এই কথা বলি আমি, এই কথা বলো তুমি—আমি এক, তুমি দুই। একটা ছোটো বৃষ্টি, যে আসে অচেনা হাত থেকে, অচেনা শরীর থেকে; বলে সে, আমরা কেউ না। এবার বর্ষাকালে আমাদের গৃহে বৃষ্টি না এলে বলা যেতে পারে সে অচেনা হাতের কথা, অচেনা শরীরের কথা; যে অচেনা হাতের, অচেনা শরীরের আয়ত্তে আছে বৃষ্টির প্রহেলিকা, বৃষ্টির বণ্টন—আমাদের গৃহের শরীর ও হাতের বিবিধ ছদ্মভ্রমণ।
২.
কার বর্ণনায় আগে আসি—শরীরের কিংবা হাতের। শরীর কাকে বলে, জানে সে, যে পালিয়েছে শরীর থেকে। হাত কাকে বলে, জানে সে, যে পালিয়েছে হাত থেকে। গৃহ কাকে বলে জানে সে, যে পালিয়েছে গৃহ থেকে। সে সকল পালিয়ে যাওয়া শরীরের, পালিয়ে যাওয়া হাতের, পালিয়ে যাওয়া গৃহের, ছবি আঁকতে আঁকতে ভাস্কর্য গড়তে গড়তে জন্ম নেয় যেসব রাক্ষস, তাকে বলো মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদারো, গ্রিস, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের বইয়ের সকল জ্ঞান শরীরকেন্দ্রিক হলে তার শরীরের সৌন্দর্য ও পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য প্রথমে আবিষ্কার করতে হয় বর্ণমালা। অতঃপর সে বর্ণমালার সাহায্যে লিখিত হয় শব্দ, বাক্য এবং আরও অজস্র কিছু, যার কিছু থাকে স্মরণে কিছু থাকে বিস্মরণে।
৩.
নাম তার রিয়া। সে তো শরীর, ফিসফিস করে বলি এই কথা। শরীরের কত যে বিপদ এই গৃহে। তার শরীরের সৌন্দর্য বর্ণনা করার জন্য কত আগে থেকে লিখিত হতে থাকে বই, নির্মাণ হতে থাকে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। এই রিয়া নিজে পড়বার জন্য, নিজেকে পড়াবার জন্য, ভর্তি হয় আমাদের বইয়ে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে ভর্তি হয় আমাদের জ্ঞান চর্চার নানাবিধ বইয়ে, অজ্ঞান চর্চার নানাবিধ বইয়ে। আমাদের বইয়ের সকল জ্ঞান শরীরকেন্দ্রিক হলে তার শরীরের সৌন্দর্য ও পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য প্রথমে আবিষ্কার করতে হয় বর্ণমালা। অতঃপর সে বর্ণমালার সাহায্যে লিখিত হয় শব্দ, বাক্য এবং আরও অজস্র কিছু, যার কিছু থাকে স্মরণে কিছু থাকে বিস্মরণে।
রিয়া বইয়ের ভেতর দিয়ে, বর্ণমালার ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করলে, কেউ বলে জীবনের কেন্দ্রে আছে কবিতা, কেউ বলে গল্প, কেউ বলে রাজনীতি, কেউ বলে অর্থনীতি, কেউ বলে ধর্মনীতি, কেউ বলে আরও কত কত কিছু—সে কথা যায় আমারও অসীমে তোমারও অসীমে।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে একটি প্রবেশদ্বার থাকলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও তার ব্যতিক্রম হয় না। আর প্রবেশদ্বারের দুপাশে দুটো ফুল গাছ তাদের ফুল দিয়ে সবাইকে সর্বদা অভ্যর্থনা ও বিদায় জানাতে থাকলে বলি সে দুটো ফুল গাছের নাম। শিউলি ফুল। ফুলের শরীরের ফুলের বাইরে যাবার ক্ষমতা থাকলে বলি তার কথা। ফুল সর্বদা গাছ থেকে ঝরে গিয়ে শরীরহীন হতে চাইলে দেখি সে পড়ে আছে পায়ের তলায়। আর শিউলি ফুল নিয়ত পতনশীল হলে, সে-সকল ফুলকে সব সময় আমরা আমাদের পায়ের নিচে রাখি, আর তার গন্ধকে বলি ভালো লাগে। পায়ের নিচে চাপা পড়ে শিউলি ফুল তার গন্ধ আরও বাড়িয়ে দিলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ এবং প্রস্থান করে আনন্দিত হই। আর কোনো কারণ ছাড়াই এ সময় রিয়ার কথা মনে হয়। রিয়াকে মনে হয় শিউলি ফুল। আর যে ঝরে পড়ছে অজস্র শিউলি ফুল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পায়ের তলায়।
