১.
হাট। দুই অক্ষরের এই শব্দটির মধ্যে আমি একটা ম্যাজিক খুঁজে পাই। ব্যাক্তিগতভাবে আমি হাট ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে হাটকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন আবর্তিত হয়ে আসছে আবহমান কাল জুড়ে। গড়ে উঠেছে একটা ‘হাটকেন্দ্রিক সংস্কৃতি’। যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজজীবনে লোকজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরপ্রান্তের মানুষ। গঞ্জ হাট ঘেরা জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার জন্ম আর বাল্য কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে উত্তরের ডুয়ার্স অঞ্চলের একটি সুবৃহৎ হাটের কোলে। মথুরার হাট। বহু বিচিত্র মানুষ, লোকজীবনের ছায়ায় ছায়ায় আমার নিবিড় হাটকেন্দ্রিক সেই যাপন আমার কাছে মহার্ঘ্য হয়েই থাকবে আমৃত্যু। আমি দেখেছি একটা হাটের ভেতর থরে থরে সাজানো থাকে কতরকমের সব হাট।
২.
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রচুর হাট আমি অন্তহীন ঘুরেছি। দেখেছি বিচিত্র সব চরিত্র।
চিলাপাতার হাটে প্রতি হাটবারে ঢোল-মাদল বাজাতে বাজাতে আসত কিন্ডাস এক্কা। সে শোনাত করম পূজার গান। জল্পেশ হাটে দেখেছিলাম খড়ম জোতদারকে; যিনি তার জোত জমির গল্প শোনাতেন। নিম্ন অসম রংপুর দিনাজপুরের হাটে প্রচুর লোকগানের শিল্পীর দেখা পেয়েছি। কালিগঞ্জের হাটে প্রথম শুনি বৃহত্তর রংপুরের বিখ্যাত একটি গান─
‘অংপুর হামার রঙ্গে ভরা রে
ও বন্ধুধন আইসেন হামার বাড়ি
ভোগ ধানের ভাত খোয়ামো
থাকেন দিনা চারি
বৈদ্যেশা বন্ধু রে’
বিচিত্র মানুষ, মানুষের জীবন যাপনের বৈচিত্র্য, লোকজীবন জড়ানো গান, মানুষের না ফুরোতে চাওয়া সব গল্প কুড়িয়ে পেয়েছি হাটগুলিতে।
৩.
হাট ছিল বস্তুত বিনিময়ের কেন্দ্র। বাণিজ্য কেন্দ্র। দশ বিশ গ্রাম গঞ্জের মানুষের দেখাসাক্ষাৎ, গল্প ও খবরাখবর বিনিময়ের উপযুক্ত স্থান। কবিরাজ, ফকির, মিসকিন আসতেন। গৌরীপুরের হাটে দেখেছি ভিখিরিদের সুর করে গাওয়া সব গান। কুপির আলোয় একবার ঢেঁকিশাক কিনেছিলাম ডুগডুগির হাটে। আদিবাসী নাচ-গানের পাশে যৌবনবর্ধক ওষুধ বিক্রি হতো। গোপনে যৌনরোগ থেকে মুক্তির আশায় সেখানে সমবেত হতেন নানান বয়সের পুরুষেরা।
রাজনীতির মানুষ, পুরোনো জোতদারের ক্যাম্প অফিস, গাড়িয়ালদের দই চিড়া খেয়ে ঘাড়ের গামছায় মুখ মোছা, রংপুরের খিলি পান, লণ্ঠনের আলোয় কথা বলতে থাকা মানুষদের উষ্ণতায় গমগম করে উঠত অনন্তের সব হাটগুলো।
৪.
