শুক্রবার, অক্টোবর ১৮

মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – পর্ব ৩

0

পর্ব ৩


চার. নিঃসঙ্গ ওই যে নায়ক! তার পথচলা কাকে মনে করিয়ে দেয়!

 

আহমাদ মোস্তফা কামালের এই যে নায়কেরা, তারা সংবেদনশীল, অন্তর্মুখী, স্বপ্নকাতর ও স্বপ্নতাড়িত, বহুলাংশে নিরুদ্যম, মৃত্যুব্যথাভারাতুর; বহুকিছুতেই নিগূঢ় আসক্তি বোধ করতে করতেও তারা শেষ পর্যন্ত হয়ে থাকে আসক্তিশূন্য, নিস্পৃহ একজন। তাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলি কখনো কখনো আমাদের জীবনানন্দের উপন্যাসের নায়কের কথা মনে করিয়ে দিতে থাকে। কখনো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের নায়ক রঞ্জুর ছায়া যেন কেঁপে কেঁপে যেতে থাকে আমাদের সামনে। কখনো যেন-বা মাহমুদুল হকের বাহ্যনির্লিপ্ত কিন্তু আন্তর-রক্তক্ষরণে নিভৃতে-নিরলে নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকা নায়ককে আমরা দেখতে পেতে থাকি। তবে কামালের নায়কেরা ওই নায়কদের মতো শুধু গোপনে-নিঃশব্দে নিজেকে দগ্ধাতে দগ্ধাতেই মানবজন্ম চরিতার্থ করে চলে না, তারা আরো প্রবলরকমের ভিন্ন কিছুও করে।

আমরা দেখতে পাই, তারা আছে যেন আছে এক অন্বেষণযাত্রায়। আছে এক সমাপ্তিহীন পরিব্রাজনে। তারা মৌন। নিঃশব্দ পরিব্রাজনরত নিঃসঙ্গ পথিক। সহস্র বছর আগে, সভ্যতার আদিলগ্নে রচিত গল্পে গল্পে আমরা যেমন পাই, বীর নায়কের অন্বেষণব্রতের কাহিনী; কামালের নায়কেরাও আছে তেমনই এক অন্বেষণব্রতে। অঞ্জন বা কায়সার বা ঋভু শুধুই বহিরিস্থিত, নির্লিপ্ত বা মনোজটিলতাদীর্ণ আধুনিক নায়কই নয়, আমরা লক্ষ করতে থাকি যে, তারা আছে একাকী এক যাত্রায়—অন্বেষণযাত্রায়। যেমন অন্বেষণযাত্রায় ছিলো সভ্যতার আদিতম মহাকাব্য গিলগামেশ-এর বীরনায়ক গিলগামেশ।

 

২.
কামালের নায়কেরা আমাদের মনে করিয়ে দিতে থাকে দূরতম মহানিঃসঙ্গ সেই নায়ককে; বন্ধুতা একদা যার কাছে হয়ে ওঠে নিজ অস্তিত্বের সমান মূল্যবান। ওই সেই অপার ক্ষমতাধর রাজা গিলগামেশ, নিজের শৌর্য ও ঐশ্বর্য ও বাহুবল ও প্রতিপত্তি নিয়ে তার জীবন অতি সড়গড় হলেও ক্রমে সে বুঝে উঠতে থাকে, সে আদতে একা। খুব একা। একসময় সে দৈব আশীর্বাদের মতোই তার জীবনে পায় এনকিদুকে। দিনে দিনে গিলগামেশ বোধ করতে থাকে যে, তাঁর সমস্ত সত্তাকে পূর্ণ করে তুলতে পারে শুধু তার প্রিয় বন্ধু এনকিদু। এনকিদু ছাড়া তার জীবন অপূর্ণ আর অর্থহীন। বন্ধুতাকে নিজ অস্তিত্বের সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে জেনে ওঠে গিলগামেশ। কামালের নায়কেরাও এমনই আত্মোপলব্ধিকে পায়। গিলগামেশের মতোই অঞ্জন বা কায়সার বা ঋভুর কাছে বেঁচে থাকা মানে জীবনের সুখে-দুখে পতনে-উত্থানে বন্ধুতার ছায়ায় থাকা। ওই দিব্যছায়া যদি অস্তিত্বকে ঘিরে না থাকে তাহলে সকল গৌরব মিথ্যা, আয়ু মিথ্যা, সম্ভোগ-উপভোগ-জয়ের উল্লাস—সব নিরর্থক।

অকালমৃত বন্ধু এনকিদুকে মৃত্যুলোক থেকে ফিরিয়ে আনার নিদানের সন্ধানে পথে নামে গিলগামেশ। অমরত্ব-অন্বেষণে শুরু হয় তার একা পথ চলা। শুরু হয় তার অন্বেষণযাত্রা। কামালের নায়কেরাও আছে যেন তেমনই এক যাত্রায়। তারা কেউই এখন আর আদি নায়ক গিলগামেশের মতো অমিত বিক্রমশালী বীর নয়। তারা আদতে বীরত্বদৃপ্ত কেউই নয়। তারা বাঁকাচোরা, অশক্ত, ভঙ্গুর, আবেগজীর্ণ সামান্য মানুষ মাত্র। আর, তারা কেউই এখন অমরতাকে পাবার জন্য মরিয়াও হয়ে নেই। অমরতা পাওয়া বা না-পাওয়া এখন তাদের বিবেচনার বিষয়ই নয়।

