয় আমার সমকালীন কবি মিনার মনসুরের কবিতা ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ। একজন স্বল্পপ্রজ কথাশিল্পী উম্মে মুসলিমার গল্পও আমার ভালো লাগে। তবে সেগুপ্তা শারমিনসহ কয়েকজন তরুণীর কথাসাহিত্য সত্যিই খুব ভালো লাগে, যেমনটা আগে কম পড়েছি।
মাযহার আমাদের কথাশিল্পীদের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জানান, গত শতাব্দীর শুরু থেকে আধুনিক জীবনের জটিলতা ও বহুধাবিভক্তি বেড়ে যায়, আর তার কারণেই কথাশিল্পে জীবন-ব্যাখ্যার অন্তরমুখিনতা প্রধান উদ্দিষ্ট হয়ে দাঁড়ায়! ইউরোপে ফ্রয়েড বা ইয়ুং, অন্যদিকে বিজ্ঞানে আইনস্টাইন ও সমাজতত্ত্বে মার্কস বিশেষ প্রভাব ফেলেন শিল্পে। মাযহার বলেন, সমাজ সভ্যতার মর্মশায়ী গভীর ও দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধির ছায়া বিষয়ে মানুষের, বিশেষ করে শিল্পীরা মানুষের মনোময় সত্তার সন্ধানী হয়ে উঠেছিলেন। উপন্যাসিকরা জাতীয় চরিত্র চিত্রণের জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রিক বা জাতীয় ঘটনা-নির্ভর হওয়ার চাইতে ব্যক্তিক চরিত্রের অন্তরমুখীনতাকে রূপায়িত করতেই বেশি সচেতন হন বা মগ্ন থাকেন, যাতে মনোজগতের বিচিত্র-বর্ণিলতা বেশি বাঙময় করে তুলেছেন। মাযহারের এই কথা শোনার পর আমার মনে পড়ে জোসেফ কনরাডের কথা, যিনি তাঁর লেখায় বর্ণাঢ্যতা, বীর্যবত্তা ইত্যাদি ঝোঁকগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে উপন্যাসের গঠন সৌষ্ঠবে আশ্চর্য সৌন্দর্য সৃষ্টির কুশলতায় চরিত্রের অন্তরগামী স্বরূপকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের সাহিত্যের এই সময়ের তরুণ ও তরুণী কথাশিল্পীদের লেখা বিষয়ে মাযহারের বক্তব্য শুনেই মমীন ভাই টেলিফোনে ঢাকার আজকের কবিদের কবিতার ভাষা ও বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন। গত কয়েক বছর ধরে তিনি শীতের সময়ে কয়েক মাস ঢাকা বাস ও তরুণ কবিদের সঙ্গে মিশে, তাঁদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ে তাঁর যে ধারণা হয়েছে তিনি তা ব্যক্ত করেন। মমীন ভাই বলেন এই তরুণ তরুণীদের কাব্যিক মেধা অবশ্যই আছে, কিন্তু সম্ভবত প্রতিদিনের চারপাশের জীবন, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে সম্ভবত কৌতূহল আরেকটু বেশি থাকলে অনেক ভালো হত। খেটে খাওয়া মানুষের জীবন, জীবনের সংগ্রাম, জটিলতা, বা রাজনৈতিক অনুষঙ্গ থেকে উদ্ভূত বাস্তবতা যদি আমাদের কবি লেখকদের আরেকটু বেশি ধাক্কা দিত, যদি তাঁদের চিন্তায় আরেকটু বেশি অভিঘাত ফেলতে পারতো, সম্ভবত তাঁরা সত্যিই অনেক বেশি শক্তিশালী শিল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম, হোক তা কবিতায় বা কথাসাহিত্যে, বা চলচ্চিত্রে।
ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত সেনা-স্বৈরশাসকরা নীরবে বা সরবে যে-ধর্মীয় সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে, তাকে উপড়ে ফেলা দূরে থাক, তাকে আর রোধ করাই সম্ভব নয়। আমাদের দেশের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে আমরা যারা সারাক্ষণ তক্কাতক্কি ও উদ্বেগ প্রকাশ করি, তাঁরা সম্ভবত কখনও ভাবি না যে গণতন্ত্রহীনতা কি সমাজের বড়ো ব্যাধি, নাকি ইসলামীকরণের ফলে উদ্ভূত বিজাতীয় সংস্কৃতি বড়ো ব্যাধি।
এরপর সালেহ ও আমি আমাদের আজকের রাজনীতি বিষয়ে দুয়েকটি মন্তব্য করি। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের, বিশেষ করে রাজনীতিকরা চেয়েছেন বা চান নি, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, একটি ক্ষেত্রে বিপুলভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটাকে প্রতিহত করাই ভীষণ দুষ্কর আজকের প্রজন্মের রাজনীতিকগণের । বিষয়টি পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের চাকাকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের টাকা ও সংস্কৃতি আমাদের প্রায় দেউলিয়ায় রূপান্তরিত করেছে, সমাজকে ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে পঁচাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত সেনা-স্বৈরশাসকরা নীরবে বা সরবে যে-ধর্মীয় সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে, তাকে উপড়ে ফেলা দূরে থাক, তাকে আর রোধ করাই সম্ভব নয়। আমাদের দেশের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে আমরা যারা সারাক্ষণ তক্কাতক্কি ও উদ্বেগ প্রকাশ করি, তাঁরা সম্ভবত কখনও ভাবি না যে গণতন্ত্রহীনতা কি সমাজের বড়ো ব্যাধি, নাকি ইসলামীকরণের ফলে উদ্ভূত বিজাতীয় সংস্কৃতি বড়ো ব্যাধি। আর এই ইসলামীকরণই সম্ভবত গণতন্ত্রহীনতার অন্যতম কারণ। ধর্ম হিশেবে ইসলাম বা অন্যান্য যেকোনো ধর্ম গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতাকে পরিহার করে। বিশেষ করে তিনটি পবিত্র গ্রন্থ-ভিত্তিক ধর্ম মানুষের সমালোচনাকে পরিহার করে। আর সমালোচনা বা বিতর্ক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বীজাগার। মাযহার মাঝে মাঝেই এই আড্ডায় গণতন্ত্রের চেয়ে জরুরি বলে মনে করেন সাংস্কৃতিক এই অপচ্ছায়া দূরীকরণের ব্যবস্থাকে। কিন্তু আমার মন সমাজতাত্ত্বিক থিওরি দ্বারা কিছুটা প্রশিক্ষিত বলে হয়তো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার দিকে সায় দেয়। আমি ঠিক নিশ্চিত নই আমার ধারণা ভুল কিনা। দেশের রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে কি তাহলে সাংস্কৃতিক বর্জ্য নির্মূল করার জন্য সামাজিক বিপ্লবের জন্য তৃনমূল থেকে ব্যবস্থা নেয়া? এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলেই আমার মনে পড়ে জীবনের অপরাহ্ন বেলায় বিপ্লবী রেডিকেল হিউম্যানিসট এম এন রায়ের সেই বিখ্যাত উক্তি, Political revolution must be preceded by the Social revolution in India’. কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো, মাযহারের বক্তব্য মেনে নিলে, Political democracy must be preceded by the cultural and religious democracy in Bangladesh.
এরপরও দীর্ঘক্ষণ আমাদের আড্ডা চলতে থাকে সাহিত্য এবং বাংলাদেশের চলমান ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে, নির্বাচন ও সামনের দিনগুলোর অনিশ্চিত অবস্থা বিষয়ে। বিষয়গুলোর অনেক কিছুতেই আমি আর মাযহার ভিন্নমত রাখি, কিন্তু মাযহারের বিশ্লেষণ গভীর মনোযোগ দাবি করে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
রাত গভীর হয়, এক সময় আমাদের আড্ডায় ক্ষান্তি দিতেই হয় সেদিনের মত! সবাই চলে গেলে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে! সাহিত্য বা শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবলেও আমার মনটা সারাক্ষণ দীর্ণ হয়ে থাকে রাজনৈতিক অবস্থার কথাই ভেবে ভেবে! এও এক ধরণের দুশ্চিকিৎস্য ছায়াচ্ছন্ন ব্যাধি হয়তো!
১৯৫৫ সালে শরীয়তপুরের জাজিরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তথ্য ক্যাডারে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৩ সালে পড়াশোনার জন্য নিউইয়র্ক যান। নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Communications-এ এমএ এবং নিউ স্কুল থেকে Political Sociology-তে এম.ফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি নেন। ২০০১ সাল থেকে নিউজার্সির এসেক্স কলেজে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। এছাড়া খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে সমাজবিজ্ঞান পড়ান। নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সাল থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে লেখা শুরু। মূলত প্রবন্ধ লেখেন গবেষণা, পড়াশোনা এবং আগ্রহের বিষয় সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান। তিনি সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এবং ইমদাদুল হক মিলনের ‘পরাধীনতা’ উপন্যাস দুটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। এছাড়া দেশের কয়েকজন লেখকের গল্প ও কবিতাও ইংরেজি অনুবাদ করেন। ‘বড় বেদনার মতো বেজেছ’ ছাড়াও তার আরও একটি প্রবন্ধের বই ‘দ্বীপান্তরের গান’। ইংরেজি প্রবন্ধের বই একাধিক। এ-বছরের নতুন ‘Media Power and other Essays’. তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তেরো। ১৯৯৩ সাল থেকে আবেদীন কাদের নিউইয়র্ক প্রবাসী।