রিয়া কার সহপাঠিনী, এ প্রশ্ন অযথা। রিয়া সবার সহপাঠিনী। যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণমালা। রিয়া কার পাশে বসে আছে, এ প্রশ্ন অযথা। রিয়া সবার পাশে বসে আছে। যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আছে। আর রিয়া যদি ঝরে যাবার পাশে ঝরে যাওয়া—তবে সে আমাদের পায়ে পায়ে প্রবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রস্থান করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমাদের পা ভ্রমণপিয়াসী হলে, সে ভ্রমণ করেছে আমাদের সাথে। রিয়া কী জানে? এ প্রশ্ন অযথা। রিয়া জানে এ গ্রহের প্রথম গল্প। ফুলের পাশে ফুল, ঝরে যাবার পাশে ঝরে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে, সেখানে প্রবেশে ও প্রস্থানে নানারূপ প্রশ্নের ও পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হলে রিয়াকেও প্রশ্ন ও পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। একটা প্রশ্ন যতটুকু স্তব্ধতা ধারণ করতে পারে আর একটা উত্তর যতটুকু কোলাহল ধারণ করতে পারে, রিয়া জানে ততটুকু স্তব্ধতা ও কোলাহল। সে থাকে স্তব্ধতায়, সে থাকে কোলাহলে।
ক্লাসরুমের চাইতে পরীক্ষার হল রুম সর্বদা বড়ো হয় যেভাবে, সেভাবে শেখার চাইতে প্রশ্ন বড়ো সর্বদা। এই কথা কে বলেছিল—জানে না কেউ, পৃথিবীতে উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন বেশি। কোলাহলের চেয়ে স্তব্ধতা বেশি। আরও কথা এই, প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের থাকে না কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক।
রিয়া এখন পরীক্ষার হলে। সে এসেছে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে। কত কত প্রশ্নের উত্তর সে শিখে এসেছে, কত কত কোলাহল সে শিখে এসেছে পরীক্ষার হলে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য।
পরীক্ষা চলছে। রিয়া উত্তর লিখছে। হঠাৎ সে অনুভব করে কেউ তার শরীরে হাত দিয়েছে। এই ভুল হয় তার, শরীরে হাত দেওয়া দেখতে সে প্রথমে বাইরে তাকায়। বাইরে আকাশ। আকাশে মেঘ। আকাশের মেঘ কি আকাশের প্রশ্ন, আকাশের উত্তর; আকাশের স্তব্ধতা, আকাশের কোলাহল? আকাশের গোপন সঞ্চয় থাকলে সে সময় বিদ্যুৎ, সে সময় বজ্রপাত। তার শরীরে বিদ্যুৎ ও বজ্রপাতের আগমন। আকাশ থেকে তার দৃষ্টি পরীক্ষা হলে—সেখানে কয়েকজন শিক্ষক যারা বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ নয়, নকল ধরার চেষ্টা করছে। কয়েকজন ছাত্র যারা বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ নয়, তারা নকল করার চেষ্টা করছে। কে তার শরীরে হাত দিয়েছে এটা এখন তার কাছে পরীক্ষার প্রশ্নের চাইতে বড়ো প্রশ্ন হয়ে যায়। সবার আগে সে নিজেকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়। পুনরায় সে তার চারপাশে তাকায়। আবারও একই দৃশ্য, কয়েকজন ছাত্র নকল করার চেষ্টা করছে, আর কয়েকজন শিক্ষক নকল ধরার চেষ্টা করছে। সে সবার হাতের দিকে তাকায়। সবার হাতে নকল। সে তো জানে পরীক্ষার হল মানে নকল করা ও নকল ধরা। যে শিক্ষকটি বিদ্যুৎ ও বজ্রপাতের আগে তার চারিদিকে নকল ধরার জন্য ঘুরছিল তার হাতেও নকল। সে কার নকল ধরেছে? বিদ্যুৎ ও বজ্রপাতের আগে তার শরীরে কি নকল ছিল? এই শিক্ষকের হাতে ধরা নকল কি তার শরীর থেকে বের হয়েছে? সে-ই কি তবে তার শরীরে হাত দিয়েছে? বিদ্যুৎ চমকের মতো তার একবার মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় আসলে জেলখানা, যে জেলখানায় প্রশ্ন ও উত্তর বন্দি করে রাখা হয়েছে।
রিয়ার এ সময় মনে হয় সকল মানুষের শরীরে নকল রয়েছে। সকল মানুষ নকল করছে নানারূপ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, জেলখানায় প্রবেশ করার জন্য এবং জেলখানা থেকে বের হওয়ার জন্য। এরপর এই কথা মনে আসে তার, কত কত পরীক্ষা দিতে হয় মানুষকে। সে যদি মানুষ—কখনো তবে তার পরীক্ষার শেষ নাই। আর যখন সে মেয়ে, যখন সে পোশাক, যখন সে বড়ো হতে থাকে, যখন তার পোশাক বড়ো হতে থাকে, তার প্রশ্ন বড়ো হতে থাকে, যেভাবে মৃত্যু বড়ো হতে থাকে সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্তের দিকে যেতে। প্রশ্ন তার বিশ্বাসে—বড়ো হতে থাকে বিশ্বাস, যেভাবে আকাশ বড়ো