মেয়েটি স্বয়ং এবং তার বয়স একসঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে বলে মনে হয়নি। তার বয়স চলমান এবং নিশ্চিত যে তা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল স্বয়ং সে যেন কোন এক অমনোযোগী বিষণ্নতায় হারিয়ে গেছে। কখনও সে অনুভব করেছে যে তার বয়স তাকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে এবং সে এক জায়গায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় তার মনে হয়েছে যে তার বয়স, ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত, প্রতিদিন একটু একটু করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অথচ স্বয়ং সে তারচেয়ে অনেক সামনে কোথাও চলে গেছে।
মেয়েটি এগিয়ে ছিল, নাকি পিছনে ছিল, তা সে জানত না। কিন্তু সে মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করছিল যে তার বয়স কুড়ি বছর, একসময় বাইশ এবং পরে জীবনের চব্বিশতম বছর অপরিবর্তিত ভাবে কেটে গেছে। সে দেখছে তার জীবনের পঁচিশতম বছর পেরিয়ে এখন ছাব্বিশতম বছরে এসেছে।
সে অনুভব করেছে যে তার বয়স তাকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে এবং সে এক জায়গায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সময় তার মনে হয়েছে যে তার বয়স, ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত, প্রতিদিন একটু একটু করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অথচ স্বয়ং সে তারচেয়ে অনেক সামনে কোথাও চলে গেছে।
মেয়েটি তার যৌবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়ে পৌঁছেছে। অথচ সে নিজের মধ্যে শীতলতা এবং শান্তি অনুভব করে। আজ ক্লাবে অপরাহ্ণের ছায়া গাঢ় হওয়ার সময় তার মনে হয়েছে যে, ঘাসগুলো তার মতোই শীতল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল টেবিল থেকে কয়েক গজ দূরে একটি প্রদীপ, যা উজ্জ্বল আলোকরশ্মি বিকিরণ করছিল, এবং টেবিলে উপর পড়ে থাকা গরম কফির কাপ।
ছেলেটি মেয়েটির পাশের চেয়ারে বসেছিল। ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগে মেয়েটির ভাই মন্তব্য করেছিল, ‘সীমা, তার মতো সুদর্শন আমি কাউকে দেখিনি, এমনকি যেকোনো অপ্সরী রাজকন্যাও তার দিকে তাকালে মুগ্ধ হবে। সে খুবই সুন্দর চেহারার পুরুষ।’
‘সত্যি! যদি তাই হয়, তাহলে আমিও তার দিকে তাকাব,’ মেয়েটি হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছে।
ছেলে এবং মেয়েটির মা-বাবা উভয়ই গত হয়েছেন। সুতরাং মা ও বাবার পক্ষে ভাইটি বোনের দায়িত্ব নিয়েছে। সে উদ্বেগের সঙ্গে সীমার বেড়ে ওঠার প্রতি দৃষ্টি রেখেছে। বোনের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য সে তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভাইয়ের বন্ধুদের সঙ্গে বসে এক কাপ চা পান করা ছাড়া তার অন্তরে অন্য কোনো ধরনের অনুভূতি সে খুব কমই উপলব্ধি করেছে। আর আজ, যেমন একজন মা তার মেয়েকে পরামর্শ দিতে ভেতরে যাচ্ছেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সে বোনকে সেই ধরনের পরামর্শ দিয়েছে। পথের মাঝে সে তার গ্রহণ যোগ্যতা নিয়ে হেসেছিল এবং বারবার বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমি ভবিষ্যত পরিকল্পনা এবং পেশা নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করব— তার প্রিয় খেলাধুলা সম্পর্কে… চলচ্চিত্র… বইপুস্তক… রং…’
মেয়েটি তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। আর যখন ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সে ভাইয়ের দিকে এমন দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল যেন সে ভাইয়ের প্রশংসা আশা করেছিল। কেননা সে তার কথা রেখেছে।
একটু পরে মেয়েটির ভাই পাশের টেবিলে বসা অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিতে উঠে যায়। মেয়েটি নিজেকে পরিত্যক্ত মনে করে। অল্প সময়ের মধ্যে তার ভেতরের শীতলতা ক্রমশ টেবিলের উপর ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় তার উপর নজর রাখার মতো কেউ ছিল না। তাই তার প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রয়োজনীয়তাও ছিল না। কিন্তু তারপর মেয়েটির মনের মধ্যে সন্দেহ জাগে… সে তার প্রতিশ্রুতি ভাঙছে। যাহোক, সে কোনোভাবে কথাবার্তার রেশ খুঁজে পেয়েছে।
মেয়েটির বয়সে যৌবনের আগুন ছিল। সেই আগুন কাঠের জ্বলন্ত আগুন নয়, যা বাতাসের ঝড়ো হাওয়ায় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে, অথবা কেউ ফুঁ দিয়ে জ্বালাবে। সে ঠান্ডা কাচের মধ্যে মোড়ানো আগুনের মতো ছিল, যা চারপাশে প্রজ্জ্বলিত কিন্তু অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হতে পারেনি— এমনকি সবুজ পাতায়ও আগুন ধরাতে পারবে না।
ছেলেটি মেয়েটির দিকে কয়েকবার দীর্ঘ সময়ের জন্য তাকিয়েছিল এবং অনুভব করেছিল যে, সে মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কথাটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল, ‘তুমি অনন্যা।’ কিন্তু সেই মুহূর্তে অসতর্কতার জন্য তার হাত মেয়েটির হাত স্পর্শ করেছিল। তখন ছেলেটির মনে হয়েছিল সে যেন আগুনের উষ্ণতার বদলে শীতল কাচ ছুঁয়েছে। আর অবাধ্যতা তাকে উসকে দিয়েছিল— শীতল কাচের দেওয়াল ভাঙা— অনুভব করা এবং স্পর্শ করা সেই আগুনের শিখা, যা জ্বলছিল। সে তার হৃদয়কে দৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করে প্রায়শই মেয়েটির দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে ছিল।
টেবিল থেকে কয়েক গজ দূরে একটি বাতি উষ্ণ আলো ছড়িয়ে জ্বলজ্বল করছিল… সেই টেবিলের উপর গরম কফি ছিল— পুরুষালি ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছিল… এবং সেই পুরুষালি ঠোঁটের আড়ালে আবেগ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল।
সীমার মধ্যে সামান্য অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল। সে বাইরের বাগানে শান্ত ঘাসের দিকে তাকিয়েছিল— তার শীতল মনের দিকেও। সে তার মনের শীতলতার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত ছিল— নরম সবুজ পাতার শীতলতা, কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছিল যে, পাতার সজীবতা শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
অস্থিরতা সীমার পুরো শরীর আক্রমণ করেছিল। সে চমকে উঠে এবং তার পাশে বসা ছেলেটির দিকে তাকায়। তার পুরুষালি ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছিল এবং সেই ঠোঁটের আড়ালে আবেগ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। মেয়েটি অনুভব করেছিল যে, গাঢ় সবুজ শীতল পাতাগুলো ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
অস্থিরতা সীমার পুরো শরীর আক্রমণ করেছিল। সে চমকে উঠে এবং তার পাশে বসা ছেলেটির দিকে তাকায়। তার পুরুষালি ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছিল এবং সেই ঠোঁটের আড়ালে আবেগ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। মেয়েটি অনুভব করেছিল যে, গাঢ় সবুজ শীতল পাতাগুলো ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সে কিছুটা ভীত এবং সামান্য বিরক্তি বোধ করে। একসময় সে ভাইকে ডাকে। ক্লাবের বিল পরিশোধ করার পরে ছেলেটিকে, যার সাহচর্যে তারা সন্ধ্যা কাটিয়েছে, রেখে বেরিয়ে যায়। কোনো এক সময় আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সীমাকে নিয়ে ভাই বাড়ি ফিরে যায়।
তাদের বাড়ি ক্লাব থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ফেরার পথে সীমা নিশ্চুপ ছিল। অথচ ভাইয়ের মনে হয়েছে অনেক দূরের পথ।
বাড়ি পৌঁছে সীমা দরজার কাছে থেমে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। সে তার পায়ের চপ্পলের সঙ্গে আটকে থাকা কিছু একটা ঝেড়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিল। তা কী ক্লাবের বাগানের কোনো নুড়িপাথর, ঘাসের কচি ডগা, নাকি কোনো চিন্তা-ভাবনা…
পরমুহূর্তেই সে হাসতে থাকে এবং ভাইয়ের দিকে তাকায়। তার হাসির মধ্যে একধরনের স্বস্তির ছবি ভেসে ওঠে। কিছুক্ষণ আগে একটা কিছু তাকে খুশি করেছিল।
আর তারা কক্ষের সামনে পৌঁছনোর আগে সীমার ভাই এক নিশ্বাসে তাকে প্রশ্ন করে, একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— যে প্রশ্ন সবকিছুর অর্থ বহন করে। ‘তুমি কী ছেলেটিকে পছন্দ করেছ?’
সীমার ভাইয়ের প্রতিটি প্রশ্ন এক ধরণের উত্তরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। কারণ সে ছেলেটির গুণাবলীর প্রশংসা করতে থাকে। ভাইয়ের সব কথার সঙ্গে সীমা সহমত পোষণ করে এবং একই কথা বলতে থাকে, হ্যাঁ, হ্যাঁ।
সীমা উচ্চস্বরে হাসার পরিবর্তে মিটিমিটি হাসছিল। ভাইয়ের মনে হলো সে বিষয়টি ঠিকমত বুঝতে পারছে না। সুতরাং সে সোজা-সাপ্টা জিজ্ঞেস করে, ‘আগামীকাল কি তাকে হ্যাঁ বলব।’
‘না।’
খানিকটা ভড়কে গিয়ে ভাইটি এক মিনিটের জন্য বোনের দিকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ একটা কিছু চিন্তা করে। তারপর সে মুখ খোলে, ‘তুমি কি তার সঙ্গে আরও কয়েকবার দেখা করতে চাও?’
‘না।’
ভাইটি খুবই চিন্তিত এবং সে চুপ করে থাকে। কিন্তু নিশ্চুপ থাকাটা তার কাছে কঠিন হয়ে পড়েছিল। তা ছিল তাদের জীবনের কঠিন দিনগুলোর প্রয়োজনীয়তা— ভাই এবং বোনের উদার শিক্ষার একটি অংশ, যা খোলামেলা এবং বিশেষত বন্ধুদের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে ভাইটি তার অনুভূতি বলতে অসুবিধা বোধ করছিল।
‘তুমি জানো, আজ যখন তাকে দেখেছি, তখন আমি কী অনুভব করেছি?’ হঠাৎ সীমা প্রশ্ন করে।
সীমার ভাইয়ের মনে হয়েছে যে, অনেক দূর থেকে বোনের কন্ঠস্বর ভেসে এসেছে। সেই মুহূর্তে সীমার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন থমকে গিয়েছিল।
সীমারও তাই মনে হয়েছে যে, তার দম ফুরিয়ে গেছে। ঘরের এক কোণায়, যেখানে বাতি জ্বলছিল এবং একটা গদির চেয়ার পাতা আছে, সে যায় এবং চেয়ারে বসে। কোণার বাতির পাশেই টেবিলের উপর তার মায়ের ছবি রাখা ছিল। সীমা কয়েক মুহূর্তের জন্য মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তারপর দৃষ্টি ভাইয়ের দিকে ঘুরিয়ে বলল:
‘আমিও জানি না, এমনকি তুমিও জানো না আমাদের বাবা দেখতে কেমন ছিলেন। কিন্তু আজ তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছে…’ কথাটা শেষ না করে সীমা চুপ হয়ে যায়।
ভাইটি হাসতে শুরু করে, ‘আমাদের মায়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল বাবার সঙ্গে এবং মায়ের চোখে বাবা ছিলেন সমস্ত পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন। তুমি কি মনে করো এই পৃথিবীর সুন্দর চেহারার সব পুরুষই দেখতে বাবার মতো সুদর্শন?’
‘না, মুখমণ্ডল নয়, বরং মনের দিক দিয়ে,’ টুলের উপর থেকে মায়ের ছবি দু’হাতে ধরে তোলার সময় সীমা জবাবে বলল। সে কিছু সময় মায়ের ছবি দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তারপর ছবিটা যেখানে ছিল, সেখানেই রাখে।
‘কী বলতে চাও?’ ভাই জিজ্ঞেস করে।
‘আমি দৈহিক গঠনের কথা বলছি না,’ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে সীমা বলল। ‘আজ ছেলেটির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যা বাবার সঙ্গে মিল রয়েছে… এবং আমার সঙ্গে রয়েছে মায়ের মিল…’ সীমা পুনরায় গদির চেয়ারে বসে। তাকে দেখে মনে হয় সে খুবই ক্লান্ত।
‘তুমি ঠিক আছ, সীমা?’ ভাই জিজ্ঞেস করে।
‘আমি ঠিক আছি, কিন্তু মনে হয়, ওহ… খুবই ক্লান্ত।’
‘শুরু থেকেই আমি লক্ষ্য করছি তোমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’
‘আমি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি…’ সীমার ঠোঁটের ফাঁকে হালকা হাসি ফুটে উঠে। ‘শুধু আমার জীবনের বছরগুলোই নয়, পথ পেরোনোর সময় মায়েরও কয়েক বছর আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তুমি তা ভালো করেই জানো…’
‘আমি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি…’ সীমার ঠোঁটের ফাঁকে হালকা হাসি ফুটে উঠে। ‘শুধু আমার জীবনের বছরগুলোই নয়, পথ পেরোনোর সময় মায়েরও কয়েক বছর আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তুমি তা ভালো করেই জানো…’
ভাইয়ের ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে বলল, ‘তা ছিল মায়ের দূর্ভাগ্য। তখন আমরা খুব ছোটো ছিলাম। আমরা কী করতে পারতাম?’
‘শুধু দেখেছি তার কান্না আর কান্না… এমনকি এখনও আমি সেই সময়ের কথা ভাবলে… আমি কেঁপে উঠি।
‘তিনি যদি বাবাকে এতটা ভালোবাসতে না পারতেন, তাহলে মায়ের জন্য কোনোকিছুই কঠিন ছিল না। ঠাকুরদাদা বিত্তশালী ছিলেন এবং মা আবার…’
‘মা ঠাকুরদাদার একটি কথাও শোনেননি। মা শুধু বাবার কথা শুনেছেন, যাকে তার জীবনে প্রয়োজন ছিল।’
‘মাকে ছেড়ে যাওয়ার পরে মা বাবার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন… তিনি ছিলেন অসহায়।’
‘অনেক বার দেখেছি মা হাঁটু গেড়ে নিচু হয়ে দুঃখ-শোকে মেঝেতে কপাল ঠুকে কেঁদেছেন…।’
‘সীমা, এখন এসব কথা বলে কী লাভ…?’
‘আমি তখন খুব ছোটো ছিলাম যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমি কখনই কাউকে ভালোবাসবো না।’
‘তুমি কী বিয়ে করতে চাও না? আগে তো এ কথা কখনও বলোনি।’
‘আমি কিন্তু তা বলছি না।’
‘তবে কী?’
‘আমি বিয়ে করব, তবে ঠাকুরদাদা সব সময় যেভাবে মাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।’
‘সেই ধরনের বিয়ের ফলাফলের উপর তোমার কী বিশ্বাস আছে?’
‘আমি বলছি না যে তা ভুল। যদি তাই হয়, তবে তার সম্পর্ক হবে কেবল সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে। কিন্তু মা যেভাবে করেছেন, তাতে শুধু ভালোবাসার বিষয় ছিল। যখন প্রচলিত বিয়ে ভেঙে যায়, তখনও সমস্যা দেখা যায়। মানুষই সেসব সমস্যা নিয়ে জন্মায় এবং সবসময় সমাধানও করে… কিন্তু এটা…’ কথাটা সম্পূর্ণ না করে সীমা চুপ হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত থেমে সে পুনরায় বলতে শুরু করে, ‘এতে কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধু প্রেম তার অস্তিত্ব এবং ভালোবাসার জন্য বেঁচে থাকে।’
ভাই চুপ করে থাকে এবং আনমনা হয়ে যায়, যেন সে তার বোনকে চিন্তার আলাদা জগতে খুঁজে পেয়েছে।
আমি বলছি না যে, মা ভুল করেছেন। কিন্তু আমি যা ভাবছি, তা-ও সঠিক। মা যেই দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, আমি কখনই সেই অবস্থা মোকাবেলা করার শক্তি পাব না…’ সীমা হাসতে হাসতে আরও বলল, ‘আমার পছন্দ বা অনুমোদন নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই।
‘আমি বলছি না যে, মা ভুল করেছেন। কিন্তু আমি যা ভাবছি, তা-ও সঠিক। মা যেই দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, আমি কখনই সেই অবস্থা মোকাবেলা করার শক্তি পাব না…’ সীমা হাসতে হাসতে আরও বলল, ‘আমার পছন্দ বা অনুমোদন নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। যখন তুমি একজনকে খুঁজে পাবে, তখন আমাকে বিয়ে দিয়ে দিও। আর তার প্রতি আমার দায়িত্ব বলে দিও। আমি সেসব দায়িত্ব পালন করব… আমি…’
সীমার কথা থামিয়ে দিয়ে তার ভাই বলল, ‘যদি তা-ই হয়, তবে ওর বিষয়ে কি… যার সঙ্গে আজ আমাদের দেখা হয়েছে?’
‘না, সে নয়…’ চটজলদি সীমা বলল, ‘আমার ভয় করছে…’
সীমা চুপ করে যায়, যেন সে হঠাৎ কথার মাঝে পা চেপে ব্রেক কষে থামিয়ে দিয়েছে। সে বুঝতে পারছে যে, এটি সেই একই দীর্ঘতম ভালোবাসার পথ, যা তার মাকে বেছে নিতে হয়েছিল।
…এবং সে সাহস করে না, এমনকি তার কোনো ঝোঁক নেই।
লেখক পরিচিতি
ভারতীয় সাহিত্যের ‘উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা’ এবং ‘কুইন অব পাঞ্জাবী লিটারেচার’ খ্যাত স্বনামধন্য নারী লেখক অমৃতা প্রীতম (জন্মকালীন নাম অমৃত কাউর) ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিকা, গল্পকার এবং কবি। তার জন্ম ১৯১৯ সালের ৩১ আগষ্ট অবিভক্ত ভারতের গুজরানওয়ালায় (বর্তমানে পাকিস্তানে)। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। দেশ বিভাগের পরে বাবার সঙ্গে দিল্লিতে এসে থিতু হন। প্রীতম সিংয়ের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধেন ১৯৩৫ সালে এবং ছাড়াছাড়ি হয় ১৯৬০ সালে। একসময় তার সখ্যতা গড়ে ওঠে প্রখ্যাত কবি সাহির লুধিয়ানভির সঙ্গে। পরবর্তীতে প্রখ্যাত শিল্পী এবং লেখক ইমরোজের সঙ্গে তিনি পঁয়তাল্লিশটি বছর কাটিয়েছেন।
শৈশবে মা হারানোর একাকিত্ব কাটানোর জন্য অমৃতা প্রীতম লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। মাত্র সতের বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর ছোটোগল্প সংকলনের মধ্যে ‘দ্য এরিয়াল অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’, ‘দ্য স্কেলিটন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ এবং ‘ডেথ অব এ সিটি’ অন্যতম। তিনি পঁচাত্তরটিরও অধিক গ্রন্থের রচয়িতা। ‘পিঞ্জর’ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ‘দ্য পেপার অ্যান্ড দ্য ক্যানভাস’ সংকলনের জন্য অমৃতা প্রীতম ১৯৮২ সালে ভারতের ‘জ্ঞানপীঠ’ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬৯), ‘পদ্মভূষণ’ (২০০৪) এবং ‘সাহিত্য একাডেমী অ্যাওয়ার্ড’ (১৯৫৬) অর্জণ করেন। এক পর্যায়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৮৬ সালে রাজ্যসভার সদস্যা নির্বাচিত হন। তার মৃত্যু হয় নয়া দিল্লীতে, ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর।
‘দুই রমণী’ গল্পটি অমৃতা প্রীতমের ইংরেজিতে ‘টু উইমেন’ গল্পের অনুবাদ। পাঞ্জাবী ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হরি শর্মা। গল্পটি লেখিকার ‘ডেথ অব এ সিটি’ ছোটোগল্প সংকলনে প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।