ঘরামী চালের ভাত
ও বউ ধান ভানো রে…ঢেঁকিতে পাড় দিয়া,
ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া,
বউ ধান ভানোরে….
ঘরামী চালের অন্ন, খেলে হবে ধন্য। গাঁ-গ্রামে এমন একটা কথা চালু আছে। আগে সবাই ঘরামী চালেরই ভাত খেত। তখন দিকে দিকে এত চাল মিল, মুড়ি মিল হয়নি। মিলের চালের এত কদরও থাকেনি। অনেকেই মুখ বেজার করে বলত, রাবারের মতো ভাত, কোনো স্বাদ নাই। মিলের চাল আবার চাল নাকি! ঘরামী চালের ভাতের স্বাদ কত! শুধু নুন ছড়িয়েও এক থালা ভাত পেঁয়াজ-লঙ্কা কামড়ে, আলুভাতে দিয়ে গব গব করে খাওয়া যায়।
মাঠের ধান খামারে উঠলে, সেই ধান ঝাড়াই-মাড়াই করে, কুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাতাস করে, কুটোকাটা তুষ পরিস্কার করে নেওয়া হয়। তারপর বড়ো বড়ো মাটির হাঁড়িতে ভরে ধান ভাঁপানো হয়। কারও কারও বাড়িতে স্টিলের কড়াই, ডেক, মাটির খোলা থাকত। মা-চাচিদের বছরে দু’-বার পড়ত ধান সিঁজানোর পালা। প্রথমে শুকনো ধান ভাঁপিয়ে নিয়ে ডাবাতে জল ঢেলে ভিজিয়ে রাখা হতো। পরের দিন ভোর ভোর উঠে চুলো জ্বেলে সেই ভিজে ধান সিঁজানো হতো।
ধান ভালো মতো ‘সিঁজে’ গেলে, মানে সেদ্ধ হয়ে গেলে খামারে মেলে দু’দিন তিনদিন ধরে চলত রোদ খাওয়ানোর পালা। ধান শুকিয়ে খটখটে না হওয়া পর্যন্ত কুড়ানো হতো না। ধান ভিজে থাকলে হাস্কিং মেশিনে চাল ভেঙে যে টুকরো টুকরো খুঁদচাল হয়ে যাবে।
খামারে ধান মেলে আমাকে মেচেতে বসিয়ে দিত মা। হাতে একটা লম্বা কঞ্চি ধরিয়ে দিয়ে মা রান্নাবান্না করতে চলে যেত। লম্বা কঞ্চিকে আমরা বলি ‘লগা’। সেই লগা ধরে এবার বসে বসে হাঁস-মুরগি, পাখপাখালি ‘খেদারো’। মানে তাড়াও। কোথাও যে একটু খেলতে যাব, ঘুরতে যাব, তার কোনো জো নেই। এমন শাস্তি ভালো লাগে!
মা যতক্ষণ খামারে থাকত, হাঁস-মুরগি, পাখপাখালি কেউ খামারে আসতে সাহস পেত না। ধান খাওয়া তো দূরের কথা। কাঠবিড়ালিগুলো গাছের ডাল থেকেই পুটুস পুটুস করে চেয়ে দেখত মাকে। পায়রাগুলো টিনের চাল থেকে মুখ বাড়িয়ে মাকে দেখে এমন ভান করত, যেন ওরা ধানই খায় না।
মা যতক্ষণ খামারে থাকত, হাঁস-মুরগি, পাখপাখালি কেউ খামারে আসতে সাহস পেত না। ধান খাওয়া তো দূরের কথা। কাঠবিড়ালিগুলো গাছের ডাল থেকেই পুটুস পুটুস করে চেয়ে দেখত মাকে। পায়রাগুলো টিনের চাল থেকে মুখ বাড়িয়ে মাকে দেখে এমন ভান করত, যেন ওরা ধানই খায় না। হাঁসগুলো পুকুর থেকে কলবল কলবল করে উঠে এসে যেই দেখল খামারে মা, তখন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ভদ্র ছেলের মতো হাঁটা দিত। যেন ওরা তো ধান খেতে আসেনি, অন্য জায়গায় যাওয়ার তাড়া আছে।
মা চুলোয় ভাত, তরকারি চাপিয়ে রেখেই মাঝে মাঝে খামারে এসে ধান নেড়ে দিয়ে যেত। ধান নাড়ার সে কী কায়দা! ধানের ওপর চরকি ঘোরা ঘুরে ঘুরে দুই পায়ের কারসাজিতে ধান উপর-নীচ করে দিত। ফলে উপরের শুকনো ধান তলে চলে যায়, আর ভিজে ধান উপরে। মা যেই চলে গেল, অমনি ভদ্র পাখপাখালির দল, কাঠবিড়ালিরা সুর সুর করে নেমে এলো। জানে তো খোকার ছোটো ছোটো হাত। লগা দিয়েও তাদের যে মারবে, নাগাল পাবে না। এধারে লগা চালালে, ও মাথায় হাজির হবে, আবার ও মাথাকে গেলে, এ মাথায়। কত আর সামলাবে!