কবেকার কোন এক হেমন্তের হাটে হেমকান্ত দেখে ফেলেছিলেন সেই জোড়া কৈতর। আর হাটে ঢুকে পড়া মেয়েরা তাদের শরীরে নাচ নিয়ে শুরু করেছিল গান─
‘আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে’
নাচের পর নাচ গানের পর গান চলে, চলতেই থাকে হেমন্ত জুড়ে। মাঠে মাঠে সোনার ধান। মানুষের ঘরবাড়ি থেকে দৈনন্দিন কথাবার্তা ভেসে। হিমে ভেজে খোলানের নিঃসঙ্গ আখা। দূরে কোথাও আগুন জ্বলে ওঠে। আগুন ঘিরে মানুষের ছায়া আবছায়া। আল ও আলি দিয়ে দৌড়ে পালায় হেমন্তের ছাইবর্ণ শৃগাল। রহস্যময় মনে হয়, মনে হতে থাকে দূরে কাছের গ্রামদেশ। মস্ত চাঁদ ওঠে। জোড়াদিঘির জলে চাঁদ আর সুপুরি গাছের ছায়া। কোথাও পুঁথি পড়া হয়। আর গান জেগে ওঠে─
‘বাপরে বাপ কি জাড়
মাওরে মাও কি জাড়
জাড়ত কাপে দেখং এল্যা
দিন দুখির সংসার’
এভাবে জীবন সেজে ওঠে। জীবন প্রবাহিত হয়। জন্ম আর মরণের ঘোর জাগিয়ে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন হেমকান্ত। আর হেমন্তের মাঠে খেতে হাহাকারের মতন ছুটে
যায় গান─
‘ওরে মানুষের দেহা
পবন গেইলে হবে মরা’
৫.
সব হাট কি একরকম! সোমবারের হাটের ভেতর কি খুঁজে পাওয়া যাবে বুধবারের হাট! তামারহাটের রঙের সাথে কি পুরোপুরি মিল থাকা সম্ভব রতিয়াদহ হাটের! ছত্রশালের হাটের পাখিদের কি দেখা মেলে পানবাড়ির কোনো এক শনিবারের হাটে!
সব হাট একরকম হয় না। সব গান একরকম হয় না। সব গঞ্জ আর গাঙ একরকমের হতে পারে না।
প্রবেশ আর প্রস্থান দিয়ে এক একটি হাটপর্ব রচিত হতে থাকে। আর লোকমান পাগলার হাটে ধুলোর ঝড়সমেত ঢুকে পড়ে জোড়া মহিষ। গদাধর নদীর কোণ বা চর থেকে বাথান ভেঙে এরা বুঝি চলে এসেছে এই হাটে ভেতরে। সমস্ত হাট জুড়ে একটা হুড়াহুড়ি লেগে যায়। মানুষের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। তখন কোথায় ইয়াকুব ব্যাপারী কোথায় মহিউদ্দিন ওস্তাদ কোথায় লোকমান! ভরা হাটের কোলাহল থেকে সরে আসতে আসতে ময়কান্ত মৈশাল তখন খুঁজতে শুরু করে বাথান পালানো সেই জোড়া মহিষদের। তার হাতে দীর্ঘ পেন্টি। মাথা গামছা দিয়ে পাগড়ির মতো করে বাঁধা। প্রায় তিন কুড়ির পেশীবহুল সুঠাম শরীরের পেশীগুলো একত্রিত করে ময়কান্ত তার কণ্ঠে তুলে আনেন মহিষের কণ্ঠের আকুতি। এই ডাক শুনে সেই জোড়া মহিষ কেমন থমকে দাঁড়ায়। তাদের বড়ো বড়ো চোখে কেমন মেঘের ছায়া! একটু বাদে দেখা যাবে সেই জোড়া মহিষ অদ্ভুত আহ্লাদ নিয়ে হেলে দুলে ময়কান্তর পিছনে পিছনে সেই বাথানের পথ ধরে ফেলেছে। গদাধর নদীর কোণ বা চরের খুব অন্দর থেকে ভেসে আসছে হাহাকার ভরা গানের সুর─
‘আরে ও মৈষের দফাদার ভাই
ডালা সাজাও ডালা সাজাও
চল মৈষের বাথানে যাই রে’
ময়কান্ত তার জোড়া মহিষ নিয়ে বাথানে চলে যেতে থাকে। কিন্তু হাট ভেঙে যায়।
৬.
ইয়াকুব ব্যাপারী মহিউদ্দিন ওস্তাদ লোকমান পাগেলাকে ভুলে গিয়ে আপাতত আমরা ঢুকে পড়তেই পারি বালাজানের হাটে। গঙ্গাধরের বাতাসে নদীর বালু উড়ে আসছে হাটের মস্ত খোলের ভেতর। শরীর ভর্তি বালুকণা মেখে গরুহাটির উত্তর শিথানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাজু চোরা। না, সাজু চোর নয়। তার নাম সাজু মোহাম্মদ। হাটে হাটে গরুর দালালি করে বেড়ায়। আর ‘চোর চুন্নি’ পালাগানে সাজু চোরের ভূমিকায় অভিনয় করে। তার শরীরের পরতে পরতে তীব্র এক নাচের ছন্দ লুকিয়ে আছে। সাজু চোরার পালা দেখার জন্য মানুষ হামলে পড়ে গানবাড়িতে। সাজু মোহাম্মদকে এখন আর কেউ চেনে না। সবাই সাজু চোরাকে একনামে চেনে। সাজু যখন নেচে নেচে শরীরে অদ্ভুত পাক দিতে দিতে গেয়ে ওঠে─
‘ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়’
তখন সমগ্র গানবাড়ি জুড়ে কী এক উন্মাদনা! সাজু চোরা ছিল গানমাস্টার মঈনুদ্দিন এর শিষ্য। মঈনউদ্দিন আবার ছিল আলাউদ্দিন এমেলের সাগরেদ। সারাজীবন এই গান, এই নাচ, রাতের পর রাত গানবাড়ি নিয়েই জীবন কাটে সাজু চোরার।
গরুর দালাল সাজু চোরা গরুহাটির ভেতর দাঁড়িয়ে কি ভাবছিল রহস্যমোড়া গানবাড়ির কথা! নাকি সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরবার কথা! তার শরীর জুড়ে নাচের ছন্দ ক্রিয়াশীল থাকে আর হাটের অন্ত মধ্যে সাজু ছড়িয়ে দিতে থাকে গুনগুন সুরের কোন এক গান, যা দূরাগত হওয়ার ডানায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমস্ত হাটের পরিসরে─
‘ওরে ফুলবাড়িত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি’
এইভাবে পুরোনো হাটপর্ব শেষ হয়ে যায়। নুতন নুতন হাটগুলোর হাট হয়ে উঠবার জন্যই হয়তো বা!
৭.
তামারহাটের ভেঙে যাওয়া হাটের বাইরে আসতে আসতে সিকান্দার মিস্তিরি তার ঝাঁকড়া চুল নাড়াতে নাড়াতে বেশ মজাদার এক ভঙ্গি তার দীঘল শরীরে বহন করে আনতে থাকে আর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়েই গানের দু-এক কলি গেয়ে ওঠে─
‘ও কি মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তির শিকারে’
এই গানের হাহাকারের মতন সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত লয়ে। গঞ্জ বাজার খেত খামার আর মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে এই গান তার সুরসমেত মিশে যেতে থাকে গঙ্গাধর নদীর মস্ত বালার চরে। সিকান্দারের চোখ ভিজে ওঠে। এই জীবন এই জীবন মায়া নিয়েই তো আবহমান বেঁচে থাকা মানুষের। সিকান্দার হাঁটতেই থাকে। লিলুয়া বাতাসে দোল খায় সিকান্দারের মাথার বাবরি চুল। ফাঁকা প্রান্তরে সে আচমকা দু-তিন পাক নেচেই ওঠে আর ঝুঁকে পড়ে নুতন গানের ওপর─
‘বিনা বাতাসে ভাসা
ঢোলে রে’
সিকান্দার সিকান্দার হয়েই থেকে যায়। দূরে ক্রমে আবছা হয়ে আসে তামারহাটের ভরসন্ধ্যাবেলা। গঙ্গাধরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিকান্দার মিস্তিরির শরীরের পুলক সহসা ভেঙে যায়। তার প্রাচীন কালের কালো পাথরের মতো কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সে কি তবে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়!
সিকান্দার আসলে নৌকো বানানোর দক্ষ এক কারিগর। আর এই জল ও জলার দেশে ধনী বলো জোতদার বলো জমিদার বলো বা গৌরীপুরের রাজাই বলো, নৌকো বানাবার কাজে প্রায় সারা বছরই ডাক পড়ে সিকান্দারের। প্রায় পঞ্চাশ বছর জুড়ে এই কাজ করে চলেছে সে। এই জনপদ তাকে সিকান্দার মিস্তিরি বলেই জানে। চেনে। একসময় সিকান্দার কালু বয়াতির দলে সারিন্দা বাজাতো। তার সারিন্দা কত কত ভরযুবতী নারীকে উন্মনা করেছে! কত নারীকে এক সংসার থেকে অন্য সংসারে ঠেলে দিয়েছে! কত চেংড়া কে বাউদিয়া করেছে! তার কোনো ঠায়-ঠিকানা নাই। তাকে দেখলে এখনও কত মানুষ মজা করে গেয়ে ওঠে─
‘কি ডাং ডাঙ্গালু বাপই রে
নাঠির গুতা দিয়া’
তবে কি সিকান্দার তার সারিন্দার জীবনের কথা ভাবছিল! না কি গয়েশ্বর ধনীর জোতজমি আর বাইচের নাও তাকে আরও আরও এক ভাবনার জটিলতায় ঠেলে দিচ্ছিল!
৮.
কতরকমের হাটে হাটে জমে ওঠা আড্ডার ভেতর দিয়ে আস্ত এক জীবন কেটে গেল! শীত ও কুয়াশায় ঘন হয়ে ওঠা সেই কবেকার চিলাপাতার হাট। এই হাটের চারপাশে গহীন বনাঞ্চল। সন্ধ্যের মুখে অদ্ভুত এক ছমছমে রোমাঞ্চের আবহ। আন্দু বস্তি থেকে রাভা মেয়েরা আসত। বানিয়া বস্তি থেকে শুকরা ওরাও আসত খড়ি বিক্রি করতে। কুর্মাই বস্তি থেকে আসত চিত্তরঞ্জন রাভা। আমিও মথুরা থেকে সাইকেল নিয়ে চলে আসতাম চিলাপাতা হাটে। দেখতাম হাট হলো এক নকশাকাটা বর্ণময় শীতলপাটি। কত রকমের মানুষ। হাটে ঢুকছে। হাট থেকে বেরিয়ে আসছে। তাদের শরীরের পেশী জুড়ে তীব্র এক স্পন্দন। এই হাটেই পরিচয় হয়েছিল শিবজির সঙ্গে। চিলাপাতা মোড়ে তার দোকান ছিল। শিবজিকে একবার মহাকাল বাবা মানে হাতি শুড়ে তুলে আছাড় দিয়েছিল জঙ্গলের গভীরে বানিয়া নদীর পাড়ে। বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। আর তারপর থেকে শিবজির ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়েছিল। শিবজি ছিলেন গল্পের খনি। আমি তার কাছে জঙ্গল জনপদের গল্প শুনতাম।
৯.
মথুরার এক সোমবারের ভরা হাটে আমাকে মাছ ধরবার রাভা নৃত্য দেখিয়েছিলেন পুষনি রাভা ও তার দল। এখানেই দোলেশ্বর বর্মণের চায়ের দোকানের আড্ডায় পরিচয় হয়েছিল জার্মান রাভা, টুনুমুনু এক্কা এবং ফুলচান বর্মণের সঙ্গে।
জার্মান রাভা, রাভা ভাষায় লোকনাটক লিখতেন। অভিনয় করতেন। আর তার সেই লোকনাটকের দলে বাঁশি বাজাতেন টুনুমুনু এক্কা। কোমরে গোঁজা সেই বাঁশি কত যে শুনেছি।
ফুলচান বর্মন ডুয়ার্সের হাটে হাটে টর্চ লাইটের দোকান নিয়ে ঘুরতেন। বিচিত্র এক জীবন অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতেন। তিনি ছিলেন তেভাগার সৈনিক। জোতদারের গোলা লুটের অংশীদার। আর কুচবিহারের মহারাজা পাতলাখাওয়ার জঙ্গলে শিকারে এলে তিনি মহারাজার ‘হাকোয়া বাহিনীতে’ যোগ দিতেন। একটা ঘোরের ভেতর তিনি শোনাতেন দেশি-বিদেশি রাজপুরুষদের হরেক রকম গল্প। মহারানী ইন্দিরা দেবী, রাজকুমার ইন্দ্রজিতের গল্প। গৌরীপুরের রাজকুমার লালজির বাঘ শিকারের কথা। মনে হতো বুঝি রূপকথার গল্প শুনছি। সহেবপোতার হাটে পলাশবাড়ির হাটে শালকুমারের হাটে আসতেন ইয়াকুব কবিরাজ। সেটা নয়ের দশক।
ইয়াকুব কবিরাজ দোতরা বাজিয়ে গান গাইতেন আর কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করতেন। মাঝে মাঝে শোনাতেন নানান মজাদার শ্লোক। তার কথা বলা, গায়নভঙ্গী, মাথা ভর্তি বাবরি চুলের দুলুনি একটা তীব্র আকর্ষণ তৈরি করত।
আমি তার সঙ্গে সঙ্গে হাটে হাটে ঘুরে বেড়াতাম একসময়। বিচিত্র রকমের সব মানুষজন দেখতাম।
১০.
জল্পেশ মন্দিরের কাছে চাকরি করতাম একসময়। খুব ঘুরে বেড়াতাম জনপদের পর জনপদ। নুতন নুতন আড্ডায় শামিল হতাম। জল্পেশ, জটিলেশ্বর মানে ইতিহাস। ইতিকথা। আড্ডা দিতাম লোকগানের শিল্পীদের সঙ্গে। দীপ্তি রায়ের ‘তুক্ষ্য গানের’ প্রেমে মজেছিলাম। আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন কামেস্বর রায় অঞ্জলি রায় ডাকুয়া তাদের ভাওয়াইয়া দিয়ে। জল্পেশের হাট আমার খুব প্রিয় ছিল। বৈশাখ মাসে প্রায় ৭-৮ দিন জল্পেশ মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়াতাম ‘মেচেনি গানের’ দলগুলির পরিবেশনা দেখব বলে।
জল্পেশ হাটে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই শ্রী হেরম্ব চন্দ্র বর্মন মহাশয়ের সঙ্গে। একসময় নিজস্ব ‘পালাটিয়া গানের’ দল ছিল ওনার। ভারি অদ্ভুত মানুষ! ওনার একটাই শখ ছিল। আশপাশের সমস্ত হাটগুলোতে ঘুরে বেড়ানো।
ওনার কাছ থেকেই জেনেছি পুরোন জোতদারদের গল্প। জল্পেশ হাটে উত্তরাখণ্ড আন্দোলনের মিছিল (দেবেশ রায়ের তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্তে যার ছবি পাই আমরা)। হেরম্ব বর্মন আমাকে শুনিয়েছিলেন রাজারহাটের সেই দাপুটে জোতদার ভূপেন রায়কতের আখ্যান, যিনি পরিবারের সবাইকে গুলি করে নিজেও আত্মঘাতী হয়েছিলেন। শুনিয়েছিলেন লাল শুক্রা ওরাও আর সতী সেনগুপ্তের লোকবিতার কথা। হেরম্ব বর্মন আজ নেই। কিন্তু তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। তাকে নিয়ে আমার লেখা একটি গদ্যের বই রয়েছে─ ‘হেরম্বচরিত’। বর্তমানে নিঃশেষিত।
১১.
নগরায়ন, সভ্যতার বিকাশ আজকের হাটকে অনেক বদলে দিয়েছে। কিছু কিছু গ্রামীণ হাট প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। হাটের তেমন গুরুত্ব আজ অনেকক্ষেত্রেই নেই। মানুষের প্রয়োজনে এখন প্রায় সব গ্রামেই নিত্যদিনের বাজার বসে। মোবাইলে চটুল গান শোনে আমাদের নুতন প্রজন্ম। তাই লোকগান, লোকগল্প আর জমে না। তবু হাট থাকে। হাট বসে নিয়মিত।
হাট কখনোই তার বর্ণময়তা হারিয়ে ফেলতে পারে না। হাট আসলে আবহমান। চিরকালীন।
সুবীর সরকার বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ নাম। জন্ম ১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারি। নয়ের দশকে লিখতে আসা এ কবি উত্তরের লোকজীবনের সাথে জড়িয়ে আছেন তীব্র ভাবে। ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে কবিতা গদ্য সহ বিভিন্ন ধারায় অনায়াস যাতায়াত করেছেন। ভাষার প্রায় সব কাগজে নিয়মিত লেখালিখি করছেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতাবই প্রকাশিত হয় কবিতা পাক্ষিক থেকে। গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ও গদ্যের বইগুলো- ধানবাড়ি গানবাড়ি, মাহুত বন্ধু রে, নির্বাচিত কবিতা, বিবাহ বাজনা, নাচঘর, উত্তরজনপদবৃত্তান্ত, মাতব্বর বৃত্তান্ত, ভাঙা সেতুর গান। পেশায় শিক্ষক এ কবি ভালোবাসেন রবিশস্যের খামার বাড়ি, সাদা ঘোড়া আর যৌথ যাপনে চাঁদের আলোয় কবিতা আড্ডা, লোকগানের আমেজ।
কবিতা পাক্ষিক সম্মান ইতিকথা সাহিত্য পুরস্কার শিতলগড় সাহিত্য সম্মান কবিতা করিডোর সম্মাননা তোর্ষা বিশেষ সাহিত্য সম্মাননা বিবৃতি সাহিত্য পুরস্কার সমিধ কবিতা সম্মাননা আলপনা স্মৃতি সম্মাননা সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ স্মৃতি পুরস্কার।