সে অনেক আগের কথা। কত আগের কথা? প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগের! অত আগের কথা কি আমরা ভাবতে পারি? এখন তো দশ বছরেই সবকিছু পুরোনো হয়ে যায়। বদলে যায় ভাষা, বদলে যায় গেজেট, বদলে যায় সংগীত, বদলে যায় জীবন যাপনের যাবতীয় অনুষঙ্গ। মহাকালের আবর্তে আমরা ক্রমশই তলিয়ে যাই। এই মহানিমজ্জনের কালে কেউ যদি শোনায় আমাদের গুহাবাসী আদিপিতাদের কথা, যারা পাথর খুঁদে তৈরি করত অস্ত্র, কাঁচা মাংস আগুনে ঝলসে খেয়ে মেতে উঠত জীবনের উল্লাসে, সেই গল্প শোনার ধৈর্য এই প্রজন্মের হবে কি না জানি না, তবে মহাপুস্তকের পাতায় এই গল্পের জন্যে অবশ্যই একটা বিশেষ স্থান থাকা উচিত। সেই গল্পটাই শুনিয়েছেন আশান উজ জামান তার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘স্বরূপকথা’তে, বাংলা ভাষায় এমন লেখা, তাও আবার এত বড়ো পরিসরে আছে বলে আমার জানা নেই।
তিরিশ হাজার বছর আগের পৃথিবীর গল্প বলতে হলে প্রচুর প্রস্তুতি প্রয়োজন। তৈরি করতে হবে পৃথিবীর বুকে এক টুকরো নতুন পৃথিবী। কোথায় গেলে পাওয়া যাবে জলের সন্ধান, কোথায় মিলবে সাগরসোহাগী অন্তরীপ, দেবগাছ আর আলোপাতার মাঝখানে আছে ঘাসফুলের কোন বংশ, নিজের বসতি থেকে কতদূর গেলে বনমানুষদের আক্রমণের শঙ্কায় মনের তন্ত্রী বাজানো শুরু করবে বিপদের সংকেত
তিরিশ হাজার বছর আগের পৃথিবীর গল্প বলতে হলে প্রচুর প্রস্তুতি প্রয়োজন। তৈরি করতে হবে পৃথিবীর বুকে এক টুকরো নতুন পৃথিবী। কোথায় গেলে পাওয়া যাবে জলের সন্ধান, কোথায় মিলবে সাগরসোহাগী অন্তরীপ, দেবগাছ আর আলোপাতার মাঝখানে আছে ঘাসফুলের কোন বংশ, নিজের বসতি থেকে কতদূর গেলে বনমানুষদের আক্রমণের শঙ্কায় মনের তন্ত্রী বাজানো শুরু করবে বিপদের সংকেত—এমন অসংখ্য বিস্তারিত উপাদান দিয়ে একটা প্রতিবেশ তিনি তৈরি করেছেন নিপুণ হাতে। একজন লেখকের রিসোর্স হতে পারে কয়েকরকম। প্রচুর বই, অভিজ্ঞতা, এবং কল্পনা। ‘স্বরূপকথা’তে কল্পনার সুচারু প্রয়োগ বিস্ময় জাগায়। তার ভাষা এতটাই চিত্রময়, যে চোখের সামনে দৃশ্য ভেসে ওঠে। বইয়ের শেষে ভেবেছিলাম সহায়ক গ্রন্থের একটা বড়ো তালিকা থাকবে। সেটা না থাকাতে নিশ্চিত হওয়া যায় তার ধ্যান এবং নিমজ্জনের ব্যাপারে।
বইটিতে লেখকের মূল প্রচেষ্টা ছিল আদিম পৃথিবীর দিনকালকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা। বিশাল কলেবরের এই উপন্যাসটিতে তাই পাতার পর পাতা—অনেকসময় থেকে গেছে তেমন কোনো ঘটনা ছাড়াই। আপনি যদি লেখার আবহের সাথে ভালোভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেন, তাহলে আপনার এই জল-জঙ্গল, সাগর-অন্তরীপে ঘুরে বেড়াতে এবং নতুন কোনো শিকারের কৌশল উদ্ভাবন করতে, বিশ্রাম অথবা স্নানের জন্যে নতুন কোনো জায়গা খুঁজতে খারাপ লাগবে না। তারপরেও যদি আপনার কাছে গতি ধীর মনে হয়, সময়মত পেয়ে যাবেন নতুন উত্তেজনা।
উপন্যাসটিতে আমরা কাছাকাছি জায়গায় দুটি মানবপ্রজাতিকে দেখতে পাই। হোমো স্যাপিয়েন্স আর নিয়ানডারথাল। হোমো স্যাপিয়েন্স নারী হু-এর সাথে নিয়ানডারথাল নর অব-এর প্রণয়পর্ব থেকেই মূলত হোমো স্যাপিয়েন্স পাড়ার দৈনন্দিকতা বের হয়ে কাহিনি গতি পাওয়া শুরু করে। হু আর অব এর সন্তান মান-এর জন্মের পর থেকে কাহিনি জল-জঙ্গল চরিত বর্ণনের পাশাপাশি তুমুল গতিতে মানব মন আর আচরণকে অবলম্বন করে লতিয়ে ওঠে। অন্যদের চেয়ে আলাদা, জিজ্ঞাসু এবং কৌতূহলী মান এর জন্ম এবং বেড়ে ওঠার মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনের। এদিকে নিয়ানডারথাল পাড়ার ক্রমাগত মৃত্যু আর কমজোর হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার বেদনাদায়ক আখ্যান। তবে বইটিতে কোথাও হোমো স্যাপিয়েন্স অথবা নিয়ানডারথাল বলে আলাদাভাবে কিছু উল্লেখ করা নেই। এক প্রজাতির কাছে আরেক প্রজাতি হলো বনমানুষ। এটা পাঠকের মধ্যে কিছুটা সংশয় তৈরি করতে পারে। বইয়ের ফ্ল্যাপে অবশ্য ছোটো করে উল্লেখ আছে, তবে সেটা অনেকের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।