বন্ধুতা তাদের কাছেও আদিনায়ক গিলগামেশের মতোই জীবনের পরম মহার্ঘ্য ধন বলেই গণ্য হয়। বস্তুগত সাফল্য অর্জনের জন্য অঞ্জন বা কায়সার বা ঋভু কিছুমাত্র কাঙাল-কাতর নয়। কিঞ্চিৎ মুদ্রাগত সুস্থিরতা তাদের দরকার পড়ে বটে, তবে সেটা আত্মসুখের জন্য নয়। তাদের ওপর ভরসা করে বেঁচে আছে যারা, নিরুপায় নিরাশ্রয় সেইসব নিকটজনকে নিরাপত্তা ও অভয়বলয় গড়ে দেওয়ার জন্যই মুদ্রা-মরিয়া হয় তারা।

কিন্তু তারা প্রত্যেকে সেই মধুরতাময় মনুষ্যসম্পর্ক, বন্ধুতা যার নাম, সেই সম্পর্কের জন্য গভীরতম আকুলতাকে ধারণ করে চলে। বন্ধুতা তাদের কাছেও আদিনায়ক গিলগামেশের মতোই জীবনের পরম মহার্ঘ্য ধন বলেই গণ্য হয়। বস্তুগত সাফল্য অর্জনের জন্য অঞ্জন বা কায়সার বা ঋভু কিছুমাত্র কাঙাল-কাতর নয়। কিঞ্চিৎ মুদ্রাগত সুস্থিরতা তাদের দরকার পড়ে বটে, তবে সেটা আত্মসুখের জন্য নয়। তাদের ওপর ভরসা করে বেঁচে আছে যারা, নিরুপায় নিরাশ্রয় সেইসব নিকটজনকে নিরাপত্তা ও অভয়বলয় গড়ে দেওয়ার জন্যই মুদ্রা-মরিয়া হয় তারা। বাহ্যত অতি নির্লিপ্ত, আর ভেতরে মানবিক করুণায় পূর্ণ তারা প্রত্যেকে। জীবনের পথে পথে চলতে চলতে জীবনের গূঢ় অর্থকে বুঝে ওঠার গভীর-গোপন তাগাদা তাদের তাড়িয়ে ফেরে। তাই তারা অনিঃশেষ পরিব্রাজনরত।

কায়সার বা ঋভু যেমন উচ্চণ্ড খাপ না-খাওয়া মানুষ, অঞ্জনও তাই। অফিসের কাজটুকু অঞ্জন করে চলে ঠিকই, কিন্তু যেন ওটি করে তার সত্তার অপর কোনো অংশ, স্বয়ং সে নয়। সেই কাজে তার যেন কোনো লগ্নতা নেই। তার আছে এক ভাবনার জগত। সে জানে তার পূর্বপুরুষদের ছিলো এক বর্ণাঢ্য জীবন। সমাজ-সংসারের কল্যাণ সাধনের জন্য তারা ছিলো সদা সক্রিয়। তাদের সেই সফলতাময় জীবনের কথা মনে আনে সে, সর্বক্ষণই মনে আনে। ওই মনে আনার ঘোরে পড়ে থাকাটাই পছন্দ তার। তাই সে ওতেই মগ্ন থাকে নিবিড়রকমে। দেহধারণের রসদ জোটানোর জন্য যেই বাস্তবকর্ম তাকে সম্পন্ন করতে হয়, তার যে চাকুরি, সেটি সে প্রতিদিন করে আসে প্রায় যন্ত্রেরই মতো, বাকিটা সময় বুঁদ হয়ে থাকে তার ভাবনায়। অঞ্জন অক্রিয় নিরুদ্যম একজন।

 

৩.
পূর্বপুরুষদের সাথে নিজের তুলনা করে করে বিপন্ন বোধ করতে থাকে অঞ্জন। সে দেখে, তার পূর্বপুরুষেরা প্রত্যেকেই সক্রিয় এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষ। তাদের কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছে, কেউ নিজ গ্রামের সংস্কারকর্মে আজীবন ব্যাপৃত থেকেও কখনো ক্লান্ত হয়নি। কেউবা সরকারি উচ্চ-চাকুরে হিসেবে সদা নিজেকে গভীর কর্মনিষ্ঠ একজন হিসেবে প্রতিপন্ন করে গেছে। তাদের সাথে তুলনায় অঞ্জন কী!

সে বুঝে ওঠে, সে নিতান্তই অশক্ত আর অকর্মণ্য একজন। তার পূর্বপুরুষের প্রত্যেকে যে দৃপ্ত আন্তরতেজ ধারণ করে ছিলো, ওটি তার ভেতরে কিছুমাত্র নেই। সে লড়াকু কর্মবীর নয়। আর ওটি হয়ে ওঠার কোনো তাগাদাই সে নিজের ভেতরে পায় না। বরং নিজের ভাবনার ভেতরে ডুবে থাকাটাকেই তার কাছে উপাদেয় আর স্বস্তিকর আর নিরাপদ লাগতে থাকে। গ্রামের সাধারণ সকলে যখন তাকে তাদের পথনির্দেশক হিসেবে পাশে চাইতে থাকে, তখন সে কুণ্ঠায় জড়োমরো হয়ে উঠতে থাকে।

তখন তার এমন আন্তর-উপলব্ধি জাগতে থাকে: ‘সে কি দায়িত্ব পালন করবে? তার পিতা, পিতামহ বা প্রপিতামহের জন্য সময়টি ছিলো তাঁদের অনুকূলে। যেমন দাদা তাঁর বাবার প্রবল প্রতিপত্তি থাকতে থাকতেই নিজের আসন পাকা করে ফেলেছিলেন, আবার বাবাও দাদার প্রভাবপ্রতিপত্তি থাকতে থাকতেই এখানে এসে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। …কিন্তু অঞ্জনের ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটি সে-রকম নয়। বাবার মৃত্যুর পর প্রায় ১৪/১৫ বছরের ব্যবধানে সে প্রথমবারের মতো এখানে এলো। মাঝখানের এই সময়টুকুতে স্বাভাবিকভাবেই শূন্যস্থান শূন্য থাকেনি। …প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে অনেকেই। তারা অঞ্জনের কথা শুনবে কেন? অঞ্জনকে মেনে নেয়া দূরে থাক, …বরং তাকে প্রতিহত করতে চাইবে। না, তার কিছুই করার নেই। সে এমন যুদ্ধে নামতে পারবে না। …নিছক গণ্ডিবদ্ধ ছাপোষা জীবন যাপন ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা ৯২)

গ্রামের বিপন্ন সাধারণের জন্য সক্রিয় ও কর্মতৎপর হয়ে ওঠার ডাককে সে এভাবে ঝেড়ে ফেলে। এভাবেই নিজের জন্য নিজে স্তোক তৈরি করে এবং নিজেকে ভুলিয়ে রাখে। সে তারপর আবার ডুবে যায় তার স্মৃতি রোমন্থনে। স্বস্তি ফিরে আসে তার পৃথিবীতে। কিন্তু কিছুতেই দৃঢ় চিত্ত আর কঠিন পণ নিয়ে লোকের কল্যাণকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যম আসে না তার মধ্যে।

দারিদ্র্য অঞ্জনের সমস্যা নয়; তার সমস্যা বহুলাংশে তাত্ত্বিক। সে জানে, তার পরদাদা বা দাদা বা তার বাবা নানাভাবে এই ভূখণ্ডে নানাপর্বের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলো। নানাভাবে উচ্চপদ পেয়েও তারা সেইসব পদে নিজেদের যুক্ত রাখেনি, কোনো রাজনীতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বা উচ্চপদ থাকার কারণে চাকুরিস্থলে পাওয়া কোনো সুবিধা ইত্যাদিই ওই পূর্বপুরুষগণ ভোগ করতে যায়নি। স্বেচ্ছায় তারা সেইসব থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে গ্রামের বাড়িতে এসে থিতু হয়েছে। যাপন করেছে সাধারণ জীবন। পূর্বপুরুষদের ওই নিস্পৃহতার পেছনে কোন উদ্দীপনা কাজ করে গেছে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজে খুঁজে হয়রান হতে থাকে সে।

অঞ্জন এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না: ‘…আমার সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বাবা কেন চাকরি-বাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছিলেন, দাদা কেন উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি ত্যাগ করেছিলেন, বা তার পিতা কেন খান বাহাদুর উপাধি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন—আমি তা জানি না। এগুলোকে আমি কেবল ঘটনা হিসেবে জানি, কিন্তু এর পেছনের কারণটি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো গ্রাউন্ড ছিলো, সেটা না জানলে তাদের এই প্রবণতার ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। …তিনি যে তাঁর চিন্তাকে বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার কোনো চেষ্টা করেননি—এটা নিয়ে আমার দুঃখবোধ আছে। কোনো লিখিত রূপও রেখে যাননি তিনি, এমনকি ডায়রি পর্যন্ত লিখতেন না বাবা। কেন? তাঁর কি ভাবা উচিত ছিলো না যে, তাঁর ছেলেমেয়েরা এই ভাবনাগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে? একই সমস্যা আমার দাদারও। তিনিও কিছুই লিখে যাননি যে, তাঁর চিন্তার সঙ্গে ভবিষ্যত বংশধরদের পরিচয় ঘটবে। ফলে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে লোকমুখে কিছুদিন বেঁচে থাকা ছাড়া তাঁদের সমস্ত কিছুরই ইতি ঘটে গেছে। আমি এর কোনো মানে খুঁজে পাই না।’ ‘…চিন্তার জগতকে ছড়িয়ে না দিয়ে উদাসপুর এসে বসে রইলেন—এটা কেমন কথা?’ (পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭) এমত জিজ্ঞাসা ও অমীমাংসাকে নেড়েচেড়ে দিন পার করে যেতে পারাটাই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে তার জীবন।

অঞ্জন যেমন কেবলই মগ্ন থাকে তার অতীত পূর্বপুরুষগণের ভাবনায়, যেমন থাকে সে তাদের উদ্যম-সফলতা-পরোয়াহীনতার স্বরূপ উদ্ঘাটনের চেষ্টায়; অন্যদিকে অন্ধ জাদুকর উপন্যাসের নায়ক কায়সারও তেমন গভীরভাবে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে অন্য এক ভাবনায়। সে মনুষ্যসম্পর্কের স্বরূপটি নির্ণয় করে উঠতে চায়। সে কেবলই বুঝে উঠতে চায়, মনুষ্যসম্পর্কের মহিমা ও অমহিমাকে। নির্ণয় করে উঠতে চায় এই সম্পর্কের গাঢ়তা ও ভঙ্গুরতাকে। ব্যাখ্যা করতে চায় এর গুরুত্ব-অগুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা- অপ্রয়োজনীয়তাকে। কায়সারের ভাবনা এমন: ‘জীবনের অন্য নাম সম্পর্ক। কিংবা সম্পর্ক মানেই জীবন—বলা যায় এভাবেও। … যে ঘড়িটি হাতে পরি, যে দোকান থেকে সিগারেট কিনি—এসব কিছুর সঙ্গেই একটি সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে আমার। নাকি বলবো যে, এগুলোর সঙ্গে আমার একধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে? …সম্পর্কের অন্য নাম কি তবে অভ্যাস? জীবন মানে সম্পর্ক আর সম্পর্ক মানে অভ্যাস?’ (পৃষ্ঠা ১৪)

মাঝেমধ্যে তার এমনও মনে হয়: ‘সম্পর্ক মানে কনভারসেশন, মানে সংলাপ। আমাদের মধ্যে এই চর্চাটা নেই বলেই আমাদের সম্পর্কগুলো তৈরি হয় না, দু-একটা হলেও টেকে না।’ (পৃষ্ঠা ১২৫)

কখনো তার মনে হয়: ‘একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের সম্পর্ক কখনো একমাত্রিক হতে পারে না, এটা অবশ্যই বহুমাত্রিক ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা সম্পর্ককে একমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে চাই, …একেকটা সম্পর্ককে একটা মাত্র নাম দিয়ে চিনে নিতে চাই। …সব সম্পর্কের নাম হয় না, নাম দেয়া যায় না।’ (পৃষ্ঠা ৫১-৫২)

অঞ্জনের মতো কায়সারও ক্ষুন্নিবৃত্তির অর্থ আয়ের জন্য চাকুরি করে চলে; তবে সেটি যেন আসল অঞ্জন বা কায়সার করে, ওটি যেন করে চলে তাদেরই অন্য আরেক সত্তা। অঞ্জন করে, কারণ তার সামাজিক সত্তাটিকে ওই ভ‚মিকাপালনকারী রূপেই দেখতে চায় সমাজ ও আত্মীয়বর্গ। অঞ্জন সেই ভ‚মিকা পালন করে করে সামাজিকগণের সন্তুষ্টি বিধান করে। আর নিজে থাকে তার পূর্বপুরুষ-বিষয়ক বিবিধ ভাবনা ও ধন্দের মীমাংসা সন্ধানে। ওই অমন সামাজিকতার চাপই যেনবা ঋভুকে চাকুরিলগ্ন রাখে। এ ছাড়াও আছে তার ‘সময় কাটানোর’ সমস্যা। ‘চাকরিটা সেজন্যই করে, যদিও প্রয়োজন নেই তেমন। একে ঠিক চাকরি বলাও যায় না। যদিও গালভরা পদপদবী আছে ঋভুর, কিন্তু ধরাবাঁধা কোনো কাজ নেই, কোনো নিয়মও নেই তার জন্য।’ (জলের অক্ষরে লেখা, পৃষ্ঠা ১২৮)

আর কায়সার তো জীবনে কোনোদিন এই চাকুরির জগতে ঢুকতে চায়ইনি। কিন্তু পরিস্থিতির চাপ তাকে ঠেলে দেয় এই দুনিয়ায়। নিজের বিপন্ন পরিবারটিকে নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নতা এনে দেওয়ার তুমুল তাগাদা বোধ করে তার অন্তর। সে চাকুরি নেয়। মুদ্রা আয়ের জন্য কঠোর চেষ্টা করে চলে। ওটি সে করে, আদত কায়সারকে বিসর্জন দিয়ে। করে তার মানবজন্মের দায়বোধ থেকে।

কিন্তু সে যখন একা, যখন সে প্রকৃতরকমে নিজের মুখোমুখি থাকে, একা নিজে, তখন সে প্রবল ঘোরবিহ্বল ও ভাবতাড়িত একজন। কায়সারের নিজস্ব চরাচর বা তার মনোজগৎ উদ্বেল হয়ে হয়ে ওঠে তার সময়ের নামজাদা সব লেখকের সাথে পার-করা সময়ের স্মৃতি নেড়েচেড়ে। কথোপকথনগুলো স্মরণে আসে তার। সুখী হয় কায়সার।

কিন্তু সে যখন একা, যখন সে প্রকৃতরকমে নিজের মুখোমুখি থাকে, একা নিজে, তখন সে প্রবল ঘোরবিহ্বল ও ভাবতাড়িত একজন। কায়সারের নিজস্ব চরাচর বা তার মনোজগৎ উদ্বেল হয়ে হয়ে ওঠে তার সময়ের নামজাদা সব লেখকের সাথে পার-করা সময়ের স্মৃতি নেড়েচেড়ে। কথোপকথনগুলো স্মরণে আসে তার। সুখী হয় কায়সার। কখনো সে ভাবতে থাকে, ভরাপূর্ণিমার সাথে গৌতম বুদ্ধের সম্পর্কের নিবিড়তার বিষয়টি। কখনো কখনো তার মনে আনাগোনা চালায় জগদীশ চন্দ্র বসু ও তাঁর প্রকৃতিভাবনা। কায়সার দুলে ওঠে, দুলতে থাকে। যেন ওই ভাব-বিহ্বলতার সময়টুকুতে সে বেঁচে থাকে প্রকৃত অর্থে। একা মৌন; কিন্তু অভিভ‚ত এক সুখীজন।

