শুক্রবার, নভেম্বর ২২

সে শুধুই দাঁড়িয়ে ছিল : আহসান ইকবাল

0

যে লোকটি সাত-সকালে ভাপ ওঠার মতো ভাদ্রের মিহি বৃষ্টির ধোঁয়ায় মোড়া, নামমাত্র পিচের খড়খড়ে পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে, জিহ্বা সামলে, সারা রাত আত্মীয়ের জন্য হাসপাতাল ডিউটি থেকে ফিরতে ফিরতে তাকে থানার বাম পাশের কুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল, তাঁর যেন মনে হয়, এই নারীকে তিনি এর আগে কোথায় যেন দেখেছেন। খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু তিনি ঠিক চিনতে পারেন না। যেমনটা আমাদের সবারই হয়—এইখানে, এইভাবে যেন তার সাথে আমাদের আবারো দেখা হয়েছে, হয়েছিল বা ভবিষ্যতেও হবে আর আমরা একইভাবে ভাবব, ভেবেছি অথবা ভেবেছিলাম—খুব চেনা চেনা লাগছে, খুব চেনা কিন্তু মনে করতে পারছি না!

জেলখানার সামনে একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কুকুরকে আড়মোড়া ভাঙতে দেখে বিরক্ত হন এই ভেবে যে, আল্লার দুনিয়ায় সব কিছু সৃষ্টির কারণ আছে, কিন্তু এই কুত্তা সৃষ্টির কারণটা তার কাছে অজ্ঞাত।

তিনি দেখছিলেন বেশ দূর থেকে; পুরোনো খেয়া ঘাটে যাবার ভাঙা ইটের রাস্তার সমন্তরালে এসে দুহাত তোলার ভঙ্গিতে যেখানে রাস্তা দুদিকে বেঁকে গেছে, বরফ কলের নোনা ধরা বিল্ডিংটা বাঁয়ে আর তার সামনের ব্রিটিশরাজের আমলে বানানো লাল ইটের লাশকাটা ঘরকে ডাইনে রেখে। ঠিক সেখান থেকে তিনি প্রথমে ডানে তাকিয়ে জেলখানার সামনে একটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কুকুরকে আড়মোড়া ভাঙতে দেখে বিরক্ত হন এই ভেবে যে, আল্লার দুনিয়ায় সব কিছু সৃষ্টির কারণ আছে, কিন্তু এই কুত্তা সৃষ্টির কারণটা তার কাছে অজ্ঞাত। কিছু না বুঝলে তিনি বিরক্ত হন, সেই সাথে তার ভেতর কেমন একটা উত্তেজনা তৈরি হতে থাকে যা তার শরীরের পক্ষে বেশ ক্ষতিকর। তাই, আল্লাহর অনেক নিয়ামত যা তার ব্রেন্টে (ব্রেনে) খেলে না, তেমন করে মিরাকল ভেবে উড়িয়ে দিতে গিয়ে যখন পারেন না তখন রিকশার ঝাঁকিতে জিহ্বায় কামড় খেয়ে তার মনে হয়, তরুণ বয়সে একশিরা হবার যে লাথি তিনি খেয়েছিলেন, সেটাও এর থেকে মোলায়েম ছিল আর তাই ভেবে তিনি রিকশাওলার মাকে ঠাস করে কি কি করবেন, কেমন করে করবেন তার বর্ণনা দিতে দিতে বিচি আর তার কামড়ের ব্যথা ভুলতে ৭০ বা ৭২ গজ দূরে দাঁড়ানো নারীটিকে জড়সড় অবস্থায় কুলগাছের নিচে দাঁড়ানো দেখতে পান। নারীটিকে তিনি আল্লাহর অশেষ নেয়ামতের ফল মনে করেন এবং এই দুনিয়ায় কারণ ছাড়া বা তাঁর ইশারা ছাড়া কিছুই ঘটে না বলে, ভেতরে ভেতরে খানিকটা উষ্ণতা অনুভব করেন। দেখবার পর থেকেই নরীটিকে তিনি অনেকক্ষণ ধরে চিনতে চেষ্টা করেন, পারেন না। তবু, খুব চেনা চেনা মনে হয় তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি। রিকশাওলার গাজার ঘোর তখনো কাটেনি বলে সে শুধু সামনে তাকিয়েই মাথা নিচু করে গরুর জোয়াল টানার জেদি ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। রিকশা আরোহী ক্রমশ নরীটির দিকে এগোতে এগোতে তাকে আপাদমস্তক ভালো করে বুঝতে, চিনে নিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখেন। খালি পা, কাঁদার একটা আস্তরণ শুকিয়ে দাগ পড়ে আছে, পায়ে কোনো স্যান্ডেল দেখা যায় না। হবে কোনো বেশ্যা টেশ্যা—শাড়ি পরার ধরণ অবশ্য তাকে একটু ধন্দে ফেলে। তিনি পেটের একফালি চর্বির ঊর্বর ভূমি দেখাবার জন্য শাড়ির যে প্যাঁচ খুঁজছিলেন বা চেনেন সেটা এই নারীর না থাকায় যেখানে স্তন থাকে সেখানে তাকিয়েও তিনি আশাহত হন। কতো আর বয়স হবে ২৭/২৮। কিন্তু, এই বয়সে যে গঠনের স্তনাভাষ পাবেন ভেবেছিলেন তার অভাব দেখে বেশ আশাহত হন।

এমন তো অহরহ হচ্ছে গরু বা মুরগী তুলতে গেছে ব্লাউজ ছাড়া, এলাকার পোলাপাইন সারা রাত ধরে খেতে নিয়ে মউজ-মাস্তি করে ফেলে রেখে গেছে; রাত-বিরাতে বাথরুম সারতে বেরিয়েছে, কয়েকজনে মিলে কাম সারছে সারা রাত ধরে বা হয়তো বরের ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে রাতে একজনের সাথে অভিসারে বের হয়ে আরও দুই তিন জনের ঘা-গুঁতা খাইছে আর বাড়ি ফেরার মুখ না থাকায় চলে আসছে হাসপাতালে

তবে তিনি কোনো প্রমাণ না পেয়ে নিশ্চিত হন এই শাড়ির নিচে কোনো ব্লাউজ-ব্রা নাই। কিন্তু এই কাকভোরে, এমন নির্জন কুল গাছের আবছায়ায় দাঁড়ানো এলো চুলের নারী তাকে কোনো একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে বাধা দেয়। চুলের ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তাতে নারীটিকে তার তখনো, খুব পরিচিত মনে হয়। ঠিক এভাবে কোথায় যেন আগেও দেখেছেন তিনি তাকে। একবার না, হয়তো অনেকবার। কিন্তু, ঠিক মেলাতে পারছেন না। তাহলে কি গত রাতে হাসপাতালে? ইমারজেন্সির সামনে বা হাসপাতালে ঢুকবার গেটে? কিন্তু, নারীটির ভেতর অসহায় বা উদ্ভ্রান্ত বা সাহায্যপ্রার্থিতার কোনো লক্ষণ তিনি খুঁজে পান না! মেয়েটিকে যদি হাসপাতালে রাতের কোনো একসময় দেখে থাকেন, তাহলে এই সকালে সে থানার পাশে কী করে? তাহলে কী কোনো রেপ কেস? তাঁর জিহ্ববার তলে সুড়সুড় করে জল জমা হতে থাকে। এমন তো অহরহ হচ্ছে গরু বা মুরগী তুলতে গেছে ব্লাউজ ছাড়া, এলাকার পোলাপাইন সারা রাত ধরে খেতে নিয়ে মউজ-মাস্তি করে ফেলে রেখে গেছে; রাত-বিরাতে বাথরুম সারতে বেরিয়েছে, কয়েকজনে মিলে কাম সারছে সারা রাত ধরে বা হয়তো বরের ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে রাতে একজনের সাথে অভিসারে বের হয়ে আরও দুই তিন জনের ঘা-গুঁতা খাইছে আর বাড়ি ফেরার মুখ না থাকায় চলে আসছে হাসপাতালে, থানায়—মাইয়া মানুষ তো এমনই হয়! আবার এমনও হতে পারে গ্রাম্য ক্যাচালে আহত কাউকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল, সকাল হতেই থানায় কেস করতে আসছে? নাকি পাড়ার (বেশ্যালয়) কোনো কেস! খালি পা, একপ্যাঁচের শাড়ি, এলোমেলো চুল তাকে বিভ্রান্ত করে। রিকশাটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে গেলে তিনি তার হা-মুখের মতো বিশাল কিন্তু রাতজাগা লালাশূন্য চোখে নারীটিকে ঝুঁকে পড়ে শেষবারের মতো বুঝে নিতে, ৩০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে যেতে চুলের ফাঁকে, সিঁথির মাঝে এক টুকরা লালের অস্তিত্ব আবিষ্কার না করতে পারলেও মনে মনে ‘মাগি’ বলে নিশ্চিত হয়ে যান। মাগি (বেশ্যা) না হলে কি আর এই কাকভোরে থানার কোনায় কুল গাছের নিচে, খালি পায়ে একপ্যাঁচে শাড়ি জড়িয়ে কোনো গৃহস্থ বাড়ির বউ-মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!

তার মনে হওয়াটা যেন ভোর-সকালে থানার পাশে বা কুল গাছের নিচে খালি পায়ে, শাড়ি পরা কোনো নারী দাঁড়ালেই বেশ্যা তাকে হতেই হয়—রাস্তায় তো বেশ্যারাই দাঁড়ায়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

আহসান ইকবাল ৯০ দশকের শুরুতে লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘সংবহন সার্কাস’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য পাতায়, সাহিত্য ম্যাগাজিন এবং লিটল ম্যাগাজিনে লিখে থাকেন। পেশায় একটি লোকাল মাল্টি-ন্যাশনাল অ্যাড এজেন্সির গ্রুপ ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।