‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো, তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়’— এই কথাগুলো একদিন গানের সুরে গেঁথে গেল আর উড়তে থাকল বাংলাদেশের হাওয়ায় হাওয়ায়। অনেক বেশি কাছাকাছি চলে যাবার পর অনেকে ভাবতে লাগল, প্রেমিকাই বুঝি ঘুড়ি, আর এটা পুরোদস্তুর এক প্রেমেরই গান। অনেকেই এই গানকে তাদের প্রেমিকা হারানোর শোকের প্রতিষেধক হিসেবে এগিয়ে রাখল প্লে লিস্টের শুরুর দিকে। অথচ এই গানটি প্রেমের গান নয়। তাহলে?
সেটা দুই হাজার চার সালের কথা। আমাদের একদল স্বপ্নবাজ তরুণের একসাথে মিশে যাবার দিন। সেসময় বলতে গেলে আমাদের চাল-চুলা কিছুই নেই। আমাদের প্রায় সকলেই বয়সে তরুণ। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে এসেছি কেউ, কারো কারো পড়ালেখা তখনও শেষ হয়নি, কেউ আবার ছিল এরকম যে, অ্যাকাডেমিক পড়ালেখার ধার ধারে নাই। কিন্তু সকলেই ছিল লেখালেখিতে একেকজন পাকা মুনশি। দারুণ লেখার হাত ছিল সবার। সবাই বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল শুধুই শিক্ষানবিস হিসেবে। এদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছিল যে দুই চারজন, তাদের মধ্যে সোমেশ্বর অলি ছিল অন্যতম। সে একদিন লিখে আনল এক গান।
‘ময়লা টিশার্ট ছেঁড়া জুতো,
ক’দিন আগেই ছিল মনেরই মতো,
দিন বদলের টানাপড়েনে শখের ঘুড়ি নাটাই সুতো,
ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো,
তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়।’
অলি প্রথমে একটা খসড়া সুরে এটা গুনগুন করত। আমি সেটা নিয়ে বসলাম। ভেঙেচুরে নতুন সুরে এসে গেল গান। সেই গান গলা ফাটিয়ে আমরা গাইতে শুরু করলাম শাহবাগ মোড়ে। জাদুঘরের সামনে। সেই অন্তর, জাহিদ, রাব্বানী, রাশেদ, লাবু, সৌখিন, রঞ্জু, গাজী, চন্দন, ইস্রাফিল, কাব্য, মিল্লাত, শামীম, এসব নামের মিছিল অনেক লম্বা। এই তরুণেরা গলা মিলিয়ে নিত সেদিন সেই দুই হাজার চার সালের দিকে।
দিন কেটে যায়। সকলেই ব্যস্ত। অনেকের সাথেই আমাদের অনেকের দেখা নেই। ততদিনে আমি গীতিকার হিসেবে মোটামুটি ব্যস্ত। টানাপড়েনের দিন শেষ হয়েছে আমাদের। সোমেশ্বর অলি আর আমি থাকতাম কাছাকাছি। আমি তখন নিজের একটা অ্যালবামের প্রস্তুতি নিচ্ছি। মিক্সড অ্যালবাম। আমার সুরে। গাইবে অনেকেই। প্রথমেই খসড়া গানটা রেকর্ড হলো। গাইলাম আমিই। জিতুর স্টুডিওতে। কিশোরের মিউজিকে। কীবোর্ডে ছিলেন মীর মাসুম। ভায়োলিনে সুনীল’দা। গিটারে জিতু। কিশোর গাইল কোরাস লাইনের নেপথ্যেও। তারপর অন্যান্য গানের প্রস্তুতি।
একদিন গানের অডিও নিয়ে আমি অলি আর শোয়েব মিলে গেলাম ‘রেডিও আমার’-এ। আরজে রাজুর কাছে। সে অডিও নিয়ে রেখে দিল তার কাছে। জানাল রাত এগারোটায় প্লে হবে। হয়ে গেল! রাজুর হাত ধরে বেজে উঠল প্রথমবার— ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো, তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়।
সেই শুরু। তারপর সিদ্ধান্ত হলো মিক্সড অ্যালবাম নয়। আমার প্রথম অ্যালবাম হবে একক। যে অ্যালবামে সব গান আমি গাইব। অ্যালবামের কাজ শুরু হলো। সবকটা গান লিখল সোমেশ্বর অলি। সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে একটা গান লিখে এনেছিল ইশতিয়াক আহমেদ। সেই গানটি এই অ্যালবামে রাখলাম। বাকি গানগুলোর অধিকাংশ মিউজিক করলেন সুমন কল্যাণ। দুইটা গানের মিউজিকে ছিলেন পারভেজ জুয়েল। ইমরান মাহমুদুল, সাব্বির ও এসকে সমীর করলেন একটি করে গানের মিউজিক। তিনটা গানের সুর করেছিলেন ফিরোজ কবীর ডলার। অ্যালবাম প্রকাশ পায় ডেডলাইনের ব্যানারে দুই হাজার এগারো সালের জুলাই মাসে।
মারজুক রাসেল অভিনিত ‘ঘুড়ি’ গানের প্রথম মিউজিক ভিডিও
তারপর সেই গানের মিউজিক ভিডিও। ঘুড়ির মূল মডেল ছিলেন কবি মারজুক রাসেল। ভিডিও নির্মাণে ছিলেন হিজল জোবায়ের। ক্যামেরায় শোয়েব। এডিট করলেন মাকসুদ আহমেদ। প্রথমবারের মতো গানটি প্রচারিত হয় বৈশাখী টেলিভিশনে। প্রযোজক ছিলেন নূর হোসেন হীরা। এছাড়া জাবেদ ইকবাল তপু এই গান খুব ভালোবেসে প্রচার করতে লাগলেন মাছরাঙা টেলিভিশনে; তার প্রোগ্রামে। ধীরে ধীরে এই গান ছড়িয়ে পড়ল দেশ-বিদেশের অনেক জায়গায়।
একজন শিল্পীর বেঁচে থাকার জন্য একটা সেরকম গানই দরকার, যে গান মানুষের খুব আপন হয়ে যায়। এই যে আমি আজকের যতখানি লুৎফর হাসান, সম্ভবত এটা ওই ‘ঘুড়ি’ গানের মাধ্যমেই। আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা আমার। আরও কৃতজ্ঞতা জানাই এই গানের গীতিকার সোমেশ্বর অলির প্রতিও। আর বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে আমার ঋণের শেষ নাই। শেষ হবে না।
‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো’ গান গেয়ে গায়ক হিসেবে পরিচিত। তিনি গান লেখেন, সুর করেন এবং নিয়মিত গেয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে নিজের ও অন্যের জন্য লিখেছেন পাঁচ শতাধিক গান। লিখছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস মিলিয়ে প্রায় সব শাখাতেই। কাজ করছেন একটা অডিও ভিজুয়াল প্রতিষ্ঠানে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে।