লালন সাঁইয়ের গানের পাঠ নিয়ে গায়ক তথা শিল্পীদের মধ্যে যেমন নানা মতভেদ রয়েছে তেমনি বিভিন্ন প্রকাশনেও বিভিন্ন পাঠ প্রত্যক্ষ করা যায়। শুধু তাই নয়, লালন সাঁইয়ের গানের প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তার কারণে অনেকের গান লালনের নামে প্রচার করার প্রবণতাও বহুদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে। এই নিবন্ধে সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা হলো।
এক
লালনপন্থী ফকির-সাধুদের সাধনার একটি অনিবার্য ও আবশ্যিক অঙ্গ হলো সাধুসঙ্গ। সাধুসঙ্গে লালনপন্থী সাধুগুরুরা একত্রিত সাঁইজির নির্দেশনাগুলো পালন করেন, গান করেন এবং গুরু-শিষ্যের মধ্যে সেবা গ্রহণ-প্রদান, গুরুকর্ম ইত্যাদি অনুষঙ্গ থাকে। প্রতিটি গুরুর বাড়িতে বাৎসরিক সাধুসঙ্গের আয়োজন হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিষ্যরাও গুরুর সম্মানে সাধুসঙ্গ করেন। গত প্রায় বিশ বছর ধরে সে রকম সাধুসঙ্গে ঘুরি ফিরি। সাধু-গুরুদের গান শুনি। সাধুরা বলেন— যে গানে চেতনার বোধন ঘটে না তা কোনো গান নয়, আর গানকে তাঁরা যেভাবে দেখেন, গেয়ে থাকেন, এমনকি গানের বিবেচনা করে থাকেন, তাতে আমার খুব মনে হয়— ‘গান’ শব্দটিকে সাধু-গুরুরা আসলে ‘জ্ঞানে’র আঞ্চলিক ও প্রতীকায়িত শব্দ বলেই মনে করেন। সাধু-গুরুদের ভাষ্য অনুযায়ী— গানের আরেক নাম ‘কালাম’, যেমন— লালন সাঁইজির গানকে তাঁরা বলেন— ‘সাঁইজির কালাম’ অর্থাৎ সাঁইজির দিকনির্দেশনা বলে থাকেন। সাধুসঙ্গে ঘুরে ফিরে বুঝি সাঁইজির যে দিকনির্দেশনায় যখনকার কথা বলা হয়েছে তখনই তা গাইতে হয়, যেমন— গোষ্ঠলীলার গানকে সকালেই গাইতে শুনেছি, আবার রাসলীলার গানকে কখনোই রাতে গাইতেও শুনি নি। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে যে মাটিতে লালন সাঁইজি শায়িত— সেখানকার শিশু থেকে সাধারণ পর্যন্ত সবাই একটা কথা জানে ও মানে— ‘রাতে গোষ্ঠ দিনে রাস যে গাই তার সর্বনাশ।’ এমন সুসঙ্গবদ্ধ নিয়মের কারণে সাঁইজির গানের বাণীকে যখন তখন গাইতে শোনা যায় না। তাই সাঁইজি দিকনির্দেশনামূলক বহু গানই সাধারণ শ্রোতাদের শ্রুতির অগোচরেই থেকে যায়, কেননা তা সময়ের বিধান মেনে সুনির্দিষ্ট সময়েই গীত হয় এবং তা সচারাচার সাধুসঙ্গেই গীত হয়। আজ আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না, আজ শুধু একটা বিষয়ের অবতারণা করছি, তা হলো সাধুসঙ্গে লালন সাঁইজির গানের পাঠ নিয়ে।
সাধু-গুরুদের গান তো মৌখিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশক্ষেত্রে তার লিখিত পাঠ পাওয়া ভার, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু গানের বাণীর লিখিত পাঠ পাওয়া যায়, এক্ষেত্রেও সমস্যা হয় একই গানের একাধিক লিখিত পাঠ পেলে, আবার লিখিত পাঠ প্রথমবার আবিষ্কৃত হবার পর আকষ্মিকভাবে তা হারিয়ে গেলে এবং কোনো হারানো লিখিত পাঠ নতুনভাবে পুনরায় আবিষ্কৃত হলে, কিংবা লিখিত পাঠের সঙ্গে সাধু-ভক্তদের গাওয়া বা শহুরে শিক্ষিত শিল্পীদের গাওয়া পাঠের মিল-অমিল নিয়েও কখনো কখনো বির্তক ওঠে।
