আরো অনেকের মতোই হাসান আজিজুল হকের ভুবনে আমার প্রবেশ ‘শকুন’ ও ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর মতো গল্পের মাধ্যমে। এবং, অন্য অনেকের মতোই, সে প্রবেশ শিহরণ জাগানো। কত বছর চলে গেছে, এখনও মুক্তি মেলেনি প্রথম পাঠের সে শিহরণ থেকে; ধনুকের টঙ্কারের মতোই এখনও বেজে চলেছে। কত গল্প পড়লাম জীবনে, কিন্তু ‘আত্মজা ও করবী গাছ’-এর মতো চাবুক খেয়ে জেগে ওঠার সেই অনুভূতি আর খুব বেশি গল্প দিতে পারেনি। গল্পের সেই অবিস্মরণীয় শুরুটা— ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেলগাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত থানের বাড়ির টিনের চাল হিম ঝক ঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে। হঠাৎ তখন স্কুলের খোয়ার রাস্তার দুপাশের বনবাদাড় আর ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ থেকে হু-উ-উ চিৎকার ওঠে।’ ইনাম, ফেকু ও সুহাসের সঙ্গী হয়ে আলগোছে ঢুকে পড়ি গল্পের জগতে, উপলব্ধির উন্মোচন ঘটতে থাকে, এবং একসময় একটা ঘোরের মধ্যে শেষ করি গল্প। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে উৎপীড়ন করতে থাকে ইনামের সেই তেতো উচ্চারণ— ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?’
এবং হাসান আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন সেই মোহন পটুয়া হিসেবে, তুলির ছোটোবড়ো আঁচড়ে যিনি আঁকতে থাকেন জীবনের জলছবি। ক্যানভাস ভরে উঠতে থাকে অসংখ্য মানুষে। জঙ্গল কেটে বসতি গড়া কঠিন মানুষ, অস্ত্র হাতে অমানুষের জান কবচ করা লড়াকু মানুষ, খিদেয় কোঁ কোঁ করা দুর্বল মানুষ, ইন্দ্রিয়ের কাছে পরাজিত ঊনমানুষ এবং সংকল্পের আগুনে সমস্ত বাধাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া অজেয় মানুষ।
হাসানের গল্পপাঠ পুনঃপুনঃ আত্মআবিষ্কারের এক অডিসির মতো। তাঁর কলম থেকে অমোঘ সত্যের মতো বেরিয়ে আসা শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা বিদ্যুৎতরঙ্গের মতো ঝাঁকি দেয় আমাদের। প্রবল সে ঝাঁকুনিতে আমাদের রক্তে জোয়ার ওঠে, সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বেজে চলে তীব্র এক বৃংহতি। সেই কবে হাসান লিখেছিলেন ‘শকুন’ নামে একটি গল্প। অথচ পাশাপাশি মরে পড়ে থাকা শকুন ও মানবশিশুর সেই রোমহর্ষক ছবিটি এখনও মুছে ফেলতে পারিনি স্মৃতি থেকে— ‘ন্যাড়া বেলতলা থেকে একটু দূরে প্রায় সকলের চোখের সামনেই গতরাতের শকুনটা মরে পড়ে আছে। মরার আগে সে কিছু গলা মাংস বমি করেছে। কত বড় লাগছে তাকে। ঠোঁটের পাশ দিয়ে খড়ের টুকরো বেরিয়ে আছে। ডানা ঝামড়ে, চিত হয়ে, পা দুটো উপরের দিকে গুটিয়ে সে পড়ে আছে। দলে দলে আরও শকুন নামছে তার পাশেই। কিন্তু শকুন শকুনের মাংস খায় না। মরা শকুনটার পাশে পড়ে রযেছে অর্ধস্ফূট একটি মানুষের শিশু। তারই লোভে আসছে শকুনের দল। চিৎকার করতে করতে। উন্মত্তের মতো।’
অজস্র দৃষ্টান্ত দিতে পারি হাসানের গল্প থেকে। বস্তুত হাসানের প্রতিটি গল্প তার সমগ্রতা নিয়েই উদ্ধৃতিযোগ্য। মনে পড়ছে ‘আমৃত্যু আজীবন’-এ সাঁতলা বাতাসের উন্মত্ততা, ঘন কালো মেঘ আর ভরদুপুরের দানবীয় খিদের সেই অংশটুকু— ‘যে সুর্মারঙের মেঘবাহিনী উঠে আসছিল, তারা এখন আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। করমালি শুনতে পেল গর্জন গড়িয়ে বেড়াচ্ছে শানের মেঝেতে পিপের মতো।
এভাবে অজস্র দৃষ্টান্ত দিতে পারি হাসানের গল্প থেকে। বস্তুত হাসানের প্রতিটি গল্প তার সমগ্রতা নিয়েই উদ্ধৃতিযোগ্য। মনে পড়ছে ‘আমৃত্যু আজীবন’-এ সাঁতলা বাতাসের উন্মত্ততা, ঘন কালো মেঘ আর ভরদুপুরের দানবীয় খিদের সেই অংশটুকু— ‘যে সুর্মারঙের মেঘবাহিনী উঠে আসছিল, তারা এখন আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। করমালি শুনতে পেল গর্জন গড়িয়ে বেড়াচ্ছে শানের মেঝেতে পিপের মতো। দেখল কালো মেঘ ধোঁয়াটে হয়ে টগবগ করে ফুটছে। এই ব্যাপারে অগুনতি বর্ষাকাল এবং সহচর দৃশ্যপটগুলো— অর্থাৎ সাঁতলা বাতাসের ঝড়ো উন্মত্ততা, অতি বলশালী কৃষ্ণকায় মেঘ, পৃথিবীর মতো পুরনো বিল এবং গাব ভেজানো পানির মতো কালো অতল জলরাশি, হাঁসেরা, বাড়ন্ত লতাপাতা আর দ্বিপ্রহরের দানবীয় খিদে— এইসব তার পিঙ্গল চোখের তারায় নেচে উঠল।’ এবং ‘জীবন ঘষে আগুন’-এর অতিকায় সেই ঐরাবতের কথা— ‘রাজহস্তী পিছনের পা দুটি টেনে টেনে চলে। এই ভূভাগ এখন দিকহীন থ্যালানে একটি পাত্রের মতো— মাঝখানে ঢালু আর ঢেউখেলানো— যার কিনারায় অস্পষ্ট গ্রামরেখা, কখনো কখনো ছিন্ন— সেখানে ধোঁয়াটে দৃষ্টিহীনতা। এই পাত্র তপ্ত, তাতানো কাচের মতো ঠুনকো হালকা— কারণ মাইলের পর মাইল কোনো ছায়ার ভার নেই— সজলতার দেখা নেই। তাই জঙ্গলে, চিৎকার কাঁপে কাঁসার পাত্রের মতো। রাজহস্তী হারিয়ে যেতে থাকে, তার পিঠের উপর যারা ছিল তারাও।’ মনে পড়ে ‘সাক্ষাৎকার’ গল্পে সূর্যাস্তের স্বর্ণাভা মাখা সেই প্রকৃতির বর্ণনা— ‘তার চোখে ফুটে উঠেছিল তন্ময় কল্পনা; বাঁদিকে চওড়া নদী, সেখানে সূর্যের প্রতিবিম্ব ডুবে যাচ্ছে খানিকটা স্রোত সিঁদুরের তো হিঙ্গুল, স্রোত পেরিয়ে বালির চড়া, ধূসর হতে হতে আস্তে মিলিয়ে যায়; লোকটার ডানদিকে বিরাট মাঠ, মাঠ উঁচু-নিচু, মধ্যে মধ্যে টিলা আছে। এতক্ষণ লাল রঙ মাখানো ছিল, এখন মিলিয়ে যাচ্ছে।’ এবং ‘মা মেয়ের সংসার’-এ হৃদয়ের তন্ত্রীতে কান্নার ঝংকার তোলা সেই উচ্চারণগুলো— ‘মা মেয়ের খুব কাছে এগিয়ে এসে তার বিরাট গর্ভে হাত রেখে আঁধার ফুঁড়ে একদৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার সমস্ত পৃথিবী মেয়ের মুখে দেখতে পায়-কী বিষন্ন মাটি এই পৃথিবীর, আহা, মাটির কী বিষণ্ন রং, মাটিতে কী চমৎকার চোখ, জোড়া-জোড়া, ভাসা-ভাসা, কী অসংখ্য নদী-নালা, কী নিঃশব্দে হাঁটে তারা, কী ধীরে কাটে মাটি। মা এইবার বলে, আর কোনোদিন দেখতি পাব না মা তোকে। কী গজব, কী গর্কি আসতিছে আমি জানি। তুই কোনদিকে যাবি, আমি কোনদিকি যাবো, আমরা জানিনে মা। কেউ জানে না। এই নদীতি, আঁধারে, সমুদ্দুরে, জোঙ্গলে মিশে যাব, জানবো না আমার এমন একটা মেয়ে ছিল।’
আমাদের সাহিত্যভুবনের অমূল রত্ন হাসানের মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো। মুক্তিযুদ্ধের গল্প অনেকই লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু হাসান যেভাবে নির্মোহ এক দ্রষ্টার মতো মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তার তুলনা খুব বেশি নেই। কীভাবে ভুলি ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পের অনামা সেই মানুষটিকে যিনি ভূতগ্রস্তের মতো বিরামহীন কোদাল চালিয়ে মাটি থেকে তুলে আনছেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানের ‘পাঁজরের