ট্রেন থেকে নামার পর, স্টেশনের বাইরে পা দিতেই ঠান্ডাটা জাপটে ধরে।
উত্তরের জেলাগুলোতে শীতের আগমন ঘটে আগে, বিদায়ও হয় সবার শেষে। কিন্তু এবারের শীতটা বোধহয় জাঁকিয়ে পড়েছে। ঢাকা শহরে শুধু শার্ট-প্যান্ট পরে বাইরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করা গেলেও রাজশাহীতে তা কল্পনাও করা যায় না। ভাগ্যিস, ব্যাগের ভেতরে রাতুল একটা গরম কাপড় নিয়ে বেরিয়েছিল।
রাস্তায় পা রাখতেই রিকসা ও অটো-ড্রাইভাররা ছেঁকে ধরে, মামা আসেন, কতি যাবেন? আমার রিকসায় আসেন, যেখিনে যাবেন, টপাক করি লিয়্যা যাব।
দু’পা এগিয়ে রাতুল ভাড়া মিটিয়ে একটি রিকসায় উঠে বসে। বয়স্ক রিকসাওয়ালা আপনমনে রিকসা টেনে যায়।
অনেকদিন পরে সে রাজশাহীতে এলো। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবন এই শহরে কেটেছে তার। শহরের রাস্তা ও অলিগলি ভালো করেই চেনা। তবুও অনেকদিন পরে আসায় শহরটাকে কেমন অচেনা ও নতুন মনে হয়। রাস্তাগুলো শুধু প্রশস্ত হয়েছে তা নয়, সুন্দর এবং নয়নাভিরাম হয়ে উঠেছে। অজস্র নতুন দোকান ও ভবন উঠেছে। ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। রাজশাহীকে বলা হয় শিক্ষানগরী। বছর পনেরো আগে আন্তর্জাতিক একটি জরিপে রাজশাহীকে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
রিকসায় যেতে যেতে কথাগুলো মনে আসে রাতুলের। স্টেশন রোড পেরিয়ে এসে বিন্দুর মোড়; ডানদিকে রেলগেট, বাঁয়ের রাস্তাটা চলে গেছে নিউমার্কেট হয়ে সাহেব বাজারের দিকে। তবে রাতুলকে বহন করা রিকসাটা সোজা গ্রেটার রোড ধরে চলতে থাকে।
গতরাতে মা স্ট্রোক করেছেন। জলজ্যান্ত একটা মানুষ স্ট্রোক করে পুরোপুরি নীরব হয়ে গেছেন। এখন কী অবস্থা কে জানে। সকালে মাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। দুপুরের মুখে শীতল গলায় বাবা ফোনে জানালেন, খোকা, তোর মা স্ট্রোক করেছে। আমরা হাসপাতালে আছি। তুই সময় করে চলে আয়।
রাজশাহীতে হঠাৎই আসতে হলো। গতরাতে মা স্ট্রোক করেছেন। জলজ্যান্ত একটা মানুষ স্ট্রোক করে পুরোপুরি নীরব হয়ে গেছেন। এখন কী অবস্থা কে জানে। সকালে মাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। দুপুরের মুখে শীতল গলায় বাবা ফোনে জানালেন, খোকা, তোর মা স্ট্রোক করেছে। আমরা হাসপাতালে আছি। তুই সময় করে চলে আয়।
রাতুলের বেশ কিছুদিন চাকরি নেই। হাসপাতালে যাওয়া মানেই পয়সার শ্রাদ্ধ। বাসায় কোনো ক্যাশ টাকা ছিল না। কী করা যায়? ব্যাংকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে হাজার পঞ্চাশেক ছিল, ওটাই সে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এ মুহূর্তে টাকাপয়সার খুব দরকার পড়বে। বাবা চাকরি করতেন, রিটায়ার করেছেন। তাঁর হাতের অবস্থা ভালো নয়। কোনো রকমে সংসারটা চলে। বড়োভাই একটা আছে বটে, নামমাত্র। সে চাকরি করে, বছর বছর জমি কেনে, থানা সদরে তিনতলা বাড়িও করেছে; কিন্তু পরিবারের দিকে ফিরেও তাকায় না। ছোটো বোনদুটো এখনো পড়াশোনা করছে। এমনিতে সাধারণ সুখী পরিবার। তারমধ্যে হঠাৎ এই কাণ্ড।