বহু দিন ধরেই দেখে আসছি, সাধু-গুরুদের গানের পাঠ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষক, এমনকি শিল্পীদের মধ্যেও গবেষণা, বির্তক বা ঝগড়া-ঝাটির অন্ত নেই। অথচ, এই ঝগড়া-ঝাটি ও বির্তকের মধ্যে কখনোই প্রায় আলোচনা হতে দেখিনি— গবেষকদের মতো গানের বাণীর পাঠ নিয়ে বির্তক কিন্তু সাধু-গুরুদের সাধুসঙ্গেও নিত্যই হয়ে থাকে। যেখানে গুরুর উপস্থিতিতে শিষ্য গান পরিবেশন করেন সেখানে শিষ্যকে যেমন গানের উত্তর ব্যাখ্যা করতে হয় তেমনি গানের পাঠের ভিন্নতা নিয়েও জবাব দিতে হয়। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, খলিসাকুণ্ডু, মিরপুর এবং মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সাধুসঙ্গে গিয়ে লালন সাঁইজির বিভিন্ন গানের বাণীর পাঠ নিয়ে সাধু-গুরুদের বির্তক দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
দুই
আমাদের আলোচনায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে চুয়াডাঙ্গা জেলার বেলগাছি ইউনিয়নের অন্তর্গত ফরিদপুর গ্রামে রইসউদ্দিন শাহ’র বাড়িতে অনুষ্ঠিত একটি সাধুসঙ্গে কীভাবে লালন সাঁইজির একটি গানের পাঠ নিয়ে বির্তক উঠেছিল তা উপস্থাপন করছি।
সে সাধুসঙ্গে পূর্ণসেবার আগে গানের অনুষ্ঠানে শব্দগান বা ভাবগানের শিল্পী সানোয়ার হোসেন (২৭) তাঁর ভাঙা দোতরা বাজিয়ে বেশ সুরেলাকণ্ঠে লালন সাঁইজির যে গানটি গাইলেন, তা হলো—
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সব দেখি তা না না না ॥
যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কী জাত ছিলে
যাবার বেলায় কী জাত নিলে
এ-কথাটি বলো না ॥
ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল চামার-মুচি
একই জলে সব হয় শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না ॥
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রমও তো গেল না ॥
গানটি গাওয়া শেষ হতেই সাধুসঙ্গে উপস্থিত বাউলগুরু দিদার শাহ (৮৪) বললেন— “গান তো ভালই গাইলে, কিন্তু কথা হলো— ওইখানে কি বললেন— ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি’! এটা কি ঠিক?”
সানোয়ার উত্তর করলো— “আপনারা আমাদের গুরুজন। আমরা যেটা শুনেছি তাই গেয়েছি। ভুল হলে শুধরে দেবার জন্যে আপনাদের মুখ চেয়ে আছি।”
দিদার শাহ বললেন—“সত্য কাজে কেউ নয় রাজি’ এটা বলার অধিকার তোমার কে দিয়েছে! দুনিয়ায় কতজন সত্য কাজে রাজি আছে। আর তুমি বলছো ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি’। সাঁইজি দুনিয়ার লোককে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না, আমাদের জানার বাইরে বহু লোক আছে যারা সত্য কাজে রাজি আছে। আসলে কথাটা হবে ‘সত্য কাজে মন নয় রাজি’। আমার মন রাজি নেই, অনেকের মনও হয়তো রাজি নেই, তাই কথাটা হওয়া উচিত ‘সত্য কাজে মন নয় রাজি/সব দেখি তা না না না।’ আর একটা কথা বললে— ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়’। এ কথাটাও ঠিক নেই। কারণ, কি জানো?”
সানোয়ার মন্ত্রমুগ্ধের মতো গুরু দিদার শাহের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল— ‘কি গুরু?’