এর বাইরে নয়তো সে থাকে ভয়াল বাস্তবের কঠিন পেষণে। সে দেখে তার রাষ্ট্রসংঘে স্বৈরাচারী শাসকের তাণ্ডব। নবীন তারুণ্যে কায়সার ও অন্যরা অন্তরে অন্তরে ধস্ত, মূক হয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক দুর্গতি তাকে করে তুলতে থাকে ম্রিয়মাণ। অপঘাতে প্রিয় ভগিনীর মৃত্যুর বোঝাই শুধু সে এবং তার পরিবার বয়ে চলে। না আছে পাষণ্ড-পাপিষ্ঠ-দুষ্কৃতির দণ্ড বিধানের কোনো শক্তি-সামর্থ্য-পরিস্থিতি তাদের, না আছে স্মৃতির কামড় থেকে নিস্তার পাবার কোনো পথ।

এইসব চাপ ক্রমে তাকে করে তুলতে থাকে বন্ধ্যাত্বগ্রস্ত। সে লিখতে পারে না আর।

যখন সে একা থাকে, তখন সে আসলে থাকে তার একান্ত নিজস্ব হাহাকারের সাথে।

কেন হাহাকার?

তার অন্তরে তার সত্যকার যে বাঞ্ছাটি ছিলো, যেটি তার রক্তপ্রবাহ হয়েই যেন তার ভেতরে বিরাজ করে চলছিলো একদা; সেই বাঞ্ছা অথবা স্বপ্নকে সে সার্থকতা দিতে পারেনি। সেই সাধ ও স্বপ্নকে বিনষ্টি দিতে হয় তাকে। ওই স্বপ্নবিনষ্টির জন্য তার অন্তর অহর্নিশি কেবলই হাহাকার করে চলে। কেবলই গুমরে মরতে থাকে। সে তো প্রকৃতপক্ষে লেখকই হতে চেয়েছিলো। মেধাবী কায়সারকে অন্য কোনো পেশা কিছুমাত্র টানেনি, মুদ্রার ওম পাবার আকাক্সক্ষা, তার মধ্যে কদাপি মাথা উঁচোয়নি। আগাগোড়া সে শুধু চেয়েছিলো লেখক হয়ে থাকতে। কিন্তু সংসারে অকস্মাৎ নেমে আসা প্রলয় তাকে ঠেলে দেয় মুদ্রা উপার্জনের দুনিয়ায়। বিপন্ন কয়েকটি প্রাণকে তাঁর সেইসব অতি আপনার-জনকে রক্ষার জন্য সে রুক্ষ-থড়বড়ে বাস্তবতার দুনিয়ায় পা রাখে। আর কীভাবে যেন দিনে দিনে সে হারিয়ে ফেলে বাগ্দেবীর দেওয়া বর ও অভয়কে, লেখার বন্ধ্যাত্ব চলে আসে তার।

জীবনানন্দ দাশের বাসমতীর উপাখ্যান-এর নায়ক সিদ্ধার্থের সাথে প্রবল মিল পাওয়া যায় অন্ধ জাদুকর-এর নায়ক কায়সারের। সিদ্ধার্থ নিজেকে কর্মযোগী করার তোলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সে কলেজে পড়ায়, ইউনিয়নের মিটিংয়ে যোগ দেয়, টিউশনি করে, সভাসমিতিতে যোগ দেয়, কলেরাগ্রস্ত দরিদ্রপল্লিতে ভলান্টিয়ারের কাজ করে। কিন্তু সকলের মধ্যে থেকেও সে একা ও বিচ্ছিন্ন। সে কোনো কিছুর সঙ্গেই খাপ খাওয়াতে চায় না। সমাজে ও সংসারে গৃহীত হওয়ার বাসনা তার নেই। তার জীবনে আছে আর্থিক দুস্থতা। কিন্তু সাংসারিক জীবনে ব্যর্থ হবার কারণে গøানি সে বোধ করে না। সে কোনো কিছুর সঙ্গেই খাপ খাওয়াতে চায় না।

অশেষ ঋণে জর্জরিত সে, পরিত্রাণের কোনো উপায় তার জানা নেই, পরিত্রাণের পথ খোঁজার কোনো উদ্যমও সে বোধ করে না। বরং অর্থকড়ি বিষয়ক স্থ‚ল ব্যাপারগুলোতে তাকে মনোযোগ দিতে হয় বলে সে গ্লানি বোধ করে।

 

৪.
তার মনে হতে থাকে, ‘টাকাকড়ির কেমন একটা পাপচক্রের ভেতর পড়ে গেছে সে’। এই স্কুল, সংসার ও যন্ত্রণাদায়ক বাস্তব ব্যাপারগুলো নষ্ট করছে তার নিজস্ব বিজন-বিশ্বের শান্তি। নষ্ট করছে তার লেখালেখির সাধ ও শক্তিকে। সে বোধ করে, ‘বড় বেশি টাকার কথা ভাবছে সে। যদি না ভাবতে যাওয়া যায়, তাহলে’ বড়োই নিস্তার মিলতো।

কায়সার নিজেকে অমন কর্ম-উন্মত্ত করে তোলার কোনো তাগাদা পায় না ঠিক, তবে সংসারের পাঁকে-চক্রে আটকে যাওয়া কায়সারও ভেতরে ভেতরে সিদ্ধার্থের মতোই দগ্ধাতে থাকে: ‘সংসারের প্রয়োজন তাকে দিনে দিনে এক বেরসিকে পরিণত করেছে। বাড়তি সময়টুকুও তার ব্যয় হয় অর্থ উপার্জনের নানা চিন্তায়। যে বেতন পায় সে, তাতে যে চলে না তা নয়, কিন্তু সচ্ছলতার জন্য আরো কিছুর প্রয়োজন। সচ্ছল তারা কোনোদিনই ছিলো না।’ (অন্ধ জাদুকর, পৃষ্ঠা ২৫)