হাড়, হাতের অস্থি, হাঁটুর লম্বা নলি, শুকনো খটখটে পায়ের পাতা, একটি ছোট্ট হাত, দীর্ঘ চুলের রাশ, কোমল কণ্ঠাস্থি, ছোট ছোট পাঁজরের হাড়, প্রশস্ত পাঁজরের হাড়, একটি করোটি’? ভোলা কঠিন ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পের সেই গেরিলা যোদ্ধাদের, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও স্বদেশের স্বাধীনতার সংকল্প থেকে যারা পিছপা হয় না এক বিন্দু। অথবা ‘ফেরা’ গল্পের আলেফকে, যুদ্ধ থেকে ফিরে যে বাড়ির পেছনের ডোবার মধ্যে নিজের রাইফেলটা ফেলে দেয়, কারণ সে উপলব্ধি করেছে, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও ভাত-কাপড়ের নিরন্তর যে যুদ্ধ তার অবসান নাও ঘটতে পারে, কাজেই অস্ত্রটি পুনরায় প্রয়োজন হতে পারে। ভোলা যায় না ‘ঘরগেরস্থি’ গল্পের রামশরণকে, মুক্তিযুদ্ধের পর যে গ্রামে ফিরে আবিষ্কার করে, তার পরিস্থিতির একবিন্দুও পরিবর্তন হয়নি, কারণ পাকিস্তানি হানাদারেরা চলে গেলেও নতুন চেহারায় দখলদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তারই প্রতিবেশীরা।
‘আগুনপাখি’-র মতো অসাধারণ উপন্যাসের সৃষ্টি করলেও হাসান আজিজুল হকের কালোত্তীর্ণতা নির্ভর করবে মূলত তাঁর গল্পের ওপর। মানবজীবনের দ্বন্দ্বদীর্ণ বাস্তবতাকে শল্যচিকিৎসকের পারঙ্গমতায় ব্যবচ্ছেদ করেছেন তিনি। যা কিছু বাস্তব, যা ধ্রুব তাকেই ফেলেছেন নিজের প্রতিভার আতশকাচের নিচে, আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে।
‘আগুনপাখি’-র মতো অসাধারণ উপন্যাসের সৃষ্টি করলেও হাসান আজিজুল হকের কালোত্তীর্ণতা নির্ভর করবে মূলত তাঁর গল্পের ওপর। মানবজীবনের দ্বন্দ্বদীর্ণ বাস্তবতাকে শল্যচিকিৎসকের পারঙ্গমতায় ব্যবচ্ছেদ করেছেন তিনি। যা কিছু বাস্তব, যা ধ্রুব তাকেই ফেলেছেন নিজের প্রতিভার আতশকাচের নিচে, আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে। একটা ঘোরের মধ্যে আমরা তাঁর লেখা পড়ি এবং বিহ্বল চিত্তে অনুধাবনের চেষ্টা করি, কোথায় জন্ম নেয় এসব অলৌকিক শব্দমালা? কোত্থেকে উৎপন্ন হয় এই ভাব ও চেতনা? মানবমনের অন্ধিসন্ধিতে আলো ফেলে জীবন ও জগৎকে ছেনে দেখার এই অপূর্ব মুন্সীয়ানা? হাসানের লেখা পড়ি এবং আদিঅন্তহীন এক ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকি। রূপকথার কোনো ঐন্দ্রজালিকের মতো হাসান অবাধে প্রবেশ করেন আমাদের মনের মধ্যে, অস্তিত্বের গহন গভীর থেকে তুলে আনেন জীবনোপলব্ধির সারসত্য। হাসানের গল্প-সেটি যে গল্পই হোক না কেন— পড়তে গিয়ে প্রতিটি চরিত্রের জীবনাভূতি ও চেতনার নানা মাত্রার সঙ্গে পরিচিত হই। তার অন্তলীর্ন দ্বন্দ্ব-সংকট, স্বপ্ন ও সংগ্রাম, ভাব ও কল্পনার সঙ্গে অদ্ভুত এক সংযোগ ঘটে আমাদের। হাসানের গল্পপাঠের পর একধরনের এপিফ্যানির মতো ঘটে। যে অবস্থায় পাঠ শুরু করেছিলাম তার থেকে উজ্জ্বল এক উত্তরণ ঘটে, আমাদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার পালকে যুক্ত হয় নতুন পালক। এ কারণেই হাসান স্বতন্ত্র। বাংলা সাহিত্যে এমন একটি নিজস্ব ভুবন তিনি সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন যেখানে তিনি স্বয়ম্ভূ। এবং এ কারণেই হাসানকে পাঠ করতে হবে গভীর অভিনিবেশে। জীবনের সারসত্যকে আবিষ্কারের গভীর অনুসন্ধিৎসায়।
জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।