হয় মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে। প্রশ্ন তার অবিশ্বাসে—বড়ো হতে থাকে অবিশ্বাস, যেভাবে আকাশ বড়ো হয় মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে। তারপর সে দেখেছে সবাই তার শরীরে নকল রয়েছে ভেবে নকল ধরতে চেয়েছে। সবাই তার শরীরে নকল ধরার চেষ্টা করলে চারপাশের সবাইকে তার শিক্ষক মনে হয়েছে। সবাই তাকে ভেবেছে পরীক্ষার্থিনী। আর রিয়া, কত রকম বইয়ের যে পাতা ছিঁড়ে তার শরীরে রেখেছে নকল করে উত্তর দেওয়ার জন্য। রাজনীতির, অর্থনীতির, ধর্মনীতির বইয়ের পাতা ছিঁড়ে রেখেছে সে তার শরীরে। সে ভেবেছে একটা শরীর ধারণ করে কত কত রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি। আর সবার ভেতর আকাশনীতি থাকলে সে কিভাবে পাবে আকাশনীতির কথা! মাঝে মাঝে তার বাবা-মা শিক্ষক হলে, তারা জিজ্ঞেস করেছে বইয়ের পাতাগুলো কোথায়? রিয়া জানে তার শরীর সব কথা শোনে না, তার গৃহ সব দেয়াল জানে না। তার মা-বাবা সে-সময় রিয়াকে দেয়াল জ্ঞান করলে তাদের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে যায়। একটা পাখি উড়তে উড়তে এমন এক বৃক্ষের নিকটে আসে যার ডাল পুড়ে গেছে বিদ্যুৎ ও বজ্রপাতে।
ধ্বনি থেকে পৃথিবী সৃষ্টি, ধ্বনি থেকে পৃথিবী বিনাশ—এই কথা কোন শিক্ষক বলেছিল জানা না থাকলেও এখন পরীক্ষা শুরু হয় ঘণ্টা ধ্বনি দিয়ে, শেষ হয় ঘণ্টা ধ্বনিতে। ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে। পরীক্ষা শেষ হয়, প্রশ্নের স্তব্ধতা ও কোলাহল ভেঙে যায়। আজ রিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে তার মনে হলো তার শরীরে যে হাত দিয়েছে সে একজন শিক্ষক। কারণ এযাবৎ যতবার তার শরীরে হাত এসেছে সবগুলো শিক্ষকের হাত। সে হাতের বর্ণমালা সে জানে। এই বর্ণমালা পৃথিবীর আদি বর্ণমালা হলে সে জানে এ বর্ণমালার ভাষা। আরও কথা এই যে, সে সর্বদা নানারূপ শিক্ষকের মাঝে বাস করেছে। রাজনীতির শিক্ষক, অর্থনীতির শিক্ষক, ধর্মনীতির শিক্ষক—সবাই, সবাই শরীর চর্চার শিক্ষক। আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পরীক্ষা দিতে এসে তার মনে হয় তার জানা দরকার, কারা কারা তার শরীরে হাত দিয়েছে, একবার, অজস্রবার, আজবার, পরীক্ষাবার। তার শরীর কত আগে অপরাধী হয়েছে কার দ্বারা কী কারণে এখন তার জানার ইচ্ছা হয়। যদি তার শরীর অপরাধী, সে কি তবে জেলখানায় আছে মানুষের মুখের এবং চিন্তার সকল বর্ণমালায়? প্রতিটা মানুষের মুখ ও তার ভাষা তবে জেলখানা।
৪.
রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে একটা দরখাস্ত দেয় এটা লিখে যে, পরীক্ষা হলে একজন শিক্ষক তার শরীরে হাত দিয়েছে। এবং নিজেকে তার জেলখানার কয়েদি মনে হচ্ছে। হাত দেওয়ার প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকলে তার মনে হবে, যা এখন মনে হচ্ছে, সে রয়েছে জেলখানায়। এই জেল থেকে মুক্তি না পেলে তার উদ্ধার হবে না কোনো ভবিষ্যতে। তার দরখাস্ত বড়ো হলে আরেকটু পড়া যেতে পারে তা রিয়ার বর্ণমালা দিয়ে। রিয়া বলে তার চিন্তার সারমর্ম এই যে, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি শরীরচর্চা কেন্দ্র, যেখানে শেখানো হয় শরীরে হাত দেওয়া বিদ্যা। হাতের গর্জন সে শুনছে অবিরাম। হাতের চেয়ে বড়ো বাঘ আর কোথায়।
এই ঘটনার পর রিয়ার পক্ষে যারা হাত তোলে, তাদের তো হাত আছে; এবং যাদের হাত একই সঙ্গে শরীর ও আকাশ সন্ধানী। রিয়ার বিপক্ষে যারা হাত তোলে, তাদেরও হাত আছে এবং যাদের হাত একই সঙ্গে শরীর ও আকাশ সন্ধানী। রিয়া এখন কোথায়? একটু পরে জানা যাবে কোথায় দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখতে গিয়ে বটগাছের পাতা গণনা করছে, ছায়া গণনা করছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছগুলো পাতায় পাতায় সকল আকাশ ঢেকে ফেললে শিক্ষার্থীরা বটগাছের পাতা আর ছায়া ছাড়া আর কিই-বা গুনতে পারে।
৫.
