ফোন আধ ডজনবার বেজে যাওয়ার পর এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর জবাব দিল: ‘বন্ড বলছি।’ তারপর অভিবাদন পর্ব। ‘এখানে বেশ ঠান্ডা পড়ছে’, কথাটা বললেন মিসৌরির সবচেয়ে বিখ্যাত বাসিন্দা। তিনি আর কেউ নন রাস্কিন বন্ড। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জগদ্বিখ্যাত চরিত্র জেমস বন্ডের মতো যিনি শুরুতে নিজের পরিচয়টা ‘বন্ড’ দিয়ে দিতে ভালোবাসেন। ‘মিন্ট’ নামের এক অনলাইন পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে রাস্কিন বন্ডকে ফোনটা করেছিলেন সোমক ঘোষাল। ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। তখন রাস্কিন বন্ডের বয়স ৮৫ বছর চলছে। ওই বয়সে প্রকাশিত হয় তার নতুন গল্পের বই ‘রডোডেনড্রনস ইন দ্য মিস্ট’। যেটাতে তিনি হিমালয়ের জন্য তার পুরনো ভালোবাসার কথা স্মরণ করেছেন। যেখানে তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। রাস্কিন বন্ড সাক্ষাৎকারটি দেন ফোনে। জনপ্রিয় এই লেখক কথা বলেন তার দৈনন্দিন জীবন, পাঠাভ্যাস এবং চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসার বিষয়ে। সাক্ষাৎকারটি শ্রী-র জন্য অনুবাদ করেছেন উপল বড়ুয়া।
কীভাবে এখানে আপনার বসবাসের বছরগুলোতে হিমালয় পরিবর্তিত হয়েছে?
আচমকা বা নাটকীয় নয়, ক্রমাগত পরিবর্তন অনুভব করি, কারণ দীর্ঘদিন ধরে আমি এখানে বাস করছি। ৫০ বছর আগে যখন আমি প্রথম মিসৌরিতে এসেছিলাম, তখন এখানে ছিল কেবল তিনটি কার এবং দু’টি ট্যাক্সি। এখন এখানে শত শত যানবাহন ও ট্র্যাফিক জ্যাম। অন্যথা, পাহাড় পরিবর্তন হয় না, কেবল শহরের আয়তন বাড়ে এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
পাহাড়ে বসবাস কি লেখালেখির ক্যারিয়ারে বিশেষভাবে সহায়তা করে?
এখানকার হাওয়া নিঃসন্দেহে পরিষ্কার স্বাস্থ্যকর। যদিও, আমার অনুমান, একজন লেখকের যেকোনো জায়গায় লেখার সক্ষমতা থাকা উচিত। বস্তিতে থাকুক বা ট্রেনে, কিংবা সাগরে হোক বা পাহাড়চূড়ায়। তবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা সবসময় ভালো।
আপনি লন্ডন এবং দিল্লিতেও জীবনযাপন করেছেন। বড়ো শহর কি আপনার লেখালেখিতে ভিন্নতা আনতে পেরেছিল?
লন্ডনে থাকাকালীন অল্পকিছু লেখা লিখছিলাম, দিল্লিতে তেমন কিছুই লেখা হয়নি। সব গল্পই আসলে মানুষকে নিয়ে। ছোটো শহরে মানুষদের আপনি খুব ভালোভাবে জানতে পারবেন। এখানে বাস স্টপের নিচে একটা মার্কেট আছে। এখানে যারা সওদাপাতি করে আমি তাদের সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানি। বড়ো শহরে, অন্তরঙ্গভাবে আপনি তাদের কিছুই জানতে পারবেন না।
এই সময়ে লেখকদের পেশা অনেক পাল্টেও গেছে।
হ্যাঁ, এখনকার বিষয়টা খুব বেশি মার্কেটিংয়ের। আপনি যদি সুপরিচিত হোন, তবে ছোটোখাটো সেলিব্রেটি হয়ে উঠবেন। কিন্তু ৩০-৪০ বছর আগে, আপনি যদি সফল হতে চাইতেন, নিজের নামে পরিচিত হলে চলত, রাস্তাঘাটে স্বীকৃতির দরকার পড়ত না। একজন লেখক মোটামুটি বেনামেও থাকতে পারেন, যা হওয়া উচিতও। তাঁকে অবশ্যই বিশ্বের দিকে তাকাতে হবে এবং বিশ্ব তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে না। আমার মনে আছে, ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে একবার লন্ডনের এক স্টুডিওতে গ্রাহাম গ্রিনকে না চিনেও তাঁর পাশে বসেছিলাম। তিনি চলে যাওয়ার পর যতক্ষণ না কেউ বলে দেয় উনি গ্রাহাম গ্রিন, ততক্ষণ আমি তাকে চিনতে পারিনি।
আপনি সব সময় জোরালোভাবে আপনার জীবনকে এঁকে চলেন, এমনকি আপনার ফিকশনেও।
আমার জন্য এটা হচ্ছে লেখালেখির খুবই সহজাত পন্থা। যখন নিজেকে গল্পের ভেতরে দেখি তখন আমি শান্তি পাই। হোক তা সত্য ঘটনা অবলম্বনে বা পুরোপুরি কাল্পনিক কিংবা এই দুইয়ের সংমিশ্রণ। আমি গল্পের অংশ হতে ভালোবাসি, কী ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করি। এটা উভয়ক্ষেত্রে শক্তিমত্তার ও দুর্বলতার। কিছু সমালোচকের বিশ্বাস, লেখককে তার বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত। আমি তা করি না, আমি জড়িয়ে যাই।
কবে থেকে বাচ্চাদের জন্য লেখালেখি শুরু করেছিলেন?
