.
প্রিয় সত্য, আমি তোমায় ভালোবাসি
কুয়াশায় মোড়ানো এক স্থগিত হয়ে যাওয়া শিল্পাঞ্চল—
তার লেদ, তার কার্গো, ইস্পাতের পুরু পাত, ড্রিল মেশিন,
এখনো উৎগিরিত হওয়া গ্যালভানোমিটার, সোলার সিস্টেম,
লে অফের নিচে চাপা পড়া মাদ্রাসা-পড়ুয়া
মেয়েটির তড়িঘড়ি বিয়ে এবং গর্ভপাত
প্রিয়, আমি ভালোবাসি তোমার সত্য।
ভূমি অধিগ্রহণের নামে আদিবাসী-নিধনের উপর গড়ে ওঠা
এক পাহাড়ি রিসোর্টের গল্প নাহয় না বলি!
কাঁটাঝোপে জব্দ হওয়া শনিবারের মেঘে চমকানো বজ্ররেণু,
প্রেতসাধকের জ্যান্ত খুলিতে জমা শোচনা ও কস্তুরী,
অমৃতার হ্রদে স্নানে নেমে স্মৃতিখোয়ানো
এক যুবা গণ্ডারের শিঙে আটকে যাওয়া
ত্রিকাল ও তামাম অধিবিদ্যার ভবিষ্যৎ
প্রিয়, একমাত্র তোমাকেই স্বপ্নাদিষ্ট জেনেছি।
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে মোরাল পুলিশিঙের মতো,
ভোটের আগে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট মামলায়
সাজানো বাদিনীর বাইপোলার ক্রাইসিসের মতো,
বন্ধুদেশের আরোপিত সামরিকচুক্তির মতো স্নিগ্ধ,
উপমার সকল অসম্ভাবনার মতো তীব্র
প্রিয়, তাবৎ বাইনারি হতে মুক্ত করতে চেয়েছি তোমায়।
আমি সেই প্রাচীন দাসদের ছেনির কথা বলব,
যারা সম্রাটের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে গিয়ে
সেই বিদ্রোহী ম্লেচ্ছরমণী,
যার খঞ্জরে মহান অধিপতি মৃগয়ায় খুন হয়েছিল,
সে নারীর তামাটে মুখ ফুটিয়ে তুলেছিল সে স্তম্ভে!
প্রিয়, সেই প্রতিবিপ্লবী দাসদের মনোদ্যুতির আড়ালে
এত শত বছর ধরে আমিই সেই বীরঙ্গনাকে ভালোবেসে এসেছি,
তোমায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় অধিষ্ঠান করব বলে।
প্রিয়, তোমার এথিকসের বাইরে আসা ন্যুডিটি
আমি ঈর্ষা করি, তোমার নিতম্বে আটকে পড়া
মিলনোন্মুখ লেডিবাগদের ফ্রেসকো আমি ঈর্ষা করি,
তোমার নাভির নিচে যে নবী ধ্যানস্থ সত্তর হাজার ডানায়…
তাকে স্নেহবঞ্চিত জ্যোতির মতো, লীন চুম্বনের মতো
মওলা হোসাইনের রক্তবীজের মতো ভালোবাসি
প্রিয়, তোমার কলোনিয়াল মূল্যবোধ আর সভ্যতাচুল্লী
আমি অন্তঃপুরের আজ্ঞাবহ খোজার মতো
মাকামে মাহমুদায় বয়ে নিয়ে চলেছি,
পেত্রা নগরীর হেরেমে বলৎকারের হাত থেকে বাঁচিয়ে
তবু ট্রিনিটির আশ্রম জানল না, সঞ্চিত ধূলিঝড়,
গন্ধবণিকও জানল না— এ আড়াল গন্ধরাজের আয়ু!
“কতদিন যে পেট ভরে খাই না…!”
খাওয়াটা বড়ো কথা না,
বিষয় হইল, এই আক্ষেপগুলা কই যায়?
তারা কি ফিরে আসে আবার? অন্য কোনো প্যারাডাইমে?
মাইনষের বাড়িতে রোজ খাইতে আসা দুইটা ঘুঘুর শনিবার বলল,
“পেট ভরে খাইতে পারেন না, তাইলে আমাদের খান!”
খাওয়াটা বড়ো কথা না,
বিষয় হইল, আমাদের না দেখা হরিণগুলা আপনাদের ছুরি-নদী পার হইতে পারছিল তো?
প্রিয়, তোমার আলট্রা ভায়োলেট অন্তর্বাস আমি
বুনে চলেছি টারান্টুলার জালে আর তাদের জোড়া দিচ্ছি
আমার ফুরিয়ে আসা ব্যাকুল শ্বেতকণিকায়
তবু, আমার জাহাজ তুমি পুড়িয়ে দিয়েছ!
