রবিবার, নভেম্বর ২৪

শিবলী মোকতাদির-এর দশটি কবিতা

0

বুদ্ধিজীবী

দুই হাত আকাশের দিকে তুলে, উত্তপ্ত বালির মরীচিকা সম্বল ক’রে
নিষ্ফল হবার একশোভাগ রিস্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি।
নিচে আন্ডারলাইন বরাবর অনেকটা অক্ষত,
চরিত্রে চর্চিত, অনাবিল— গোত্রভুক্ত কাঁটাতার ঘেঁসে চলে গেছে
প্রায় নির্জন একটি রাস্তা।

কেউ নেই। এখন, এই মুহূর্তে; কিছু অভিমানী বায়ু ছাড়া।
দুর্ভিক্ষের হাহাকারের মতো
কেবল সারিসারি লাল-সবুজের রাজনৈতিক চেয়ারগুলো পড়ে আছে।

সূর্যের আলো অতীব ক্রমপ্রসারিত।
অনেক বেদনার পর সুখের মানদণ্ড নিয়ে
একটু আগে এই আলোটুকু মাড়িয়ে চলে গেলেন একজন মৎসজীবী
খানিকটা ফারাক রেখে—
তাকে অনুসরণ করলো একজন অতিথি বিড়াল।

কৌতূহলের কাহারবায় নেচে নেচে এইসব দেখি আমি।
দেখি— একটি জিপ। বায়ুকে জব্দ করে ছুটে আসছে
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাঁক ঘুরেই
চালকবেশী কাস্টমস অফিসার আমাকে বললেন— উঠে পড়ুন।
আসলে হয় কী, এই অ্যাটমোসফেয়ারে সীমান্ত থাকার প্রয়োজন আছে।
সীমান্ত আসলে খারাপ কিছু নয়!

কানকথা

আসো এই পথে—
তালসহ সংগীতে, বিচূর্ণ পাপড়িতে ভর করে।
প্রতিনিধি প্রশ্ন তুললে
সূক্ষ্ম হাসিতে ইন্দ্রিয় ভরে দেবে

মোহর আর মোতি নিয়ে বসে আছি আমি
বাহিরে ভীষণ হাসি, হায়েনার মতো হট্টগোল।
বুঝি— থেকে থেকে চালাকি চমকায়

ওহে ভারপ্রাপ্ত, সিপাহসালার,
দেখো তো, মরুযাত্রীদল উট ফেলে
হাতি ও ঘোড়া নিয়ে পালালো কোথায়?

খোয়াজখিজির

বৃক্ষ আর বৃদ্ধ সমৃদ্ধ এক গ্রাম;
এখানে যা কিছু ঘটে সব জোড়ায় জোড়ায়।
যেমন : মানুষ আছে বলেই থাকে মানবিকতা।
মনকে কেন্দ্র করে ঘোরে মোহাব্বত।
সাধুর সঙ্গে তত্ত্বফত্ত্ব এড়িয়ে জাপটে ধরে সম্মাননা।
জাবেদা খাতার মতো কেমন প্রসন্ন আর পোয়েটিক।

গ্রামের একবারে সর্বোদক্ষিণে যিনি থাকেন তিনি নির্বাচিত নির্বাণ।
পাগড়ির আড়ালে লুকানো তার মাথা, মেহেদির মর্মে দাড়িতে উজ্জ্বলতা।
হেঁটে গেলে দাপটে বাতাস কেঁপে ওঠে,
মিথমুক্ত হাসি তার ভয়ানক সাংকেতিক।

তো— আষাঢ়ের শেষ রবিবার মরা এক নদীর দু’পাড়ে দুই পা রেখে
তিনি বললেন— মাটির আস্তরণের মধ্যে পানির শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি;
এই গ্রাম নদীর গর্ভে চলে যাবে।

শুনে, অকার্যকর মানুষও হয়ে পড়ে সক্রিয়, অভিব্যক্তিময়।
হতাশার ভূগোলে কিছুটা হয় অভিষিক্ত।

এভাবে দিন যায়। মাস এবং বছর। সালের পরে আসে নতুন শতাব্দী।
বালিয়াড়ি বদল হয়ে ঘন সবুজের আবরণে বক্র-রৈখিক হয় পুরো গ্রাম।
বাতিল, জীর্ণ ইদারার মতো
একসময় আদেশকারী হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ, নিঃশ্চুপ
অপমানের আলকাতরা গায়ে গলে ফর্সা মানুষ রূপান্তরিত হয় আংরাতে।

এরও বহুদিন পর বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো
পিঠেহাঁড়ি গাছের ডালে পাওয়া যায় ঝুলন্ত তার লাশ।

আসলে শূন্যকে যতই অনুবাদ করা হোক
ফলাফল তার কখনোই অঙ্কে উঠে আসে না।

আমি তুমি প্রশ্ন করি, গ্রামশুদ্ধ লোক উত্তরে অধীর
হয়তো কোনো কারণে নাখোশ ছিলেন পানির ফেরেশতা খোয়াজখিজির!

