রবিবার, নভেম্বর ২৪

মাধবীর আত্মহত্যা আবিষ্কারের চেষ্টা এবং তার অসফলতা

0

[ভূমিকা :
মাধবী একেবারে একা হয়ে গেছে। আজকেই তার বাবা মারা গেছে কয়েকমাস অসুখে পড়ে থাকার পর। তার বাবা শ্রীদাম যখন অসুস্থ ছিল তখন রমজান নামের এ লোকাল ডাক্তার তার চিকিৎসা করছিল। চিকিৎসা কিছু হয়েছিল কি না সেটা পরের কথা কিন্তু একটা ব্যাপার হয়েছিল, সেটা হলো মাধবীর মা আরতি ঐ লোকাল ডাক্তারের প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে গিয়েছিল।

অসুস্থ বাপের সেবা করে কোনোরকমে দিন চলে যাচ্ছিল তার। কিন্তু আজকে তার বাপ মরে যাওয়াতে সে একেবারে ভেঙে পড়ে। তারও মরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে ভেবে দেখে, তার কোনো অসুস্থতা তো নেই, কীভাবে মরবে? এই মৌলিক প্রশ্ন জাগলে সে নিজ মরণ আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে, যেমনভাবে একজন বিজ্ঞানী কোনো কিছু আবিষ্কার করার চেষ্টা করে।]

কেউ মরে গেলেও, জ্বলে গেলেও, গলে গেলেও, জগতের কিছু যায় আসে না। সূর্যের কিছু যায় আসে না, চাঁদের বা অন্ধকারের বা গাছের কারো কোনো বিকার নাই। অসুস্থ হোক তবু তার বাবা এতদিন বেঁচে ছিল এটা একটা বড়ো ব্যাপার ছিল তার কাছে। এখন তার নিজেকে বড়ো একা মনে হচ্ছে। নিঃসহায় মনে হচ্ছে। একটা ঘরের বাতাস তারা বাপমেয়েতে ভাগাভাগি করে গ্রহণ করছিল এখন পুরো ঘরের পুরো বাতাস একা তার, একার জন্য এত বাতাস তার ভালো লাগে না।

তার ভেতর চিতা জ্বলছে। তার ইচ্ছে করে দেয়ালে মাথা ঠুঁকে পুরো জগৎকে জ্বালিয়ে দিতে, যেমনভাবে ম্যাচবাক্সের গায়ে মাথা ঠুঁকে ম্যাচের কাঠি নিজেকে শেষ করে দেয়। সে দেয়ালে মাথা ঠুঁকে, ভেতরের আগুন ভেতরেই থাকে, বাইরে বের হয় না শুধু কপাল ফেটে রক্ত বেরোয়, জগতের গায়ে তার ভেতরের আগুনের আঁচ লাগে না একবিন্দুও। কখনো কখনো প্রাণ কত সহজেই বেরিয়ে যায়। কখনো কখনো কত কসরত করেও প্রাণ বের হতে চায় না।

সন্ধ্যা হবার আগেই গাঁয়ের লোকজন তার বাবাকে দাহ করে ফিরে এসে যে যার বাড়ি চলে গেছে। কেউ একজন তার জন্য কিছু খাবার রেখে গেছে। শ্রীদামের ওষুধ যে ছোটো টেবিলের উপর থাকত সেখানেই রাখা আছে। তার বাবা নাই। ওষুধগুলো আছে। সাদা রঙের, লাল রঙের, হলুদ রঙের ওষুধ নির্বিকারভাবে যেখানে রাখা ছিল সেখানে সেভাবেই আছে। এতটুকু নড়ে চড়ে ওঠেনি। তার বাবা মারা গেছে কিন্তু ওষুধগুলো এখনো জীবিত। তারা তাদের শক্তি নিয়ে বসে আছে এখনো। যদিও তাদের শক্তি তার বাবার অসুখের কাছে হার মেনেছে। তার বাবার অসুখের কাছে ওষুধগুলো অসহায় খরগোশ ছিল মাত্র। ওষুধ আর রোগের সম্পর্ক হলো বাঘ আর খরগোশের মতো। ওষুধ কখনো বাঘ হয় কখনো খরগোশ হয়। রোগ কখনো খরগোশ হয় কখনো বাঘ। কে কাকে পরাস্ত করতে পারে তারই উপর নির্ভর করছে মানুষের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া। ওষুধ যদি বাঘ হতে পারে তবে অসুখ মারা যায়। মাধবী তার বাবার রোগ আর ওষুধের কুস্তি লড়াই দেখেছে। লড়াইয়ের ভেতর তার বাবার অসহায় ছটফট করা মুখ দেখেছে। রোগ ওষুধকে হারিয়ে দিয়ে তার বাবাকে নিয়ে চলে গেছে শিরোপার মতো, তুলে দিয়েছে মৃত্যুর