জ্যোৎস্না ভাবি তখন হয়তো আমাদের বাখুলেই যাচ্ছে কলে জল আনতে। আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে ঢঙ করে বলল, ও আমার ছোটো নাগর। বলি ধানগুলো কি সব পাখ-পক্ষীর পেটেই ভরবে? কী মরদ হলে, সামান্য ধান আগুলতে পার না!
কলশিটা কাখ থেকে নামিয়ে ভাবি আমার হাত থেকে লগাটা কেড়ে নিল। তারপর আমার গাল টিপে দিয়ে বলল, শুধু বসে বসে খেলেই হবে! লি-মরদ!
জ্যোৎস্না ভাবি ধান নেড়ে দিচ্ছে। দুধে-আলতা রঙা পায়ে নূপুর পরেছে। পরেছে আসমানী রঙের শাড়ি। এখনও তো পুরনো বউ হয়নি। আমাদের বাখুলের একমাত্র নতুন বউ জ্যোৎস্না ভাবি। ধানের ওপর যত ঘুরছে, ঠুনঠুন করে নূপুর বাজছে। হাতের চুড়িগুলোও কী মধুর শব্দ তুলে!
জ্যোৎস্না ভাবি ধান নেড়ে দিচ্ছে। দুধে-আলতা রঙা পায়ে নূপুর পরেছে। পরেছে আসমানী রঙের শাড়ি। এখনও তো পুরনো বউ হয়নি। আমাদের বাখুলের একমাত্র নতুন বউ জ্যোৎস্না ভাবি। ধানের ওপর যত ঘুরছে, ঠুনঠুন করে নূপুর বাজছে। হাতের চুড়িগুলোও কী মধুর শব্দ তুলে!
খামারের পাশে মল্লিকদের বাপকালের পোড়োভিটেয় একটা নিমগাছ। নিমফল পেকেছে তখন। যত রাজ্যের পাখিরা এসে কিচির মিচির করছে। নিমফুলের উগ্র গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে নেশা ধরায়। একটা হলদে রঙা পাখি কোথা থেকে উড়ে এসে নিমগাছের টুগডালে বসল। পাখিটা ডাক পাড়ল—খুকির খোকা হোক…খুকির খোকা হোক…
ওমন ডাক শুনে জ্যোৎস্না ভাবির পা থেমে যায়। ঘাড় তুলে পাখিটাকে দেখে। সারা গায়ের পালক হলুদ, মাথা আর দুই ডানার পাশে কালো। যেন কেউ কাজল লেপে দিয়েছে।
পাখিটা পাকা নিমফল খায়। গালে নিমফল থাকে বলে ডাকতে পারে নাকো। চুষে চুষে নিমফল খেয়ে বীজগুলো ফেলে দেয়। দু-একটা গিলেও নেয়। তারপর আবার ডাকে, খুকির খোকা হোক…
মরিয়ম দাদি গোয়ালঘরের দেওয়াল থেকে ঘুটে ছাড়াচ্ছিল। ওখান থেকেই ফোড়ন কাটল, বলি ও নতুন গাঁয়ের মেয়েটা, ক’মাস চলছে লো?
লজ্জ্বায় জিভ কাটল জ্যোৎস্না ভাবি। ধ্যাৎ! তুমার কি মুখের কুনু আঁটসাঁট নাই দাদি!
কেনে লো! ছেলেপুলে কি লিবি নাই নাকি? পাখটা কী বলছে কান পেতে শুন। ওই হলুদ পাখি যখন ডেকেছে, দেখবি কোল আলো করে খোকা আসবেক। মিলিয়ে নিস।
কেনে চাচি! যদি খুকিই হয়, তাতে অসবিধা কী! মেয়ে বলে কি ফেলনা?