লিখতে না-পারার যন্ত্রণায় দম আটকে যেতে থাকে তার: ‘অনেকদিন সে লেখার কথা ভুলে ছিলো। যে জীবনের মধ্যে সে প্রবেশ করেছে, বলা উচিত যে জীবনের ফাঁদে সে ধরা পড়েছে, তাতে লেখালেখির কথা ভুলে থাকাই ভালো। কিন্তু ইদানীং কেন যেন মনে হচ্ছে, তার তো লেখক হবারই স্বপ্ন ছিলো, সে চেয়েছিলো কেবল লেখক হতে, আর কিছু নয়।’ (পৃষ্ঠা ৯)

বিষাদ ও গ্লানি-জরজর কায়সারের মনে হতে থাকে: ‘আমি তো মরেই গেছি। …কতদিন আমি আর লিখি না। কী এক ঘোরই না ছিলো আমার! অচেনা-অজানা এক ঘোরে দিন কেটে যেত। …সেইসব ঘোরলাগা দিন কি আর ফিরে আসবে? আমি কি কোনোদিন লিখবো না আর? কোনোদিন না?’ (পৃষ্ঠা ২৫)

সৃষ্টিশীলতার এমন আগুন ঋভুকে দগ্ধ করে না ঠিকই, কিন্তু কায়সারের মতোই ঋভুরও; আত্মার এক অমোঘ আশ্রয় হয়ে থাকে রঞ্জু। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেই রঞ্জুকে চিত্রিত করেন তাঁর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ গল্পে। প্রয়াত মায়ের কথা ঘুরেফিরে ঘুরেফিরে মনে আসতে থাকে ঋভুর। সেইসাথে মনে আসতে থাকে রঞ্জুর কথাও। নিজের সাথে নিজে কথা বলে চলা রঞ্জুর ভাবনাগুলোর কথা স্মরণে আসতে থাকে ঋভুর। মনে আসতে রঞ্জুর একাকিতের¡ কথা। রঞ্জুর বিনিদ্রাজড়ানো স্বগত কথনগুলো মনে আসতে থাকে, আর থেকে থেকে ঋভুর ভেতরে উথাল-পাথাল জলের উচ্ছ¡াস জাগতে থাকে। যেন সেও আরেক রঞ্জু, মায়ের ওপর অভিমানে অভিমানে নিজেকে যে করে নিয়েছে ছায়ার মতো মৌন আর মন্থর। ঋভুও অবিকল কায়সারের মতোই, প্রিয় লেখকদের গড়া নায়কের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। রঞ্জুর সাথে জড়িয়ে যেতে থাকে।

ঋভুর জীবনে বিপুল সচ্ছলতা আছে, কিন্তু কিছুতেই অন্তর্গত ঔদাস্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না সে। আসলে সে বেরিয়ে আসতে চায় না। ওই বিমর্ষতা ও নৈরাশ্যের গুহায় থেকে থেকেই জীবনকে অনুধাবন করে উঠতে চায় ঋভু। সেও ঘোর নিরুদ্যম এবং একা। বেঁচে আছে সে, কিন্তু যেন গত্যন্তর নেই বলেই, যেন বাধ্য হয়েই দেহ ধারণ করে চলছে সে। বন্ধু অংশুর চোখে এই যে ঋভু এমন: ‘একেবারে জীবন-বিমুখ। কিছুই করতে চায় না। কিছু করতে নাকি ওর ভালোও লাগে না। টাকাপয়সাও খরচ করে না। ও কিন্তু কৃপণ টাইপের না, তবু খরচ করে না। চাকরি করে, তাতেও মন নেই। যে বেতন পায় তাতেই চলে যায়। খরচ তো তেমন কিছু নেই। কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে পড়ে আছে। এর কোনো মানে হয়?’ (জলের অক্ষরে লেখা, পৃষ্ঠা ১৬৪)

তার নিকটজনেরা সকলেই প্রয়াত, সে আদ্যোপান্ত একা একজন ঠিকই, কিন্তু বন্ধু অংশু তাকে ভালোবাসা দিয়ে ঘিরে রাখে সবসময়, যতোভাবে সম্ভব ঘিরে ঘিরে রাখে। ঋভু জানে অন্যরা বন্ধুতাকে ভুলে গেলেও অংশু তাকে ছেড়ে যায়নি। এবং ঋভুও ছাড়েনি অংশুকে। ‘অংশু আর ঋভু রয়ে গেছে এখনো, গলায় গলায়।’

কিন্তু সেই অংশুর পাশে বসেও ঋভু হয়ে যেতে থাকে চরমতম একা। অংশুর বর্ণনা আমাদের জানায়: ‘ছাদে গিয়ে অংশু দেখলো, ঋভু দাঁড়িয়ে আছে দূরে তাকিয়ে। উদাসীন, বিষণ্ন। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়ছে একা একাই, ওদিকে ওর খেয়ালই নেই। … ঋভুর এই হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে অংশু পরিচিত। অনেকের ভেতরে থাকলেও সে অনেকসময় এরকম একা হয়ে যায়। কী যে ভাবে, তল পাওয়া যায় না। এত চাপা ও!’ (পৃষ্ঠা ১২৫) ঋভু যতোটা নিরাশামোড়ানো, নিস্পৃহ, উদ্যমশূন্য আর নিরর্থকতাবোধ-বিদ্ধ, অংশু ঠিক ততোটাই উদ্যমী, কর্মস্পৃহ, আশাবাদী। ‘অংশু বিশ্বাস করে জীবন অর্থহীন নয়, উদ্দেশ্যহীনও নয়, নিশ্চয়ই এর কোনো মহত্তর তাৎপর্য আছে। সে সেটি খুঁজে বার করতে চায়।’ (পৃষ্ঠা ২৪৫)

ঋভু এবং অংশুকে মনে হতে থাকে যো তারা একই সত্তার দুই বিপরীত রূপ। একটি সত্তা সদা সক্রিয় ও আশা চনমনে ও প্রবল স্বপ্নবাজ। অন্য সত্তাটি বেদনাজীর্ণ, নিরাশা-মলিন, স্বপ্নখোয়ানো ও চির-ব্যথিত হয়ে থাকা। তবে এই দুই সত্তার কাছেই বন্ধুতা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। বা, বন্ধুতাই তাদের প্রাণবায়ু।

বন্ধুতাই তাদের কাছে বেঁচে থাকার অন্য নাম। কায়সারের দুই প্রিয় বন্ধু কবীর আর কাজল। একজন শুধুই বন্ধু, রক্তের সম্পর্কহীন বটে; কিন্তু আত্মার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা আছে দুইজন। অন্য যে-জন, কাজল, সে সহোদরা কিন্তু তুমুল সখ্যের অচ্ছেদ্য বন্ধন আছে এই দুই ভাইবোনের ভেতরে। জীবিকার দরকারে কবীর ‘দেশ ছেড়ে চলে যায়’, আর অসাধু প্রেমিকের প্রতারণার আঘাত সইতে না পেরে কাজল আত্মহত্যা করে। ওই দুজনকে হারিয়ে কায়সার নিজের দেহকে বয়ে চলে বটে, কিন্তু সে বুঝে ওঠে যে, সে আদতে হয়ে উঠছে মৃত। ‘আমি তো মরেই গেছি’, কায়সার ভাবলো। কাজল মরে গিয়ে আর কবীর চলে গিয়ে আসলে আমাকেই মেরে রেখে গেছে।’ (অন্ধ জাদুকর, পৃষ্ঠা ২৫)

একা-একাই ঘুরে বেড়ায় এই প্রাণ, এই কায়সার। নিজের আত্মার দোসর বলে সে মানে তার সমকালের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের গড়া চরিত্রদের। একা হাঁটতে হাঁটতে ওই কাল্পনিক চরিত্রসকলকে নিজের সহযাত্রী করে নেয় কায়সার। আর, তারা তাকে শুশ্রƒষা দিতে থাকে। তখন পরিতোষে ভরে উঠতে থাকে কায়সারের অন্তর। সে আকুল হতে থাকে, সুখী হতে থাকে।

হাহাকার করে ওঠে তার সমস্তটা সত্তা। খুব প্রিয় কারো কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতে থাকে অন্তর। নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়ার বাঞ্ছা হতে থাকে তার। কিন্তু কোথাও তো কেউ নেই। কেউ তো তার জন্য অপেক্ষা করে নেই: ‘কে আমাকে আশ্রয় দেবে? আমার কেউ নেই। আমার ঘর নেই, ঠিকানা নেই, গন্তব্য নেই, অপেক্ষায় থাকার মানুষ নেই

গহন রাতের ‘জনশূন্য রাস্তাঘাট’ দিয়ে একাকী হেঁটে চলতে চলতে এমন বোধ জাগনা দিয়ে ওঠে কায়সারের ভেতরে: ‘আমি একা, অকৃত্রিম একা, একাই থাকতে চাই। একটা জনপ্রাণীর ছায়াও মাড়াতে চাই না আমি।’ তারপর আচমকাই আবার, নিশুতি ওই রাত্রির, একলা পথিকের প্রাণ ‘একটা উষ্ণ আশ্রয়ের সাধ’কে দাউদাউ হয়ে উঠতে দেখে নিজের ভেতরে। হাহাকার করে ওঠে তার সমস্তটা সত্তা। খুব প্রিয় কারো কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতে থাকে অন্তর। নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়ার বাঞ্ছা হতে থাকে তার। কিন্তু কোথাও তো কেউ নেই। কেউ তো তার জন্য অপেক্ষা করে নেই: ‘কে আমাকে আশ্রয় দেবে? আমার কেউ নেই। আমার ঘর নেই, ঠিকানা নেই, গন্তব্য নেই, অপেক্ষায় থাকার মানুষ নেই। আমি এক জন্ম যাযাবর। অনন্তকাল ধরে পৃথিবীর পথে পথে হেঁটে বেড়াবার জন্য আমার জন্ম হয়েছে। …কিছুই করতে পারিনি জীবনে। একেবারে কিছুই না।’ (পৃষ্ঠা ১৫০) অশ্রæশূন্য রোদন তাকে ফালাফালা করে দিতে থাকে।

গিলগামেশকেও আমরা এমন নিঃসঙ্গতা-থরথর আর ক্রন্দনদীর্ণ হাহাকারে বিদীর্ণ হতে দেখি। তার অশ্রুরা এমন বিলাপ হয়ে ঝরতে থাকে:

Bitterly Gilgamesh wept for his friend Enkidu; he wandered over the wilderness as a hunter, he roamed over the plains, in his bitterness he cried, “How can I rest, how can I be at peace? Despair is in my heart, …and my face is the face of one who has made a long journey, it was burned with heat and with cold. Why should I not wander over the pastures in search of the wind? My friend, my younger brother, …Enkidu my brother, whom I loved, the end of mortality has overtaken him. I wept for him seven days and nights till the worn fastened on him. …because of my brother I stray through the wilderness and cannot rest.