রাত শুরু হলো মাত্র। এতবড়ো রাত নিয়ে মাধবী কী করবে? বিশাল বিপুল রাত। এত বড়ো ঘর নিয়ে কী করবে? ঘরভর্তি বাতাস নিয়ে সে কী করবে? তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যায়। আগে তার এমন মনে হতো না। হাতে।

রাত শুরু হলো মাত্র। এতবড়ো রাত নিয়ে মাধবী কী করবে? বিশাল বিপুল রাত। এত বড়ো ঘর নিয়ে কী করবে? ঘরভর্তি বাতাস নিয়ে সে কী করবে? তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যায়। আগে তার এমন মনে হতো না। খেতে পেত বা পেত না ঘুমিয়ে গেলেই কাবার। কিন্তু এখন কী করবে সে?

তার চোখে ঘুম নাই। খিদে আছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। বাবার মুখ মনে পড়ছে। তার চোখ বেয়ে ধেয়ে আসে কান্নার জল। ছল ছল চোখ নিয়ে বিশাল বিপুল অন্ধকারের দিকে সে তাকায়। ঝিঝি ডাকছে। ডাকতেই আছে। অজস্র ঝিঝি ডাকছে। সে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে তারা ফুটে আছে ফুলের মতো। তার বাবার লাশের উপর অযত্নে ফেলে দেওয়া বুনো ফুলের মতো। ফুলের উপর শুয়ে মানুষের জন্ম, কাঁটার ভেতর তার চলন আর মানুষের মৃত্যুতে মরা মানুষের গায়ের উপর শুয়ে থাকে ফুল। তার ঘুম আসে না। সে বসে থাকে। সে শুয়ে থাকে। সে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ঘুম বসেও থাকে না, শুয়েও থাকে না, দাঁড়িয়েও থাকে না, পালিয়ে থাকে। তার বাবার মুখ ধীরে ধীরে তার চোখের দিকে এগুতে থাকে। চোখের ভেতর একেবারে ঢুকে যায়। তার বাবার মুখ আবার চোখ থেকে বেরিয়ে আসে, ধীরে ধীরে বেরিয়ে অন্ধকারের ভেতর ঢুকে পড়ে। আবার অন্ধকার ফুড়ে বের হয়ে আসে, আবার চোখের ভেতর ঢুকে পড়ে। মুখের এভাবে চোখের ভেতর ঢুকে পড়া আর বেরিয়ে আসা তাকে ক্লান্ত করে তোলে। ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসে।

কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। তার মা আর রমজান ডাক্তারের হাসাহাসিতে তার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারে, সে স্বপন দেখেছে। তার মায়ের হাসি ঘুম ভেঙে যাবার পরেও কানে কিছু কিছু লেগে থাকে। দেয়ালের গায়ে এখনো লেগে আছে ভাঙা স্বপনের কিছু কিছু। স্বপনটা পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার সময় পায়নি। মিলিয়ে যাবার আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। ফলে তাড়াহুড়ো করে স্বপন পালাতে গিয়ে কিছু কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে গেছে। বিড়াল দেখে যেমন টিকটিকি পালিয়ে যাবার সময় লেজ খুলে ফেলে পালায়। ঘুমের ভেতর দেখা স্বপন ঘুম ভাঙলেই চলে যায়। চলে যায় কেন? ঘুম ভাঙলেও স্বপন শেষ হবার পর বিদায় নিয়ে তারপর যেতে পারে। ঘুম আর জাগরণের মধ্যে খুব বিরোধ? ঘুমন্ত মাধবীর সাথে জাগ্রত মাধবীর খুব বিরোধ? ঘুমন্ত মাধবীর সাথে জাগ্রত মাধবীর কখনো দেখা হবে না?

