প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পটি পড়ার আগেই দেখেছিলাম মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’ ছবিটি। ওই ছবি নির্মাণের অনেক আগে নাকি পূর্ণেন্দু পত্রী ওই একই গল্প অবলম্বনে একটি ছবি করেছিলেন। সেটি অবশ্য আমাদের অনেকেরই দেখা হয়নি। যা হোক এই ‘খণ্ডহর’ ছবিটা দেখার পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ওই গল্পটা পড়ি এবং সাহিত্যমনস্ক কয়েকজন বন্ধুকে পড়াই। বন্ধুদের মধ্যে কারো কারো প্রতিক্রিয়া আমার চেয়েও তীব্র হয়ে ওঠে। একজন তো বলেই বসল, চল একদিন ওই জায়গাটা খুঁজে বার করি, ঘুরে আসি। আইডিয়াটা মন্দ নয়। কিন্তু মুশকিল হলো ওই নামে কোনো গ্রামের সন্ধান আমরা কিছুতেই পেলাম না। তেলিনীপাড়া আছে, তেলেনাপুর আছে কিন্তু তেলেনাপোতা নৈব নৈব চ। শেষকালে তেলেনাপোত বলে গ্রামের একটা গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেল মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। অবশেষে সেখানেই যাওয়া স্থির করলাম আমরা। আমরা অর্থাৎ শিবু, গোরা, পরিতোষ এবং আমি। বয়সটা তখন যে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ারই!
লালগোলা লোকালে সারারাতের ট্রেনযাত্রার পরে বাসে জঙ্গিপুর এবং সেখান থেকে টোটোয় ঘন্টাখানেক লাগল ওই তেলেনাপোত গ্রামে পৌঁছাতে। বেলা তখন অনেকটাই। মাঝখানে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছি। খুবই একটা সাদামাঠা গ্রাম। এখানে ভাঙা পোড়ো বাড়ি, যেখানে যামিনী এবং তার মা থাকেন, আছে কি আদৌ?
লালগোলা লোকালে সারারাতের ট্রেনযাত্রার পরে বাসে জঙ্গিপুর এবং সেখান থেকে টোটোয় ঘন্টাখানেক লাগল ওই তেলেনাপোত গ্রামে পৌঁছাতে। বেলা তখন অনেকটাই। মাঝখানে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছি। খুবই একটা সাদামাঠা গ্রাম। এখানে ভাঙা পোড়ো বাড়ি, যেখানে যামিনী এবং তার মা থাকেন, আছে কি আদৌ? সেই বাড়ি খোঁজার আগে আমাদের একটা নিভৃত আশ্রয়ের সন্ধান শুরু হলো। কাছাকাছি হোটেল তো দূর অস্ত, পাকা বাড়িও তেমন চোখে পড়ল না। কথায় কথায় জানা গেল, একটা বাগানবাড়ি মতো আছে একটু দূরে। তবে প্রায় পরিত্যক্ত। সেটাই আমরা অবশেষে খুঁজে বার করলাম। জঙ্গলাবৃত একটা মলিন কোঠা। অযত্নে অবহেলায় আশ্রয়যোগ্য মনে হলো না। কিন্তু বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। আপাতত একটা ঠাঁই তো দরকার! একটু হাঁক ডাক করতেই একজন আধবুড়ো লোক বেরিয়ে এলেন। জানা গেল ওটা কলকাতার এক বনেদী পরিবারের বাড়ি, একসময় ওঁরা আসতেন কেউ কেউ, এখন অনেকদিন কারো দেখা নেই। বছরশেষে ভদ্রলোক কলকাতায় গিয়ে কিছু দক্ষিণা নিয়ে আসেন, দিয়ে আসেন গাছের কিছু ফল পাকুড়। আমাদের অভিপ্রায় জানতে পেরে পত্রপাঠ বিদায় দিতে চাইছিলেন তিনি। অনেক বলে কয়ে দুদিনের জন্যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে দুটো বড়ো বড়ো ঘর একটু সাফসুতরো করে তিনি আমাদের দিলেন। তাঁর হাতে গুঁজে দিলাম কিছু টাকা। দুবেলার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা তাঁকেই করে দেবার জন্যে অনুরোধ জানালাম। স্বল্পভাষী ভদ্রলোক নিমরাজি হয়ে চলে গেলেন এবং আধঘন্টার মধ্যে আমাদের জন্যে চা বিস্কুট নিয়ে এলেন। জানা গেল ভদ্রলোক সস্ত্রীক ওখানেই থাকেন অনেকদিন ধরে। একমাত্র পুত্র চাকরিসূত্রে সস্ত্রীক দিল্লিতে থাকে। খোঁজখবর তেমন নেয় না। বছরে একবার আসে পুজোর সময়ে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়।
একটা গণ্ডগ্রামে তো আসা তো গেল! কিন্তু আমাদের অভিযানের কী হবে। কাছাকাছি কি কোনো ধংসোন্মুখ বাড়ি আছে? যেখানে বাস করে রোগগ্রস্ত কোনো এক মা এবং তার যুবতী কন্যা, যামিনী যার নাম। আমাদের নিরাশ করে দিয়ে ওই ভদ্রলোক বললেন ওই গ্রামে এই একটাই পাকা বাড়ি অর্থাৎ আমরা যেখানে আছি। ওখানকার অধিকাংশই মানুষই চাষাভূষো গোত্রের। ধর্ম পরিচিতিতে তারা অবশ্য মুসলমান। অবশ্য কয়েক ঘর হিন্দুও নাকি আছে ওই গ্রামে। কী আর করা! বিকেলে আমরা ক’জন গ্রাম পরিক্রমায় বেরোলাম। ঘুরতে ঘুরতে একটা চায়ের দোকানের সন্ধান পেলাম। দোকানী একটি মাঝবয়েসী মেয়ে। তার বানানো চা খেতে খেতে তার সঙ্গেই আমরা গল্প জুড়ে দিলাম। না, তার নাম যামিনী নয়, আয়েশা। স্বামী চাষবাস করে। বছর কয়েক আগে সে এই বাড়ির বধূ হয়ে এসেছে বটে, তবে সন্তান জন্ম দিতে পারেনি বলে স্বামী কিছুদিন আগে আরেকজনকে বিয়ে করে এনেছে। আয়েশা বাড়ির যাবতীয় কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দোকানটা চালায়। বোঝা গেল আমাদের এখানে দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটাতে হবে। সময় কাটাবার জন্যে আমরা এটা ওটা জিজ্ঞেস করছিলাম ওকে। আমাদের অবাক করে দিয়ে মেয়েটি হঠাৎ আমাদের বলে বসল তাকে আমরা শহর কলকাতায় কোনো কাজের সন্ধান দিতে পারি কি না! এই বাড়িতে তার আর ভালো লাগছে না। দুটো খাওয়া পড়ার বিনিময়ে নিত্য গঞ্জনা সে আর সহ্য করতে পারছে না। আমাদের মধ্যে পরিতোষ একটু আধটু গল্প লেখে। সে অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে আয়েশাকে রাতে আমাদের ওই বাড়িতে আসতে বলল। ও রাজি হওয়ায় আমি একটু অবাকই হলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা বলল রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে আসবে। মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে তার স্বামী খুব তাড়াতাড়িই রাতের খাওয়া সেরে নতুন বউকে নিয়ে ঘরে খিল দেয়। সেই সময়ে সে চুপিচুপি আসবে ওই বাড়িতে। ভাবলাম, না একেবারে হতাশজনক নয় যে! আমরা কেমন এক সুন্দর গল্পের আভাষ পেলাম আয়েশার কথাবার্তায়। চায়ের দাম মিটিয়ে আমরা ফিরে এলাম আমাদের আশ্রয়ে।
ততক্ষণে রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে। গ্রামের রাত্রি অতি দ্রুত এসে যায়। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আমরা বারান্দায় বসে তাস খেলছিলাম। শিবু ততক্ষণে গ্লাসের আয়োজন করে ফেলেছে। এমন গ্রামীণ পরিবেশে ‘অফিসার্স চয়েসে’র স্বাদ ও সুগন্ধে (?) আমরা অচিরেই মগ্ন হয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে রাত তখন অনেক। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। রেডিওতে একটা রহস্য রোমাঞ্চঘেরা নাটক হচ্ছিল। সেটাও একসময় শেষ হয়ে গেল। ক্রমে রাত বাড়ছে। একসময় মনে হলো আয়েশা আসবে না।
অতি সাহসী মেয়ে সে। এসেই সে বলল, কোনোরকমে ম্যানেজ করে এসেছে। আরেকটু হলে সে ধরা পড়ে যেত। আমাদের সঙ্গেই সে কলকাতা চলে যাবে বলে ঠিক করেছে। তাকে কোনোরকমে আশ্বস্ত করে পরিতোষ বলল পরশু ভোরে বাসস্ট্যাণ্ডে আসতে।
হঠাৎ দূরে এক আলোর রেখা দেখতে পেয়ে আমরা একটু নড়েচড়ে বসলাম। হ্যাঁ, আয়েশাই। অতি সাহসী মেয়ে সে। এসেই সে বলল, কোনোরকমে ম্যানেজ করে এসেছে। আরেকটু হলে সে ধরা পড়ে যেত। আমাদের সঙ্গেই সে কলকাতা চলে যাবে বলে ঠিক করেছে। তাকে কোনোরকমে আশ্বস্ত করে পরিতোষ বলল পরশু ভোরে বাসস্ট্যাণ্ডে আসতে। ওদের দুজনের চোখে চোখে যেন কী কথা হয়ে গেল এরমধ্যে। ততক্ষণে শিবু আয়েশাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। দেখলাম অপর পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রত্যাখ্যান এলো না। ওরা তিনজন আয়েশাকে সঙ্গে নিয়ে অতিদ্রুত ঘরে ঢুকে আলো নিভিয়ে দিল। আমি একটু অবাক ও অপ্রস্তুত অবস্থায় বাইরে বসে রইলাম। ঘণ্টাখানেক পরে আয়েশা বেরিয়ে এলো আলুথালু বেশবাসে। খুবই ধীরপায়ে হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে সে চলে গেল। যাবার সময় মনে করিয়ে দিয়ে গেল পরশু ভোরের কথা।
পরদিন সকালেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আর এখানে নয়। কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আগে অতিশীঘ্র পালাতে হবে। ঠিক হলো, একটু বেলা বাড়তেই আমরা ওই জায়গাটা ছেড়ে জঙ্গিপুরের দিকে চলে যাব। ওখান থেকে বাসে লালগোলা হয়ে কলকাতার ট্রেন ধরতেই হবে। ঘাড় থেকে নামাতেই হবে আয়েশার ভূত। মোটামুটি সবাই এ ব্যাপারে একমত। যেমন ভাবা তেমনই আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে ভদ্রলোকের দেনা পাওনা মিটিয়ে চুপিসারে জায়গাটা থেকে চলে এলাম। খানিকটা হেঁটে অবশেষে একটা ভ্যান রিক্সা পাওয়া গেল এবং সেখান থেকে সটান জঙ্গিপুর এবং তারপর কলকাতা।
তেলেনাপোতের গল্পটা এখানেই শেষ করা যাচ্ছে না। প্রায় একশো বছর আগের পৃথিবী অনেকটাই পালটে গেছে, সেইসঙ্গে পালটে গেছে মানুষজন। আমাদের সেই গ্রামের অভিযানও তাই যেন একটু অন্যরকম হয়েছে। তবে কিছু কিছু অনুষঙ্গ কিছুতেই যেন পাল্টায় না। শত চেষ্টা করেও আমার মন থেকে ওই মেয়েটার ছবি মুছে ফেলতে পারছিলাম না। কী হলো তার শেষ পর্যন্ত? পরদিন ভোরে বাসস্ট্যাণ্ডে এসে আমাদের না পেয়ে ও কোথায় গেল? বাড়িতে না অন্য কোথাও? আমাদের বিশ্বাস করে এইভাবে প্রতারিত হওয়ার জন্যে না জানি কত অভিসম্পাত দিয়েছে আমাদের! এইসব ভাবতে ভাবতেই একদিন ঠিক করে ফেললাম আমি একাই যাব ওই গ্রামে। আয়েশার খোঁজ করব। শুনব তার অকথিত গল্প। তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেবার জন্যে ক্ষমা চাইব। চেষ্টা করব তাকে কোনো কাজের সন্ধান দিতে।
এইসব এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই একদিন আমি প্রবল জ্বরে পড়লাম। আহা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পের সঙ্গে কিছু তো মিল থাকতেই হবে। সময় যতই পালটে যাক না কেন! তাহলে কি আমারও ম্যালেরিয়া হলো? গা হাত পা অসম্ভব ব্যথা। প্রায় জ্ঞানহারা হয়ে থাকলাম তিন-চার দিন। রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেল, না ম্যালেরিয়া নয়, ডেঙ্গি।
প্রবল জ্বরের ঘোর যখন কাটল, ততদিনে তেলেনাপোত গ্রামের কথা, সেই অভাগিনী মেয়ের কথা আমি কেমন যেন আস্তে আস্তে ভুলে যেতে থাকলাম। ঠিক ভুলে যাওয়া নয়, চাইলাম মন থেকে মুছে ফেলতে ওই গ্রামের স্মৃতি। আয়েশা নামের একটি মেয়ের কথা এবং সেইসঙ্গে আরও অনেক কিছু। তার জন্যে যে কিছু ভেবেছিলাম সেইসব মহান ভাবনার কথা মনে এলো কয়েকবার। কিন্তু তা ক্ষণকালের জন্যে। একেকবার এসেই আবার কোথায় হারিয়ে গেল।
এইভাবে তেলেনাপোত গ্রামটি আমার কাছে পুনরাবিষ্কৃত হয়েও ক্রমে ক্রমে একদিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল।
জন্ম (১৯৪৭) খুলনায়। লেখক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। দীর্ঘকাল সম্পাদকীয় সহযোগী হিসেবে যুক্ত ছিলেন ‘বিজ্ঞাপন পর্ব’ এবং ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার সঙ্গে। সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০। প্রিয় বিষয় সংগীত, নাটক ও নৃত্য। তাকে ‘দুই বাংলার নিরর্গল সেতু’ আখ্যা দিয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। বর্তমান বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনার হৃদয়পুরে। পেশায় ছিলেন গ্রন্থাগারিক। ‘একটি গৃহের কথা’ শিরোনামে স্বল্পদৈর্ঘ্যের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।