বক্তৃতা চলছে বটগাছের তলায়। ছায়ার তলায়। অর্থনীতির, রাজনীতির, ধর্মনীতির ছায়ায়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতার জন্য নির্ধারিত দুটি বটগাছতলা থাকলে দুটি বটগাছতলায় বক্তৃতা চলছে। বক্তৃতা চলছে হাত বিষয়ে, শরীর বিষয়ে, শিক্ষা বিষয়ে। আর ক্লাসরুমের চাইতে ক্লাসের বাইরেই সবচাইতে বেশি শিক্ষা খুঁজে পাওয়া যায় বটগাছতলায়। হাতের পক্ষে শরীরের বিপক্ষে এক বটগাছতলা। হাতের বিপক্ষে শরীরের পক্ষে আরেক বটগাছতলা।
কয়েকদিন পর স্পষ্ট হয় শরীর। শরীর আসে ধীরে, যদিও তা ছায়ার আগে। রিয়ার শরীর। স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট হয় হাত। ইমরুল কায়েসের হাত। শিক্ষক ইমরুল কায়েস হাত দিয়েছে রিয়ার শরীরে। রিয়ার অভিযোগ তাই।
ইমরুল কায়েস কিসের শিক্ষক? সে কি রাজনীতির শিক্ষক? ছাত্র কোথায়? একজন ছাত্র বলল, ইয়েস স্যার। সে কি অর্থনীতির শিক্ষক? ছাত্র কোথায়? একজন ছাত্র বলল, ইয়েস স্যার। সে কি ধর্মনীতির শিক্ষক? ছাত্র কোথায়? একজন ছাত্র বলল, ইয়েস স্যার। এরপর কত কিছুর শিক্ষক বলা যে বাদ থেকে যায়।
ইমরুল কায়েস কিসের শিক্ষক? সে কি রাজনীতির শিক্ষক? ছাত্র কোথায়? একজন ছাত্র বলল, ইয়েস স্যার। সে কি অর্থনীতির শিক্ষক? ছাত্র কোথায়? একজন ছাত্র বলল, ইয়েস স্যার। সে কি ধর্মনীতির শিক্ষক? ছাত্র কোথায়? একজন ছাত্র বলল, ইয়েস স্যার। এরপর কত কিছুর শিক্ষক বলা যে বাদ থেকে যায়। হাতের শিক্ষক, ইয়েস স্যার। শরীরের শিক্ষক, ইয়েস স্যার। তার বই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, ইয়েস স্যার। তার বই ইউনিভার্সিটি অব ফেসবুকে পড়ানো হয়, ইয়েস স্যার। সে লিখেছে হাত ও শরীর নিয়ে কয়েকটি বই, ইয়েস স্যার। এই সমস্ত ইয়েস স্যার ভেসে আসে বটতলা থেকে, যেখানে কয়েকটি বিলুপ্তপ্রায় পাখি মলত্যাগের জন্য খাবার খুঁজতে এসেছে। আর এই কথা বলে একটা পাখির শেষ ডিম, পৃথিবীর সকল বটগাছ জন্মেছে পাখির মল থেকে।
৬.
রিয়া ও ইমরুল কায়েসের শরীর ও হাত বিষয়ক খবর মিডিয়াতে আসে, টকশোতে আসে, ফেসবুকে আসে, আর সে সব থেকে জানা হয় শরীর ও শরীরের ইতিহাস, হাত ও হাতের ইতিহাস। একজন বুদ্ধিজীবী চলে যায় সেখানে, যেখানে একটা ছবি, যার নাম ‘দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’। এ ছবির সাহায্যে রিয়া ও ইমরুল কায়েসের ঘটনার ব্যাখ্যা চলতে থাকে, বলতে থাকে সবাই, সমাজের অগ্রগতি, মানুষের অগ্রগতি, আঙুল থেকে হাতে, হাত থেকে শরীরে। তারপর কত কত বিদ্যার উৎপত্তি হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি হয়। সিস্টিন চ্যাপেল কত শিল্প যে ধারণ করে।
৭.
একটি পিঁপড়া খাদ্য বাঁচাবার চেষ্টা করছে, নিজের শরীর বাঁচাবার জন্য। খাদ্য ভেসে যায়, শরীর ভেসে যায়। জল আর তার ঢেউ নির্মাণ করে ব্যাপক অন্ধকার। জল আর অন্ধকারের তৃষ্ণা মৃত্যুকে আহবান করলে পিঁপড়াটা দাঁড়াবে কোন বৃক্ষের পাতায়? কেউ বলে জ্ঞানবৃক্ষের পাতায় আছে পিঁপড়ার আশ্রয়। এতটুকু পিঁপড়া আর তার এতটুকু শরীর কতটুকু ধারণ করতে পারে জ্ঞান। জ্ঞান ভেসে যায় শরীর বেয়ে, জ্ঞান বয়ে যায় মৃত শরীরের পাশ দিয়ে।