বায়স

বসো— বসে বসে আঁকো এই ছবি
যা-কিছু কলঙ্ক একপাশে রেখে
দ্যাখো— ব্যক্তির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে কবি।

একে তো খুন, তুমি আর নাই-বা দিলে
ভুলেও লিখো না লাল কথাটি
অশান্ত ক্যানভাস সবুজেই খাও গিলে।

জরিপে নামো, সখা হে গ্রামীণ প্রকারে
এদিকে হলুদ, বেগুনি ও বদমাশ
তালার অভাবে আটকে রেখেছো ঘরে।

জলের-ই জনক, গাংচিল নামায় বৃষ্টিধারা
জলকাক শোক আর শূন্য রঙে
কবির মধ্যে গজিয়ে দিচ্ছে কাব্যের শত চারা।

পাহাড় পর্ব

যে পাহাড় দূরে— নেত্রজুড়ে,
সেখানে রোজ যেতে চাই আমি।

ধূসরে অ্যালার্জি, বলেছো বিজ্ঞাপনে।
ভাবি— এতটুকু ঘোড়া
কী করে বইবে আমায়?

উপসংহারে লিখেছো কথা দামি
পাহাড়ে ধস, ডাকাতি ডাক,
উপরন্তু চারিদিকে সর্বহারা।

সারল্য

বিশ্বহরিগাছা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আলী ইদ্রিস আকন্দ
বলতে গেলে বিনা নোটিশে, কারো কোনো প্রবঞ্চনা ছাড়াই
হাসতে হাসতে খুন করার মতো অলীক ক্ষমতা নিয়ে
একদিন হুট করে হারিয়ে গেলেন।
উধাও হলেন স্বর্ণচাঁপার গন্ধসলিলে।
সেই যে গেলেন, বাড়ি ফেরার এক্কেবারে নামগন্ধটি নেই
অনেক তল্লাশি, স্তরে-স্তরে খোঁজ কিন্তু সবকিছু বিফল।

শোকের ধারাবাহিকতায় কেবল বিবিধ সান্ত¦নাই মেলে।
বিশ্বনিয়মের সেই সূত্রকে আঁকড়ে ধরে
পরিবার শান্ত হয় নীরবে নিবিড়ে।

এদিকে ক্রমশ বয়স বাড়ে পুরো গ্রামের।
বাটপার থেকে ব্যাপারী হয়ে যায় কেউ
কেবল একজন— সেই শিক্ষকের ছোট ছেলে ইয়াছিন
অসমীকরণ নিয়ে চিরসত্যের সম্ভারে
চেয়ে থাকে দিনরাত মহাকাশের দিকে।
প্রতিদিন মাগরিব ও এশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে
বিলের ওপারে পিঠেহাঁড়ি গাছের
পাহাড়প্রমাণ মনঃসংকলনের পাশে এসে দাঁড়ায়।
পিতা হারানোর বেদনারা
ফুল হয়ে টুপটাপ ঝড়ে পড়ে আর মাটি ভিজে যায়।

কথিত আছে— মানুষ ঠিক যে সময়ে, যে স্থান থেকে হারিয়ে যায়
সেই সময়, স্থানেই নাকি সে ফিরে আসে।

নাছোরবান্দা ইয়াসিনের বিশ্বাস
পিতা তার কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়াবে একদিন;
এখানে, এই পিঠেহাঁড়ি গাছের অন্তরালে
পৃথিবীর ভাষায় ধ্যাননিবিড় ডায়ভারসিটির মধ্যেই ডেকে উঠবে—
কাছে আয় বাপ! আমার উত্তরাধিকার।

মুদ্রা

যে-মুদ্রা নিক্ষেপে সমাধান সংক্ষেপে আমাকে হারাতে এসে
বাঁধনে দিয়েছো জ্বালা প্রাপ্তিতে এইবেলা অধীনে নিয়েছো হেসে
আমাকে তোমার সাথে বোধের বাড়ানো জাতে করো কী নিবিড় ঘৃণা
রচনার কৌশলে অবসাদে ভরা-দলে আমি বাঁচি তুমিহীনা।

অথচ নির্ধারক পথে ঘুরে প্রতারক নাটকে দিয়েছো আলো
জাদুর প্রবাহ যেন ক্ষণে তাকে চম্কানো মন বলে, এত কালো?
শাসিত নায়ক তার বিগত জটিলতার কঠিন ক্ষমতা আঁকা
বোঝা দায়, মুশকিল চোখ তার অনাবিল ভাবের অভাবে বাঁকা।

