পরম পূজনীয় অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে এসে প্রথমে ছিলেন ন’গরিতে। দুই বছর য়্যাংচুব ঊ’র শিষ্যদের তিনি ধর্ম, বুদ্ধ ও জীবন নিয়ে দীক্ষা দিয়েছেন। দু’বছর পর তার ভারতে (বিক্রমশীলা) ফেরার কথা। য়্যাংচুব ঊ তাঁকে অনুরোধ করেন শেষ বারের মতোন কিছু উপদেশ দিতে, একটি ভাষন দিতে। অতীশ বললেন, প্রয়োজনীয় উপদেশমালা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু য়্যাংচুব নাছোড়বান্দা। ফের অতীশ মুখ খুললেন। নিচের কথামালাগুলিই অতীশের সেই দেশনা।
অমৃত বচন!
প্রিয়সখা, এতো কম জানি আমি। আমার কাছে জ্ঞানের কথা জানতে চাওয়ার আর প্রয়োজন দেখি না। জ্ঞানী আপনারা, যা কিছু জেনেছেন তা জলের মতোন স্বচ্ছ জেনেছেন। তবু সহৃদয় বন্ধু অনুরোধ করলেন কিছু দেশনা দিতে। আমি আপনাদের কাছে হৃদয় খুলে কিছু কথা বলছি। খুব সহজ কথা, শিশুর মতোন সরল কথা।
প্রিয় সুহৃদ, আপনারা জানেন অপার্থিব আলোর দিশা পেতে একজন দিশারীর দরকার। একজন দীক্ষাগুরুর পথ নির্দেশনা বড়ো প্রয়োজন।
পরম সত্যের কাছে পৌঁছাতে হলে শুনতে হবে, গুরুর কথা। শোনার বিকল্প নেই। তাঁর নির্দেশনাবলীই তো একমাত্র পাথেয়।
-
- ধর্ম ছাড়া বুদ্ধের কোনো হদিস নাই। তাই ধর্মকে বুঝতে হবে সর্বান্তকরণে।
- তোমার মন যেখানে ভ্রান্তিতে পড়ে, সবার আগে তাকে ত্যাগ করো। সদগুণ যেখানে বাড়ে সেইখানে থাকো।
মনকে বশে রাখো। পার্থিব আমোদ ক্ষতিকর। আমোদ-প্রমোদের বিবিধ আয়োজন তোমার বোঝাপড়া এলোমেলো করে দেবে। - আর মনে রেখো, তেমন বন্ধু পরিত্যাজ্য যার সাহচর্য তোমার চিত্ত বিকলনের কারণ ঘটায়। সৎ সঙ্গ করো।
- জগৎসংসারে কাজকর্মের অন্ত নাই। অতএব সাংসারিক কর্ম গুটিয়ে আনো।
- মনের ঘরে পাহারা বসাও। রাতদিন সে যেন সৎকর্মে নিবেদিত থাকে।
- আপনারা দীক্ষা নিয়েছেন, যখন ধ্যানে নেই তখনো সদগুরুর কথা মানতে হবে।
- মন দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে চর্চা করলে হাতেনাতে ফল পাওয়া সম্ভব। সেজন্যে দীর্ঘকাল অপেক্ষায় থাকতে হয় না।
- হৃদয় দিয়ে ধর্ম করলে খাদ্য আর সমৃদ্ধি আপনিই আসে।
- বন্ধুরা, ব্যাকুল বাসনার তৃষ্ণা মেটে কী সাগরের জলে? অতএব সবটা দিয়ে, পুরোটা দিয়ে এই চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।
- মনে উদ্ধত অহংকার ঠাঁই দিয়ো না। মনকে বশে আনো এবং প্রশান্ত হৃদয়ে থাকো।
- পাণ্ডিত্ব্যের গাম্ভীর্য এড়িয়ে চলো। ধর্মের পথে ও বড়ো বাঁধা।
- অপরের ভক্তিশ্রদ্ধা অর্জনের আশা ত্যাগ করো। এ-ও এক রকমের ফাঁদ।
- খ্যাতি বা প্রশংসায় ফাঁপা বুলিতে কান দিও না। এসব কাছে এলে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দাও।
- সুখ, সমৃদ্ধি, বন্ধুতা অর্জন সকলই ক্ষণিকের। এদের মায়া ত্যাগ করো।
- ভবিষ্যৎ কাল এক লম্বা সময়। সবকিছু তোলা থাকুক তার জন্যে।