ইমরুল কায়েস সাংবাদিকদের সামনে নিজের সমর্থনে কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সকল বই ঘেঁটে ঘেঁটে। তার সমর্থনে কত বই যে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে তা এখন জানা হয় তার ব্যাখ্যাতে। শরীরে হাত দেওয়া বিষয়ে তার অজস্র ব্যাখ্যা। তার ভাষা, তার ব্যাখ্যা দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি করে। সে হাত ও শরীর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বিষয়হীনতার দিকে যায়। একজন সাংবাদিক, যিনি উপন্যাস লিখতে গিয়ে সব সময় উপন্যাসকে রিপোর্ট ভাবেন, তার মনে হয় ভাষা তবে যোগাযোগ সৃষ্টি না করার মাধ্যম হতে পারে। পৃথিবীর ভাষাসমূহের প্রধান কাজ যোগাযোগহীনতা সৃষ্টি করা কিংবা যোগাযোগের দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া। তার ভীষণ ভালো লাগে ইমরুল কায়েসের কথাবার্তা। সে বিস্মিত হয় ইমরুল কায়েসের ভাষার সাহায্যে কিছু না বলার দক্ষতা দেখে। সে এই সময় নিজের লেখা গল্প উপন্যাস এবং এ সময়ে অন্য লেখকদের লেখা গল্প উপন্যাসের কথা ভাবে। কিছুই না বলে চেয়ারের, টেবিলের, জামার, প্যান্টের, খাবারের বর্ণনায় সমৃদ্ধ গল্প উপন্যাসের সঙ্গে ইমরুল কায়েসের ভাষার সে মিল খুঁজে পায়। তারপর তার আরও মনে হয় ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অকেজো করে দেওয়ার জন্য কত আয়োজন চার পাশে। একজন রাজনীতিবিদ বলছেন, ভালোবাসি; একটা পাতা ঝরে যায়। একজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, ভালোবাসি; একটা ফুল ঝরে যায়। একজন ধর্মনীতিবিদ বলছেন, ভালোবাসি; একটা পাখি ঝরে যায়, আকাশ ঝরে যায়। একজন ঔপন্যাসিক লিখছেন, ভালোবাসি; শব্দ ঝরে যায়, অভিধান হারিয়ে যায়।
ইমরুল কায়েস কথা শেষ করলে সকল সাংবাদিক তাকে অভিবাদন জানায় তার যুক্তির পাপহীনতা দেখে। তারা ভাবে একজন মানুষ সভ্যতাকে বাক্যে কতটা ধারণ করলে এভাবে কথা বলতে পারে, যুক্তি দাঁড় করাতে পারে। সাংবাদিকেরা মাঝে মাঝে ভাবতে পারলে তারা ভাবে, পৃথিবীর সকল সভ্যতায় আছে ঘর হারানোর পথ। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত যুক্তিগুলো, সভ্যতাগুলো তারা লিখে রাখে নিজেদের জন্য। যখন তাদের সবারই হাত আছে অন্ধকারের দিকে, শরীরের দিকে যাত্রার জন্য। তারা ভাবে শরীরের চাইতে বড়ো অন্ধকার আর কিছু নাই। হাতের চাইতে বড়ো অন্ধকার আর কিছু নাই।
৮.
ইমরুল কায়েসের ভাবমূর্তি উদ্ধারে অনেকের সঙ্গে তার পরিবারও অংশগ্রহণ করে। তার পরিবারে রয়েছে এক স্ত্রী ও এক কন্যা। তার স্ত্রীও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং তার মেয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য শরীর বিষয়ে গবেষণা করছে। ইমরুল কায়েসের পরিবার গবেষক পরিবার। সাংবাদিকদেরকে তার স্ত্রী জানায়, স্বামীর বিরুদ্ধে রিয়া নামের যে মেয়েটি অভিযোগ করেছে তা পুরোপুরি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। সে জানায়, তার স্বামী তার হাত তার কাছে, তার স্তনের কাছে জমা রেখেছে বিয়ের সময়। ইমরুল কায়েসের স্ত্রী সালেহা ইমরুল আরও জানায়, বিয়ের শাড়িতে সে তার স্বামীর হাত জড়িয়ে রেখেছে। বছরে মাত্র একবার তাদের বিবাহ বার্ষিকীতে সে হাত বের করা হয়। তাদের মেয়ে ইভানা ইমরুল জানায়, তার বাবা, তার কাছে, তার ভালোবাসার কাছে হাত জমা রেখেছে। সে তার বাবার হাত দেখাশোনা করে। সে আরও বলে, তার দোলনায় তার বাবার হাত জমা আছে। হাত বিষয়ে ইমরুল কায়েসের স্ত্রী ও কন্যার বক্তব্য আলাদা আলাদা হলেও উপস্থিত সাংবাদিকেরা সেটা বুঝতে পারে না। তারা খুব মুগ্ধ হয় এই ভেবে যে, ইমরুল কায়েসের নিকট তার হাত ও তার পরিবার অশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র। পবিত্রতায় কান্না একটা বড়ো ভূমিকা পালন করলে ইমরুল কায়েসের স্ত্রী ও কন্যা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এই কান্নার ছবি ছাপা হয় দেশের সকল দৈনিকে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়া এক সাংবাদিকও এই ছবি ছাপায়। আর একজন ফেসবুকের কবি লেখে, একটা পিঁপড়ার শরীর ভেসে যায় সামান্য জলে, আত্মহত্যার জলে।
৯.
