শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ২১

অলৌকিক স্বপ্নের থিয়েটারে : শামসুদ্দিন শিপন

0

১.
দুরন্ত আলোর প্রস্তরীভূত প্রাসাদে আমি ইন্দ্রজালে নিদ্রাস্থির; উদ্বৃত্ত মনে ভেবে চলেছি— আমারও বন্ধনমূর্তি আজো ভাঙে: প্রদাহ বর্ধক কিছু অগ্নিরেণু। সমীরণ লেহনের মতো যে সকল বিপন্ন স্মৃতি ইজেলের নর্দমা থেকে বেরিয়ে আসে, আপক্ক অতীতের সুবর্ণরেখায় কিংবা সামাজিক সন্ধ্যায়-অবগত চেতনার ভঙ্গিমায় তাকে আজ অনুশীলন করি। কিংবা প্রণয়িনীর মহীরুহ কল্পনায় আমি ভেসে থাকি অল্প-স্বল্প; যেন ব্যবহৃত বস্ত্রের গহ্বরে ঘামের অক্ষরগুলো ঘুমিয়ে থাকে; আর সন্ত্রাসে-সন্ত্রাসে গীতিময় ভাষ্কর্য খসে পড়ে। স্বাক্ষর নেই বলে, শিল্পভূবন নির্বিকার… তবুও নিজের অশরীরী জাগে সুচতুর শব্দগুচ্ছের বিভায়। নিভে আসে স্মরণের বিচিত্র মেঘরথ— যখন চক্ষুদ্বয় এ-সবে মিশে থাকে— প্রকৃত লাবণ্যে, প্রত্যক্ষ নির্বাসনে আমি বস্তুটেবিলে গিয়ে বসে থাকি; এই কি যথেষ্ট নয়— বিশৃঙ্খলা নির্মাণে?

২.
বহু কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণভাবে ছড়িয়ে থাকে জৈবিক পথে; তাই সৃষ্টির প্রতি অমোঘ বিশ্বাস রেখে কখনো আমি পলায়ন করব না, পুনঃকরাঘাতে, ধ্বংসের উপলব্ধি নিয়ে সংস্কৃতির বানোয়াট সমুদ্রে। তোমরা বরং কর্মপৃষ্ঠে রুগ্ন রাজনীতির অভ্যন্তরে নিবন্ধ থাকো; বৈষ্ণবীয় সিদ্ধি লাভ করো, আলোহীন প্রেক্ষাগৃহে অচেনা কন্ঠস্বরে দৃশ্যকল্পের আহ্বান করে! আমাকে যেতে হবে নিগূঢ় মনক্ষোভ ফেলে রেখে অকথ্য আঁধারে; যেখানে আমাকে খেতে দেবে হিমভাত পার্থিব কোনো দয়িতা— কুয়াশার নীল নৌকায় করে প্রশস্ত খড়ের বিছানায়, অভিমুখে, নিরুদ্বেগ আখ্যান, কিভাবে প্রত্যাখান করব? সকল জ্বরজীর্ণ জাদুকর তোমরা বরং অসংলগ্ন কিছু গেঁয়ো কবিতা পড়ো… আমি প্রতীয়মান দৃশ্যের সাক্ষাৎ-এ আরও ঢ়ের কিছুক্ষণ মৌন থাকি।

৩.
মুদ্রাদোষের বৈভবে আমার সমস্ত স্বতন্ত্রচিহ্ন মুছে গেছে রক্তাক্ত ভূ-পৃষ্ঠে; যাকে ভেবেছিলাম আদিরত্ন, পায়ের উপর নির্ভর করে মুখোমুখি সেই অরণ্যে তাকেও ফিরিয়ে দিয়েছি অখণ্ড শ্বাসাঘাতে। এখন ঋতুচক্রে ধ্রুবসত্যের স্থাপত্য সৃষ্টি হয়। অলৌকিক স্বপ্নের থিয়েটারে আমি সৌন্দর্যসন্ধানীর মতো ঘোরা-ফেরা করি; মুকুট পরিহিত কীটের উলাহুলা দেখি নিজের ঋদ্ধ ছাঁয়ায়। গম্বুজীয় সেমিকোলনের ভেতর তখন আবদ্ধ হয় তোমার কলাকৈবল্য। নক্ষত্রজগৎ তবু বুঝি না— দুটি বস্তুর মধ্যে গবেষণা করে কিছু সাদৃশ্য পেলে তবেই আমাদের ভালো লাগে; রক্তের শিকড়ে ধর্মপ্রাচীর এখন ধীরে-ধীরে নবান্ন জলরাশির মতো ঝরে পড়ে পৃথিবীতে; মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শৃঙ্খলা বেজে ওঠে।

 

৪.
ধূলোধৌত এই শরীরে পাবে মহিষের শিকারি সতর্ক উপক্রমণিকা। তবুও অক্ষরপ্রতিমার স্তব্ধ বিজনে, শোকের ছিন্নপত্রগুলো উড়ে যায়, কোথায়, কোন বিপদসংকুল উদ্যানে? মরুবিদ্যার অর্কোজ্জ্বল নিরাবরণ দৃশ্যে আমিও আজকাল ঝরে পড়ি। যা তুমি ভাবো, বৈসাদৃশ্যে, বয়সক্রমে, ভাবনার অন্তর্শাখায় বসবাস করে— নির্বাণের চেয়ে ধ্বংসভূমির পথে স্থবির হয়ে পদ্মপাতার আড়ালে আমি বুনোমৎস্যের মতো লুকিয়ে থাকি। সন্ধানে-সন্ধানে যে গহ্বরে প্রবেশ করেছি, সেখানেই সর্পডিমে তাপ দেয় কিছু বিপন্ন ফড়িং। যেখানে আজ দাঁড়িয়েছি, দৈত্যপুরুষের নাক্ষত্রিক খামারে— চেটেপুটে সব খাদ্য উপাদান লেহন করে গেছে ওঁরা: যারা ক্ষণিকের মস্তকবীজে, ভাষার নিরাকার ছাঁয়ায় এসেও, আক্ষরিক জিরাফের গলায় ঝুলে থাকে; এই কি সমাপনীচিত্র! না কি অনাদি বিরহের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কৃত্রিম স্মারকীয় কুসুম… বলো? নিশ্চুপ সন্ধ্যায় বইভর্তি ঘরে বসে কোন প্রণয়ী-প্রণয়িনীর সঙ্গম দৃশ্যের কথা ভাবছো, জীবন্ত অভিলাষে…

 

৫.
এই কৃষ্ণমন্দির শরীরে জলৌকার মতো প্রবেশ করেছিলে তুমি। তারপর দুরারোগ্য রৌদ্রে কথ্য ভাষায় যে আলেখ্য এঁকেছিলে— চিরকাল তার দিগন্তচূর্ণ কালিমা রয়ে যাবে। আমার বেদনা সম্ভারে তুমি এক অসীম বহ্নিশিখা; যত যন্ত্রকৌশলে আজ সংকেত দাও— মহাশূন্যে সেই শীর্ণ হাত সনাতন বৃক্ষের মতো মনে হয়। এখনো তোমার প্রণয়শিল্পের অফুরন্ত বীজ নিয়ে আমি জীবনকে দৈনিক ব্যবহার করি বিবিধ যুগ্মলিপির অভ্যন্তরে, হে মর্মপ্রদাহিনী।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মস্থান: কুড়িগ্রামকবিতাচিত্রকলা ও সংগীত-এর উপর সবিশেষ আগ্রহী

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।