বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

যখন কবিতা নাইমা আসে সুবর্ণনগরে : তুষার কবির

0

০১.
যিনি কবিতায় পাথরচিত্রে লিখে চলেন মর্মচেরা নদীকথা, হাজার বছর ধরে কবিতার খোঁজে যিনি হেঁটে যান দূর বিশ্বের নালন্দা থেকে নিজভূমি সুবর্ণনগরে, কবিতায় যিনি প্রত্মনগরের শিলালিপি খোদাই করে খুঁজে ফেরেন ব্রক্ষ্মাণ্ডের ইসকুল, সমস্ত দিনের শেষে যিনি বাগ্‌দেবীর মুখোমুখি বসে সঁপে দেন তাঁর হৃদয়লিপি, যিনি কবিতায় মা, মাটি, মানুষ, নদী, জোছনা তথা রূপসী বাংলার সৌন্দর্যে সম্মোহিত হয়ে এক ব্রাত্যজনের মতন হেঁটে যান দেশহীন মানুষের দেশে—তিনি বাঙলা কবিতায় নব্বই দশকের এক সক্রিয় ও স্বতন্ত্র স্বর—কবি শামীম রেজা! অন্য এক কাব্যভাষায় কবি শামীম রেজা তাঁর কবিতায় পাঠকদের নিয়ে যান ইমেজ ও ইল্যুশনের এক কুহকলাগা ভুবনে, ভিন্ন নিরীক্ষায় ক্রিয়াপদের প্রচলরীতিকে তিনি আমূল গুঁড়িয়ে দেন, ঐতিহ্যের পরম্পরায় তাঁর কবিতায় পাঠক খুঁজে পান চর্যাপদ থেকে উত্তরাধুনিক কবিতার যোগসূত্র! দীর্ঘ কাব্য অভিযাত্রায় কবি শামীম রেজার এ যাবৎ আটটি কাব্যগ্রন্থ: ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’, ‘নালন্দা দূর বিশ্বের মেয়ে’, ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’, ‘ব্রক্ষ্মাণ্ডের ইসকুল’, ‘শামীম রেজার কবিতা’, ‘হৃদয়লিপি’, ‘দেশহীন মানুষের দেশ’, ‘চর্যাধুনিক’ প্রকাশিত হয়েছে! তবে এ নিবন্ধটি কবির একটি ভিন্ন নিরীক্ষাধর্মি, বলা যায়, কবি শামীম রেজার একটি সিগনেচার বই ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’কে ঘিরে!

Shamim Reza 1

যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে | শামীম রেজা | প্রকরণ : কবিতা

০২.
‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থে কবি শামীম রেজা পাঠকদের নিয়ে যান চিত্রকল্পের এক চুল্লির ভেতরে! এ চুল্লি যেন আবহমান গ্রামবাংলার গনগনে চুল্লি যাতে পাঠকের সংবেদনে আছড়ে পড়ে রূপসী বাংলার সৌন্দর্যখচিত ইমেজারির দাউ দাউ শিখা! লহমায় পাঠকের চেতনায় ঘুরপাক খেতে থাকে ইন্দ্রপাশা গ্রামের মেলায় পাশা শিকারীরা, ধূলামাখা চাকতির মতো শবরীর স্তন, ছেউড়িয়ার ঘাটে সিকি চাঁদ, পূর্ণতোয়ার জলে কমলারঙের আগুন, আদিম হেতাল বনের আঁধার, পোখর্ণার রাজার করুণ প্রাসাদ! কবি শামীম রেজার এই চিত্ররূপময় কাব্যপ্রতিবেশ ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’তে জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার মতন স্নিগ্ধ-সরল-নিরীহ-মৃদু-কোমল নয়; বরং মনে হতে পারে জীবনানন্দের রূপসী বাংলার নৈসর্গিক ক্যানভাসে উত্তরসুরী এক কবি জ্বেলে দিয়েছেন হু হু দাবানল! আর তাইতো কবি শামীম রেজার এই চিত্রশোভাময় রাত্তির কখনোবা নাইমা আসে সুবর্ণনদীর ধারে, জলপদ্মের পাতার উপরে, জ্বীনগাছের শিকড় ছায়ায়, শিলিগুড়ি পাহাড়ের ধারে! আবার কখনো এই রাত্তির নাইমা আসে হেতাল বনের আঁধারে, নীলাচল পাহাড়ে, হাড়গুঁজি পাতার কাঁটায়, জংলাপাখির ঝরা পালকের লোমকূপে।

 

 

০৩.
ইন্দ্রিয়আচ্ছন্নতা—‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’র একটি প্রধানতম অনুষঙ্গ; কবি শামীম রেজা এ কাব্যগ্রন্থে এক মন্দ্রিত ইন্দ্রিয়আচ্ছন্নতায় বুঁদ হয়ে থেকেছেন! পঙ্‌ক্তির পর পঙ্‌ক্তিতে ইন্দ্রিয়ভারাতুর শব্দঅভিধা, দেহজ কামনা বাসনা, উদগ্র শরীরী লালসার এক চরম ক্যাথারসিস ঘটেছে এ কাব্যগ্রন্থে! এ প্রসঙ্গে কবি মন্দাক্রান্তা সেন ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ বইটির কাব্যভাষা নিয়ে তুলে ধরেন তাঁর নিজস্ব বয়ান; “এখানে ভাষা অসম্ভব শরীরী, হাত ছোঁয়ালে দপদপ করে। ওই ভাষাধমনীর দপদপানি হয়ে এখানে বেজে ওঠে কবির পূর্ববঙ্গীয় ভাষারীতি, তার আশ্চর্য জলমাটিআকাশ-ঘেঁষা গ্রামীণতার সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর নাগরিকতার মোক্ষম মিশ্রণে যা মারাত্মক লক্ষ্যভেদী, অথচ মাদক হয়ে উঠেছে।” (এ এক আশ্চর্য কবিতায় বোনা উপকথা, মানুষী যন্ত্রণার ইতিহাস/ ভূমিস্বর্গের কবি) আবার এই ইন্দ্রিয়আচ্ছন্নতার পাশাপাশি এ কাব্যগ্রন্থে উঠে এসেছে কবির এক ক্ষুৎকাতর প্রমত্ততা যার স্ফূরণ দেখতে পাওয়া যেত অনেকটা ‘হাংরি জেনারেশন’ বা হাংরিয়ালিস্টদের কবিতায়! এই ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, ক্ষুৎকাতর প্রমত্ততা এবং sensuousness ‘কৃত্তিবাস’-এর ক্ষুধিত প্রজন্মের কবিদের অন্যতম proposition ছিল। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয় রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরীদের কবিতাতেও ছিল এই ক্ষুৎকাতর প্রমত্ততা! ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ বইটিতে কবি শামীম রেজার ইন্দ্রিয়আচ্ছন্ন পঙ্‌ক্তিগুচ্ছ উঠে এসেছে এভাবে:

ক. পানশালায় সাতাইশ বছর পইড়া আছি, বেহায়া বাতাস পিছন ছাড়ে না
খ. ধূলামাখা চাকতির মতো শবরীর স্তন, সবই কলকব্জা মনে হয়
গ. মধুকর মুখ রাখে গর্ভকেশরে—ঝিঙার কুসুমে;
ঘ. বেশ্যার খিস্তির মতো আমার নিরর্থ কান্না ঝইরা গেছে
ঙ. গণিকার ঋতুস্রাবে বর্ষা এলে এই পৃথিবীতে জোছনা ওঠে না আর
চ. পতিতার নূপুরের ন্যায় খুইলা যায় অন্ধকারের পাঠ
ছ. তোর মধু আলতা শরীরের ভাঁজে জোছনা উঁকিঝুঁকি মারে

 

০৪.
প্রত্নতাত্ত্বিক অন্বেষা, নৃতাত্ত্বিক অভীপ্সা, ইতিহাসচেতনা আর পুরাণের প্রয়োগ ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় দ্যুতিময় ক্র্যাফটসের মতন! কবি শামীম রেজা যেন শিলালিপি খোদাই করে তুলে এনেছেন প্রত্মজনপদের মর্মচেরা গাথা! নালন্দা, আলতামিরা গুহা, আরিহা, মথুরা, অজন্তাগুহার পাশাপাশি কবি ঘুরে বেড়িয়েছেন বেথেলহাম, আমাজন, অ্যাঙ্গোলার জনপদ। কবির এই প্রত্নমোহগ্রস্ততা বারবার প্রকাশ পেয়েছে ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’তে:

ক. শুইনাছি, পাহাড়পুরী এক মেয়ে প্রত্নজন্ম থেইকা আছে এখানে
খ. তুমি প্রত্নমেয়ে হয়া পইড়া আছো কোন এক রাজবংশীর খড়ের ডেরায়
গ. প্রস্তুরীভূত প্রত্নমেয়ে এখনো দাঁড়ায়ে আছে, অজয়া নদী তীরে গোপনে
ঘ. শশাঙ্ক পাল কত কত সেন সুলতান আর মুঘল/ সিরাজ এরা কস্তুরী রক্ত শুষেছে দুগ্ধবতী মায়ের শরীরে/ আমার

 

তবে কবি শুধু এই প্রত্নসময়ের পোর্ট্রেট এঁকেই থেমে থাকেননি; ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’তে এই সাইবার পৃথিবীর বিদীর্ণ সময়কেও তিনি এঁকেছেন, খুঁজে ফিরেছেন ভোগবাদী পণ্যপৃথিবীর পড়ন্ত জোছনার হাট! আর এই ভ্রষ্ট পৃথিবীতে রাত নেমে এলে কুষ্ঠরোগের ছোঁয়াচে ঘা, মক্ষিকার বিষাক্ত শরীর ও খুনীদের পরকীয়া প্রেম পার হয়ে কবি দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর প্রিয় সুবর্ণ নদীর ধারে:

যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণ নদীটার ধারে, অন্ধপাখির পাখনায় ভর করে সোনালু আগুন আইসা ঝইড়া পড়ে কার অন্তরে? পোখর্ণার রাজার করুণ প্রাসাদের কথা মনে পইড়া যায়, কেন মনে পড়ে? নিসর্গের হেঁয়ালি বিছ্নায় একরাশ পরগাছা ঘাস-গ্রহের মনীষা গিইলা গিইলা খায় নিশিরহীন প্রভাত-বেলায়। আর সম্রাজ্ঞীর মেয়ে কোনো এক ক্ষৌরকার নাগরের পিরিতে ভাইসা অদ্ভুত ঈশ্বরের জন্ম দেয় সাইবার পৃথিবীতে।

 

০৫.
ক্রিয়াপদের প্রচলরীতিকে আমূল গুঁড়িয়ে দিয়েছেন কবি শামীম রেজা ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’তে। তিনি মানভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ও কথ্য ভাষার মিল ঘটিয়েছেন, সম্বন্ধ ও সম্বোধন পদের ব্যাকরণগত রীতি ভেঙে দিয়েছেন। ক্রিয়াপদের এই অভিনব প্রয়োগ, বলা যায়, ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’র একটি প্যারাডাইম শিফট! প্রকরণকৌশলের দিক থেকে, শামীম রেজার প্রথাবিরোধী ক্র্যাফটস্ম্যানশিপ লক্ষ করা যায় এ কাব্যগ্রন্থে! আবার তিনি ছন্দানুগামীও হননি; মাত্রা গুনে গুনে কবিতা লিখেননি, প্রথাগত প্রমিতির অনুসারীও হননি। ক্রিয়াপদের এই ভিন্ন নিরীক্ষা তাঁর কবিতায় আছড়ে পড়ে এভাবে:

ক. ঘুমন্ত নদী হেথায় কাঁইপা ওঠে মধুর আস্বাদে
খ. ছেউড়িয়ার ঘাটে সিকিচাঁদ পইড়া থাকে
গ. শুকতারা গাঁইথা থাকে আকাশের ঘরে
ঘ. আমি দশমাস আরাধনায় জাইগা থাকবো সোমপুরে
ঙ. পোষ না-মানা পড়শি সকাল ঝুইলা থাকবে পাকুড় শাখায়

 

যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’তে কবি শামীম রেজার এই প্রচলের বাইরে গিয়ে কবিতা লেখা প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন এভাবে; ‘বাংলা ভাষার পদ্ধতিগত পরাক্রম এখানে এই পাণ্ডুলিপিতে ঠিকমতো অনুসরণ করা হয়নি। এটা কবি হিসেবে শামীম রেজার ত্রুটিও হতে পারে, আবার উদ্ভাবনাও হতে পারে। আমি ধরতে পারছি না। যেখানে আমি শনাক্ত করতে পারছি না, সেখানে আমি শামীম রেজাকে নিরুৎসাহিত করতে যাব কেন? এই যে শামীম রেজা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছেন, এটাকে আমি তাঁর কবি-প্রতিভার প্রধান লক্ষণ বলে মেনে নিচ্ছি।

 