রিয়া আসে কথা বলতে। ভাষা কতটুকু তার আয়ত্তে। কতটুকু জলে ভাসতে পারে তার ভাষা নৌকা হয়ে। কয়টা বর্ণমালা জানে সে; কয়টা প্রশ্নের উত্তর জানে সে—নিজেকে খোঁজে জানা সকল বর্ণ দিয়ে, শব্দ দিয়ে, বাক্য দিয়ে? কোন বর্ণে, কোন শব্দে, কোন বাক্যে আছে সে? কিভাবে ভাসাবে সে তার শরীরের সমান পিঁপড়াটা? সাংবাদিকদেরকে কী বলবে সে? সে তার লিখিত অভিযোগটা পুনরায় পড়ে শোনায়। সাংবাদিকেরা কতটা বোঝে শরীরের ভাষা, পিঁপড়ার ভাষা, জানে না সে তা। দৈনিক পত্রিকা পড়ে মনে হয়েছে তার, পত্রিকার সকল শব্দ, সকল বাক্য বাতিল হয়ে যায় একবার পড়ার পর কিংবা একবারও না পড়ার পর। সাংবাদিকদের শব্দ ও বাক্যের আয়ুর অল্পতা দেখে তার লিখিত অভিযোগের বাইরে কিছুই বলা হয় না। আর এছাড়াও এ সময় তার নিজেকে মনে হয় অবিরাম পতনশীল শিউলি ফুল। তার কিংবা সকল মানুষের শরীর থেকে ঝরে পড়ছে একটা দুটো ঘটনা শিউলি ফুলের মতো। যে ফুলের সঙ্গে ফুলের গাছের কখনো পুনরায় সম্পর্ক হয় না। যে ফুল ফিরতে পারে না বৃক্ষের শরীরে। দাবি করতে পারে না সে ছিল সে বৃক্ষের শরীরে। ভাবনা কত দিকে যায়। শরীরে সন্ধ্যা নামার আগে শরীরের চিন্তা ঘুমিয়ে পড়ে। নিস্তেজ হয়ে যায় একটা কাঠবিড়ালী গাছে ওঠার আগে। রিয়া নিজেকে একসময় ভেবেছিল একটা কাঠবিড়ালী।
শরীরের আছে নিভৃত ইতিহাস। জানে রাত, রাতের বিদ্যালয়। তার শরীর এসেছে আকাশ থেকে—এ শরীর আকাশের। তার শরীর এসেছে পরিবার থেকে—এ শরীর তার পরিবারের। শরীরে এসেছে রাষ্ট্র থেকে—এ শরীর রাষ্ট্রের। আরও কত কত জায়গা থেকে যে এসেছে এ শরীর, কত কত যে তার মালিক তার ইয়ত্তা দিবে এমন গণিত কোথায়।
নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে সে কি আবিষ্কার করে? নিজেকে অথবা অন্য কাউকে? নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে অথবা পৃথিবীর সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে? নিজের শরীরকে সে নিজের বলে দাবি করতে পারছে না। সংসারে নানা রকম কেনাবেচা থাকলে সে তার শরীরকে কিনতে চেয়েছে। সে ঠিক জানেনি নিজের শরীরকে কিভাবে কেনা যায়। তারপরও সে ভুলভাবে ঠিকভাবে নিজের শরীরকে কিনতে চেয়েছে। অন্য অনেকেও কি তার শরীরকে কিনতে চেয়েছে? চারপাশের নানা রকম শিক্ষক তাকে জানিয়েছে তার শরীর তার নয়। শরীরের আছে নিভৃত ইতিহাস। জানে রাত, রাতের বিদ্যালয়। তার শরীর এসেছে আকাশ থেকে—এ শরীর আকাশের। তার শরীর এসেছে পরিবার থেকে—এ শরীর তার পরিবারের। শরীরে এসেছে রাষ্ট্র থেকে—এ শরীর রাষ্ট্রের। আরও কত কত জায়গা থেকে যে এসেছে এ শরীর, কত কত যে তার মালিক তার ইয়ত্তা দিবে এমন গণিত কোথায়। গণিতের থাকে অশেষ সীমাবদ্ধতা, গণিতের থাকে অশেষ ভুল। কত কত মাতৃগর্ভে, পরিবার গর্ভে, ধর্ম গর্ভে, শিক্ষা গর্ভে, রাষ্ট্র গর্ভে তার জন্ম হয়েছে তা জানার জন্য সে শিখতে চেয়েছে শরীরের বর্ণমালা। মানুষ হাঁটতে হাঁটতে কতটুকু নিকটে যেতে পারে তার শরীরের। একটা মানুষের হাঁটা আসে উটের কাছে, যেখানে শায়িত মরুভূমি। আর এ সময় তার মনে হয় ইমরুল কায়েস তার শরীর বলতে বুঝিয়েছিল স্তন।
১০.
বটতলায় যারা বক্তৃতা দিচ্ছিল তারা অনুভব করে তাদের সিগারেট ও নাস্তা খাওয়ার টাকা শেষ হয়ে গেছে। সিগারেট ও নাস্তা খাওয়ার টাকা শেষ হলে তারা তাদের বক্তৃতা বদলায়। তারা অলিখিত বক্তৃতায় বলে ইমরুল কায়েসের হাত আসলে তার স্ত্রী ও কন্যার কাছে জমা নাই। তার হাত পরীক্ষার হলে ছিল। এবং যে হাত রিয়ার শরীর খুঁজছিল। তারা আরও বলে ইমরুল কায়েসের হাত নগ্ন ছিল। তার হাতে কোনো রাজনীতির, অর্থনীতির, ধর্মনীতির পোশাক ছিল না। পোশাকহীন যেকোনো হাত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করতে পারে এবং করেছে যুগে যুগে। বটতলার বক্তারা ইমরুল কায়েসের যথাযথ শাস্তি দাবি করে। তারা বলে ইমরুল কায়েস শিক্ষার হাতে মাখিয়েছে কলঙ্ক। হাতকে নামিয়েছে সে নর্দমায়। তারপর তারা হাতের গৌরবের কথা স্মরণ করায় ইতিহাসের উদাহরণ দিয়ে। মাথার উপরে যে বটগাছ, বটগাছের ছায়া, সে বটগাছ রোপন করেছিল বিখ্যাত হাত। তাদের কাঁধে যে বা যারা হাত রেখেছিল, সে হাতে বা হাতসমূহে তরবারি ছিল দেশ উদ্ধারে। দেশের সকল আলো জ্বালিয়েছে হাত।
১১.