নতুন ভূখণ্ডে বাণিজ্যবিস্তারের কালিমা নিয়ে ফিরতিপথে
পিগমিদের কথ্যভাষায় করা প্রতিবাদ রপ্ত করেছিলাম বলে
আমার জাহাজ তুমি পুড়িয়ে দিয়েছ!
নাস্তিকের অশ্রুতশোভা থেকে নেমে আসা একঝাঁক মধ্যআকাশ দিয়ে
বিয়োগচিহ্নের নির্জনতা ভরিয়ে তুলছিলাম বলে
আমার জাহাজ তবু তুমি পুড়িয়ে দিয়েছ!
নূহের হাতের অলৌকিক লাঠিটি
সমকামী ফারাও রানির নাভিতে লুকিয়ে রেখে এসেছিলাম বলে
আমার সমুদ্রও তুমি পুড়িয়ে দিয়েছিলে,
ব্যাঘ্রকুহেলির মতো তোমায় অসহ্য ভালোবাসি বলে।
ঋণমুক্ত বিদেশী সাহায্যের জেল্লার মতো
প্রিয় প্রতিবিম্ব, তোমায় আমি বিস্মরণ থেকে বাঁচিয়ে চলেছি
যেভাবে ব্রাহ্ম সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে মূলনীতিগুলো,
যেভাবে কার্বন ডেটিঙের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছি
ওকাম্পোর গুহায় আঁকা তোমার বিরহচিহ্নিত কাটাহাতের ছাপ,
যেভাবে যোডিয়াক চক্র আমাদের বিশ্বাসী করে তুলেছে
এলিয়েনদের যৌনতা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চিহ্নের প্রতি,
যেভাবে কুবো পাখির জলের-উপর-নেচে-চলা ডাক শুনে
ভাইকিং জলদস্যুরা ইতিহাস বদলের সিদ্ধান্ত নিত
প্রিয়, অপ্রচলিত লজ্জার মতো আমি তোমায় ভালোবাসি।
যে রেললাইন কখনো পেরুতে পারেনি তোমার সন্ধ্যা,
যে পেট কেয়ার সেন্টারে আমাকে কফির সাথে
খেতে দিয়েছিল কুকুরের বিস্কিট আর গথিক হাড়,
যে ব্যাংক চেক শুধু তোমার ফর্সা নারীবাদী আঙুলের স্পর্শ পাওয়ার জন্য
হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে এ শাখা থেকে ও শাখায়,
যে মাতৃভাষায় চড়কের তুরীয় নিবেদন বোঝান যায় না…
তার বেহাত শ্রাবণ,
যেসব শস্যবীজ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কেউ ক্রসফায়ারে
গর্ভহারানো মার মতো হাত-পা ছেড়ে বিলাপ করেনি
সে লড়াইয়ে নিজের দু স্তন কেটে তুমি নাঙ্গেলি হতে পারবে?
তবু তোমার ধারণা আমি জড়িয়ে বাঁচি—
দেয়ালে মৃত ভাইটির আঁকা কয়লাছবিতে প্রশান্তি…
যা ক্রমশ আলোহীন হয়ে পড়ছে, সেই ছবির কুহুর মতো,
পুরনো বইয়ের দোকান… ল্যাটিন মিউজিকে অপ্রত্যাশিত রিদমের মতো,
পশ্চিমের মোকাবিলায় চীনা বাণিজ্যনীতির মতো
তোমায় অমুখস্থই রাখি ওগো উজ্জয়নী!
এ নেটিভ দুনিয়া আর বেশিদিন নেই, নিঃস্ব হয়ে যাবে
মানুষের অন্তর্গত খেয়া ও ফিরিঙ্গিপাড়া—
সেদিন বিষাদসিন্ধুর অধিবাস্তবতা থেকে
লুসিড ড্রিমের দেশে আমিই তোমার গদ্যভাষায়
লাল পেঁচার দুয়ার ছড়িয়ে রাখব
প্রিয়, আমি তো তোমারই প্রতিশ্রুতি, মনে রেখো
বাংলা কবিতায় অমিত রেজা চৌধুরীর উত্থান নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে, বগুড়ায় বসবাস করেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা— বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিচরণ অবাধ। একসময় দেশের প্রথিতযশা লিটলম্যাগাজিনগুলোয় লিখেছেন নিয়মিত। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথেও ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত ছিলেন এবং এখনও সেই বিশ্বাস লালন করেন। কী এক অজ্ঞাত কারণে গদ্যরচনার জগৎ থেকে এখন অনেকটাই দূরে অবস্থান করেন। কোনো বই প্রকাশিত হয়নি।