ইশরাতের পেঁচারা
কবরে মৃত বন্ধুকে নামাতে গিয়ে দেখি
তার একটা পা নেই!
দূরে, মেঘে ফেলে আসা তার প্লাস্টিকের পায়ে
পায়ের স্মৃতিতে বসে আছে বাসনাবিরল এক পেঁচা,
আমাদের বাঘনখ ফুটে ওঠার দিনগুলোতে
পেঁচা বলতে তুমি
জীবনানন্দের প্রায়-অবাস্তব হিম রেশনকার্ডকে বুঝতে,
আর আমি সায় দিয়েছিলাম… ভাষণ দিতে দিতে লেনিনের
টুপি খুলে ফেলা হলো অদৃষ্টবাদী পেঁচা
হৃদয়ভার নিয়ে এরপর আমরা
অপছন্দের গানগুলি দু’লাইন করে গাইতে থাকি
বাঁধের উপর উল্কার পতন কুড়াতে কুড়াতে
আর হন্টেড সাবওয়েতে
কয়লার স্তুপে কারা যেন পোড়াচ্ছিল ভ্যানবোঝাই পুলিশ
যারা কিনা কালরাত্রি হয়ে ওঠছিল এ বদ্বীপে,
তার পাশ দিয়ে বোর্হেসের গল্পের টীকাটিপ্পনীর সাথে
তুমি ছুটে গেছো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের দিকে
আর আমি স্প্যানিশ জানতাম না বলে
অন্ধত্বের বাইরে বোর্হেসকে সাক্ষাৎকার দিতে শুনি নি কখনো
তোমার নাট্যকালীন সন্ধ্যাগুলোতে
যেভাবে টিকিট বিক্রি করবার ছলে
তোমার শীতের লম্বা কার্ডিগান আগলিয়ে রেখেছি আমি
গ্রিনরুমের চৌকো আয়না হয়ে, মুমূর্ষু তারাদের মতো
দর্শকদের জুতায় স্যান্ডেলে আটকে যাওয়া
আধেক টিকিটগুলির পানে তুমি ফিরেও তাকাও নি,
হলরুমে ঢোকা বারণ ছিল বলে
আমার বিহ্বলতা আমার নয়ন ছড়িয়ে দিয়েছিলাম
ছেঁড়া টিকিটগুলোর সিলে, অর্থহীনতায়…
মঞ্চে শাঁখীর আনা কারেনিনা হয়ে ওঠা দেখবে বলে
পেঁচা বলতে তুমি জীবনানন্দের মরা ধানসিঁড়িকে
জড়িয়ে এনেছিলে চুলের কাঁটায়,
নারীমুক্তি বিষয়ে একটা জার্নাল লিখতে সে তোমার
খোলা চুলে, অবিশ্বাসে, নাইটির তীর্থস্থানগুলোতে
লাজুক ড্রাকুলার মতো হানা দিতে চাইছিল
পেঁচা বলতে তুমি মানুষের মৃত্যুমূহুর্তকে
যাবতীয় ইগনোরেন্স দিয়ে শ্বেতচন্দন দিয়ে
নিঃস্বতার ভঙ্গির মতো থামাতে চেয়েছিলে,
অথচ তোমার কাজলমাখা চোখ… দেখি কী,
ঘাইহরিণীর শিং-এ এসব পাজলট্রাম্পেট বেঁধে
তার চারদিকে সাম্বা নেচে ক্যাম্পফায়ারে মেতে উঠছে!
উৎপলের বাদামপাহাড়ে, ভেঙে পড়া যুদ্ধবিমানে
আটকে যাওয়া মেঘে সংসারপাতা পেঁচার মতো
তুমি কি পারবে জেন কবিতার সন্ধিডাক পেরিয়ে
মডিগিলিয়ানির শেষ ছবির চিরনৈ:শব্দ্য হয়ে উঠতে?
ওগো চিরপ্রণম্য পাথর, আমিও কি পেরেছি
তোমার ছেঁড়া লাল ব্রার স্ট্র্যাপ উজিয়ে
চারদিকের জ্বলন্ত ফুয়েলস্টেশন ডিঙিনৌকায় ভাসিয়ে দিয়ে
‘জগতে সকল প্রাণী সুখী হোক’ বলতে বলতে
তোমার পঞ্চমীর চাঁদে উপলক্ষহীন দুয়ার হয়ে উঠতে?
অসংরক্ষিত হৃদয় হয়ে উঠতে পেরেছি কি?
ডায়নোসরের চেয়ে সাড়ে তিন হাজার বছর পুরনো
ওগো আদিম বিষণ্ণ পেঁচা,
রোমান দেবী মিনার্ভার হাতের ইশারা থেকে তুমিই কি
জ্ঞান ও ম্যাজিকের বিদ্যা নিয়ে এসেছিলে?