মাধবী ঘুমিয়ে গেছে আবার। ঘুম ভালো। ঘুম পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীতে না থাকার স্বাদ দেয়। পৃথিবীতে না থাকার স্বাদ ভালো। আলো নাই বা আলোর বোধ নাই, অন্ধকার নাই বা অন্ধকারের বোধ নাই। সুখ নাই, দুখ নাই। ‘নাই’ আর ‘আছে’র দোলাচল নাই। ঘুম ভালো। ঘুমিয়ে গিয়ে জাগতে যদি একবার ভুলে যেত তবে বেশ হতো কিন্তু তা হয় না। মন কত কিছুই তো ভুলে যায় কিন্তু ঘুম ভাঙাতে ভুলে না। মন তো বাবাকেও কখনো ওষুধ খাওয়াতে ভুলিয়ে দিয়েছে, ঘুম ভাঙাতে ভুলাতে পারে না?

মাত্র ভোর হলো। চারদিকে কাকের কা কা। আলো ফুটছে। আলো তার কী কাজে লাগবে সে বুঝতে পারে না। তার অন্ধকারের দরকার নেই, আলোর দরকার নেই, শ্বাস-প্রশ্বাসের দরকার নেই। অথচ আলো আছে, অন্ধকার আছে, শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে আগের মতোই। সূর্যটা জোর করে আলো দিচ্ছে, রাতটা জোর করে অন্ধকার দিচ্ছে, ফুসফুসটা জোর করে শ্বাস-প্রশ্বাস করছে, পেটটা জোর করছে খাবার জন্য।

শিশুকে শিশুর মতো থাকতে দিতে হয়। আস্তে আস্তে তাকে শিক্ষা নিতে দিতে হয়। কিন্তু আমরা বয়স্করা শিশুর ভেতর ঢুকে পড়তে চাই। এতে শিশুদের ভালো হয় না। যেমনভাবে এক মনের বস্তায় দুই মন ধান ঢুকাতে চাইলে বস্তা ফেটে যায়।

তার বাবার একটা ফতুয়ার দিকে তার চোখ যায়। অসুখে পড়ার কদিন আগে কিনেছিল। কয়েকবারের বেশি পরতে পায়নি। ফতুয়াটা নতুনই আছে। তার বাবা কাজ করতো প্রেসে। প্রেস থেকে ফিরেই তার হাতে ধরিয়ে দিত চকলেট বা বিস্কুট বা কোনো ফল। কত আদর করত। তার মা বলত, ‘মেয়েদের অত আদর করতে নাই, তাদের শেখাতে হয় কিভাবে সহ্য করতে হয়। দুনিয়াতে সহ্য শিক্ষাটাই বড়ো শিক্ষা। জগতের সবচে বড়ো শক্তির নাম সহ্য।’ আরতির কথা শুনে শ্রীদাম মিটমিট করে হাসত, বলত— ‘শিশুকে শিশুর মতো থাকতে দিতে হয়। আস্তে আস্তে তাকে শিক্ষা নিতে দিতে হয়। কিন্তু আমরা বয়স্করা শিশুর ভেতর ঢুকে পড়তে চাই। এতে শিশুদের ভালো হয় না। যেমনভাবে এক মনের বস্তায় দুই মন ধান ঢুকাতে চাইলে বস্তা ফেটে যায়। এসব কথা তখন বুঝতে পারত না মাধবী। শুধু বুঝত তার বাবা ভালো কিছু বলছে।

দিন শুরু হয়ে গেল। এত বড়ো দিন নিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারে না। বিশাল বিপুল দিন। এত বড়ো দিন কিভাবে কাটাবে ভেবেই পায় না। আবার তার বাবার কথা মনে আসে। একটা মানুষ যায় তো এভাবেই যায়! সে অবাক হয়ে থাকে মনে মনে। গেল মানে গেলই! আর কোনোভাবেই ফেরার সুযোগ নাই! ডাক্তারের ভুলে রোগী যদি মরে যায় আর ডাক্তার যদি ভুল বুঝতে পারে তবেও কোনো উপায় নাই। একটা মাত্র ভুলের ফারাকে মানুষ জগতের এপার ওপার হয়ে যেতে পারে। সকল ভুলের মাফ হয়তো আছে কিন্তু মরণভুলের কোনো মাফ নাই। ভুলে একবার মরে গেলে ভুল শুধরে বেঁচে যাওয়ার আর কোনো উপায় নাই।