নদী বয়ে যায়, কথার নদী। কথার নদীতে কথা ফেলে মানুষ। মানুষ তো সর্বদা কথার নদীর পাশ দিয়ে হাঁটে, কথা ফেলে। সে সব কথায় নদী দূষিত হয়, দূষণমুক্ত হয়। ভেসে যাওয়া সে সব কথা শোনা যেতে পারে, শোনা না যেতে পারে। যাদের কথা আছে, কথার অভিধান আছে, তারা সবাই অংশগ্রহণ করে নদীর দূষণে, নদীর দূষণমুক্ততায়। যাদেরকে শরীর ঠিক রাখার জন্য হাঁটতে হয় সকালে কিংবা বিকেলে তারা কথা বলে, কথা ফেলে কথার নদীতে।
—শরীর আসলে কী? হাত আসলে কী? এইসব প্রশ্ন প্রাচীন। প্রাচীন গ্রন্থের চাইতে।
—উত্তর জানে কে? যে জানে সে ঘুমায়।
—কে বাঁচাবে তাকে? কে বাঁচাবে শরীরকে?
—বাগানের কথা মনে আসে।
—সে কি তার শরীরে বাগান নির্মাণ করেছিল?
—সে তার বাগানে কোনো কোনো নিষিদ্ধ গাছ লাগিয়েছিল?
—রাত্রি কি একটি ফুল গাছের নাম?
—ফুল কি অন্ধকার নির্মাণ করতে পারে?
—প্রতিটি ফুলই অন্ধকার নির্মাণ করার ক্ষমতা রাখে।
—ফুলের জন্য পৃথিবীর সকল যুদ্ধ।
—সকল যুদ্ধের নাম কি ফুলযুদ্ধ?
—অভিযোগ যায় কোনো দিকে?
—অভিযোগ যায় শরীরের দিকে, যে নির্মাণ করে ফুলের বাগান, রাত্রি।
—অভিযোগ যায় হাতের দিকে, যে বিনাশ করে ফুলের বাগান, রাত্রি।
—যেটুকু রোদ দিন তৈরি করে, তার কথা বলো।
—যেটুকু জল সমুদ্র তৈরি করে, তার কথা বলো।
—মেঘের কথা বলো, যে জানে কোনো বীজে আছে দিন, আছে সমুদ্র।
ইমরুল কায়েস জেনেছে তার শিক্ষা অর্জনে টাকা আছে, তার শিক্ষা প্রদানে টাকা আছে, তার শিক্ষক হওয়াতেও টাকা আছে। তাই সে বটতলার কাছে যায়, যে বটগাছ লাগিয়েছিল এক বা একাধিক প্রাচীন পুরুষ কিংবা প্রাচীন পাখির প্রাচীন মল। বটগাছতলার সবার পায়ে সে তার হাত রাখে নিজের হাতকে আরও শক্তিশালী করার জন্য।
১২.
বটতলার ক্ষমতা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের চাইতে বেশি হলে ইমরুল কায়েস বিপন্ন বোধ করে। বটতলার বক্তারা দাবি করে তাদেরকে মিষ্টি ও নাস্তার টাকা না দিলে দেশের সকল পত্রিকায় ইমরুল কায়েসের হাতের ছবি ছাপা হবে। যে হাত ছুঁয়ে আছে রিয়ার শরীর। টাকা উদ্ধার দিলে ইমরুল কায়েস সেটা মেনে নেয়। ইমরুল কায়েস জেনেছে তার শিক্ষা অর্জনে টাকা আছে, তার শিক্ষা প্রদানে টাকা আছে, তার শিক্ষক হওয়াতেও টাকা আছে। তাই সে বটতলার কাছে যায়, যে বটগাছ লাগিয়েছিল এক বা একাধিক প্রাচীন পুরুষ কিংবা প্রাচীন পাখির প্রাচীন মল। বটগাছতলার সবার পায়ে সে তার হাত রাখে নিজের হাতকে আরও শক্তিশালী করার জন্য। সে তো জানে পায়ে হাত না রাখলে সে হাত কখনো শক্তিশালী হয় না। হাতে তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করতে হয় না, হাতে পায়ের ধুলা নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়। কীসের শিক্ষক সে? তার পড়ানোর বিষয় কী? সে ইতিহাসের শিক্ষক। আর ইতিহাস যদি ধারণ করে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, শবনীতি—তবে সে সবনীতির শিক্ষক। পৃথিবীর ইতিহাস কি বটতলা থেকে মিছিল করে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সকল শরীরে, সকল হাতে? নিজের হাতের দিকে, ইতিহাসের হাতের দিকে সে তাকায়। হাতের চেয়ে বড়ো অন্ধকার সৃষ্টি করতে পারে না, বড়ো গল্প বলতে পারে না হাজার একরাত্রির গল্প।
ইমরুল কায়েস রাজধানীর সবচেয়ে সুন্দরতম ও বৃহত্তম মিষ্টির কথা বিবেচনায় এনে পরিশোধ করে মিষ্টির মূল্য। মিষ্টি দেখতে কিসের মতো? কেউ উত্তর দিলে জানা হয় মিষ্টি নানা রকম জ্যামিতির আকারের মতো। মিষ্টি একটা দশ তলা বাড়ির মতো—বাড়ি মিষ্টি। মিষ্টি একটা দোকানের মতো—দোকান মিষ্টি। মিষ্টি একটা শাড়ির মতো—শাড়ি মিষ্টি। বটতলার বক্তারা খায় বাড়ি মিষ্টি, দোকান মিষ্টি, শাড়ি মিষ্টি। তারা নক করে প্রতিটি মিষ্টিকে। বাড়ি মিষ্টি—নক করি, ভেতরে তোমার কে? দোকান মিষ্টি—নক করি, ভেতরে তোমার কে? শাড়ি মিষ্টি—নক করি, ভেতরে তোমার কে? ভেতর থেকে একটা অন্ধকার চাঁদ বলে—ও রিয়া, ও রিয়া। রাত শেষ হলে প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা বলে, আমাদের কাছে আছে রিয়ার শরীরের এক টুকরো মাংস। আর একটি পত্রিকা দাবি করে তাদের কাছে আছে রিয়ার কর্তিত স্তনের ছবি।
১৩.