How can I be silent, how can I rest, when Enkidu whom I love is dust…
Since he went, my life is nothing.”

অমনই এক হাহাকার হাউদাউ হাউদাউ করে করে ওঠে ঋভুর ভেতরেও। বন্ধু অংশুকে সে জানে তার প্রাণবায়ু বলে। সুখে-বেদনায়, অসময়ে-সুসময়ে যাকে পাশে পায় বলে আত্মীয়-বান্ধবশূন্য ঋভুর দিনগুলো আলোভরা থাকে। সেই অংশু যখন ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে, তখন ঋভুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়তে থাকে অন্ধকার কুজ্ঝটিকা আর শীত।

“ঋভু খানিকটা আপনমনেই বললো, তোরাও কি ওখানে গিয়ে থাকবি?

থাকতেও পারি। এই শহরটাকে আর সহ্য হয় না। —খানিকটা হালকাসুরে বললো অংশু।

তাহলে আমার কী হবে? —এবার ঋভু বিষণ্ন।

মানে?

ঢাকায় তো আর আমার কেউ থাকবে না। আমি কার কাছে যাবো? —হাহাকার ঝরে পড়লো তার কণ্ঠ থেকে।’ (জলের অক্ষরে লেখা, পৃষ্ঠা ২১০)

বন্ধুতাকে জীবনে পরম শুশ্রূষা-আশ্রম বলে মানে বটে ঋভু, কিন্তু আগাগোড়া সে থাকে মৃত্যুতাড়িত একজন। অকর্মণ্য নিরুদ্যম আর মৃত্যুতাপিত তার ভেতর-বাহির। নৈরাশ্য ছাড়া ব্যক্তির ভাগ্যে অন্য কিছু বরাদ্দ থাকে বলে বিশ্বাস করে না ঋভু। তার মনে হয়, কেবলই মনে হতে থাকে: ‘সকলেই মুছে যেতে আসে, মুছে যায়, কেউ আগে কেউ পরে। সকলের নামই জলের অক্ষরে লেখা। মুছে যাবেই। এসব ঋভুর জানা হয়ে গেছে।’ (পৃষ্ঠা ১৫৩)

তারপরেও ঋভু বন্ধুতার কাছেই যাচঞা করে আলো ও তাপ ও আশ্রয়। ওই সম্পর্কটাকেই জীবনের পরম ধন বলে গণ্য করে ঋভুর সত্তা।

আহমাদ মোস্তফা কামালের এই যে নায়কেরা, তারা প্রত্যেকেই আগাগোড়া নগরবাসী বটে, কিন্তু এই নগরে তারা আগন্তুক একজন মাত্র। এইখানে তাদের আত্মীয়জন আছে মাত্র গুটিকয়, বন্ধুর সংখ্যাও নগণ্য। নগরের বাসগৃহে তাদের শরীরটিই শুধু দিন যাপন করে যায়। কিন্তু অন্তরে অন্তরে তারা প্রকৃত অর্থে বসত করে গ্রামে। শৈশবের গ্রামে। তাদের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে থাকে গ্রামেরই জলের সবুজ, হাওয়ার ফিনফিনা শীতলতা, আর গাছগরানের ছায়াজড়ানো ডাঙায় ডাঙায়। এক আছে সেই গ্রাম। অনেক দূরে, দূর সুদূরে।

আহমাদ মোস্তফা কামালের প্রথম দুটি উপন্যাসই আমাদের জানাতে থাকে, এক যে আছে এক গ্রাম; তার নাম উদাসপুর। অঞ্জন এবং কায়সারের সেই গ্রাম, সেই এক সব পেয়েছির দেশ। ঋভুর অবশ্য তেমন কোনো পৈতৃক গ্রামভিটি নেই। তার মন সেই গ্রাম-না-থাকার কুণ্ঠায় অনেকটাই কুঁকড়ে থাকে, আর নানামতে সেই ক্ষতিপূরণের চেষ্টাটা করে ঋভু: ‘হেমন্তের শেষের দিকে ঋভু গ্রামে চলে যায় প্রতি বছর। নিজের গ্রাম থেকেও নেই, তাই সে বেছে নেয় দেশের যেকোনো অঞ্চলের যেকোনো গ্রাম, …গিয়ে থাকে কয়েকদিন। যেখানে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে কুয়াশা জমে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে।’ (পৃষ্ঠা ২৯৬) পরিব্রাজকের চোখে সে কয়েকদিন ধরে দেখে চলে ‘ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, মানুষের ঘরবাড়ি, তাদের জীবন যাপন’ ইত্যাদি। তারপর ফিরে আসে তার নগরভবনে।

অন্যদিকে অঞ্জন বা কায়সারের কখনোই কোথাও কোনো নগরভবনে ফিরে আসাআসি নেই। তারা শহরে শহরে দিন ও রাত্রি কাটায় হয়তো; কিন্তু তাদের অস্তিত্ব চিরকালের জন্য গেঁথে থাকে গ্রামে, তাদের উদাসপুরে।


আরও পড়ুন : মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – ১ম পর্ব

আরও পড়ুন : মনুষ্যসম্পর্ক, পরিব্রজ্যা ও রসাতল এইখানে মূর্ত ও বাঙ্ময় : আহমাদ মোস্তফা কামালের কথাসাহিত্য – ২য় পর্ব


 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।