মুখ না ধুয়েই মাধবী বসে আছে বারান্দায়। সূর্য উঠেছে অনেকটাই। কমলালেবুর মতো টকটকে রং। আশপাশের বাড়িঘর থেকে ঝাঁট দেওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। প্রতিবেশিরা ঝাঁট দিয়ে দিয়ে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছে। ঝেঁটিয়ে ফেলছে ময়লা। ময়লার কোনো স্থান নেই জগতে। সবাই দূর দূর করে বের করে দেয়। অথচ যা এখন ময়লা সেটা কত কাজেরই না ছিল। এই যেমন ধরো, লাউয়ের খোসা, পেঁয়াজের খোঁসা, এগুলো কি যত্ন করে লাউকে আর পেঁয়াজকে রক্ষা করছিল না? এই যেমন ধরো, খোকার ছোটো হয়ে যাওয়া জামা। এ জামা কি খোকাকে ছোটোকালে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত থেকে রক্ষা করেনি? আজ এগুলোই ময়লাআবর্জনা! ঝেঁটিয়ে ফেলতে হবে!

আচ্ছা জগৎ কী তার বাবাকে ময়লা আবর্জনা ভেবে ঝেঁটিয়ে ফেলে দিল। কই তার তো কখনো তার বাবাকে আবর্জনা মনে হয়নি। তার বাবা তো প্রেসে কাজ করত। তার বাবা তো বাড়ির পিছনে গাছ লাগিয়েছে। তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দীর্ঘশ্বাসের ঝড়ে ঝড়ে যদি সবকিছু উল্টে পাল্টে যেত! দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে ক্লান্ত। দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে সে ঝড় তুলতে চায়। জগৎকেই বোঝাতে চায়, তুমিই একটা আবর্জনা তোমাকেই উড়িয়ে ফেলে দেব দীর্ঘশ্বাসের ঝড়ে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে আরও জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, প্রাণপণে ফুঁ দেয় ঝড় তোলার জন্য। ঝড় ওঠে না, জগৎ ওড়ে না, ক্লান্তিতে তার নিজেরই উড়ে যাবার যোগাড় হয়।

সে আকাশের দিকে মুখ করে কাকে যেন গালি দেয়, ‘আমার বাবাকে আবর্জনা মনে হলো? বাবা না থাকলে আমার কী দাম? আমাকে কেন আবর্জনা মনে হলো না?’ আকাশে কেউ থাকে না। কেউ কোনো জবাব দিল না তার কথার। আকাশে কেউ হয়তো থাকে সে জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না। সে নিরুপায়ভাবে আকাশের দিক থেকে মুখ টেনে নেয়। যেমনভাবে মিনতিমাখা চোখে জেলপুলিশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিরুপায় বন্দি হতাশ হয়ে চোখ ফেরায় তেমনভাবে।

সে চুপচাপ বসে থাকে। চুপচাপ থাকা মাধবী মনে মনে দেখতে পায় সবকিছুরই জন্ম আবর্জনাতে রূপ নেবার জন্য। এই যে ঘরটা, একদিন আবর্জনা হয়ে যাবে, ওই যে গাছটা একদিন আবর্জনা হয়ে যাবে, এই যে নবীন দেহের মাধবী সেও একদিন আবর্জনা হয়ে যাবে। বর্জনা হয়ে যাবে। কারো রেহাই নেই। এসব ভেবেও মনের তাপ মেটে না। মাধবী খেঁকিয়ে ওঠে, মরণের উপর ঝাল ঝাড়ে, ওরে মরণ, আমার বাবাকে মারলি তোরও রেহাই নেই, তোরও মরণ হবে। কোনদিন মরণ হবে? যেদিন জগতে মরার মতো আর কেউ থাকবে না সেদিন তুইও মরবি, আবর্জনা হয়ে যাবি। মাধবীর গাল শুনে জীবন হো হো করে হাসে, মরণ হো হো করে হাসে। হাসতে হাসতে জীবন মরে যায়, হাসতে হাসতে মরণ হয়ে যায় জীবন।

বাড়ির আশপাশ থেকে থালাবাসন মাজার ঝনঝন, ঠনঠন, ঘসঘস, খসখস আওয়াজ আসে। তার মা-ও সকালবেলা এভাবে বাসন মাজত। সে চুপটি করে বসে বসে বাসনদের স্নান করানো দেখত। মুহূর্তেই বাসনগুলো ঝকঝক করে হেসে উঠত। মানুষের বুদ্ধি আছে, পুরোনো জিনিসের জেল্লা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ঈশ্বরের কি বুদ্ধি নাই, সে কেন রোগাশোকা তার বাবাটাকে ঝকঝকে তকতকে করে তুলল না? তার মায়ের উপর তার অভিমান হয়, কেন সে ছেড়ে চলে গেল। একটু কম খেয়ে থাকলে, একটু ছেঁড়া শাড়ি পরে থাকলে কী এমন ক্ষতি হয়? তার মায়ের মুখ মনে পড়ছে, তার বাবার মুখ মনে পড়ছে। তার আবার চোখ ভরে উঠে। বুকের ভেতর থেকে থেকে ঢেউ উঠছে। বুকের ভেতর কি সমুদ্র আছে? সমুদ্রে ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের তাল সামলাতে না পেরে চোখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে পড়ছে। বাইরে যে সমুদ্র আছে তার চেয়ে ছোটো নয় সে সমুদ্র। মূলত প্রত্যেকটা মানুষই এক একটা সমুদ্র। মানুষ বুকের ভেতর একসমুদ্র কান্নার জল ধারণ করে আছে। সমুদ্র সমুদ্রের চেয়ে সমুদ্র নয়, মানুষ সমুদ্রের চেয়ে সমুদ্র।

কেউ একজন বাহির থেকে ডাক দিল, ‘মাধবী।’ পাশের বাড়ির কাকি। মাধবী সাড়া দিল না। সাড়া দিতে তার ভালো লাগছে না। কাকি হয়তো এক থালা খাবার নিয়ে এসেছে। রাতে যে এক প্লেট খাবার কেউ দিয়েছিল সেটাই খায়নি। কিন্তু এখন বাহির থেকে ‘মাধবী’ ডাক শুনে তার খিদে চাগিয়ে ওঠে।

কেউ একজন বাহির থেকে ডাক দিল, ‘মাধবী।’ পাশের বাড়ির কাকি। মাধবী সাড়া দিল না। সাড়া দিতে তার ভালো লাগছে না। কাকি হয়তো এক থালা খাবার নিয়ে এসেছে। রাতে যে এক প্লেট খাবার কেউ দিয়েছিল সেটাই খায়নি। কিন্তু এখন বাহির থেকে ‘মাধবী’ ডাক শুনে তার খিদে চাগিয়ে ওঠে। তাহলে কি তার পাশের বাড়ির কাকি তাকে ডাকেনি? তার পেটের খিদের নাম ধরে ডেকেছে? তাহলে তার নাম ‘মাধবী’ নয়, তার খিদের নাম ‘মাধবী’? নইলে কেন কাকির ডাকে মনে হবে, ‘কাকি এক থালা খাবার নিয়ে এসেছে?’ পাশের বাড়ির কাকি ভাত নিয়ে না-ও আসতে পারে। ‘মাধবী’ বলে ডাকাতে, কেন তার পেট হঠাৎ করে জেগে ওঠা অজগরের মতো মোচড় দিয়ে উঠবে? মানুষকে যে নামে ডাকা হয় সেটা আসলে সে মানুষটার নাম নয়, সেই মানুষটার খিদের নাম।

আবার ডাক পড়ল, ‘মাধবী আছিস?’ মাধবী পাশের বাড়ির কাকির পায়ের শব্দ শুনতে পায়। বাহির দরজার কাছে এসে হাজির হয়েছে। মাধবী বাড়ি ঢোকার দরজার কাছে চোখ ফেলে তাকিয়ে থাকে। সাড়া দেয় না।