শীতের দাপটে নাকি রাতের অন্ধকারের ভয়ে জানে না, কোলের ব্যাগটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাতুল। রিকসা বর্ণালী সিনেমা হল পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকে যায়। এদিকে আলোটা কম। শীতের রাত বলে রাস্তায় মানুষ প্রায় নেই। দুএকটা রিকসা, ছোটো গাড়ি ও মটরসাইকেল ছাড়া কোনো কিছু চোখে পড়ে না।
হঠাৎ মায়ের মুখটা মনে পড়ে রাতুলের। চোখে জল আসে না ঠিক, কিন্তু বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। সম্পর্কে কিছুটা আড়াল ও দূরত্ব থাকলেও তার জীবনে মা-ই সেই মানুষ, যাঁকে গোপন কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। মাকে সে তেমন করেই পেয়েছে। রাতুলের মা-টা খুব সাধারণ। কুচি দিয়ে শাড়ি পরতে জানেন না, নারীবাদী কথা বোঝেন না; তবুও আধুনিক। সন্তানের কথা ও চোখ এমনভাবে পড়তে পারেন, অবাক লাগে। এখনকার মায়েদের মতো বলতে পারেন না, এতপথ পাড়ি দিয়ে এলি, তা কী খাবি? কোল্ড ড্রিংকস, না হট ড্রিংকস? বরং মা তাঁর সর্বংসহা হাতে পাতিলেবু-নুন-চিনির শরবত বানিয়ে দেন। খেয়ে শরীর শান্ত হয়ে যায়।
ফোনে বাবা জানিয়েছেন, তোর মা এখন হাসপাতালের বেডে শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন। কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে রাতুলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
মা যে খুব ধনী, উচ্চশিক্ষিত ও প্রভাবশালী, তা নয়। তবু মাকে আজও একটা ভরসার জায়গা হিসেবে অনুভব করতে রাতুলের ভালোলাগে।
বাবার ফোন পেয়ে প্রথমে রাতুলের কথা ও বুকের বাতাস থেমে গিয়েছিল; পরে সে আর দেরি করেনি। ব্যাগে দুএকটা কাপড় নিয়ে সোজা ব্যাংকে চলে যায়। এরপর স্টেশনে।
হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে রাতুল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে রিকসা মেডিক্যাল রোডে এসে যাবে। আশেপাশে কোনো জনমানুষ দেখা যায় না। এতদিনের চেনা শহর, রাস্তাঘাটও মুখস্ত, তবুও কেমন গা থম থম করে।
হঠাৎ ভূমি বিদীর্ণ করে তিনজন লোক রিকসার সামনে এসে দাঁড়ায়। লোকগুলো ভদ্র নাকি মাতাল রাতুল ঠিক আন্দাজ করতে পারে না।
রিকসার হ্যান্ডেল ধরে চালককে থামিয়ে দেয় একজন। রিকসাচালক বাঁধা দিতেই সে বলে ওঠে, ওই ব্যাটা সরলি, নাকি ভুড়ি গাল্যা দিবো?
রাতুল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রিকসার সিটে বসে থাকে। দ্রুতচোখে চারপাশে তাকায়। কাউকে চোখে পড়ে না।
আরেকজন লোক বিশ্রিভাবে হেসে সালাম দেয়। বলে, টেনশন লিছেন ক্যানে? যা আছে বাইর কর্যা দিয়্যা সুজা চলি যান। কেহু কিছু বুলবে না।
দেখো ভাই, হাসপাতালে আমার মা অসুস্থ। স্ট্রোক করেছেন। আমাকে ছেড়ে দাও।
তিনটে লোক একে অপরের দিকে তাকায়। অশ্লীল ভঙ্গিতে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে একজন বলে, ধের বাঁড়া, মামুর বুটা এগলা কী বুলছে? কুহারা কর্যা কুনু লাভ হবে না, ভাই। কী আছে টপাক কর্যা বাইর করো। আনসান চুদালে ডাইরেক্ট ঢুকিয়্যা দিব।
ঘটনার আকস্মিকতায় ও ধমকে রাতুল একেবারে ভড়কে যায়।
একজন পিস্তল বের করে। অরজিনাল নাকি খেলনা পিস্তল? ভাবার আগেই অন্যজন রাতুলের বাম হাত ঠেসে কোলের উপরে রাখা ব্যাগ চেপে ধরে। রাতুল ডান হাতের মুষ্টি পাকিয়ে একজনের চোয়ালে ঘা মেরে, অন্যজনকে ধাক্কা মেরে রিকসা থেকে নেমে দৌড় দেয়। সামনে মেডিক্যাল রোড। দুএকটা ওষুধ ও ফলের দোকান খোলা, কিন্তু রাস্তা একেবারে নির্জন। কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই।