এমন মুদ্রা আমি জড় ও জগতগামী করেছি অন্বেষণ
ফল-বিনা তার কাছে উঁচু-নিচু চোরাগাছে বিচারে বেঁধেছি মন
তুমি জয়ী ভাবো এই ভাবে বাঁকা সকলেই শুরু হোক নির্ভয়ে—
যেন, প্রকাশ করিতে না-পারি ইঙ্গিতে এ-খেলার পরাজয়ে।

ইমেজারি

নৌকা চলে, বৃষ্টি পড়ে, চারিদিকে অন্ধকার। এবার সত্যিটা শোনা যাক।

ভাবনার ভরকেন্দ্র থেকে ফিরে আসে বিন্দা মাঝি
দখল নেয় আত্মচৈতন্যে।
ধনুকের মতো বাঁকা পিঠ মুহূর্তে হয়ে ওঠে টানটান।

নৌকা চলে, বৃষ্টি পড়ে, চারিদিকে অন্ধকার। এবার সত্যিটা শোনা যাক।

বলার তো কিছু নেই বাবুমশাই!
আমি দেখলাম— জ্যান্ত বাঘের কোলে রহিম বাদশাহ
চিৎকার দিয়ে তাজেলকে মারতে গিয়ে পর্দা ছিঁড়ে গেলো।

নৌকা চলে, বৃষ্টি পড়ে, চারিদিকে অন্ধকার। এবার সত্যিটা শোনা যাক।

পুলিশ এসে আটকালো। বলে— ওরে বুদ্ধু! এসব তো সিনেমা!
কে শোনে কার কথা! জেলের ঘানি টানতে হলো
বিশ্বাস করেন, সেদিন আমি জ্যান্ত বাঘ-ই দেখেছিলাম।

নৌকা থামে, বৃষ্টি থামে, চারিদিকে আলোকচ্ছটা। এবার সত্যিটা শোনা যাক।

শূন্যের মধ্যে অনেক ইমেজারি তৈরি হয়।
বৃদ্ধিবাদের আগেই তারা অজান্তে মিশে যায়।

গুরুচণ্ডালী

উঠোনসমেত একচালা ঘর, দুটো বাতাবি লেবু আর ডুমুরের গাছ।
শীতের দুপুরে কুয়োতলায় আয়েশ করে ঘুমুচ্ছে প্রিয় বিড়াল।
গোটাকয় মেছোবক সূর্যকে সাক্ষী রেখে মাথার ওপরে উড়ছে।
এক হাতে ছিপ অন্য হাতে মাছ, বাবা ফিরছে বাড়িতে।

জয়নালের ছেলে আয়নাল ছবি আঁকতে ভালোবাসে।
খুব যত্ন করে, সময় নিয়ে উপরের দৃশ্যকাব্য
মায়ায় মুড়িয়ে স্থান দিয়েছে তার একান্ত ক্যানভাসে।

মা ফিরতেই দৌড়ে গিয়ে দেখালো,
বাবা বললো— আমাদের মতো আধুনিক হয়েছে।
মা বললো— বিড়াল, মাছ, বক একসাথে থাকায়
গুরুচণ্ডালী দোষে দুষিত এ চিত্র।

বাবা অশিক্ষিত, গানপাগল মানুষ, বোকাকান্ত।
মা মিতব্যয়ী, দূরের স্কুলে গণিতের দিদিমণি।

পরকীয়া

ড. নিতাই চন্দ্র সেন। মনোবিজ্ঞানী। মননশীল ও মহৎ মানুষ।
ইদানিং সবকিছু বাদ দিয়ে পার্কে এসে বসে থাকে।
একা একা সারাক্ষণ।
মানুষ দেখলেই বিড়বিড় করে, বিরক্ত হয়।

এখন পড়ন্ত বিকেল।
ভাব বুঝে, মচমচে গরম জিলাপি নিয়ে
সামনে এসে বললাম— ডিভোর্সটা আটকানো গেলো না দাদা?
বৌদির তো দোষের কিছু দেখি না!
বরং বাড়তি গুণ— উনি ভয়ানক সুন্দরী।

শুনে, সেভেনটি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে আমার মুখের দিকে ঈষৎ তাকিয়ে
স্পষ্ট করে বললেন— এটা মিথ্যে নয়,
তবে এই গুণের প্রধান দোষটা হলো কি জানেন— বড্ড বেশি টানে।
নির্ধারিত সীমার অধীক ব্লাড সুগারের মতো।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, প্রাবন্ধিক। জন্ম : ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশ। প্রকাশিত গ্রন্থ : ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ), নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ), সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ), রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য), ব্যবহারিক বিস্ময় (কাব্যগ্রন্থ), দুর্ভিক্ষের রাতে (কাব্যগ্রন্থ), কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দকথা (প্রবন্ধগ্রন্থ), লুপ্ত সভ্যতার দিকে (কাব্যগ্রন্থ)

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।