খাবার হাতে কাকি ঢোকে, ‘কী মাধবী সাড়া দিস না কেন? আয় নে এটুকু খেয়ে নে তো।’ মাধবী খিদেকে ঢোক দিয়ে গিলে নিয়ে বলে, ‘না কাকি খাবো না, খিদে নেই।’ খিদেটা নিজেই চিৎকার দিয়ে বের হয়ে তার কাকিকে বলতে চায়, ‘আমি আছি, আমি থাকি, আমি থাকব। খাবার আর ক্ষুধা আমরা যমজ দুভাই। পালা করে মানুষকে পাহারা দিই। খাবারভাই যখন মানুষকে পাহারা দেয় তখন আমি থাকি না, খাবারভাই চলে গেলে তখন আমি মানুষকে পাহারা দিই। আমাদের ভাই একসাথে থাকতে পায় না কখনো। মানুষের পেট এত ছোটো যে দুভাইয়ের থাকার জায়গা হয় না কখনো।’ খিদে যে কথা বলল তা মাধবী শুনতে পেয়েছে, কাকি শুনতে পায়নি। কেউ কারো খিদের কথা শুনতে পায় না। কাকি মাধবীকে বলে, ‘এটা কেমন কথা মাধবী, বাবা সবার চিরকাল বেঁচে থাকে? থাকে না। তবু তো তোকে বেঁচে থাকতে হবে।’ কাকি তার সামনে খাবার রেখে চলে যায়, প্লেটের উপর খাবার বসে আছে যেমনভাবে খাবারের সামনে গল্পের খরগোশ বসে থাকে সিংহের সামনে। গল্পে চুক্তি হয়েছিল, মাংসখেকো বনের রাজা সিংহের সামনে প্রতিদিন। তাকে ‘বেঁচে থাকতে হবে’ শুনে মাধবীর ভেতর চমকে ওঠে, তাই তো, সে তো এভাবে ভাবেনি। তাকে বেঁচে থাকতে হবে কিন্তু কেন বেঁচে থাকতে হবে? তার কাকি কি তাকে বলে দিল, ‘তোকে বেঁচে থাকতে হবে মানে তোকে মরে যেতে হবে?’ কীভাবে মরব? তার তো অসুখ নাই বাবার মতো। অসুখের কারণে তার বাবা বাতাসকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে, বাতাস তার কাছে থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। সে তার নাক চেপে ধরে। বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারে না। ভেতর থেকে কী একটা শক্তি নাক চেপে ধরে থাকা আঙুলকে ধাক্কিয়ে সরিয়ে দেয়। আঙুল সরে যেতেই হুড়হুড় করে অজস্র বাতাস ঢুকে পড়ে বুকের ভেতর। সে তার গলা চেপে ধরে। গলা চেপে ধরলেও একই ব্যাপার ঘটে। ও রে বাতাস ছুটি দে আমাকে তোরাও ছুটি নে। এভাবে সে মৃত্যুকে আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে। সে তার বাবার মৃত্যু ছাড়া আর কোনো মৃত্যু দেখেনি। বহুবার সে মৃত্যুর খবর শুনেছে কিন্তু দেখেছে একবারই।

দুপুরে আবার খাবার দিতে এসে প্রতিবেশী কাকি বলে, ‘জানিস মাধবী, ও গাঁয়ের নবকিশোরবাবু আত্মহত্যা করেছে।’ আত্মহত্যা? আত্মহত্যা কী? সে আত্মহত্যা বলে যে একটা ব্যাপার আছে তাই-ই জানে না। সে ভাবছে সে-ই বুঝি প্রথম নিজের নাক চেপে, গলা চেপে স্বেচ্ছা মৃত্যু আবিষ্কারের কথা ভেবে বের করল আর পথ খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু না, এখন দেখা যাচ্ছে আরও কত মানুষ নিজে নিজে মরেছে। ‘হোক তবু, এ আমারই আবিষ্কার’ ভাবল মাধবী। পরীক্ষার খাতাতে নকল করা যায়, মৃত্যু কি নকল করা যায়? সে কি নবকিশোর বাবুর মৃত্যুকে নকল করছে? মাধবী ভাবল, না, কেউ কারো মরণ মরে না, কেউ কারো মৃত্যু নকল করে না? প্রত্যেককে আত্মহত্যা আবিষ্কার করতে হয়।

মাধবী কাকির কাছে নবকিশোরবাবুর গলায় ফাঁসি দিয়ে মরা শুনে চুপ করে থাকে। ‘খেয়ে নিস মাধবী’ বলে চলে গেল কাকি। মানুষ তবে অসুখ ছাড়াও মরে, মরতে পারে। নাকি মেলারকমের অসুখ আছে। কোনো কোনো অসুখের নাম আত্মহত্যা।

সে আত্মহত্যা করার চিন্তা করে। আজ রাতেই তবে তা করা যেতে পারে। এটা ভেবে অনেকটাই তার নির্ভার মনে হচ্ছে। খাবার থালা হাতে তুলে নেয়। ধীরে ধীরে খায়। তার খিদে হেসে ওঠে, তার খিদে লালামিশ্রিত চিবুনো খাবারে স্নান করে। খাওয়া শেষ হলে থালাটা ধোয়। কাকি চলে গেছে। থালা একসময় দিয়ে আসা যাবে বা সে-ই এসে নিয়ে যাবে। সে কিছুটা খুশি যেন, কিছুটা নিশ্চিন্ত যেন। যেন তার সাথে তার কিছু একটা কথা হয়ে গেছে। তার সাথে তার একটা আপোশ হয়ে গেছে। আপোশের নাম আত্মহত্যা। বেঁচে যাওয়ার নাম আত্মহত্যা। নিজেকে মৃত্যু দান করার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পেরে সে ভালো বোধ করছে। যারা বিজ্ঞানী তারাও নিশ্চয় কোনো কিছু আবিষ্কার করার পর এমনই আনন্দ পায়। ঐ তো বিজ্ঞান বইয়ের আর্কিমিডিস আবিষ্কারের আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে ছুটছিল। মাধবীও কান্না ভরা চোখে ব্যথাতুর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, ‘ইউরেকা, ইউরেকা।’

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। সে বিকেল বেলাতেই একটা দড়ি খুঁজে বের করে ঘরে রেখে দিয়েছে। দড়ি নড়াচড়া করছে না। তার আত্মহত্যার ব্যাপারে দড়িটা যেন রাজি। দড়ি চুপচাপ শুয়ে আছে। তার বাবার কাটা পা হেঁটে বেড়াচ্ছে ঘরে, সে কাটা পায়ের হাঁটার শব্দ পাচ্ছে। বনমুরগির কর কর শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কাটা পা হাঁটছে। বনমুরগি হাঁটছে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। সে বিকেল বেলাতেই একটা দড়ি খুঁজে বের করে ঘরে রেখে দিয়েছে। দড়ি নড়াচড়া করছে না। তার আত্মহত্যার ব্যাপারে দড়িটা যেন রাজি। দড়ি চুপচাপ শুয়ে আছে। তার বাবার কাটা পা হেঁটে বেড়াচ্ছে ঘরে, সে কাটা পায়ের হাঁটার শব্দ পাচ্ছে। বনমুরগির কর কর শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কাটা পা হাঁটছে। বনমুরগি হাঁটছে। কাটা পা বনমুরগিকে দেখতে পেয়ে তেড়ে যায়। বনমুরগিও তেড়ে গিয়ে ঠোঁকর পাড়ে কাটা পাকে। মারাত্মক লড়াই। মাধবী ভয় পেয়ে হুস হুস করে তাড়াতে চায়। বনমুরগি আর কাটা পায়ের লড়াই থামে না। হঠাৎ সে হাসির শব্দ শুনতে পায়, চমকে ওঠে মাধবী হাসি শুনে। সে দেখে, তার মা আরতি ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে আর কাটা পা আর মুরগির লড়াই দেখে হাসছে, হাসছে মাধবীর ভয় পাওয়া দেখে। মায়ের হাসি শুনে মাধবী অজ্ঞান হয়ে যায়।

[শেষিকা :
জ্ঞান ফিরে আসার পর সে ফাঁস দেবার জন্য চালার বর্গার সাথে দড়িও বেঁধে ফেলেছিল। সে যখন দড়ির ফাঁসে গলা ঢুকাতে যাবে ঠিক তখন কয়েকজন যুবক ঢুকে পড়ে আর তাকে ধরে ফেলে। সে আত্মহত্যা করতে পারেনি। ঐ যুবকেরা তাকে ধরে নিয়ে দূরের এক শহরের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। চৌদ্দ বছরের কিশোরীর বাধ্যতামূলক জীবন শুরু হয় পতিতালয়ে।]

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম  ১৯৮০ সালের ২৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে। প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়টি। কাব্যগ্রন্থ : ‘পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ডপত্র’, ‘এসো মহাকালের মাদুরে শুয়ে পড়ি’। গল্পগ্রন্থ : ‘মন ও শরীরের গন্ধ’, ‘দৃশ্যবিদ্ধ নরনারীগান’ ও ‘জীবগণিত’। উপন্যাস : ‘আগামীকাল থেকে সূর্য পূর্বে উঠবে’।পুরস্কার : জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।