নাকি গ্রিক দেবী এথেনার বাহন হয়ে প্রজ্ঞা ও শান্তির বার্তা
প্রচার করতে এসেছিলে এ ভূভারতে?
শুধু জানি, সেকেন্দারের পরে এথেন্সের শাসকদের
ধাতব মুদ্রায় ও দাসের বাজারে তুমিই ছড়িয়ে পড়েছিলে…
ওগো মা লক্ষ্মীর পথ, পেঁচা, একাকী।
যেভাবে ভাস্কর তার ছুঁচালো জিভ দিয়ে
দেবীর নাভি ও নির্জনতা খোদাই করে,
যেভাবে নারী সৈনিকের বেয়োনেট
আধুনিকতার সব আলোক, করতালি কেটে-ছেঁটে
বোধিবৃক্ষের পিছনে স্তুপ করে রাখে,
যেভাবে বৈঠকি গানে অন্যমনস্ক শ্রোতারা
মেয়েদের ব্রাহ্মকলেজের চৌকাঠে হোঁচট খেয়েছিল
যেভাবে মেরুজ্যোতিমুখর অঞ্চলে
বরফ গলতে গলতে নৌ বিদ্রোহের শহরে রূপ নেয়,
যেভাবে একটিমাত্র পাতা চিবিয়ে রসটুকু খেয়ে
খোদাপ্রেমে সাতদিন পার করতেন হাজি শরীফ জিন্দানি,
যেভাবে কথাকলি নৃত্যের মাঝ দিয়ে
পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে পড়ুক রংমশাল মিছিল
সেভাবে আমি তোমার পোস্টমডার্ন পেঁচাদের
নিজের সন্তানের মতো, পূর্ণিমা ঘনিয়ে এনে
ঘরে-বাইরে, যৌথ অবচেতনায়
লালনপালন করে যাচ্ছি, তোমার আয়নায়
তবু ব্যাটারির কারখানা থেকে সিসা ছড়াচ্ছে,
গিলতে হচ্ছে দস্তইয়েফস্কির অসফল চলচ্চিত্ররূপ।
দরিয়ায় গ্যাসফিল্ড, বাণিজ্যপথ লুঠ করছে
এ্যাডোনিসকে নোবেল দিল না যারা,
তবু মিলুর ৪২৭২ পৃষ্ঠার লিটেরেরি নোটসের মহিমা
ছায়পথে এ্যান্টিম্যাটারের নতুন উৎস পাওয়ার চেয় কম নয়
যে শহরে প্রজাপতির জন্য মায়া নেই
সেখানে মানুষের যামিনী লুকাবার মতো সহৃদয় কোথায়?
যে বন্দরে যুদ্ধাহত শিশুর জন্য কোন অলীক সাম্পানও ফেলে নি পাটাতন
সেখানে বিশ্বাস ব’লে কোন শুশ্রূষা জন্ম নেয় কি?
যে স্পেসস্টেশনে এলিয়েনদের প্রজনন বিষয়ে তর্ক জারি থাকে না,
সে আসমানে কৃষ্ণগহ্বরের পীড়ন ও ছড়ানো পালকের পাশাপাশি
বাবা নিজামুদ্দিনের শামাগানের আসর জমে উঠবে কীকরে?
বেইজ জাম্পিং ছাড়া কীকরে জানতাম,
সেলুলার সভ্যতার পানে টানা বক্রোক্তি ছুঁড়ে মারা
পেঁচার গহিনে বাস করে এক অবাঞ্ছিত চৌকিদার?
ইতিহাসের প্রাচীন অলিতেগলিতে
জোড়া ময়ূরের ট্রাপিজিয়াম বিক্রি করতে করতে,
যেন সময়হীন শ্লেষহীন এক দুনিয়ায়
বুদ্ধের নির্বাণপ্রাপ্তির মতো
চন্দ্রপঞ্জিকায় জেগে ওঠা এক আশ্চর্য সবুজ পাহাড়
তোমায় কুড়িয়ে এনে দিব
একদিন সেই পাহাড়জুড়ে ফুটে থাকবে শ শ পেঁচা,
তোমার হাতে ভেসে উঠবে আমার আয়ুরেখা,
শুধু নীল নয়, তোমার নিত্যবাসনার বাইরে
আর কোথাও রইব না আমি
পরজন্মে নাহয় তোমার পেঁচা হয়েই ফিরব,
কুড়িয়ে নিও
বাংলা কবিতায় অমিত রেজা চৌধুরীর উত্থান নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে, বগুড়ায় বসবাস করেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা— বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিচরণ অবাধ। একসময় দেশের প্রথিতযশা লিটলম্যাগাজিনগুলোয় লিখেছেন নিয়মিত। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথেও ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত ছিলেন এবং এখনও সেই বিশ্বাস লালন করেন। কী এক অজ্ঞাত কারণে গদ্যরচনার জগৎ থেকে এখন অনেকটাই দূরে অবস্থান করেন। কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।