ছেলের প্রচণ্ড জ্বর। গায়ের উত্তাপ এত যে, মনে হয় একমুঠ চাল ফেলে দিলে নিমিষে মুড়ি হয়ে যাবে। থার্মোমিটার বলল টেম্পারেচার একশ পাঁচ ডিগ্রি ফারেনহাইট। ছেলে আমার কুঁই কুঁই করে কাঁদছে। জ্বরের ঘোরে কতো কী বলে তার ঠিক নেই। বাবার মন কেঁপে ওঠে ভয়ে। ছেলেটার কিছু হবে না তো! খারাপ কিছু!
সময় নষ্ট না করে ছেলেকে কোলে করে বেরিয়ে এলাম। ইস্ লিফট নষ্ট। আমার মাথা কাজ করে না। এগারতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামলাম। রিকশা বা সিএনজি-অটো কিছু পেতে হবে। আপাতত গন্তব্য শ্যামলী পপুলার হসপিটাল। চেনাশোনা ডাক্তার আছে। নাহ্ কেউ যাবে না। এত অল্প দূরত্বে গেলে নাকি ওদের পড়তা হয় না। আচ্ছা, একটা বাচ্চার জীবনের চেয়ে কি ওদের পড়তাটাই বেশি দামী!
অটোঅলা খুব চেষ্টা করছে জ্যাম কাটিয়ে দ্রুত যাবার জন্য। আমি তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ। কিন্তু সংশয়ী মন কতো কী ভাবে! লোকটা পরে ইচ্ছেমতো ভাড়া চাইবে না তো! পরিস্থিতির সুযোগ নেবে হয়তো। নিলে নিক। ছেলের জীবনের চেয়ে টাকা বড়ো নয়।
রিকশা বা অটো কিছুই পাওয়া যায় না। আমি কুলকুল করে ঘামি, আমার ছেলে কুঁই কুঁই করে কাঁদে। আমার হৃদয়ের পাড় ভাঙে। আহা, ছেলেটার কিছু হয়ে যাবে না তো! শেষে একজন থামে। বলি, শ্যামলী যাবেন? পপুলার হসপিটাল? সে কী বুঝলো কে জানে। বলল, উঠে পড়ুন। জলদি।
মিটার আছে? ভাড়া কত দিতে হবে?
দিতে হবে না। মাথা নেড়ে আবার বলল, মন যা চাই তাই দিয়েন। নিন উঠুন। কত আর বয়স তার! খুব জোর কুড়ি-বাইশ। আমার হাতে সময় কম তাই দরাদরিতে না গিয়ে উঠে বসলাম। রাস্তায় জ্যাম, কারণ এটা ঢাকা শহর, আমার বাসার ড্রয়িংরুম নয়। অটোঅলা খুব চেষ্টা করছে জ্যাম কাটিয়ে দ্রুত যাবার জন্য। আমি তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ। কিন্তু সংশয়ী মন কতো কী ভাবে! লোকটা পরে ইচ্ছেমতো ভাড়া চাইবে না তো! পরিস্থিতির সুযোগ নেবে হয়তো। নিলে নিক। ছেলের জীবনের চেয়ে টাকা বড়ো নয়।
দ্রুততম সময়ে অটোঅলা আমাদের হাসাপাতাল পৌঁছে দেয়। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা উপচে ওঠে। কতো দিব ভাই বলুন! যা খুশি দিন। নিপাট ভালমানুষি উত্তর। আমি ধন্ধে পড়ে যাই, বড্ড বিপন্ন বোধ করি। অথচ তার মিটার নেই যে সেই বুঝে দেব।
বলুন না ভাই কত দেব! নিশ্চুপ অটোঅলা। যেন সে কথা বলতে জানে না। হাতে সময় কম তাই একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলাম। তাজমহল রোড টু শ্যামলী। এতে মন না উঠলে আরো কিছু দেব।
কিন্তু সে আমাকে চমকে দিয়ে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিল। বলল, এইটুকু পথ এত ভাড়া হয় না। হলেও নিতাম না।
কিন্তু সে আমাকে চমকে দিয়ে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিল। বলল, এইটুকু পথ এত ভাড়া হয় না। হলেও নিতাম না। কেন বলো তো? আমি তাজ্জব। অটোঅলা মৃদু হেসে বলল, আপনার ছেলেটা দেখতে আমার ভাইয়ের মতো। আব্বা বলেছেন, রোগীর সাথে কখনও বারগেন করবি না। সেবা দিবি, তোরে আল্লায় দিবো।
আমার দুচোখে অশ্রুর বান ডাকল। এখনও এত ভালমানুষ আছে এই দুনিয়ায়! ছেলের আমার কান্না থামল। কে জানে কেন! ও বোধহয় একজন ভালোমানুষের দেখা পেয়ে সুস্থির বোধ করছে।
এক্স-নটরডেমিয়ান, ইংরেজি সাহিত্যে এমএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স করেন লন্ডনে। লেখালেখির শুরুটা তার কলেজকাল থেকেই। তিনি অসম্ভব প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ। ঘুরতে পছন্দ করেন। নতুন দেশ নতুন মানুষ তার আগ্রহের বিষয়। বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীতে শিশু-কিশোরদের জন্য লিখছেন ছড়া, কবিতা, অ্যাডভেঞ্চার, উপন্যাস, ভুতুড়ে ও গোয়েন্দাগল্প। পেশাগত কাজের ফাঁকে (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখছেন। তিনি আড্ডার আমেজে জম্পেশ গল্পও বলেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০ এর অধিক।