শনিবার, নভেম্বর ২৩

সত্যজিৎ রায়ের উল্লেখযোগ্য তিনটি বই

0

Sattajit Ray_Head Strip_Sree


Jokhon Choto Chilam_Sreeযখন ছোট ছিলাম


বাংলা ভাষার অন্যতম প্রতিভা এবং বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে ভাবলে প্রথমে কী মাথায় আসে? গম্ভীর মুখভঙ্গির এক সুপুরুষ ভারি কন্ঠস্বরে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। আমার সামনে অন্তত এটাই ভেসে ওঠে। স্বাভাবিক নিয়মে এই মানুষটারও একটা শৈশব ছিল। সবার ছোটবেলার গল্পই বেশ মজার। কিন্তু বিখ্যাত রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ছেলেটির ছেলেবেলা আসলে কেমন ছিল? সে যদি হয় স্বয়ং সত্যজিৎ রায়, তাহলে তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ‘যখন ছোট ছিলাম’ সত্যজিৎ রায়েরই ছোটবেলার গল্প।

এখানে সত্যজিৎ তাঁর শৈশব-কৈশরের চিত্র এঁকেছেন। তাঁর ছোট্টকালের বিষ্ময়, আগ্রহ, কৌতুক ও প্রাণবন্ত হাওয়ার দোল লেগেছে বইয়ে। এখানে কেবল তাঁর শৈশব-কৈশরের স্মৃতিই উঠে আসেনি, সেসময়কার কলকাতার পরিবেশ পরিচিতিও বেশ স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে।

এই বইয়ে সত্যজিৎ তাঁর ছেলেবেলার কথা বেশ উপভোগ্য করে বর্ণনা করেছেন। সাথে যোগ হয়েছে কিছু দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র আর তাঁর নিজের হাতে আঁকা কিছু ছবি। এখানে মূলত তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে স্কুল জীবনের শেষ পর্যন্ত, তিনি ও তাঁর মা কোথায় কোথায় থেকেছেন, কোথায় কোথায় ঘুরেছেন সেসবই বলা হয়েছে। অনেকগুলো ছবির মধ্যে একটা ছবি দেখে আমি রীতিমতো শিহরিত হয়েছি। সেটা হলো, একটা পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে লেখা কয়েকটি লাইন৷ রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। এটা অস্বাভাবিক কিছুও না। কারণ তিঁনি নিজেই বিখ্যাত রায় পরিবারের সদস্য। সত্যজিতের শৈশবের অনেকটা কেটেছে তাঁর দাদার প্রতিষ্ঠা করা গড়পারের বাড়ি ও মামাবড়ি ভবানীপুরে। এই বইয়ের দুটি ভাগ। প্রথমভাগে বর্ণনা করেছেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগের ঘটনাবলী আর দ্বিতীয় ভাগে বর্ণনা করেছেন বালীগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে তাঁর ছাত্রজীবনের কথা। স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সাথে ঘটে যাওয়া নানা স্মৃতি নির্দ্বিধায় শেয়ার করেছেন। স্কুলজীবনের বর্ণনায় বেশ মজা পেয়েছিলাম হেডমাস্টারমশাইদের মজার মজার নামকরণের উল্লেখে, যেমন নগেনবাবুর নাম ‘নগা’, যোগেশবাবুর নাম ‘গাঁজা’ ইত্যাদি। বলে রাখা ভালো, সত্যজিৎ তার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফাকেও, তাঁর স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে এই কবির বেশকিছু বর্ণনা৷

বিভিন্ন সময়ে ফেলুদা, তোপসে কিংবা প্রফেসর শঙ্কুর মতো দারুণ কিছু চরিত্রকে আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়া সত্যজিৎ এই বইয়ের মাধ্যমে এবার আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এক অচেনা সত্যজিৎকে।


একেই বলে শুটিং


সিনেমা বানানো আমার কাছে এক বিষ্ময়। হঠাৎ করেই সিনেমা নিয়ে এক-আধটু পড়াশোনা করার ইচ্ছা জাগে। সে ইচ্ছা মেটাতেই এই বই পড়া৷ বইটি শুরু করার আগে ভেবেছিলাম— বইয়ে হয়তো শুটিংয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোন এঙ্গেল থেকে কি করলে কি হয়, এইসব। কিন্তু শুরু করার পরে বুঝলাম এটা তারচেয়েও ইন্টারেস্টিং কিছু। এখানে সত্যজিৎ রায় তাঁর শুটিংয়ের ফাঁকে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা শেয়ার করেছেন। শুটিংয়ের কাজ কখনো স্টুডিও’র মাঝেই হয় আবার অনেক সময় কিছু দৃশ্য নেয়ার জন্য বাইরেও যেতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় শুটিং করতে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারই কিছু কিছু এই বইয়ে বলা আছে।

সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন বিখ্যাত চলচ্চিত্র— যেমন, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘অপুর সংসার’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’সহ আরও কিছু ফিল্মে বিশেষ বিশেষ শটগুলো নেওয়া হয়েছিল। কুকুরকে কীভাবে পোষ মানিয়ে বা বাঘকে বাগে এনে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে। সত্যজিৎের নিজের কল্পনাকে চিত্রনাট্যে নিয়ে সেই জায়গা খুঁজে বের করা হয়েছে। লোকের ভিড়, আলোর সল্পতা-আধিক্যসহ আরও নানা সমস্যার সমাধান বের করা হয়েছে, তারই অভিজ্ঞতার সংকলন ‘একেই বলে শুটিং’।

ছবি বানাতে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করেছেন সত্যজিৎ। মাঝেমাঝে টাকার অভাবে ছবি বানানো স্থগিত করতে হয়েছে। এমনকি স্থগিত হওয়া কাজ একবছর পর করার নজিরও আছে৷ যেমন, একবার শুটিং ছিল এক কাশবনে৷ দুইদিন সবকিছু ভালোভাবেই হলো। তৃতীয় দিন শুটিং করতে গিয়ে দেখেন কাশবন উধাও! তারপর? অগত্যা পরবর্তী শরতে সেই শ্যুট শেষ করতে হয়েছিল। তবুও তিনি সিনেমা বানিয়েছেন এবং এতোদিন পরেও মানুষ সেগুলি দেখছেন।

সবমিলিয়ে দারুণ এক বই। যাতে এডভেঞ্চার, ভ্রমণ, আত্মজীবনীমূলক স্বাদও পাওয়া যায়। মাত্র আশি পৃষ্ঠার একটি বই। পড়ার পর মনে হবে, এই, শেষ হয়ে গেল যে! এটা কোনো কথা!


Bishoy-Cholochchitro-Sree

বিষয় চলচ্চিত্র


‘বিষয় চলচ্চিত্র’ সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। বইয়ের চৌদ্দটি প্রবন্ধে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশল, চলচ্চিত্রের ইতিহাস, ছবি বানানোর অভিজ্ঞতা এবং তাঁর নির্মিত ছবির বেশকিছু সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।

‘বিষয় চলচ্চিত্র’ এর সূচনা নির্বাক চলচ্চিত্রের ইতিহাস দিয়ে। সেখান থেকে সবাক চলচ্চিত্রে উত্তরণের কাহিনি, দুটির তুলনামূলক বিশ্লেষণ, এই দুই মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন সিনেমার সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে সবিস্তার আলোচনায় বইটার প্রথমভাগ ঋদ্ধ। খুব গভীরে গিয়ে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত সিনেমার উত্থান-পতনকে, জার্মান ও পূর্ব ইউরোপিয় সিনেমা সম্বন্ধে নিজের মুগ্ধতাকেও। বাকিটুকু জুড়ে আছে লেখকের নিজের চলচ্চিত্র সাধনার কথা, নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা, চলচ্চিত্র-সম্পাদনা, ক্যামেরার ব্যবহার, আলো ও রঙের ব্যবহার নিয়ে নিজস্ব মতামত এবং তাঁর চলচ্চিত্র সম্বন্ধে প্রচলিত সমালোচনার অকপট প্রত্যুত্তর।

‘চলচ্চিত্রের ভাষা : সেকাল ও একাল’ প্রবন্ধে চলচ্চিত্রের সেই সাইলেন্ট বা নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে বিশ্ব চলচ্চিত্রের গঠন এবং এতে পরিচালকের ভূমিকাসহ আরও নানাদিক তুলে ধরেছেন। ‘সোভিয়েত চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় তুলে ধরেছেন তৎকালীন সময় পর্যন্ত তাদের চলচ্চিত্রের গুণগত দিক, এর নির্মাতাদের অবদান ও বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব। তাঁর ছোটবেলার ছবি দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ‘অতীতের বাংলা ছবি’ প্রবন্ধে। এছাড়াও, ‘ওরফে ইন্দুরন ঠাকুরণ’, ‘দুই চরিত্র’, ‘বিনোদদা’ প্রবন্ধত্রয়ে সত্যজিৎ বলেছেন নানা অভিজ্ঞতার কথা৷ ‘চারুলতা’ ও ‘অপুর সংসার’ প্রবন্ধে তিনি মূলত তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।

বইটি পড়তে গিয়ে প্রথম দিকে কাটখোট্টা টাইপ মনে হতে পারে। তবে কিছুক্ষণ পড়লে এই ভাবটা আর থাকে না। যাঁরা চলচ্চিত্র ভালোবাসেন বা আমার মতো সত্যজিৎ রায়ের গুণগ্রাহী বা যারা সিনেমা নিয়ে কাজ করেন, তাদের এই বইটি পড়া উচিত বলে আমার মনে হয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।