০৬.
‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থে কবি শামীম রেজা সমসাময়িক বিশ্বায়িত পৃথিবীর অবক্ষয়, পণ্যমানুষের হাহাকার, বিপর্যয়কামিতা, নৈরাশ্য, নেতিবাচকতা, নৈঃসঙ্গ্য, অশুভতা—এ সবকিছুর চালচিত্র তুলে ধরেছেন বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা ও অতিবাস্তবতার এক অভিনব ফিউশনে! ‘ফ্ল্যর দ্যু মাল’-এ শার্ল বোদলেয়ার যেভাবে অশুভতার ভেতর সৌন্দর্য খুজেছেন ঠিক সেভাবেই শামীম রেজা যেন দেখতে পান মর্গের দেয়ালে যোনিরক্ত, যুবতী মাংসের ঘ্রাণ, ক্যাসিনোর জিপসি আঁধার, চে’র ছবি আঁকা খণ্ডিত মুখ—এ সব দৃশ্যাবলী পাঠকের চেতনায় বারবার আছড়ে পড়ে ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থে। এ যেন বোদলেয়ারের সেই ইশতেহার—‘অদৃশ্যকে দেখতে হবে, অশ্রুতকে শুনতে হবে, ইন্দ্রিয়সমূহের বিপুল ও সচেতন বিপর্যয়সাধনের দ্বারা পৌঁছতে হবে অজানায়, জানতে হবে প্রেমের, দুঃখের, উন্মাদনার সবগুলি প্রকরণ, খুঁজতে হবে নিজেকে, সব গরল আত্মসাৎ করে নিতে হবে, পেতে হবে অকথ্য যন্ত্রণা, অলৌকিক শক্তি, হতে হবে মহারোগী, মহাদুর্জন, পরম নারকীয়!’ সেই বিপর্যয়কামি, নৈরাশ্যবাদী, অবক্ষয়ধর্মী ও চেতনাপীড়ক পঙ্‌ক্তিগুচ্ছ ছড়িয়ে আছে এ কাব্যগ্রন্থে:

ক. লাবণ্যরা হারাইতে থাক দূর ক্যাসিনোর জিপসি আঁধারে
খ. পণ্যমানুষের কলজে ছিঁইড়া ফ্যালানোই আমার আদর্শ
গ. চারিদিকে পাখিদের কান্নায় দোলনচাঁপার কামুক ঘ্রাণ বন্ধ হইয়া আসে
ঘ. নকল নগরে আইসা বারবালিকার হাতে সুরা পান শেষে দেখি পরিচিত মুখ তার
ঙ. মর্গের দেয়ালে যোনিরক্ত লেপটায়ে রাখছে যে ডোম তার চোখে চোলাই মদের ঘোর…
চ. যুবতী মাংসের ঘ্রাণ গইলা গইলা মিশে পশ্চিমী হাওয়ায় রেটিনার পিছে তার ছায়া আঁইকা রাখি
ছ. সাপরক্ত ঢুকায়া দেছে জারজ-ইংরাজ
জ. মর্গের দুয়ার থেইকা ফিইরা-আসা লাশ আমি গ্লোবাল এন্টিনায় নিজেরে শুকাই

যেন এটি তাঁর শৈশবের প্রিয় নদী—যে নদীর সাথে কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোরের দিনগুলো—এ নদী যেন কবির সোনালি নস্টালজিয়া। এই দোয়েলা ছাড়াও পদ্মা, পূর্ণতোয়া, আগুনমুহা, মহানন্দা, সুরমা, কুশিয়ারা, পশুর, জয়ন্তী, কোপাই, মূর্ছনানদী, সন্ধ্যানদী, শিপ্রানদী—এ সব নদীর কথা ঘুরে ফিরে এসেছে ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থে

 

০৭.
নদীমোহগ্রস্ততা—‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’তে কবি শামীম রেজার আরেকটি উল্লেখ করার মত দিক। ‘এই জনপদে তুই ছাড়া আর কোনো নদী নাই ও কুমারী/ নদী দোয়েলা আমার, তুই কি জানো তোর চোখে ঘুমায়/ বৃষ্টিমাসী সকাল, ইমনরাগে সন্ধ্যা জাগে কণ্ঠে তোমার’। এ কাব্যগ্রন্থে বারবার উঠে এসেছে ‘দোয়েলা’ নদীর কথা। যেন এটি তাঁর শৈশবের প্রিয় নদী—যে নদীর সাথে কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোরের দিনগুলো—এ নদী যেন কবির সোনালি নস্টালজিয়া। এই দোয়েলা ছাড়াও পদ্মা, পূর্ণতোয়া, আগুনমুহা, মহানন্দা, সুরমা, কুশিয়ারা, পশুর, জয়ন্তী, কোপাই, মূর্ছনানদী, সন্ধ্যানদী, শিপ্রানদী—এ সব নদীর কথা ঘুরে ফিরে এসেছে ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’ কাব্যগ্রন্থে:

আহারে! দোয়েলা; রাত্তির আমার, একলা পরান! কার ভিডায় কান্দো নরমকণ্ঠী পাখি, কার প্রশ্রয়ে ভিজাও মন, কার ঠোঁটে কাঁপে অনুভূতির প্রথম চুম্বন, কোথায় তোর বাউড়িয়া গাঁ, খাডালের ছিট ছিট জোছনা-রৌদ্রে কীরহম তোর চলাফেরা মনে পড়ে, মনে পড়ে না? কৈশোরের বেশ কিছু দিন পর, তোর সাথে বাইন্ধা ছিলাম ঘর, সাক্ষী ছিল হাওর-বাঁওর আর দেবীঘাটার চর, আরো ছিল ম্যাগলাকাটা আকাশ; হেদিন কুলহারানো হাওয়া; এরপর, কতবার সুশীল পাটিনীর খেওয়া কত্ত কত্ত বার হয়েছি পাড়, তহন ঢেউয়ে ঢেউয়ে জাইগাছি তোর বুকের ভিতর, এহন তুই ক্যামন আছো, কোনহানে তোর বাস, রোদ-পোহানো পাখির নাহান নিভৃতে কি যাস?

আবার নদীমোহগ্রস্ততার পাশাপাশি এ কাব্যগ্রন্থে উঠে এসেছে কবির দুর্মর জোছনাপ্রীতি! মধুগন্ধা জোছনা, মরা জোছনা, শয্যাবাহারী জোছনা, তুষার-জোছনা—জোছনাকে কবি চিত্রিত করেছেন বর্ণিল রূপক ও উপমার বিভায়! আর এভাবে নদী, জোছনা, মা, মাটি, মানুষ, শৈশব তথা রূপসী বাংলার টুকরো টুকরো কোলাজ বারবার উঠে এসেছে এ কাব্যগ্রন্থে। কবি গৌতম গুহ রায় এই কাব্যপ্রবণতা সম্পর্কে বলেন, ‘বারবার তাঁর কবিতায় আমরা দেখি যে চারপাশের কাঁধে কাঁধ রাখা মানুষ ও পায়ের নিচের অবলম্বন যে মৃত্তিকা তার উত্থাপন ও চিহ্নায়নের বিচ্ছুরণে সম্পৃক্ত ভাষা ও মানুষের উপস্থিতি। সেই সঙ্গে লেপ্টে থাকে তাঁর হৃদয়লিপি, তাঁর ধানসিড়ি ও সুবর্ণনগর।’ (শামীম রেজা : ‘হৃদয়লিপি’তে যে শুশ্রুষার ভাষা কয়/ ভূমিস্বর্গের কবি)

 

০৮.
কবিতার ইতিহাস বাঁকবদলের ইতিহাস! দশকে দশকে যেমন কবিতার বাঁকবদল ঘটে, মহাকালে আরও বড়ো রকমের বদল ঘটে—কবিতার আঙ্গিকে, প্রকরণকৌশলে, নিরীক্ষায় আসে ভিন্নতা! এর মাঝে কোনো কোনো কবি কবিতায় রেখে যান তাঁর নিজস্ব সিগনেচার, নির্মাণ করতে পারেন তাঁর নিজস্ব স্বর, সৃষ্টি করেন তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা, প্রচলিত কাব্যপ্রতিবেশ আমূল পাল্টে দিয়ে কেউ কেউ কড়া নাড়তে পারেন মহাকালের দরজায়! ‘যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে’—প্রথাবিরোধী প্রবণতার কারণে—ইতোমধ্যে অন্য কাব্যগ্রন্থের চেয়ে পাঠকের কাছে আলাদা হিশেবে চিহ্নিত হয়েছে! আশাবাদী হওয়া যায়, এ কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের মননের অতল গহীনে জেগে থাকবে; পাঠে ও পুনর্পাঠে বেঁচে থাকবে পাঠকের সুবর্ণহৃদয়ে!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে। পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত গ্রন্থ: বাগ্‌দেবী আমার দরজায় (২০০৬), মেঘের পিয়ানো (২০০৭), ছাপচিত্রে প্রজাপতি (২০০৮), যোগিনীর ডেরা (২০০৯), উড়ে যাচ্ছে প্রেমপাণ্ডুলিপি (২০১০), কুহক বেহালা (২০১২), রক্তকোরকের ওম (২০১৪), ঘুঙুর ছড়ানো ঘুম (২০১৫), তিয়াসার তৃণলিপি (২০১৬), কুঠুরির স্বর (২০১৬), হাওয়াহরিৎ গান (২০১৭), ধূলি সারগাম (২০১৮), তাঁবুকাব্য (২০১৯), প্রেম সংক্রমণ (২০২২)। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন, কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার, দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার, দাগ সাহিত্য পুরস্কার, এসবিএসপি সাহিত্য সম্মাননা, বগুড়া লখেক চক্র পুরস্কার, শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।