‘স্বরূপকথা’ পড়েছি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে, ধীরে ধীরে। এখন আবার ফিরে যাব শহুরে বাস্তবতায়। হাতে তুলে নেব কোনো ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, অথবা ম্যাজিক রিয়ালিজমের কৌশল দেখানো গল্প। নিজেও লিখতে বসব এরকম কিছুই। এখন আর লিখতে এমন কি কালি কলমও লাগে না।
পুরো বই জুড়ে যে দ্বান্দ্বিক অবস্থানটি রোমাঞ্চের আবহ যুগিয়ে গেছে তা হলো দলপতি নির্বাচন এবং নারীর দখল। পৃথিবীর আদিম অপরাধগুলি আজ নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে, তবে মূল কিন্তু ওই দুটোই। নারী আর ক্ষমতা। তবে কেন যেন মনে হয়েছে উপন্যাসের দলপতিরা একটু বেশিই সদয়। যেমন সর্দার আফা রাবাকে মারার সিদ্ধান্ত নিলে পারা তাকে নিষেধ করে। আবার বনমানুষের সাথে শুয়ে এসে কৃশকায় সন্তান জন্মদানের পরেও হু-কে হত্যা না করে আলাদা গুহায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। কিছুক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনের যুক্তিকে অতিমাত্রায় জটিল মনে হয়েছে সে সময়কার মানুষের তুলনায়। যেমন, হু-কে যখন দলপতি হিসেবে নির্বাচন করার প্রস্তাব তোলা হয়, তখন হু প্রত্যাখ্যান করে এই বলে, সে দলপতি হলে তার ছেলের প্রতি অন্যায়-অবিচারের বিচার করতে গিয়ে সে বেশি কঠোর হয়ে যাবে, তাই দলপতি হবে না।
কিছু কিছু জায়গায় শব্দচয়ন এবং বাক্যের ব্যবহার যথাযথ মনে হয়নি। যেমন, কয়েকজায়গায় ‘শিশু’ বোঝাতে ‘পিচ্চি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এক জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘খবর আছে’। উপন্যাসের প্রথম দিকে ‘বিয়ে’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও পরে সেটি বদলে ‘ঘরে তোলা’ ব্যবহৃত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন প্রয়োগটি সঠিক?
কিছু কিছু জায়গায় শব্দচয়ন এবং বাক্যের ব্যবহার যথাযথ মনে হয়নি। যেমন, কয়েকজায়গায় ‘শিশু’ বোঝাতে ‘পিচ্চি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এক জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘খবর আছে’। উপন্যাসের প্রথম দিকে ‘বিয়ে’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও পরে সেটি বদলে ‘ঘরে তোলা’ ব্যবহৃত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন প্রয়োগটি সঠিক? আমি যতদূর জানি বিয়ের প্রচলন আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। তাই ত্রিশ হাজার বছর আগের গল্পে বিয়ে শব্দটি থাকা সমীচীন নয়। বিশেষ করে যখন একটি নারী চরিত্র তার পুরুষটিকে বলে ‘মেয়ে বড়ো হচ্ছে, বিয়ে দিতে হবে’, তখন যেন আদিম আবহটা হুট করে কেটে যায়।
হোমো স্যাপিয়েন্স আর নিয়ানডারথালদের ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রাখা হয়েছে। নিয়ানডারথালদের ক্ষেত্রে সেটা যথাযথ ছিল, তবে হোমো স্যাপিয়েন্সদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে আরেকটু সরল হলে ভালো হতো। যেমন, কোনো এক জায়গায় কাউকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ‘তুমি ঠিক আছো তো? কোনো সমস্যা?’ এরকম খুব বেশি জায়গায় নেই অবশ্য।
‘স্বরূপকথা’ পড়েছি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে, ধীরে ধীরে। এখন আবার ফিরে যাব শহুরে বাস্তবতায়। হাতে তুলে নেব কোনো ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, অথবা ম্যাজিক রিয়ালিজমের কৌশল দেখানো গল্প। নিজেও লিখতে বসব এরকম কিছুই। এখন আর লিখতে এমন কি কালি কলমও লাগে না। ভার্চুয়াল অক্ষরে সাজাই শব্দদল। এই মধ্যবিত্ত আয়েশ এসেছে বহুদিনের ত্যাগ আর তিতিক্ষার ফলে। আমাদেরই পূর্বপিতারা কোনো একসময় গুহাচিত্রে হরিণ এঁকেছিলেন বলেই আমরা এখন পরাবাস্তবতা চর্চা করতে পারি। সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আশান উজ জামানকে ধন্যবাদ। বইয়ের শেষ লাইনে সমুদ্রের গর্জনের সাথে মানুষের ধ্বনি মিলিয়ে-মিশিয়ে যে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়, তা আমাদের জীবনচর্চায় রাখা উচিত।
‘গাছটার শিকড় ছেঁড়া। বাঁচবে তো?’
হাসান মাহবুবের জন্ম ১৯৮১ সালের ৭ই নভেম্বর। পদ্য দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও এখন কাজ করছেন গদ্য নিয়ে। গল্প এবং উপন্যাস লিখে থাকেন।