পাখিটা ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। ডানা থেকে খশিয়ে যায় একটা হলদে পালক। পালকটা বাতাসে উড়ছে। ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসছে নিচে। দৌড়ে গিয়ে কুড়িয়ে আনি। কী নরম পালক! বইয়ের পাতায় ভরে রাখব। কত পালক আমি জড়ো করেছি। মাছরাঙা, বাঁশপাতি, বসন্তবৌরি, বউ কথা কউ…
জ্যোৎস্না ভাবি কল থেকে জল নিয়ে হেলতে দুলতে চলে গেল। যাবার কালে আমার দিকে চেয়ে হেসে গেল। হাসিতে মুক্ত ঝরল। নূপুরের শব্দ হারিয়ে গেল। মুরগিরা কুক কুক করে হাজির হলো। পায়রার দল নেমে পড়ল তড়বড় করে। কাঠবিড়ালিরা মুখ তুলে পুটুস পুটুস চেয়ে দেখে, আর দুই হাতে ধান তুলে কুটুস কুটুস খায়। ফেলে যায় ধানের খোসা।
মরিয়ম দাদি বলল, বউটার মন ভালো। জাফিরুলে একটা বউ এনেছে বটে! ক’মাসেই সবার মন জয় করে নিল গো!
মায়ের রান্না করা হলে আমাকে ভাত বেড়ে দিয়ে খামারে আসে। বলে, থালা ঢাকা দেওয়া আছে। টপ টপ খেয়ে আয়। তুর খাওয়া হলে আমি খেতে যাব।
কী আর করা! মা যা বলবে তাই। মায়ের ওপর কথা চলে না। আব্বা তো সেই সকালে বেরিয়েছে ক্ষেতে কাজ করতে। ধান তোলার পর তিল লাগানো হয়। শীতকালে সরষে, পেঁয়াজ, ধনে, আলু। মাঠগুলো জিরেন পায় না। লাগাতার তাদের ফসল ফলিয়েই যেতে হয়। রাত্রে ফাঁকা মাঠে গেলে শুনতে পাবে হু হু করে বাতাস বইছে। কাসেম কাকা আমাকে বলেছিল, ও বাতাসের শব্দ নয় খোকা। মাঠগুলো রাতের বেলা কাঁদে রে। হু হু..হু হু…
একপেট রাক্ষুসে খিদে নিয়ে আমি গব গব করে ভাত খাই। থালা উটকে দেখি মা কী রান্না করেছে। আরে! আজ মৌরালা মাছ হয়েছে! বাগদিপাড়ার লখা কাকা আমাদের পাড়াতে মাছ বিক্রি করতে আসে। জাল নিয়ে কোথায় কোথায় না চলে যায়। শালি নদীর খাল-ডোবা, করমচাঁদের ঘাট, সিঙির নালা, ডহর, ছোটো ক্যানেল সর্বত্র তার বিচরণ। মাছ তাকে ডাকে। মাছের গন্ধ পেলেই সেখানে হাজির হয়ে যায়। তাই তো আমরা মাঝেমধ্যেই খেতে পাই—কই, পাঁকাল, ভেলে, চাঁদতারা, ল্যাটা-চ্যাং, গুঁতে, গায়েনতাঁরা মাছ। এইসব মাছ খেতে ইচ্ছে হলেও বাজারে হাটে তো সবসময় পাওয়া যায় না।
টমেটোর ফালি দিয়ে, পেঁয়াজ থ্যাঁকালে মা আঠা আঠা করে রেঁধেছে মৌরালা মাছ। সঙ্গে ‘বিড়ি’ কলাইয়ের ডাল। মানে বিউলি। আর টালির চালের লাউশাক, তিল দিয়ে খুরখুরি।
আমার খাওয়া হলে মাকে পাঠিয়ে দিই। মা খেয়ে আসে। বেলা বাড়তে বাড়তে রোদ পড়ে যায়। খামারে গাছের ছায়া পড়ে। দড়ি বাঁধা কাঠের পাটা দিয়ে টেনে টেনে ধান জড়ো করতে হয়। যদি না শুকোয় তো তিরপল ঢাকা দিয়ে দাও, কাল আবার রোদ উঠলে মেলে দাও।
আমার খাওয়া হলে মাকে পাঠিয়ে দিই। মা খেয়ে আসে। বেলা বাড়তে বাড়তে রোদ পড়ে যায়। খামারে গাছের ছায়া পড়ে। দড়ি বাঁধা কাঠের পাটা দিয়ে টেনে টেনে ধান জড়ো করতে হয়। যদি না শুকোয় তো তিরপল ঢাকা দিয়ে দাও, কাল আবার রোদ উঠলে মেলে দাও। আর শুকিয়ে গেলে জড়ো করে বস্তায় ভরে নিলেই হলো।