বাউলগুরু দিদার শাহ বললেন—“ধর্মের ক্ষতি গোপনে করলেও হয় প্রকাশ্যে করলেও হয়। রোজা রেখে গোপনে ডুব দিয়ে পানি খেলে কি রোজা ভাঙে না মনে করছো! তাই ওই কথাটা বলা ঠিক না— ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়।’ আসলে, কথাটা হওয়া উচিত ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে জাতের কী ক্ষতি হয়।’ তাছাড়া, এই গানটাও তো জাতের গান।”
লালন সাঁইজির গানের প্রচলিত পাঠের সঙ্গে দিদার শাহের বলা পাঠের এই অমিল নিয়ে আমি পরবর্তীতে আরেক সাধুসঙ্গে কুষ্টিয়ার ঘোড়ামারা-ভেড়ামার গ্রামের রওশন ফকিরের সাথে আলাপ করি। রওশন ফকির (৫৪) বলেন—“দিদার শাহ প্রবীণ সাধু-গুরু তাঁর কথাকে আমরা অমান্য করতে পারি না। তবে, কথা আছে, সাঁইজির বাণীর কথাবস্তুর অন্য অর্থও আমাদের ভেবে দেখতে হয়, এই গানের বাণীতে বলা ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি’ কথাটাকে যদি আমার দেহবস্তুর দিকে তাকিয়ে বিবেচনা করি তাহলে তো কথাটা ঠিক আছে— আমার দেহের কোনো কিছুই অর্থাৎ রিপুর বিষয়গুলো কেউই তো সত্য কাজে রাজি নেই, সব সময় তারা তা না না না করে ফিরছে। তাদেরকে রাজি করানোর জন্যই সাঁইজির এই হুঁশিয়ারি ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি।”
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের ১৩-১৪ তারিখ পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ লালনমেলা সমিতি আয়োজিত লালনমেলাতে যোগ দিয়ে সাধু-ফকির বিশারদ পণ্ডিত শক্তিনাথ ঝা’র সঙ্গে আলোচনার সূত্রে জানতে পারি— উক্ত গানটি গোপাল গীতাবলী-র প্রথম খণ্ডে ৩৯ নং গান হিসেবে মুদ্রিত হয়েছিল। শক্তিনাথ ঝা যা তাঁর লালন সাঁই-এর গান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।১ উল্লেখ্য, কলিকাতার ইউনাইটেড প্রিন্টিং ওয়ার্কস্ থেকে ১৩১২ বঙ্গাব্দে মুদ্রিত গোপাল গীতাবলী ১ম খণ্ডের একটি অনুলিপি পরে আমরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হই।
সম্প্রতি অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী বাংলাদেশের পাঠক সমাবেশ থেকে রাজকুমার জোয়ার্দ্দার ও রাসবিহারী জোয়ারদার সংকলিত গোঁসাই রামগোপাল ওরফে গোঁসাই গোপালের গানের দুটি খণ্ডের ফটোসংকলন গোঁসাই গোপালের মরমি পদাবলি নামে প্রকাশ করেছেন। উপর্যুক্ত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কুষ্টিয়ার ‘নিম্বসার প্রেস’ হইতে আজিম উদ্দিন বিশ্বাস কর্ত্তৃক মুদ্রিত এবং শ্রীরাসবিহারী জোয়ারদার কর্ত্তৃক সংকলিত ও প্রকাশিত সাধক গোঁসাই রামগোপালের রচিত সাধন ও দেহতত্ত্ব সংগ্রহ গোপাল গীতাবলীর দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯ সংখ্যক পৃষ্ঠায় ২৯ সংখ্যক গান হিসেবে ‘জাত গেল জাত গেল বলে’ গানটি অধীন গোপালের ভণিতায় মুদ্রিত হয়েছে। তবে, বাউল সমাজ ও প্রচারমাধ্যমে প্রচলিত গানটি পাঠ থেকে গানটির বাণীতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়, গোপাল গীতাবলী-তে মুদ্রিত পাঠ নিম্নরূপ:
জাত গেল, জাত হেল বলে হ’ল মজার কারখানা।
সত্য কথায় কেউ রাজি নয় সব দেখি তানা নানা॥
১। আসার সময় কি জাত ছিলে, এখন তুমি কি জাত হ’লে,
যাবার সময় কি জাত নিলে, তাই আমারে ব’ল না॥
২। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি, দেখ একদিনেতে সবাই শুচি
ভাব দেখে শুনে হয় না রুচি, যম ত তোমায় ছাড়বে না॥
৩। গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
বল তাতে কি তার জাত বৃদ্ধি হয়।
অধীন গোপাল বলে জাত কারে কয়
ঐ ভ্রম আমার গেল না॥২
এমন সুস্পষ্ট প্রমাণ মুদ্রণের পরও সম্পাদক আবুল আহসান চৌধুরী গোঁসাই গোপালের মরমি পদাবলি গ্রন্থের “নিবেদন” ও “ভূমিকা”র কোথাও গোঁসাই গোপালের এই গানটি কবে থেকে লালন সাঁইয়ের ভণিতা পরিবেশন শুরু হয় তার ইতিহাস সম্পর্কে যেমন কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি তেমনি এই গানটি নতুনভাবে মূল রচয়িতা গোপালের ভণিতায় গাওয়ার বিষয়েও কোনো মন্তব্য বা মত প্রকাশ করেননি। এক্ষেত্রে গবেষকদের সমান্তরালে লালনপন্থীদের সাধুসঙ্গে গানের প্রামাণ্য পাঠের আলোচনাকে সত্যিই ব্যতিক্রমী ও সাহসী উদ্যোগ বলে চিহ্নিত করা যায়।
তিন
আরেকটি ঘটনার বর্ণনা শুনতে পাই ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে ইউনুস শাহ’র সাধুসঙ্গে বসে আব্দুল করিম শাহ’র মুখে। তিনি বলেন— “সকলেই যখন সাধুগুরু বৈষ্ণব আছেন এখানে, সবাই মহাজ্ঞানী, আমি আপনাদের কাছে তৃণ, তৃণও নই, জ্ঞানের দিক দিয়ে আপনারা আমার জ্ঞানের ভা-ার, সাধুগুরু এই যে আমার ভাই আছেন— আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ আছেন— সাঁইজির একটা কালাম নিয়ে কথা বলবো— আমি সেদিন কবিরাজ মনোরঞ্জন বাবুর ওখানে বর্তমান আছি। কিন্তু আড়মুখে আরজ আলী আর নজরুল ওরা দুই ভাই খুব নামকরা বড় গায়ক, ওরা গান করতে গিয়ে বেলায়েত-নবুয়ত গান আরম্ভ করেছে। আসরে এইকথাটা মুখ দিয়ে বলে ফেলে দিয়েছে যে, কালামটা হলো—
নবীজীর মর্ম জানা ও দীনকানা
তোর ভাগ্যে জোটে না
আছে আল্লা নবী আদম ছবি
একই তিনজনা ॥
কোথায় আল্লাহ কোথায় নবী
কোথায় সে ফাতেমা বিবি
একবার ভেবে দেখলি না ॥
রাসুল বিবির কাছে দেনা হল
মোহর আনায় হয় দেনা ॥
যে খোদেজা সেই তো খোদা
আকৃতি নাম রাখলেন জুদা
এই কারণেই মোহাম্মদা
বিবির কাছে হয় দেনা ॥
এই কথা যখনই বলেছে আসরে উপস্থিত মাওলানারা বলেছে— ‘যে খোদেজা সেই খোদা’ প্রমাণ দেখাও, খোদেজা তো হজরত মোহাম্মদের বউ। সে খোদা হয় কেমন করে দেখাও।’ এই বাধা বেঁধে গেছে ভাই, সে বিশাল কা-। এই বলে দুই গায়ক ভাইকেই তারা বন্দি করে ফেলেছে। এরপর আরজ-নজরুল বলেছে যে, আমাদের একজন ওস্তাদ আছে— কবিরাজ মনোরঞ্জন বাবু, তাঁকে আনলে এইকথার জবাব হবে। সহি জবাব আপনারা পাবেন। এর ভেতরে কবিরাজ বাবু আমি বসে কথাবার্তা বলতেছি। এমন সময় একজন লোক এসে বললো যে, ‘কবিরাজ বাবুর বাড়ি কি এটা?’
মনোরঞ্জন বাবু বলল— আমি কবিরাজ।
লোকটা বলল— ‘আরজ আলী আর নজরুল কি আপনার ছাত্র?’
কবিরাজ বাবু— ‘ছাত্র নয়, তো পরিচয়টা দেয়।’
‘ও আচ্ছা।’
‘তা কি ঘটনা?’
তো এই এই কথা। আপনি না গেলে তাদের ছাড়া হবে না। তাদের উপযুক্ত শাস্তি হবে।
কবিরাজ বাবু বলল— ‘করিম, আড়ে গরু তো খোয়াড়ে বন্দি হয়ে গেছে। আমি না গেলে ওদের তো রক্ষা নাই।’
তারপর আমরা গেলাম। ওখানে গিয়ে কবিরাজ বাবু বললো— ‘এ গো আমার দুটো আড়ে গরু আপনারা না কি খোয়াড়ে বন্দি করে রেখেছেন।’
‘আপনি না কি উনাদের ওস্তাদ?’
‘ওস্তাদ নয়, তো পরিচয় দেয়।’
‘ওরা বলেছে— যে খোদেজা সেই তো খোদা— তা প্রমাণ তো দেখাবে, খোদেজা রাসুল্লাহর বিবি। প্রথম বিবি সে খোদা হয় কি করে।’
কবিরাজ বাবু বলল— ‘দেখেন লালন সাঁইজি এমন কোনো কথা বলেন নি, যার কোনো প্রমাণ নেই, তবে ওরা খুব ভুল বলে নি, বলবার মধ্যে একটু ব্যতিক্রম হয়েছে, এই আরকি— আসলে, ‘যে খোদেজা সেই তো খোদা’ হবে না, হবে—
যে খোদে ইজা সেই তো খোদা
আকৃতি নাম রাখলেন জুদা
এই কারণেই মোহাম্মদা
বিবির কাছে হয় দেনা ॥
চৌদ্দ পোয়া চৌদ্দ ভাগে
তিন বিবি হয় কলেমার আগে
এগারো জন দাস্য ভাবে
লালন করে তার উপাসনা ॥
তখন সবাই বলল— এইটা হতে পারে। এইবার ঠিক আছে।”৩
এই পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দিয়েই আব্দুল করিম শাহ ক্ষান্ত হন না, তিনি সাধুসঙ্গের নিয়মানুযায়ী এবার উপস্থিত সাধুগুরুদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখেন এইভাবে— “এখন ‘খোদে ইজা’ শব্দটার অর্থ কি আপনারা একটু বলেন তো দেখি। আপনারা সাধুগুরুরা আছেন, আমি তো এ কথার কোনো বেড় পাচ্ছি না, আপনারা একটু বলেন?” এরপর সাধুগুরুরা নিজেদের দীনতা প্রকাশ করলে করিম শাহ নিজেই গানের অর্থটি ভেঙে বলেন।
বাংলাদেশের সাধুসঙ্গে প্রতিনিয়তই গানের বাণীর এমন পাঠ-পাঠান্তর হয়ে থাকে, আর নিশ্চিতভাবেই হয়ে থাকে মুখে মুখেই, তাই প্রায় প্রতি সাধুসঙ্গেই এক একটি গান নতুন নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হয়। এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ খুঁজে ফিরবো। আজ এটুকুই।
তথ্যনির্দেশ —————— ১. শক্তিনাথ ঝা (সম্পাদিত), লালন সাঁই-এর গান, কলিকাতা : কবিতাপাক্ষিক, ২০০৫, পৃ. ২১৭ ২. আবুল আহসান চৌধুরী (সম্পাদিত), গোঁসাই গোপালের মরমি পদাবলি, ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ২০২০, পৃ. ১০০ ৩. আরজ আলী বয়াতী জানান— ঘটনাটি সত্য এবং এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মাগুরা জেলার মাগরো গ্রামে লুৎফর চেয়ারম্যানের বাড়িতে।
সাইমন জাকারিয়ার জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে। তিনি একজন বাংলাদেশি লোক সংস্কৃতি গবেষক এবং নাট্যকার যিনি বাংলা একাডেমির ফোকলোর উপবিভাগের সহপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। লোকাচার বিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।