- সবকিছু একদিন ছেড়ে যেতে হবে। কোনো কিছুতে বাঁধা পড়ো না।
- দুস্থ, হীন জনের সমব্যথী হও। তাঁদেরকে অবজ্ঞা করার হাত থেকে রেহাই নাও।
- শত্রুর জন্যে বেদরদী হয়ো না, নয় বন্ধুর জন্যে বাড়তি দরদ।
- অপরের গুণাবলীকে ঈর্ষা করো না। বরং তা নিজের করে নাও।
- অন্যের খুঁত ধরতে যেয়ো না। বরং নিজের খুঁতগুলো খুঁজে দেখো আর শুধরে নাও।
- নিজের গুণাগুন নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। বরং অন্যের সদগুণগুলির পরিচর্যা করো।
- জগতের সকল প্রাণ সমুদয়কে পিতা-মাতা জ্ঞান করো। আর তাঁদের ভালোবাসো আপন সন্তানের মতোই।
- সদা হাসি মুখ, হৃদয়ে প্রেম জাগরূক আর কন্ঠে থাকুক সত্যবচন।
- নিরর্থক বকবক করো না, তাতে ভুলভ্রান্তির সুযোগ বাড়ে। বাক্ সংযম করো, কথা বলো প্রয়োজনে।
- একসঙ্গে হাজারটা কাজকর্মে জড়িয়ো না তাতে পন্ডশ্রম হবে। সাধন হবে না— এমন যা কিছু কাজ ছাড়ান দাও।
- অর্থহীন হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি কোনো কাজের কথা নয়। আখেরে সব কাণ্ড মিছে।
- মন সায় না দিলে কর্মযোগে শামিল হয়ো না। তারচে’ বিশ্রাম ভালো।
- পূণ্য আত্মার বিরাগভাজন হওয়া থেকে বিরত থাকো, এরচে’ মরণ ভালো। তাঁর কাছে সৎ ও সরল থাকা জরুরী।
- অন্যকে দুষো না। এই জন্মের যা কিছু সুখ কিংবা যাতনা সবই যে তোমার আপন কর্মফল।
- সব সুখ আসে সদগুরুর আশীর্বাদে। কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁর দয়া দক্ষিণার কথা মনে রাখো।
- আগে নিজের মনকে বশ করো। আপন মন বশে এলে তবেই অপরে তোমার কথা শুনবে।
- সমৃদ্ধির নামে ভ্রান্তির পাহাড় গড়ে তুলো না। অর্জন-বিসর্জনের ফারাকটুকু বুঝতে হবে।
- উন্মত্ত আমোদ কার্যত অসার। সেজন্যে মগ্নভাবে চর্চা করো।
- সকল সময় নৈতিক অনুশাসনগুলো মেনে চলো। এগুলিই জীবনে সুন্দরের খোঁজ দেবে এবং জীবনান্তে সুখের ঠিকানা।
- অস্থির এই সময়, হানাহানি চারিদিকে। তবু তুমি রাগ ছাড়ো, ধৈর্যের বর্ম পরো।
- জগৎসংসারে জুবুথুবু পড়ে আছো। এবার আপন শক্তিতে জীবন-প্রদীপ জ্বালাও।
- বিক্ষিপ্ত প্ররোচনায় বৃথা যায় মানব জনম। এখনই সময় সুস্থির সঞ্চরণের।
- ভুলের কুয়াশায় দেখা হয় নাই, জানা হয় নাই প্রকৃতির আসল চেহারা। সঠিক রূপটি তার চিনে নেওয়া চাই।
- সংসারের প্যাঁক-কাদায় সুখ নাই কোনো। এবার চলো পা রাখি মুক্তির কঠিন মৃত্তিকায়।
- সদগুরুর উপদেশ মেনে ধ্যানমগ্ন হও। সাংসারিক দুঃখের নদীর অবসান হোক।
বন্ধুরা, আপনারা দয়া করে, এসকল কথাগুলিকে শুধু আমার মুখের কথা নয়, হৃদয়ের আরক্তিম উপদেশ হিসেবে মনে করবেন, সেই অনুরোধ করি। আপানারা তা আমলে আনলে আমি শান্তি পাবো, আপনারা সুখী হবেন, সুখী হবে অন্যেরাও।
আমার মতোন এই অজ্ঞানীর উপদেশটুকুকে আপনাদের হৃদয়ে স্থান দিলে আমি ধন্য হবো।
টেলিভিশন নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা।