দ্বিতীয় পর্ব
• আরো দিন আরো রাত্রি
নদীটা নাকি শীতের সিজনে একেবারে সরু, একটুখানি হয়ে ওঠে!
কী জানি! হবে হয়তো! বাট নাউ, সেটা আমার পক্ষে এখন— নো ওয়ে টু ইমাজিন! এখন তো আমার চোখের সামনে শুধু পানি! যতোদূর তাকাচ্ছি, শুধু পানি— পানি! থপথপা পানি! ছল্লর চ্ছল ছল্লর চ্ছল করে যেতে থাকা পানি! কাঁপতে থাকা নাচতে থাকা পানি! দিনের আলোয় সেই পানির কালারটাও যে কেমন ব্রাইট দেখায়! ওশেন গ্রিন! ড্যাজলিং ড্যানসিং গ্রিন!
আর রাতে? ইফ! রাতে এ-পানিকে আর পানি বলেই তো বোঝা যায় না! এইখানের রাত যে কতো ভীষণ ডার্ক! কতো ভীষণ ব্ল্যাক! ডার্ক ডার্ক! এভরি হোয়্যার— কেমন অফুল একটা ডার্কনেস! যেন আমাকেও তখন আমি আর দেখতে পাচ্ছি না! শুধু ফীল করছি, আই এক্জিস্ট! ব্যস! অই-ই! এমন ডার্কনেস—আমি কখনো দেখেছি আগে? আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে কেমন ছিলো রাতের কালার? এমনই ব্রাইট এন্ড ব্রিলিয়্যান্ট ডার্ক ছিলো? এমনই ফুললি কাম এন্ড কোয়ায়েট, বাট লাইভলি? এমনই?
এমনই অসাম? এমনই ভয়-জাগায়ে দেওয়ার মতন অসাম? বাট! লুক! কী কথা মনে আনি আমি! আমি কী আর ওটা মনে করতে পারবো? অই যে, অমন ডার্কনেসকে আমি আগে কখনো দেখেছি কিনা? এটা কী মনে করতে পারবো আমি? পারছি কই? নিজের নামই যার আর মনে নেই, সে কিনা ডার্কনেস দেখাদেখির কথা মনে করতে চায়! ধ্যাত! নিজেকে নিজের অই কোশ্চেন করে লাভ কী! অকাজে!
রাতের অই অন্ধকারের মধ্যে, নদীটাকে তো আর ক্লিয়ারলি বোঝার উপায় নেই! শুধু সামনের অংশটাকে আরো ঘন আরো কালো দেখাতে থাকে! শুধু বাতাসটাকে পানি-ভেজা পানি-ভেজা লাগতে থাকে! আর, সেই সাউন্ডটা পাওয়া যেতে থাকে! ছ্ল্লর চ্ছল ছল্লর চ্ছল! ছল্লর চ্ছল ছল্লর চ্ছল!
এমন অন্ধকারে— এমন রাতের কালে, সেই রাতে, পচা মিয়া কেমন করে আমাকে খুঁজে পেয়েছে! কীভাবেই বা আমাকে কিনারায় টেনে এনেছে! আমি—আমি—সেটা আন্দাজও করতে পারি না! কী সাংঘাতিক! কী ভীষণ! টেরিবল! টেরিবল!
এমন অন্ধকারে— এমন রাতের কালে, সেই রাতে, পচা মিয়া কেমন করে আমাকে খুঁজে পেয়েছে! কীভাবেই বা আমাকে কিনারায় টেনে এনেছে! আমি—আমি—সেটা আন্দাজও করতে পারি না! কী সাংঘাতিক! কী ভীষণ! টেরিবল! টেরিবল! ওটা ভেবে ভেবেই তো— আমার নিজেকে হেল্পলেস লাগতে থাকে! আর, গ্রাটিচুট আসতে থাকে আমার মনে! অনেক অনেক করে আসতে থাকে! খুব বলতে ইচ্ছে করতে থাকে, পচা মিয়া! সো কাইন্ড অফ য়্যু! আই অ্যাম গ্রেটফুল! এক্সট্রিমলি এক্সট্রিমলি!
কিন্তু এখানকার এনভায়রনমেন্টটা এমন! কোনো একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলে ওঠার, একটা কোনো ইমোশনাল কিছু বলে ওঠার— কোনো স্কোপই যেন এখানে নেই! তেমন একটা রাইট কোনো মোমেন্টই যেন আসে না এখানে! সব সময়ই মনে হতে থাকে— দিস ইজ নট দ্য রাইট টাইম টু সে দিস! এখন অই কথা বলার সময় না! এই কথাটা এখন বললে খুবই অকওয়ার্ড শোনাবে! পরে বলা যাবে! পরে!
সেই পরেটা কখন আসবে? আর আসে না! আমি শুধু চুপচাপ বসে থাকি, আর তাদের দুজনকে নড়তে-চড়তে দেখতে থাকি!
নদীটা তো আর এখন—এই বাড়িটা থেকে একটু কোনো দূরে নয়! ডিসটেন্স বলতে একটা ফাঁকা ইয়ার্ড মতন জায়গা আছে, এরা দুইজনে অইটাকে ডাকে বাইরা-উঠান! সেটার পরেই নদীটা আছে! বর্ষাকালে এমনই নাকি হয়ে ওঠে এই নদী! একেবারে বাড়ি-ছোঁয়া হয়ে থাকে! দেন, শুকনার সময়ে অই কোন দূরে নেমে যায়! অনেক নাকি দূরে!
শুকনার সময়ের সেই নদীটাকে দেখারও ডিজায়ার হচ্ছে কিন্তু আমার! খুবই হচ্ছে সেটা— আজ দুদিন থেকে! কিন্তু তখুনি আবার মনে আসছে, অতোটা দিন কী আর এখানে আমার থাকা হবে? ওই যে সেই শুকনার টাইম পর্যন্ত? উমহু! মনে হয় না তেমনটা হবে! নিশ্চয়ই সেই সময়টা আসার অনেক আগেই— আমার নামটা আর আমার অ্যাড্রেসটা—আমার মনে পড়ে যাবে! আর, তখনই তো আমি রওয়ানা দিয়ে দেবো! একদম! এজ আর্লি এজ পসিবল—আই উইল স্টার্ট! একেবারে আর তখন টাইম ওয়েস্ট করবো না!
কী জানি! কতো না-জানি কাজকর্ম আমার জন্য ওয়েট করছে! না-জানি আমার রেলেশনরা—আমার জন্য কতো টেনসডই না হচ্ছে! কতো না-জানি খুঁজছে আমাকে তারা!
আচ্ছা, আমি যে এমন ভাবছি, আমার কী আসলেই রেলেশন ইত্যাদি আছে? ছিলো? যদি থেকেই থাকে, তাহলে তাদের এই মেয়েটা, এই আমি, কেমন করে নদীতে পড়ে যাই? তারা কেউ কেন আমাকে তুলে নিলো না? নাকি তারা জানতোই না, আমি জলে ডুবে গেছি?
তারা কারা ছিলো? তাদের একটা কোনোজনের মুখও কী আমার মনে আসতে পারে না? পারে না? আসা কি উচিত নয়? কিন্তু আমার মেমোরী একেবারে ব্ল্যাঙ্ক! কিচ্ছু নেই কিচ্ছু নেই! কিচ্ছু মনে আসে না আমার! আহ! এটা কী একটা ডিজিজ হয়ে আছে! কেন এমন!
রাতের নদীটার কাছে গিয়ে দাঁড়াবার—বারবার দাঁড়াবার—খুবই একটা ইচ্ছে আছে আমার! ইচ্ছে আছে, অনেক অনেকক্ষণ ধরে—সেই ডার্কনেসের— ফেস টু ফেস বসে থাকি! তাকে দেখা না-গেলো তো কী হলো! পানির সাউন্ড তো পাচ্ছি! তাই না? কিন্তু পচা মিয়া সেটা কিছুতেই এলাও করে না! বুচি বিবি তো নয়ই! তারা কিছুতেই আমাকে অন্ধকারে বের হতে দেয় না!
সেই প্রথম দিনে, আমার ইচ্ছের কথাটা একটু শুনেই যেন বুচি বিবি সেন্সলেস হয়ে গেছিলো! সেদিন থেকেই তার পরান নাকি—আর তার পরানের ভিতরে নাই! বারবার এই এক—কী একটা কথা—সে রিপিট করছে! করছেই! করেই চলেছে! বলছে, ‘এইটা তো ভালা কতা না! রাইতের নিশিকালে কন্যার ক্যান গাঙের কাছে যাওনের হাউস হইবো?
সেই প্রথম দিনে, আমার ইচ্ছের কথাটা একটু শুনেই যেন বুচি বিবি সেন্সলেস হয়ে গেছিলো! সেদিন থেকেই তার পরান নাকি—আর তার পরানের ভিতরে নাই! বারবার এই এক—কী একটা কথা—সে রিপিট করছে! করছেই! করেই চলেছে! বলছে, ‘এইটা তো ভালা কতা না! রাইতের নিশিকালে কন্যার ক্যান গাঙের কাছে যাওনের হাউস হইবো? কি গো মিছার বাপ! দেহেন দেহেন! নিশিয়ে নি ডাক দিতাছে কন্যারে! খেয়াল কইরা দেহেন কইতাছি!’
আররে বাবা! নিশি আবার কী জিনিস? সে আবার কে? এই যে বাড়িটা আছে না, এর আশপাশে, কোনো—কোনো একটাও নেইবার নেই! এই বাড়িটা নিজে— লাইক এন আইল্যান্ড! এন আউট অফ দ্য ওয়ে প্লেস! এখানে নিশি নামের কে আবার আসবে? এসে, সে আবার আমাকে ডাকবে? আসবে কোত্থেকে? ডাকা তো পরের ব্যাপার! খুব উদ্ভট কথাবার্তা বলে কিন্তু এই বুচি বিবি! ভেরি ইরেলেভ্যান্ট, ইররেশনাল কথাবার্তা বলে কিন্তু সে! যেসব কথার কোনো মাথামুণ্ডু নেই, তেমন কথা সে হড়গড় হড়গড় করে বলতেই থাকে!
যাক গা! প্রথম দিন আমি একেবারে হুট করে—সেই অন্ধকার নদীর সামনে—চলে গিয়েছিলাম! তখন কতো রাত কে জানে! বুচি বিবি পাটি পেতে পেতে সকলের শোয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট করছিলো! ঘরের কোণে কেমন একটা ল্যাম্প জ্বলছিলো! কোনো ঢাকা-ঢাকনা ছাড়া, আগুনের একটা মাত্র শিখা দপদপাতে থাকা— ল্যাম্প মতো জিনিসটা! বুচি বিবি অইটাকে বলে—কুপি! পচা মিয়াও ঠিক অই একই নামে ডাকে ওটাকে!
তাহলে আমারও তো ওটাকে কুপি বলে ডাকাই উচিত, তাই না? আচ্ছা তাহলে! এখন থেকে সবসময় বলবো— কুপি কুপি কুপি!
তো, কুপিটার শিখাটা তখন খুব কাঁপছিলো! সেই শিখাটার দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎই আমার মনে হয়েছিলো, এমন বাতি আমি আগেও দেখেছি! কোন—কোন এক বইয়ে যেন এর ছবি দেখেছি! দেখে দেখে তখন ভারী অ্যামেইজড হয়েছি! কিন্তু বাস্তবে, একেবারে চোখের সামনে, তাকে দেখছি এই প্রথম!
কোন বইয়ে এমন ছবি দেখতে পেয়েছিলাম? কোনখানে দেখতে পেয়েছিলাম? কোথায়! কোথায়? এই কথাটা মনে নাড়তে নাড়তে— হঠাৎ আমার— নদীটার জন্য একটু কেমন লাগতে থাকে! একটু কেমন যেন একটা টান! মনে হতে থাকে; যাই তো! দেখে আসি গে, এই রাত্রিতে সে কেমন আছে! আমি তখন খুব চুপ করে, ঘর থেকে বেরোই! বেরিয়ে, বাড়ির ভেতরের ইয়ার্ডে এসে দাঁড়াই! ওরা এই প্লেসটাকে কী বলে? বলে, ভিতরের উঠান!
বুচি বিবি আমার অই বেরুনোটাকে খেয়াল করতে পারেনি তখন! পারার কথাও নয়! সে তখন বাত্তি জ্বালানোর তেলের সংকট নিয়ে বড্ডই অস্থির হয়ে ছিলো! অই তো নাকি রেড়ির তেল! সেটাও নাকি এই আশেপাশের মুল্লুকের কোনোদিকে আর এখন পাওয়া যাচ্ছে না! পেতে হলে নাকি যেতে হবে—কোন সেই দশ ক্রোশ দূরের কোনোখানে! পচা মিয়া তার অই কাহিল শরীর নিয়ে, অতোটা দূর, কীভাবে যাবে! অতোখানি নাও-বাওয়ার তাকদ তো তার দেহে নেই!
তাহলে, আগে কেমন করে, সেই তেল জোগাড় করে নিতো তারা দুইজন? তখন সেটা জোগাড় করায় কোনো মুসিবতই নাকি ছিলো না! কারা নাকি বাইন্না আছে! তারা পানির দিনে নাওয়ে করে সওদা বেচতে এসে যেতো! আর যখন শুকনার সময়, তখনও আসতো তারা! পায়ে হেঁটে হেঁটে! এক পক্ষকাল একপক্ষ কাল বিরতি দিয়ে দিয়ে!
এসে, তারা রেড়ির তেল বেচে যেতো! আর, হিসেবমতো কাঠা ভরে ভরে ধান নিতো! সেই বাইন্নারাও কখনো কখনো আসতে দেরী করে ফেলতো! তখন জোলাপাড়ার কেউ না কেউ— ঠিকই এসে একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতো!
কোথায় সেই জোলা পাড়া? এই যে এই ভিটির অই দূর দক্ষিণে— অই যে অনেকটা দূরে—একটা কালো ঝোপ-মতো একটা কিছু দেখা যায়! সেটাই সেই জোলা পাড়া! সেইখানে এখন আর কেউ নেই!
কেমনে থাকবো! আকালের বচ্ছরে, ভাতের ভুখ পেটে নিয়া নিয়া—তাগো তাবৎগিলিরেই জান খোয়াইতে হইছে! বাল-বাচ্ছা কী বুইড়া কোনো একটা জোনের কেউই— বাইচ্চা নাই! অখন খালি শূন্য ভিটি—দিনরাইত ছমছম করে— ছমছম করে! বাইরার দিনে খসমেরে লইয়া কী— কোষা নাওখান বাইয়া তারা দোনোজোনে—সেইনে না—গেছে নি? গেছে! গিয়া, নিজ অক্ষিতে অই মউতাপুরীরে দেইক্ষা আইছে বুচি বিবি!
আহা! কারা ছিলো তারা? তারা খেতে না-পেয়ে মারা গেছে? মানে এইখানে একদিন তবে ফ্যামিন গোছের কিছু হয়েছিলো! ইস! ইস! পিটি!
তারপর? তারপর কী?
তারপর যে কী—সেটা আর বুচি বিবি বলে না! আবার রেড়ির তেল নিয়ে তার আফসোস শুরু হয়ে যায়!
তখন, তখন আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো, ‘আমি এনে দিতে পারি তো! আমি এনে দেবো নে! অতো ভাবতে হবে না!’
কিন্তু কথাটা বলিনি! একে তো বুচি বিবি আমার কোনো কথাই বুঝতে পারে না! আমি কিছু বললে, সে শুধু কেমন নড়বড়ে চোখ নিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে! আর, আমি কীভাবেই বা অই তেলটা এনে দিতে পারবো? আমি কী নৌকা-বাইতে জানি নাকি? কোথায় যেতে হবে—তাও কী জানি নাকি? যাহ! কী যে ইচ্ছা আসে আমার! অ্যাবসালুটলি ক্রেইজি!
তখন আমি এই-তাই ভাবতে ভাবতে— ঘর থেকে বেরিয়ে আসি! এসে, তারপর, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দিয়ে— আরো অন্ধকারের কাছে চলে আসি আমি! অই তো! ছল্লর চ্ছল ছল্লর চ্ছল! সাউন্ডটা শোনা যাচ্ছে! অই তো সাউন্ডটা কাঁপছে! এই জাস্ট ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, আবার হঠাৎই একটু যেন নিচের দিকেও নেমে যাচ্ছে! বাহ!
কিন্তু ওই সাউন্ড আর ওই ডার্কনেসে; আর ওই আই অ্যাম অল এলোন—এই ফিলিং নিয়ে হ্যাপি বোধ করে করে দাঁড়িয়ে থাকা—এমনটা আর বেশিক্ষণ পাওয়া হয় কই আমার! এক গোছা পাটখড়ির মাথায় আগুন ধরিয়ে—তারা দুজনে—ঠিক এসে পৌঁছে যায় আমার কাছে!
কিন্তু ওই সাউন্ড আর ওই ডার্কনেসে; আর ওই আই অ্যাম অল এলোন—এই ফিলিং নিয়ে হ্যাপি বোধ করে করে দাঁড়িয়ে থাকা—এমনটা আর বেশিক্ষণ পাওয়া হয় কই আমার! এক গোছা পাটখড়ির মাথায় আগুন ধরিয়ে—তারা দুজনে—ঠিক এসে পৌঁছে যায় আমার কাছে! হাঁপাতে হাঁপাতে—একদম হুড়মুড় করে— পৌঁছে যায়!
তাদের সাথে অবশ্য নিজেদের হাউরাউ চেঁচামেচিকেও নিয়ে আসে! তারপর বুচি বিবি আমাকে দিয়ে কতো কতো প্রমিস যে করায়! কীসব মাথার কিরা দেয়! আসমান-জমিনের কসম কাটায়! মায়া-বাসনা-দরদের দোহাই দেয়! বিষয়গুলো যে ঠিক কী, আমি ক্লিয়ারলি বুঝিনি! অনেস্টলি! পরিষ্কার বুঝিনি!
কিন্তু তাদের দুজনের চোখে, আমার জন্য একটা টেনশনকে দেখতে পেয়েছি আমি! এইটুকুতেই আমাকে নিয়ে এতো স্কেয়ারড হয়ে গেছে—দুজন? আরে! অবাক-কর তো!
আচ্ছা বাবা! আচ্ছা! রাতের এমন অন্ধকারে আর আসবো না আমি এমন জায়গায়! নেভার! শান্তি? শান্তি তো? আমি দেখি, তারা আমার প্রমিস শুনে খুব রিলিভড হয়ে ওঠে! এদের হেল্প নিয়ে থাকতে হচ্ছে আমাকে! তাহলে, তাদের কথা মতো চলিই না-হয় একটু! একটু না-হয় শুনলামই তাদের কথা! কী প্রবলেম!
তবে তার পরদিন; বেলা একটু চড়ে উঠতেই, পচা মিয়া নিজেই আমাকে গাঙের সামনে নিয়ে আসে! নিয়ে আসে, গাঙের মুখোমুখি বসে থাকার জন্য! বলে কী, এটা নাকি একটা টোটকা!
‘টোটকা? টোটকা আবার কী জিনিস?’ আমি পচা মিয়াকে জিজ্ঞেস করি!
কিন্তু সে আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে, চুপ মুখে আমার দিকে চেয়ে থাকে! যাহ! আমি তো ভেবেছিলাম, পচা মিয়া হয়তো আমার কথা একটু কিছু বুঝতে পারে! কিন্তু সেটা মনে হয়, আমার ভুল ধারণা!
পচা মিয়া আমার কথার কোনো জবাব দেয় না, তবে নিজে নিজেই অনেক কথা আমাকে জানাতে থাকে! সে বলে যে, আমার বিমারীর জন্য নাকি এই টোটকাটাই একমাত্র উপকারী দাওয়াই! হতেও পারে, গাঙের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে— আমার পরিচয়টা আমার মনে পড়ে যাবে! আমার নামটাও হয়তো মনে চলে আসতে পারে আমার! বা, আমার বার্থপ্লেসের কথাটা হয়তো মনে এসে যেতে পারে! হতে পারেই তো অমনটা!
একদিন নাকি তার ওস্তাদেও তার ওপর এই টোটকাটা অ্যাপ্লাই করেছিলো! তাতে কী কোনো ফল ফলেছিলো? পচা মিয়া সেটা অবশ্য আমাকে জানায়নি! আর, আমিও এমন! আই ফরগট টু আস্ক! অবশ্যই আমি তাকে এটা জিজ্ঞেস করবোই করবো!
তারপর থেকে এই যে আজকে পর্যন্ত— আমি কিন্তু নদীর দিকে চেয়ে চেয়েই—বেলা পার করে যাচ্ছি! খালি ঢেউ দেখি আর ঢেউ দেখি! আর দেখি, অই যে কোন দূরে একটা কালো ছোপ! আমার ডান হাত বরাবর—অই যে সেটা! অইটাই তো দক্ষিণ দিক? অইটাই তো সেই জোলাপাড়া? সেইখানে এখন আর কেউ বেঁচে নেই, তাই না? ইসস!
অই জোলাপাড়া ঘেঁষেই এই নদী নাকি গিয়ে মিশেছে অন্য আরেক নদীর সাথে! পচা মিয়া আমাকে বলেছে, সেইখানেই তার খড়া জাল পাতা আছে! রোজ ভোর-বিহানের সময়ে, সে তার কোষা নাও বেয়ে বেয়ে অইখানে চলে যায়! মস্ত মস্ত বাঁশের খুঁটি পোতা আছে সেইখানে! সেই খুঁটিতে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে সে জাল ফেলে, জাল তোলে! কোনোবার মাছ পায়! কোনোবার একটাও ওঠে না!
এতো মাছ দিয়ে কী হবে? এতো এতো মাছ দিয়ে কী করে ওরা? ওরা বলে কী, অমনে মাছ না-ধরলে, কেমনে কী হতো? আমার পাতে কী দিতো! এই জালটা যদি পাতা না-থাকতো, তাহলে ওরা আমাকে কেমনে— সামলে নিতো!
বাহ! আমি বুঝি বলেছি, আমাকে মাছ দাও? কিছুই বলিনি, তাও কেবল গাদা গাদা মাছের ঝোল আমাকে খেতে দেয়! ইন ফ্যাক্ট, আমাকে ওগুলো খেতে বাধ্য করে বুচি বিবি! ইফ! এটাকে টর্চার করা বলে না?
আচ্ছা! যাই হোক! এই যে রোজ সকালে এসে নদীর মুখোমুখি বসছি! বসেই চলছি! আমার কী কিছু মনে আসছে? ইজ দেয়ার এনি সাইন অফ ইমপ্রুভমেন্ট? নো! নো!
• বিজলি-আকারে ঝিলকানী দেয় বাদল-নিশীথ! আর দেওয়ায় গুড়মুড় গুড়মুড় ডাক পাড়ে!
শাঙন মাইস্যা রাইত! আসমানে মেঘের ডাকাডাকির কোনো কমাকমতি নাই! একেকটা বিজলি আতকা আতকা খাজলা দিয়া দিয়া ওঠে; আর তার এট্টু বাদেই আসমানরে কাঁপাইয়া-লড়াইয়া দেওয়ায় গর্জানী দেয়! তারবাদেই কিনা— নয়া কইরা তেজী ঢল নামতে শুরু করে! এই এক ছোলা শেষ হয়, অমনেই বিজলির চিলকানি আর দেওয়ার গমগমানি নাইম্মা আহে! হেইরবাদে ঝমঝমাইয়া-চলবলাইয়া ঢল নামা শুরু করে! এমনই চলতাছে! চলতাছেই।
সন্ধ্যা রাইত তেনেই হেদিন আসমানের অই অবস্থা!
তয় অই ঢল নামানামি আতকার উপরে ঘটে নাই! আল্লার দুনিয়ার ভোর-বিয়ানের কাল তেনেই, দিনটায়, মেঘ-বাদলায় একেবারে আখা-মাখা হইয়া আছিলো হেদিন! আসমানে হেইদিন, পুরা, থমথমা ঘুরঘুট্টি মোখ কইরা থুইছিলো! ভাবে মোনে হইতাছিলো য্যান, রাইতের কাউয়া-কালা আন্ধারটায় হেইদিন কিছুতেই দিনেরে ফুচকি দিতে দিবো না! না-ই!
অই তো আমাগো এত্তটুক সংসার! এইনে, কোনো ঢলের ছোলা-ঝাপটারে যেমুন আমাগো গোণায় ধরোনের কোনো উপায় নাই! তেমুন, রইদ-বান— বাতাসেরেও গোণায় ধরলে— আমাগো চলে না। একফোঁটা কুইড়ামী করোনের কোনো কিসমত নাই আমাগো!
বাইত তো বলতে গেলে আমরা দুই মনিষ্যি! কিন্তুক আমাগো দোনোজনের উপরে ভরসা কইরা থাকোনের জীবের তো অভাব নাই! অগো মোখে দানাপানি দেওনের দায় তো মালিকে—আমাগো কান্ধেই দিয়া থুইছে!
বিয়ান হইতে না হইতেই, মুরগীগিলিরে দানাপানি দেওন লাগে! সেই দানাপানি দেওনের চিন্তায়, সংবচ্ছরই আমার পরিবারে য্যান তার পিঠটারেও ভালামোতন পাটিতে ঠেকায় না! রোজকার শেষরাইতের আন্ধারের কালেই সেয় উইট্টা বইয়া থাকে! সেইটা তহন খটমটা জারের দিনই হউক, কী বাইরা মাইস্যা তুফান-ঢলের খোনই হউক!
সেয় একহাতে নিজের লাঠিখানরে ধরে, আরেক হাতে খুদের খোরাটারে নিয়া উঠানে নামে! মোখে মোখে—ক্বক ক্বক ক্বক আওয়াজ দিতে থাকে, আর উঠানের এককোণায় খুদ ছিটাইতে থাকে!
সেয় একহাতে নিজের লাঠিখানরে ধরে, আরেক হাতে খুদের খোরাটারে নিয়া উঠানে নামে! মোখে মোখে—ক্বক ক্বক ক্বক আওয়াজ দিতে থাকে, আর উঠানের এককোণায় খুদ ছিটাইতে থাকে! এটি হইলো খালি মুরগীর-খোরাকী!
হাঁসের খোয়ারের ঝাপখানেরে সেয় তখনও তোলে না! অই দুই জাতের পুষ্যিগো— খাওনের দানাপানি তো আর একপ্রকার না! আর সেয় একলা হাতে— অই দোনোজাতের প্রাণীরে— তো সামলানিও দেওনের তাকদ রাখে না! বেকা-তেরা দেহখান নিয়া সেয় তুইক্কা তুইক্কা যট্টুক পারে, করে! আমারে সেইসব কামে হাত দিতে দেয় না!
তাও আমি সেইদিন, বিয়ানের কালে, এট্টু কুইড়ামী করতে চাইছিলাম! পরানটায় চাইছিলো কী, আট্টু কাইত হইয়া থাকি! কিন্তুক অই যে আমার পরিবার, হেয় যুদি মেঘ-পানি মাথায় লইয়াই, লাঠি ঠকরাইয়া ঠকরাইয়া উঠানে নাইম্মা যাইতে পারে; তাইলে কী আমার আর চাটিতে পইড়া থাকোনের হাউসটা থাকে? না, সেইটা কোনো মাইনষের কর্ম হয়?
হের যুদি নিজের পালা-পোষা জীবের লেইগা এমুন দরদ থাকতে পারে, তাইলে আমার নিজের গিলির লেইগা আমার ক্যান থাকবো না? তয়, আমার মায়া-মহব্বতের জীবেরা তো খালি আর এমুন বাড়ির উঠানের খোয়ারে, নাইলে গোয়াইলে তো বসত করে না! আমারগিলি পানির সন্তান! হেরা পানিতে থাকে!
তহন আমি করি কী, তক্ষণ তক্ষণ আমার কোষা ডিঙিখানরে ঠেলা দিয়া পানিতে ভাসাইয়া দেই! অই যে দইখনে, গাঙের মোখে, আমার খরা জালখান পাতা আছে! যাই, দেহি গা দুগা আবিজাবি মাছ পাই নি! গিয়া দেহি, আয় ছোবানাল্লা! মাছে মাছে আমার জালখানে এক্কেরে সাদায় সাদা-খলবলা!
কিন্তুক এই এত্তা মাছ দিয়া—আমরা কী করমু? আমার পরিবারে অই মাছেরে—আর কতো হুটকি দিবো? কতো রান্ধবো? আমাগো এই দুই পেরানীর— মোখের আহার আর— কট্টুক লাগে? আহহারে!
এই ত্তো জোলাপাড়া! এইনের ঘরে ঘরে এককালে এই মাছ, এক মুঠ এক মুঠ কইরা হইলেও— দিয়া যাওনের দিনও তো আছিলো আমাগো! হেগো হগলতের ঘরে ঘরে তহন তাঁত! হেগো হাত জোড়া তহন খালি কর্ম আর কর্ম! এই সুঁতা কাটে! এই মাকু টানে! এই কাপড় বোনা নিয়া টানা-পোড়েনে থাকে!
তহন অই পাড়ার উঠানে উঠানে কতো আওয়াজ! কতো ডাক কতো মশকারার আখলি-পাখলি! কতো জোনেই না হোক্কা হাতে নিয়া নিয়া তাগো ভিটির কিনারে কিনারে আইয়া আমারে কতো ডাক পাড়ছে! ‘আহো শেহের পো! এক ছিলিম টান দিয়া লও! শইল্লে জুইত আইবো! আহো আহো!’
তারবাদে কেমনে কেমনে কী দিন আইলো অইটা! আগুন গজইব্বা দিন!
আগের রাজা-বাদশার রাজত্বি বোলে কেমনে কেমনে কেটায় কেটায় নিলো গা! আইচ্ছা! রাজার রাজত্বি নিছে, নিছে, এক রাজায় গেছে, আরেক রাজায় আইছে— এমুনই ত্তো দুনিয়ার রীতি! হেগোটা হেরা বুজুক! রাজ-রাজত্বির কতা দিয়া আমাগো কী কাম! আমাগো জোলাগো তাঁত লইয়া জোলারা আছে! আমার আবাদী আর মাছ-মারোন লইয়া— আমি আছি! থাকি আমরা—আমাগো মোতন!
না, হেইটা থাকোনের কিছমত হইলো না! আতকার উপরে কী জানি অইলো! কী একটা জানি! পষ্ট কইরা বোজলাম না কিছু! তয়, দেখলাম; জোলাগো উঠানে উঠানে তাঁতের জাগায় তাঁত পইড়া থাকলো, মাকুর জাগায় মাকু! হায় হায়! কেউইর হাতে কোনো কর্ম নাই! কোনো কর্ম নাই! কাপোড় পাওনের বোলে অন্য পন্থা আনছে অই নয়া রাজায়! কী কয় এইটা! কী কয়! হায় হায়!
জোলাপাড়ার সগলতের ঘরের মটকি-বোঝাই চাইল, করমে করমে মুষ্টি চাইল অইয়া আহে! কাঞ্জির ঘটিতে ঘটিতে— মুষ্টি কইরা কইরা জমাইন্না কাঞ্জির চাইলও কবে শেষ হইয়া যায়! হেইরবাদে কোনোদিগে আর কিছু নাই! হেচি শাগের ঝাড়ও তুলেমুলে শেষ অয়! হেলেঞ্চা! কলমী! আইন্না-বউন্না শাগ-লতি সব! সব শেষ অয়!
থাকোনের মিদে খালি থাকে এই গাঙখান আর গুটিক গুটিক ধুতরার ঝাড়! আহহারে! আর কিচ্ছু নাই। খাওনের সম্বল নাই। কোনো হাতে একটা কোনো কড়ি নাই! আশা নাই দিশা নাই। খালি আছে কালা জ্বর! আর পেটের দাস্ত! উলাইন্না-খিচাইন্না দাস্ত! আর থাকে, যহন-তহন দম্মর দম্মর পইড়া গিয়া গিয়া, মইরা যাওন!
হেই কিয়ামতের মিদে, এই টুন্ডা-লুলা আমাগো দোনোজোনের নি বাঁচোনের কতা? কতা না কতা না! এট্টুও না! হেইর মিদে, আমরা দোনোজোনে কেমনে বাচ্ছি, কেমনে বাইচ্চা রইছি— সেইটা আর আমাগো হিসাবে নাই! বাইচ্চা গিয়া হেষে খেয়াল কইরা দেহি, আমাগো কোনোদিগে একটা কোনো জনমনিষ্যি নাই! জ্যাতা একটা কোনো মনিষ্যি কোনোদিগে নাই! আমাগো জোলাপাড়ার একটা কোনো চালের নিছে— একটা কোনো ছাওয়ে ইস্তক বাইচ্চা নাই!
দয়াল! এইটা তুমি কী দিলা! লগের হগলতেরে নিয়া— এই দুই আভাইগ্যারে থুইয়া গেলা! এই হুনহুনা ছুমছুমা আন্ধার পুরীর মিদে, কোন পরানে বাইচ্চা থাকমু এই দুইজোনে? কেমনে বাকি জিন্দিগি পার করমু—এই অচল দুইজোনে? দয়াল!
এই আফসোস পরানে নিয়া নিয়া আমরা—কোনোমতে কোনোমতে—দিন-গুজরান করতাছিলাম! তয়, হাছা কইরা কইতে পারি, অই বাইচ্চা ওঠোনের পর তেনে— আমি য্যান আর আমাতে নাই! আমার চিত্তিরে য্যান আমি একখান ডরের কাছে বর্গা দিয়া ফালাইছি!
এই আফসোস পরানে নিয়া নিয়া আমরা—কোনোমতে কোনোমতে—দিন-গুজরান করতাছিলাম! তয়, হাছা কইরা কইতে পারি, অই বাইচ্চা ওঠোনের পর তেনে— আমি য্যান আর আমাতে নাই! আমার চিত্তিরে য্যান আমি একখান ডরের কাছে বর্গা দিয়া ফালাইছি! হেই ডরেই আমারে সর্বখোন হুকুমদারী করে! য্যান একটা লিকলিকা তেজী গোখরা হইয়া—সেই ডরখানে— আমার কইলজাটারে কেবল দংশন কইরা চলে!
কিয়ের ডর?
না! আমি যুদি দুনিয়া ছাইড়া আগে যাই গা, তাইলে আমার পরিবারের কী উপায় অইবো? আমারে মাটি-মঞ্জিলই বা কেটায় দিবো! কেইবা অই আধা অচল মাতারিরে দেইক্ষা রাখবো! মালিক সাঁই! কী উপায় করবা তুমি, হেইটা খালি তুমিই জানো রে! আমি তোমার বান্দা! আমার বুজে কিছু কুলায় না রে সাঁই!
ভিতরে ভিতরে এই কম্প নিয়া—কেমনে যে— আমার দিন যায় রাইত পার অয়! আমি তার কোনো হুঁশ রাখতে পারি না! কিন্তু হেরে.বুচি বিবিরে, তো এটি কওনের কোনো রাস্তা নাই! হেয় না—ডরাইয়া—আতকার মিদে মইরা যাইবো গা! থাকুক আমার পেরেশানী—আমার পরানের ভিতরে!
হেইদিনও, হেই শাঙন মাসের হেই দিনখানেও; খরা জালের তেনে কিছু মাছ ডুলায় তুলি আমি! আর, বেশিটা মাছরে গাঙের পানিতে ভাইস্সা যাইতে দেই। তারবাদে কোসাখানরে ঠেইল্লা-মেইল্লা আইন্না নিজেগো ঘাটায় ভিঁড়াই!
‘কিগো! আউজকা আপনেরে কিয়ে ধরছে? তামানটা দিন জালে থাকলেন কোন হিসাবে?’ বাইত পাড়া দিতে না-দিতে আমার পরিবারে আমারে ঝামটি দেওন ধরে! এই হইলো হের এক খাসলত! একটা কোনো কতারেই হেয় আর অখন এট্টুও মিঠা কইরা কইতে, কোনো এট্টু বাঞ্ছা পায় না! এট্টুও না!
কিন্তুক আমি তো বুঝ কইরা কইরা দেহি, ঠিকঅই হের দীলের ভিতরে মায়া-রহমে বসত করে! দরদে-বাসনায় হের দীল তো পুরাই টরাভরা! আমাগো এই বাইরা মাইস্যা সুখতী গাঙের লাহানই টরাভরা! কিন্তুক মোখে য্যান সেই মায়া-বাস্নারে বোঝাইতে দেওনের আর কোনো বাঞ্ছা নাই হের! ক্যান যে নাই! আহা!
এই যে আমার পরিবার— এই যে আমার উস্তাদের ঝিয়ে! হেয় তো হইলো—হেদিনের ছেড়ী! আমারে গাঙে পাওনের—বহুতদিন বাদেই— হের জন্ম হইছে! আমি তহন পুরা একবারে বুজ-বুদ্দিঅলা, ডাঙর! না-কইয়া তহন আমার চাইর গন্ডা বচ্ছর হইবো! হেইকালে উস্তাদে আর উস্তাদ-মায়ে, হেরা দোনোজোনে, আমারে একদম হেগো কইলজার ভিতরে রাইক্ষা পালা-পোষা করতাছিলো! তার মিদে তাগো কোলে আইয়া ধরা দিলো কিসে?
না! আসমানের চান্নির লাহান একখান ঝিয়ে! দুনিয়ার তেনে যাওনের আগে— হেই আসমানের চান্নিরে উস্তাদে কার হাতে সইপ্পা গেলো? না! আমার হাতে! যার কিনা বংশগুষ্টির কোনো চিনপরিচয় নাই! বাপ-দাদার নাম জানা নাই! মায়ের কুল-ঠিকুজির হদিস নাই! হেই কুলছাড়া বংশছাড়ার হাতে, নিজ ফরজন্দরে তুইল্লা দিতে উস্তাদের পরানে কোনোই অশান্তি হইতে দেখলাম না আমি! আল্লারে হাজির-নাজির কইরা সেয় আমার হাতেই— নিজ কন্যার হাতে তুইল্লা দিয়া গেলো! উল্টা আরো হেয় কয় কী, আদমের সন্তানের কাছে আদমের বংশরে থুইয়া যাইতাছি! তাইলে আমার কিয়ের চিন্তা কিয়ের অশান্তি!
মালিকে আমাগো কিসমতে কোনো পোলাপাইন লেখে নাই! সেইটা নিয়া আমার পরিবারের পরানে খিচখিচানী আছে, কিন্তুক আমার অমুন কিছু নাই! আমার ভিতরে কোনো শোক-তাপ, আহারী-মাহারী—এমুন কিচ্ছু নাই! তেমুনটা হয়ও না কোনো সোম! মালিকের কতো রহমত! সেয় আমারে আওলাদ-ফরজন্দ পাওনের বাঞ্ছা তেনে মুক্তি দিয়া থুইছে! উস্তাদের মাইয়ারেও যুদি দয়ালে হেই বাস্না তেনে নিষ্কিতি দিয়া দিতো! তাইলে হের পরানের জ্বালাটা থাকতো না! হেয় শান্তিতে বাঁচতো!
হেষে হেইদিন হের ঝাড়ি-ঝামটির তেনে কীপ্রকারে রেহাই পাইলাম আমি?
না! হের লগে লগে কাম হাত লাগাইয়া দিলাম আমি!
হেয় একদিগে মাছ কোটে, আমি আরেকদিগে হেই মাছের কতাটিরে নুন দিয়া ধুই! কিছু মাছেরে চুলার মাইট্টা তাওয়ার মিদে বিছাইয়া দিয়া— হুটকি হওনের বন্দোবস্ত করি! এই-তাই করতে করতে রাইত যে কোনসোম গহন হইতে থাকে, দোনোজোনের কেউই ধরতে পারি নাই!
হেইদিনের আসমান তো পুরা দিন ভইরাই মেঘ থলথলা, মেঘ গমগমা! ওদিগে সন্ধ্যা রাইতের তেনেই বিজলি চিলিক দিয়া দিয়া ওঠতে থাকে, দেওয়ায় গরজানী দিতে থাকে, আর আসমান তেনে য্যান ঢলকাইয়া ঢলকাইয়া ঢল নামতে থাকে! ঢলের উপরে ঢল! হেইর মইধ্যেই আমরা দোনোজোনে মাছের সামলান্তির কর্ম কইরা যাইতে থাকি!
এমনে এমনে নিশি পেরায় দুই পহর হইয়া যায়! ঠাটার গরজানী কমবো কী, আরো য্যান তেজী-তাগড়া হইয়া ওটতে থাকে! আউজকার নিশিয়ে এইটা কেমুন বান-তুফানেরে লইয়া লইছে! দয়ালে কী দুনিয়ারে আউজকা ভাসাইয়া নেওনের নিয়ত করছে?
এমনে এমনে নিশি পেরায় দুই পহর হইয়া যায়! ঠাটার গরজানী কমবো কী, আরো য্যান তেজী-তাগড়া হইয়া ওটতে থাকে! আউজকার নিশিয়ে এইটা কেমুন বান-তুফানেরে লইয়া লইছে! দয়ালে কী দুনিয়ারে আউজকা ভাসাইয়া নেওনের নিয়ত করছে? নিলে নেউক নেউক! অচল-টুন্ডা এই আমাগো দোনোজোনেরে হেয় তাইলে একবারে লইয়া যাউক! দোনোজোনেরে এক লগে নেউক! এক লগে!
এই কতা মোনে নিয়া আমি আমার পরিবারের হাতখানরে একদম শক্ত কইরা ধরি! ডোবলে, একলগেই য্যান ডুবি! ভাসলেও, একলগেই য্যান সেইটা হয়! দয়াল চান! একলগে নিয়ো! দোনোজোনেরে একলগে!
তেমন কালে আমার পরিবারে— এট্টু য্যান আমারে গুঁতা দেয়! অল্প এট্টু গুঁতা! ‘হোনছেন? কই গো উস্তাদের শাকরিদ, হোনছেন?’
‘কী হনমু? আগো কী হনমু?’
‘হিয়ালে ডাক পাড়তাছে! সবটিয়ে ঝোপ্পা বাইন্ধা, একলগে ডাক পাড়তাছে! হোনতাছেন না? কি গো?’
‘কী হোনতে আপনে কী হোনেন, উস্তাদের ঝি! এই মেঘ-আন্ধিয়ার শাঙন মাইস্যা নিশিরাইতে—আপনে হিয়ালেরে পাইলেন কই? ঠাটার কড়কড়ানীরে নি আপনে— হিয়ালের ডাক হোনতাছেন?’
‘আগো না না! হাছা হাছাই কইলাম— হিয়ালে হুক্কার দিতাছে! হোনেন গো হোনেন!’
ঘুমের মিদে নি উস্তাদের ঝিয়ে— কী কইতে কী-কইতাছে? আমি তহন ভালা কইরা কান খাড়া করি! ওরে মাবুদ! মেঘের ঝিমঝিমান্তি, দেওয়ার গরগরান্তির ভিতরেও অই ত্তো—হিয়ালের ডাক! হাছাই ত্তো দেহি!
হিয়ালেরা সবটিয়ে— একলগে চিক্কুর দিয়া দিয়া— কী কইতাছে! কারে তারা কী কইতাছে?
আরে! কারে আবার! অরা তো দেহি আমারে ডাক পাড়তাছে! অগো জান-পরান এক কইরা, আমারে ডাক পাড়তাছে! ‘হোনো গো মনিষ্যি! জলদি কইরা গাঙের ধারে আহো! অক্ষণ আহো! অরে মনিষ্যি! জলে দেহো আদম সন্তান ভাইস্যা যায়! আহো আহো! ত্বরা কইরা আহো! হের দম আর বেশিখোন নাই! তোলো হেরে! অরে মনিষ্যি!’
হায় হায়! কোন ঘাটে কে ভাসে! কোন আদম সন্তানে ভাসে! এই আন্ধারে এমুন ঘরঘট্টি বাদলায়, হের সন্ধান কেমনে মিলবো! কই মিলবো হেই আদম সন্তানের সন্ধান?
আমার পরিবারে একহাতে হের লাঠিখানরে ধরে, আরেকহাতে এক আঁটি পাটকাঠিরে নেয়! পাঠকাঠির মাথায় আগুন! ডগাবগা তেজী আগুন! আমি নিজের মাথলাখানরে সেই আগুনের উপরে ধরি! তারবাদে আমরা দোনোজোনে হেচড়াইয়া হাঁটা শুরু করি!
কোন গাঙে কে ভাইস্যা যায়?
আমাগো টরাভরা সুখতী গাঙ দিয়া— অইত্তো এক কন্যা ভাইস্যা যায়!
সেয় কী নিজে নিজে গাঙের সোরোতে ভাসে?
না না! অই দেহো, তারে পিঠে নিয়া এক কুম্ভীরে ভাইস্যা যায়!
অরে কুম্ভীর! অরে জলের সন্তান! মাটির কন্যারে মাটির ঘাটে নামান্তি দেও! দেও রে!
কুম্ভীরে অতি আলগোচ্ছে, ডাঙার কাছে আইয়া ভিঁড়ে! হেইরবাদে হেই কুম্ভীরের শইল্লের ধাক্কা আর সুখতী গাঙের ঝমলাইন্না ঢেউয়ের ঠেলা—সেই আদম সন্তানেরে ডাঙায় তুইল্লা দেয়!
আহহারে! এই কন্যা মউতা? না, জ্যাতা?
অই কন্যায় য্যান মউতাও না! আবার য্যান সেয় জ্যাতাও না!
দেহের কোন গহনে য্যান তার পরানখান ঝুরতাছে! এই আছে এই নাই—দশায় হেইটায় ঝুরতাছে! ঝুরতে ঝুরতে য্যান নিভ্ভা যাওনের লেইগা—সেই পরানে একেকবার কাতরাইয়া উটতাছে!
একবার কি তবে চেষ্টা দিয়া দেখমু না? একবার দেখমু না, হেরে বাচানো যাইবো কী যাইবো না? একদিন উস্তাদে অমুন চেষ্টা দিছিলো না? দিছিলো তো!
• ‘নিত্য যে নদী বহে’ প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
.
বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।
আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!