শুকনো ধান ভানাতে নিয়ে যেতে হবে সেই মানুষমারী, নাহলে উপর কাটনিয়া।
তখন পিক-আপ ভ্যানের এত চল থাকেনি। দাদোদের গরুরগাড়িটা জুড়া হতো ধান বওয়ানোর জন্যে। কম ধান হলে অপেক্ষা করা হয়, আরও অন্য কাকাদের ধান শুকানো পর্যন্ত। হাস্কিং মেশিনে ধান ভানানো তো আর একটা লোকের কম্ম নয়। দু’জন থাকলে অনেক সুবিধা হয়। একজন হোল্ডারে ধান ঢালো, আর একজন ধামা ধরো, চাল কুড়াও।
ধান ভানানোর দিনে আমিও যেতাম বাপ-কাকাদের সঙ্গে। সরু মোড়াম রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি চলত। ধান বস্তার ওপরে চুপ করে বসে দু-পাশের গাছপালা, বাড়িঘর দেখতে দেখতে, দুলতে দুলতে যাওয়া। গরুর কাঁধ থেকে জোয়াল খুলে গাছতলায় বেঁধে দিত আব্বা। আমি গাড়ির কাছে থাকতাম। দেখতাম কত দূর-দূরান্ত থেকে লোকে ধান ভানাতে এসেছে। কেউ কেউ সাইকেলের ‘ব’-এর ফাঁকে, পেছনের ক্যারিয়ারে দু-খুতি বস্তা ধান ঠেলে ঠেলে নিয়ে এসেছে। কেউ বা আমাদের মতোই গরুরগাড়ি নিয়ে।
ঘড় ঘড়..ঘড় ঘড়… শব্দে ধানকল চলছে। ভেতরে বাপ-কাকারা ধান ভানাচ্ছে। গাড়িতে বসে বসে ধৈর্যহারা হলে, মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি, আর ক’বস্তা বাকি আছে। কেউ গোপালভোগ ধান ভানাতে এলে আমার হাতে দু’টি আতপচাল দিয়ে বলত, যা চিবো গা।
ধানকলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে লাইন পাওয়া যায় না। যে যখন আসে পর পর ধান ভানিয়ে দেয় ধানকলের মালিক। কেমন ছাট লাগবে বলে দিতে হয়। কেউ কেউ আ-ছাটা চাল করে। ঢেঁকিতে কোটা চালের মতো। ভাতের ফ্যান হয় ‘গাঢ়ালো’। মানে মোটা।
বটতলায় যারা ধান ভানানোর জন্যে অপেক্ষা করে, তারা বসে বসে নানারকম গল্প করে। এ-গাঁয়ের ও-গাঁয়ের খবরাখবর চালান হয়। কেউ কেউ ফুক ফুক করে বিড়ি খায়।
ধান ভানানো হয়ে গেলে চালের বস্তা, কুড়োর বস্তা পিঠে করে বয়ে এনে গাড়িতে লোড করত বাপ-কাকারা। গাড়ি লোড হলে কাছের চা-চপের দোকানে চপ-মুড়ি খাওয়া হতো। চপ-মুড়ি খেয়ে ফেরার পালা।
নতুন চাল নিয়ে যখন ঘরে গাড়ি ফিরত, মা-কাকিদের তখন কী আহ্লাদ! আর মাঠের পানে চেয়ে চেয়ে অপেক্ষা করতে হবে না। ছ’মাসের চিন্তা ঘুঁচল। ঘরে নতুন ধানের চাল এলো। খালি হাঁড়ি ভরতি হবে। চালের ড্রাম ভরতি হবে। ঘরামী চালের ভাতের গন্ধে ম-ম করবে গৃহস্থের বাড়ি।
হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘আজরাইলের ডাক’। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন ‘প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান’। ২০২১ সালে ‘আজরাইলের ডাক’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন ‘দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান’। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।