এই প্রথা চালু এইখানে, এই বটতলায়, যারা বিজয়ী তারা বের করে বিজয় মিছিল, তারা নির্মাণ করে বিজয় ভাস্কর্য। হাত বিজয়ী হলে, তারা, হাত বাহিনী, বটতলা থেকে বের করে বিজয় মিছিল। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যাপন করে হাতের বিজয়কে। এই বুদ্ধি আসে কিছুদিন পর রাজধানীর বুদ্ধিজীবীদের ও শিক্ষকদের মাথা থেকে, রাজধানীর যে প্রান্তে সূর্যোদয় হয় সেখানে নির্মিত হোক সবচেয়ে বড়ো বিজয় ভাস্কর্য, হাতের ভাস্কর্য। আকার ও আয়তনে যেন তা পরাজিত করতে পারে মিশরের পিরামিডকে। মিশরের পিরামিড কিসের গল্প বয়ে চলেছে? বিজয়ের কিংবা পরাজয়ের। বুদ্ধিজীবীরা ঠিক যেতে পারে না মিশর অবধি। তারা হাতের কাছে নত হয় মিশরীয় শ্রমিকদের মতো, যারা নির্মাণ করেছিল পিরামিড, হাতের ক্ষমতাধরদের জন্য।
সরকারিভাবে নির্মিত হয় হাতের বিশালাকার ভাস্কর্য। সরকারি বুদ্ধিজীবীরা পত্রিকায় পত্রিকায় লিখে লিখে বিজ্ঞাপনে যায় এই ভাস্কর্যের। তারা সকল শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে এই ভাস্কর্যের ছবি ও বিজয় গাঁথা।
সকল ভাস্কর্যের একটা পরিচয় থাকলে, নাম থাকলে, হাতের এ ভাস্কর্যের নাম হয় স্ট্যাচু অব ডার্কনেস। কোথাও স্ট্যাচু অব লিবার্টি থাকলে সে কথা স্মরণ করে তারা এর নামকরণ করে। হাতের অন্ধকার দেখার জন্য দেশের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ভিড় করে স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে। এ ভাস্কর্যের জাদু এই যে, যে-ই তার নিচে দাঁড়িয়ে তার এক হাত কিংবা দুই হাত দেখতে চাইবে সে তা দেখতে পাবে না। নিজের হাত হারানোর আনন্দ থাকলে দেশের মানুষ নিজেদের হাত হারানোর জন্য দাঁড়ায় স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে। একটা চোর চুরি করে হাত হারাতে চাইলে, এসে দাঁড়ায় স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে। একটা খুনি খুন করার পর হাত হারাতে চাইলে এসে দাঁড়ায় স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে। একটা পুরুষ কারো শরীরে হাত দেওয়ার পর হাত হারাতে চাইলে এসে দাঁড়ায় স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে। ভাস্কর্য শিল্প যে জাদুবিদ্যাকে হার মানাতে পারে জানত কে আগে।
১৪.
আজ বিশ্ব মিষ্টি দিবস। গৃহে গৃহে মিষ্টি উৎসব। হাতে হাতে মিষ্টি উৎসব। যারা পৃথিবীতে বেশি বেশি মিষ্টি খাবার জন্য আর স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে দাঁড়াবার জন্য সর্বদা আয়ু ভিক্ষা করে, তারা মিষ্টি খাচ্ছে চিহ্নিত অচিহ্নিত সফল হাত দিয়ে। শহরে পাখি ওড়ায় হাতের মালিকেরা। আয়ুর পাখি। দেশের প্রধান মিষ্টি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় স্ট্যাচু অব ডার্কনেসের নিচে। একজন শিশু যে তার মাকে হারিয়েছে মিষ্টি খাওয়া শেখার আগে, আজ মিষ্টি খেতে গিয়ে সে বলে ওঠে—ও মা, ও রিয়া! মিষ্টি উৎসবকারীরা ভাবে নতুন গান—ও মা, ও রিয়া। তারা গান গায়—ও মা, ও রিয়া।
জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। লেখেন বিভিন্ন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : নিজকল্পা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : জল আসে মানুষের দীঘিতে, মানচিত্রকর, আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে, বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা, কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ। উপন্যাস : কেউ মরছে না ।