একজন পিস্তল বের করে। অরজিনাল নাকি খেলনা পিস্তল? ভাবার আগেই অন্যজন রাতুলের বাম হাত ঠেসে কোলের উপরে রাখা ব্যাগ চেপে ধরে। রাতুল ডান হাতের মুষ্টি পাকিয়ে একজনের চোয়ালে ঘা মেরে, অন্যজনকে ধাক্কা মেরে রিকসা থেকে নেমে দৌড় দেয়। সামনে মেডিক্যাল রোড। দুএকটা ওষুধ ও ফলের দোকান খোলা, কিন্তু রাস্তা একেবারে নির্জন। কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। দৌড়ে সে বেশিদূর যেতে পারে না। পেছন থেকে পা বাঁধিয়ে তাকে ফেলে দেয়। রাতুলের নাকমুখ খানিকটা ঘষটে যায়।
কতি য্যাছো মামুর ব্যাটা? ঘুষি খাওয়া লোকটা সামনে এসে গর্জে ওঠে—তোর ভুড়ি ফাসিয়্যা দিব। এই তুরা কী করছিস, শালাকে চটকানা দিয়্যা চিপায় তুল্যা লিয়ে চল। কানাসারা যাত্যা এমন দিব, বাপ বুইলি দিশা পাবে না।
অন্য একজন বলে, আরে থাম তো।
কীসের থামব? এই ছুঁড়া বেশি চুদুরবুদুর কইরছে। এমন মাইর মারব, বাপের নাম ভুইলি যাবে। তখন পাশ্যি লিবে আমরা কারা?
এবার আর রক্ষা নেই, কী করি; ভেবে মনে মনে রাতুল সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে।
ঘুষি খাওয়া ছেলেটা রাতুলের মুখ চেপে ধরে হুংকার ছাড়ে—এই ছুঁড়া, কাখে লাড়তে যায়্যা কাখে লাড়্যাছিস তুই? মুনে কইরিছিস আমরা বাহিরের লোক, আরে আমরা রাশশাহীর লোকাল বে। তোর বুকের পাটা তো কম লয়।
অন্যজন এসে তাকে সরিয়ে দেয়। ভাই শুনেন, তেড়িবেড়ি কইরি কুনু লাভ হবে না, পাশতে পারলেন? ব্যাগ আপনি লিয়্যা যান। মাল কী আছে, উপুড় কর্যা দেন দেখি।
না, ভাই। আমাকে ছেড়ে দিন। রাতুল মিনতি করে।
জিটু, ইয়াডা বাইর কর তো।
এবার রাতুল ঘাবড়ে যায়।
শালাকে পদ্মার ধারে লিয়ে চল। মাইর্যা শাট কর্যা নদীতে ফেল্যা দিব। শালার সাহুস কত? আমাদেরখে দৌড়ে লিয়্যা বেড়াছে।
ভাই, কী আছে বাইর করেন তো। খামোখা লেট কইরছেন ক্যানে? কুনু লাভ হবে না, সাঁটিয়্যা লাল কর্যা দিব। মাল বাইর করেন। আবে ওই, তুরা কী করছিস? ওখে ঘিরে লে।
তিনজনই হয়তো পান করেছে। ভকভক করে গন্ধ বেরুচ্ছে। একজন মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে বলে, প্যান্ট চাড়্যা তুল্যা একবার দৌড় দিয়িছেন, আবার পালাতে চাহিলে ভুল কইরবেন। ছুরি ঢুকিয়্যা দিব।
হঠাৎ পুলিশ পুলিশ বলে আচমকা চিৎকার দেয় রাতুল। তিন মাতাল ভয়ে দৌড় দেয়। রাতুল নিজেও দৌড়ে মেডিক্যাল গেটের কাছাকাছি চলে আসে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা টের পেয়ে যায়, পুলিশ আসেনি। তাদেরকে ধোকা দেওয়া হয়েছে। ওরা আবার ছুটে এসে রাতুলকে ধরে ফেলে। একজন ব্যাগ হাতড়ে টাকার খামটা বের করে নেয়। আর একজন পায়ের নিচ থেকে ধারালো চাকু বের করে বলে, সুজা চলি যা মামুর ব্যাটা। কুনু কথা বুলবি ন্যা, চিল্লাবিও ন্যা। পিছে তাকাবি তো গুলি খাবি। ভাগ ব্যাটা।
রাতুল ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে বিধ্বস্ত মনে হাঁটতে থাকে। একবারও পেছনে তাকানোর সাহস বা মনোবল খুঁজে পায় না।
ধর্ষণের স্বীকার হওয়ার পর, কোনো মেয়ের কী অনুভূতি হয়, রাতুলের জানা নেই। রাতের অন্ধকারে ছিনতাই ও বিশ্রি গালাগালের মুখে পড়ে সে ভেবেছিল হয়তো বাঁচবে না। কিন্তু বেঁচে ফিরে এখন মনে হচ্ছে, ধর্ষণশেষে কেউ যেন তাকে ছুড়ে ফেলেছে।
ধীর পায়ে রাতুল হাসপাতালের মেইন গেটে ঢুকে পড়ে। শরীর ও মনে একধরনের ভোঁতা অনুভূতি হতে থাকে। কিন্তু এসবের মধ্যেই সে গন্ধটা পায়। নরম ও স্নিগ্ধ একটা ঘ্রাণ। হাসপাতালের ভেতরে কোথাও নিশ্চয়ই হাস্নাহেনার গাছ আছে। সে হাঁটার গতি ধীর করে আনে। একটু থামে। ফুলের সৌরভ নেওয়ার ছলে মনটাকে হালকা করার চেষ্টা করে।
রাতুলের সঙ্গে এখন মোবাইল নেই। ছিনতাই হয়ে গেছে। মানুষকে জিজ্ঞেস করে, কিছুটা অনুমানে খুঁজে একসময় সে মায়ের ওয়ার্ডের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার আগে সে বুদ্ধি করে ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে মুছে ফেলে। শীতটুপিটা মাথায় পরে নেয়। মুহূর্তের মধ্যে বাবা, ছোটোবোন ও মামাত ভাই এসে তাকে ঘিরে ধরে। রাতুলকে দেখে সবাই খুশি হয়েছে, বুঝতে পারা যায়। একসময় সে মায়ের বেডের পাশে এসে দাঁড়ায়। মা, মা বলে স্বগত কণ্ঠে সে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু মা সাড়া দেন না।
ট্রেন থেকে নামার পর, হাসপাতালে আসার পথে তার সঙ্গে কী ঘটেছে, পুরোটাই সে চেপে যায়।
বাবা বললেন, এসেছিস খোকা? এখন আর চিন্তার কিছু নেই।
মামাত ভাই কাছে এসে রাতুলের হাত ধরে, টেনশানের কিছু নাই গো। ডাক্তার বুললো, বাড়িতে লিয়ে যায়্যা সেবা করতে। ভালো হয়ি যাবে। প্রেসক্রিপশানে ওষুধ লিখ্যা দিয়্যাছে।
রাতটা কোনোভাবে কেটে যায়। মায়ের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। তিনি ঘুম ও অচৈতন্যের ভেতরে ডুবে গেছেন। কথা বলেন না, সাড়াও দেন না।
সকালে একটা মাইক্রো ভাড়া করে মাকে নিয়ে সবাই বাড়িতে ফিরে যায়। বাড়িতেই ওষুধপত্র ও চিকিৎসা চলতে থাকে।
মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর, বেশ কিছুদিন কেটে যায়। ধীরে ধীরে মায়ের অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ ও স্বাভাবিক, কিন্তু পুরোপুরি ভালো হওয়াটা অনিচিশ্চত এবং সময়ের ব্যাপার। ডাক্তারও পরিষ্কার করে কিছু বলেন না।
মা আর আগের মতো নেই। পুরো সংসার যিনি একহাতে সামলে রাখতেন, তিনি এখন অন্য একজন মানুষ। যে মানুষটি চেনা, তবুও যেন দূরের কেউ। কথা বলেন না, গল্প করেন না। তিনি কথা বললেও বোঝা যায় না। কেবল তাকিয়ে থাকেন। কাউকে বকেন না, নিষেধ ও নির্দেশ করেন না।
মা আর আগের মতো নেই। পুরো সংসার যিনি একহাতে সামলে রাখতেন, তিনি এখন অন্য একজন মানুষ। যে মানুষটি চেনা, তবুও যেন দূরের কেউ। কথা বলেন না, গল্প করেন না। তিনি কথা বললেও বোঝা যায় না। কেবল তাকিয়ে থাকেন। কাউকে বকেন না, নিষেধ ও নির্দেশ করেন না। সারাদিন নিজের মতো থাকেন। কিন্তু কোনো কোনোদিন আচমকা বিশেষ কোনো কথা বলার জন্য মা বিচলিত হয়ে ওঠেন। তাঁর মুখে কথা আসে, কিন্তু কথা জিহবায় আটকে যায়। পরিষ্কার করে বলতে পারেন না।
রাতুল ঢাকা থেকে বাড়িতে এসেছে, অনেকদিন হয়ে গেল। মায়ের স্ট্রোক হওয়ায় রাজশাহীতে আসা, ভাগ্যিস সে সময় তার চাকরি ছিল না; তাই এতদিন গ্রামের বাড়িতে কাটানো সম্ভব হলো। এবার তো ঢাকায় ফিরতে হয়। কিন্তু মাকে ফেলে রেখে কি যাওয়া যায়?
পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন আসছেন। হাতে করে এটা ওটা নিয়ে আসেন। গল্প করার ছলে বসে থাকেন, গল্প আর হয় না। একা একা কথা বলে, খানিক সময় কাটিয়ে ‘যাই, ভালো থেকো। পরে আবার আসব।’ বলে তারা বিদেয় হয়। মানুষ আসে। যায়। ডাক্তার আসেন। কুশল জিজ্ঞেস করেন, ওষুধ দেন। এভাবেই চলতে থাকে।
এরমধ্যে একদিন এক বড়োভাইয়ের একটি ফোনকল এলো। তিনিও ঢাকায় থাকেন। মানবিক ধরনের মানুষ। লেখক ও অধ্যাপক, প্রায় ঘোষিত নাস্তিক। কিন্তু কথা শেষ করার মুহূর্তে বড়োভাইয়ের একটি কথায় চমকে যায় রাতুল। তিনি বললেন, ‘ঢাকায় যদি বিশেষ কাজ না থাকে, তাহলে তুমি মায়ের কাছে আরও কয়েকটা দিন থেকে যাও। যতটুকু সম্ভব মায়ের সেবা করো। এতেই তোমার সমস্ত দুঃখ ও সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হয়তো চাকরিরও।’
কথাগুলো শোনার পর, রাতুল থম ধরে বসে থাকে। সে আরও কিছুদিন গ্রামে থেকে যাওয়ার কথা ভাবে।
একদিন সকালে, নাস্তা সেরে বাড়িতে সবাই গল্পগুজব করছে। বেলা দশটার মতো বাজে। হঠাৎ বাইরের দরজার কড়া বেজে উঠল।
বাবা দরজা খুলে দেখেন, কয়েকজন অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। আগে কখনো দেখেছেন বলেও মনে হয় না। একজনের হাতে আপেল, বেদানা ও কমলার থলে। আরেকজন হরলিক্সের বড়ো জার বুকের সঙ্গে ধরে আছে।
বাবা প্রশ্নচোখে তাকিয়ে বললেন, আপনারা?
আমরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
তিনজনের বয়স পঁচিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। এরমধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ছেলেটি বলে কথাটি।
বাবা আবার জানতে চান, আপনারা কার কাছে এসেছেন?
মায়ের কাছে।
বাবা বললেন, তোমরা মনে হয় ভুল করে অন্য কোথাও এসেছ।
না, আমরা এই বাড়িতেই এসেছি।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রাতুল শুনতে পায়, কয়েকজন মানুষ এসেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে বাইরে এসে রীতিমত অবাক হয়ে যায়। কিছুদিন আগে শহরে রাতের অন্ধকারে যারা তাকে মারধর করে টাকা ও মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল, তারা। রাতুলের চোখ কপালে ওঠে; এরা বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে? ঠিকানা পেল কোথায়?
অস্থির ভঙ্গিতে রাতুল পায়চারি করতে থাকে। বাবা শুধালেন, কী হলো, ব্যাটা?
রাতুল সবাইকে সরিয়ে দিয়ে রাগী চোখে লোকগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়—আপনারা?
ভয়ে বা লজ্জায় সবাই মাথা নিচু করে ফেলে।
চোখের পলকে একজন মাটিতে বসে পড়ে। বাবার পা চেপে ধরে কাঁদতে থাকে, কাকা, আমাদের ভুল হয়ি গেছে। মাফ কইরি দেন।
বাবা বিব্রত বোধ করেন। আরে, কী করো, পা ছাড়ো?
বোনেরাও বাইরে বেরিয়ে আসে। রাতুলকে সন্দেহ করে। কিছু একটা ব্যাপার আছে, তারা আন্দাজ করে।
বাবাকে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে আসে রাতুল। বোনেরাও তার সঙ্গে আসে। সে গলার স্বর নিচু করে সেই রাতের ঘটনাটা সংক্ষেপে খুলে বলে।
বাবা হাসতে হাসতে বলেন, এত বড়ো একটা ঘটনা তুই চাইপি গেলি, বাপ?
রাতুল লজ্জিতভাবে হাসে। সেদিন রাতে তার কী-ইবা বলার ছিল? হাসপাতালে সবাই মাকে নিয়ে দুচিন্তায় দৌড়ঝাপ করছে, তার মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মড়ার উপর খাড়ার ঘা ঠেকতো। তাই সে চেপে গিয়েছিল।
ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত তিনজনের কারো মা নেই, মা থাকলেও সম্পর্ক তেমন গাঢ় নয়; একজনের মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এদের কারোরই বাবা বেঁচে নেই। ম্যাট্ট্রিক পাশের পর আর লেখাপড়া হয়নি। একরকম বখে গেছে। পার্টটাইম ছিনতাই করে, লোকাল মদ খায় এবং ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু মা যে অন্যরকম মানুষ এবং খুব সম্মানের, সেই জিনিসটা তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কীভাবে সেই উপলব্ধি ঘটল, সেটা এক রহস্য। কিন্তু তারা ভুল বুঝতে পেরে মনের কোথাও ধাক্কা খেয়েছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে ঠিকানা খুঁজে নিয়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তারা এতদূর চলে এসেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো কথাগুলো বলে তারা।
তিনজনের মধ্যে সবার বড়ো ছেলেটা লুকিয়ে বাবার হাতে একটা খাম তুলে দেয়।
বাবা অবাক; এটা কী?
পঞ্চাশ হাজার টাকা।
এত টাকা কিসের জন্য?
এই টাকাগুলা আমরা আপনার ছেলির কাছে থেকি ছিনতাই কর্যা লিয়েছিল্যাম।
বাবা ও দুই বোন রাতুলের মুখে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। ঢাকা থেকে ফেরার সময়, সেই রাতে এতকিছু ঘটে গেছে, তারা কল্পনাও করেনি। এতবড়ো ঘটনা সে চেপে গেল? কীভাবে হজম করে নিলো?
রাতুল চোখ নামিয়ে নেয়। বাবা এসে রাতুলের কাঁধে হাত রাখেন—মন খারাপ করিস নে বাপ। আল্লাহ যা করে ভালোই করে।
কিছুক্ষণ পর, চোখের পলকে ছেলেটা রাতুলের পায়ে পড়ে যায়। রাতুল বিব্রত বোধ করে। সে ছেলেটাকে দুহাতে ধরে দাঁড় করায়। বুকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটা হাওমাও করে কাঁদতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর, চোখের পলকে ছেলেটা রাতুলের পায়ে পড়ে যায়। রাতুল বিব্রত বোধ করে। সে ছেলেটাকে দুহাতে ধরে দাঁড় করায়। বুকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটা হাওমাও করে কাঁদতে থাকে।
ভেতরের ঘরে মা কিছু একটা বলতে থাকেন। তাঁর কথা বোঝা যায় না। সবাই ঘরে গিয়ে মার পাশে দাঁড়ায়। দেখে, মা ফল খাচ্ছেন। ছেলেগুলো যে ফল ও হরলিক্স এনেছে, সেগুলো তার পাশে রাখা।
মা আবারও কিছু বলতে থাকেন। সবার ছোটোবোনটা মায়ের নিত্যসঙ্গী এবং দোভাষী। মায়ের অস্পষ্ট কথা বাড়ির কেউ বুঝতে পারে না। সে ঠিকই অনুবাদ করে ফেলে।
কেউ তাঁর কথা বুঝতে পারছে না কেন? মা বিরক্ত হন।
বাবা কাগজ ও কলম এনে মায়ের সামনে ধরেন। মায়ের ডান হাত ও ডান পা অচল। বাম হাত ও বাম পা-ই ভরসা। তিনি বামহাতে যা লিখে দিলেন, হিব্রু ভাষাও হয়তো তারচেয়ে সহজ। কেউ পড়তে পারল না।
ছোটোবোনটা বাড়ির ভেতরে চলে গিয়ে গিয়েছিল। কেউ যখন মায়ের লেখা ও ইশারা বুঝতে পারছে না, সে এসে বলল, কী বুলছিস তুই উয়া? ভালো কইরি কথা বুল। তোর কথা তো কেহু বুঝতে পাইরছে না।
মা আবার ইশারা করলেন। এবার সে বুঝতে পারল। বলল, আব্বা, মা বলছে, লোকগুলাকে বাড়ির ভিতরে বসিয়্যা খ্যাতে দিতে।
বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল অচেনা ছেলেদের সঙ্গে। ঘরের ভেতরে একা একা বসে থেকেও মা ঠিক অনুমান করে নিয়েছেন, ছেলেগুলো খারাপ নয়।
যে-কোনোভাবেই হোক, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু ছেলেগুলো তো ভুল বুঝতে পেরেছে। আর তারা খারাপ ছেলেও নয়। খারাপ হলে কি আর এভাবে ঠিকানা খুঁজে ফিরে আসত?
বাড়ির সবাই খুশি। আত্মীয়ের মতো করে ছেলেগুলোকে ভেতরে নিয়ে বসানো হয়। গামছা ও সাবান দেওয়া হলো। টিউবয়েলে হাতমুখ ধুয়ে ওরা একসঙ্গে খেতে বসল। বাবা ও বোনেরা খুব যত্ন করে পাশে বসিয়ে খাওয়ালো।
শীতের দিনের বেলা সস্তা মোমবাতির মতো দ্রুত ফুরিয়ে আসে। দুপুরের আহারের পর সবাই বসে গল্পগুজব করল। বেলা পড়ে এলে ছেলেগুলো উঠে পড়ল। বাড়ি যাবে। কেউ বলেনি, তবুও মায়ের কাছে গিয়ে তারা আশীর্বাদ চাইল।
মা চোখ তুলে তাকালেন। ছেলেগুলোকে ভালো করে দেখলেন। এরপর বামহাত তুলে হাসিমুখে প্রত্যেকের মাথায় হাত বুলিয়ে কী সব বললেন, বোঝা গেল না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু পথ হেঁটে গেলে ভ্যান পাওয়া যায়। ভ্যানে করে মাইল তিনেক যাওয়ার পর, বাস চলাচলের পাকা সড়ক।
বাবা বললেন, চলো বাবারা, তোমাদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
দলের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছেলেটি বলল, না বাবজি, আপনি আর কষ্ট করেন না গো। আমরা ঠিক চইলি য্যাতে পারব। মুনের মধ্যে কষ্ট লিয়েন না। আমরা গেনু। বলেই তারা হাঁটতে শুরু করে। যেতে যেতে একবার পাশফিরে তাকায়। তাদের প্রত্যেকের চোখেমুখে আনন্দ ও বিজয়ের হাসি।
বাড়ির পেছনে গাছের আড়ালে একটা পাখি সুরেলা গলায় ডেকে ওঠে। ছেলেগুলোর চলে যাওয়ার দৃশ্য এবং তাদের হাসি দেখে বাবার মনটাও প্রশান্তির আলোয় ভরে ওঠে।
মাসউদ আহমাদের জন্ম ৫ জুন ১৯৮৫, রাজশাহীর পুঠিয়ায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। লেখালেখির চেষ্টা অনেকদিনের। গল্প দিয়ে শুরু। ছোটোগল্পই লেখার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সব দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী এবং সাহিত্যপত্রে গল্প বেরিয়েছে। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তিনটি গল্প; সর্বশেষ গল্প বেরিয়েছে দেশ শারদীয় ১৪২৮-এ। প্রথম উপন্যাস ‘নিজের সঙ্গে একা’ প্রকাশিত হয় বইমেলা ২০১৬-তে এবং ২০১৭-তে ‘রূপচানের আশ্চর্য কান্না’। তিনি গল্পবিষয়ক ছোটোকাগজ ‘গল্পপত্র’ সম্পাদনা করেন। পেশা সাংবাদিকতা। বর্তমানে দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।