প্রথমদিকে আমার কয়েকটি গল্প (যদিও ওসব ছিল প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের জন্য) স্কুল পাঠক বা পাঠ্যপুস্তকের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছিল। তবে তরুণ পাঠকদের জন্য ভেবেচিন্তে লেখালেখি শুরু করি আমার বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি। তা-ও এক দুর্ঘটনায়। ইংল্যান্ডে এক প্রকাশককে আমার একটা দীর্ঘ গল্প পাঠিয়েছিলাম। তিনি জানান, প্রাপ্তবয়স্কদের উপন্যাস হিসেবে এটা খুবই ছোটো। তবে আমি যদি এটা সামান্য পরিবর্তন করি, তবে তা বাচ্চাদের বই হিসেবে চলে যাবে। এবং এভাবেই, ‘অ্যাংরি রিভার (১৯৭২)’, বাচ্চাদের জন্য আমার উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
বাচ্চাদের জন্য ভালো লেখার মূলমন্ত্র কী?
আপনার প্রয়োজন হবে একটি ভালো গল্পের এবং তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কারণ শিশুরা খুব ধৈর্যশীল পাঠক নয়। গল্পে অবশ্যই শক্তিশালী চরিত্র থাকতে হবে এবং তা ধর্মীয় বা নীতি উপদেশ দানকারী হবে না। বাচ্চারা আমার লেখালেখি নিয়ে সমালোচনা করে। একবার এক ছোট্ট মেয়ে আমাকে বলেছিল, ‘আমরা কী তোমার গল্পগুলোতে আরেকটু অ্যাকশন পেতে পারি না?’ আরেকজন বলেছিল, ‘আমি তোমার ভৌতিক গল্প পছন্দ করি। তবে তা আরেকটু ভীতিজনক করতে পারো না তুমি?’
শুরুতেই কি আপনি বুঝতে পারেন লেখাটা ছোটোগল্প হতে যাচ্ছে নাকি উপন্যাস?
লিখতে বসার আগে, আমি সাধারণত তা মাথায় রাখি। আমি লেখাটাকে প্রায় মুভির মতো ভিজ্যুয়ালাইজ করি। যদি আমার মনে লেখাটার কোনো পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে তা মাঝপথেই ব্যর্থ হতে বসে।
মুভির প্রতি আপনার সবসময় একটা অনুরাগ রয়েছে।
হ্যাঁ, বিশেষ করে বালক বয়সে। এখন খুব বেশি মুভি দেখা হয় না। তবে আমি পুরনো সাদাকালো মুভি পছন্দ করি। টিসিএম নামে একটা চ্যানেল খুব ভালো সিনেমা দেখাত এবং একদিন চ্যানেলটি হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। আমি যখন সার্ভিস প্রোভাইডারদের অভিযোগ করলাম, তারা জানাল, এই পুরো অঞ্চলের আমিই একমাত্র লোক যে চ্যানেলটি দেখত!
আপনার প্রিয় মুভি কী কী?
আমি থ্রিলার পছন্দ করি— হামফ্রি বোগার্ত, জেমস ক্যাগনি— এবং ভালো গল্পের ভিত্তিতে নির্মিত কাসাব্লাঙ্কা এবং গুডবাই, মি. চিপস ধরনের মুভি পছন্দ।
আজকাল আপনি কী পড়ছেন?
আমি সাধারণত অবহেলিত লেখকদের পুনঃআবিষ্কারে বা পুরনো প্রিয় বইপত্র পড়তে ভালোবাসি। সম্প্রতি, ফরাসি বিপ্লবের ওপরে লেখা অ্যাডগার ওয়ালেসের জীবনীগ্রন্থ এবং প্যাট্রিসিয়া হাইস্মিথের উপন্যাস পড়ছি।
তরুণ লেখকদের জন্য কোনো উপদেশ?
মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, পাঠকদের চেয়ে অনেক বেশি লেখক রয়েছেন এখন। আমি কখনও কাউকে লেখালেখির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করি না। তবে আমি তাদের প্রেরণা দিই, ভাষার দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য। যদি তারা ভালো পাঠক হয় তবে তারা ভালো লেখক হয়ে উঠবে। আমি তাদের আরও বলতে চাই, তাড়াহুড়া বা রাতারাতি বিখ্যাত ও ভাগ্যের আশা না করতে। কারণ লেখালেখিতে তা কদাচিৎ আসে।
উপল বড়ুয়া। জন্ম: ১৯ ডিসেম্বর। রামু, কক্সবাজার। প্রকাশিত বই: কানা রাজার সুড়ঙ্গ (কবিতা), উইডের তালে তালে কয়েকজন সন্ধ্যা (কবিতা), তুমুল সাইকেডেলিক দুপুরে (কবিতা) ও ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল (গল্প)।