স্বীকারোক্তি
আমি গোড়া থেকেই এই লেখাটি মনে প্রাণে একটি মৌলিক লেখা হিসেবে দাঁড় করাবার আকাঙ্ক্ষা করেছি, অথচ লিখতে গিয়ে উত্তরোত্তর সংশয়ের সাথে দেখলাম গোটা লেখাটি একটি মাধুকরী বৃত্তি হয়ে দাঁড়াল। সেই বৃত্তান্তই শোনাব।
১৯৮৩ সালে নসাসের ১৩ নম্বর আজীবন সদস্য হয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাংলাবাজারে বইয়ের সন্ধানে যাই। এভাবেই আবুল হাসানের তিনটি পুনর্মুদ্রিত কবিতার বই আর অগ্রন্থিত কবিতার বই হাতে আসে আর পাগলের মতো পড়ি। ১৯৮৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আবুল হাসানের এক ধরণের পুনর্মূল্যায়ন শুরু হয়। সেই ঢেউ আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ চত্বরে এসেও লাগে। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের (পুরাতন) ছাত্র। কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন তরঙ্গের আমন্ত্রণে ‘একজন কবি আবুল হাসান’ প্রবন্ধ লিখে পাঠ করি। একই সময়ে একদিন ঘটনাক্রমে ঢাকায় এসে ইউসুফ হাসানের কিংবা দেশ প্রকাশনের নয়াপল্টনের অফিসে যাই; সেখানে আবুল হাসানের গল্প সংকলন দেখি, কাব্যনাট্য ‘ওরা কয়েকজন’ দেখি। একই সন্ধ্যায় আবুল হাসানের মানসপুত্র আবিদ আজাদের শিল্পতরু অফিসেও যাই। তিনি সেদিন রাদিচের কথা বলছিলেন, হাসানের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা জেনেছি আবিদ আজাদের মৃত্যুর পরে!
কামরুল হাসান মঞ্জুর চিনে বাদামের মতো মচমচে কণ্ঠে ‘বনভূমিকে বলো ওইখানে একজন মানুষ লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে’ শুনতে শুনতে আমিও লিখে ফেলি ‘চিবুক ছুঁয়ে বলেছিলাম/তোমার চোখে বলেছিলাম/ ভালবাসি’ (স্মরণ করা যাক হাসানের ‘আমার চোখে বলেছিলাম’ কবিতাটি) কিংবা ‘তোমার সান্নিধ্য যদিবা অগ্নিময়/ রঙিন চোখমুখ নিয়ে অন্য কেউ /তোমার সামনে বসে থাকুক/ আমি রইলাম নির্বাপিত নিরাপদ’ (স্মরণ করা যাক হাসানের ‘কল্যাণ মাধুরী’ কবিতাটি) ইত্যাদি।
আবুল হাসানের কবিতা আমার কর্কশ ও কিঞ্চিৎ আঞ্চলিকতাদুষ্ট উচ্চারণে আনন্দ শংকরের আবহসংগীত সহযোগে ক্যাসেটবন্দি করে নিজে নিজেই শুনি। কামরুল হাসান মঞ্জুর চিনে বাদামের মতো মচমচে কণ্ঠে ‘বনভূমিকে বলো ওইখানে একজন মানুষ লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে’ শুনতে শুনতে আমিও লিখে ফেলি ‘চিবুক ছুঁয়ে বলেছিলাম/তোমার চোখে বলেছিলাম/ ভালবাসি’ (স্মরণ করা যাক হাসানের ‘আমার চোখে বলেছিলাম’ কবিতাটি) কিংবা ‘তোমার সান্নিধ্য যদিবা অগ্নিময়/ রঙিন চোখমুখ নিয়ে অন্য কেউ /তোমার সামনে বসে থাকুক/ আমি রইলাম নির্বাপিত নিরাপদ’ (স্মরণ করা যাক হাসানের ‘কল্যাণ মাধুরী’ কবিতাটি) ইত্যাদি। এইভাবে কিছুকাল ‘আমার এই নবযৌবনে’ আবুল হাসানের প্রতিধ্বনিময় জীবনের কিছু সময় ‘শিল্পে অপচয়’।
অভিন্ন ‘সরজুদিদি’ময় শৈশব, ‘স্বাতী’র আবির্ভাব ঘটে গেছে ততদিনে, ‘রোমেনা’রা বুদ্ধদেব বসুর বদলে শীর্ষেন্দুর বই ধার নেয়। বন্ধুরা কবিতা লিখে, গলায় মাফলার পেঁচিয়ে সৈয়দ হকের ‘প্যাটের বিষ’ বা ‘বাসন’ নাটকের রিহার্সাল করে, লেবু চায়ে বাড়তি চিনি চেয়ে নেয়। সামরিক শাসনের দীর্ঘ ছায়ায় আমিও ততদিনে ‘জেনে গেছি রাজনীতি এক কালো হরিণের নাম’। আর নির্মলেন্দু গুণ যেমন হাসানের জন্য এলিজি লিখেছেন, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সে আমাকেও কবিবন্ধু কামরুজ্জামান উবাইদুল্লাহর জন্য দৈনিক পূর্বকোনে ‘কুমুর বন্ধন’ শীর্ষক এলিজি লিখতে হয়! সে মারা গিয়েছিল পিজি হাসপাতালেই, ফুসফুসের ক্যান্সারে।
এইভাবে আমি আবুল হাসানকে ধারণ করে বড়ো হতে থাকি। আমার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির নাম রাখি ‘চরৈবেতি চরৈবেতি’ আর মন্ত্র পাঠ করি ‘আগুনে লাফিয়ে পড়ো, বিষ খাও মরো!’
কয়েক বছর পর বিশ্বজিৎ ঘোষের লেখা কবিজীবনী একটা সম্পূর্ণতা এনে দেয়। ২০১১ সালে বন্ধু আমিনুল হক মিঠু ফেসবুকের আবুল হাসান গ্রুপের দায়িত্ব আমার হাতে ন্যস্ত করে, আমি তখন কক্সবাজারে, নিঃসঙ্গ; কাজটিতে জড়িয়ে যাই। সানন্দে। আবুল হাসানকে নিয়ে যেখানে যা কিছু পাই এক জায়গায় জড়ো করতে থাকি। বছর দুয়েকের মধ্যেই ফরিদ কবিরের ‘নতুনধারা’ পত্রিকায় আবুল হাসানকে নিয়ে একটি গদ্য লিখে কিছুটা আছরমুক্ত হবার চেষ্টা করি।
জুন ২০২০ সালের ২০ তারিখে কবি ও শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য প্রকাশকের নাম প্রকাশ না করে আমাকে প্রস্তাবনাটি জানালেন। আমি দীর্ঘায়তনের লেখায় অনভ্যস্ত, তদুপরি হাসনাত আবদুল হাই আর শাহাদুজ্জামানের শ্রমসাধ্য প্রবাদপ্রতিম কীর্তিগুলোর কথা এক ঝলক মনে পড়তেই নিরস্ত হয়ে যাই। কিন্তু আবুল হাসানকে নিয়ে আমার আকৈশোর উন্মাদনা, বহমান আগ্রহ, হাসানের পুরো জীবনটিকে সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখতে পাওয়া, তরুণ প্রকাশক রুম্মান তার্শফিকের আন্তরিকতা, অনেক শুভানুধ্যায়ীর কৌতূহল আর উৎসাহ শেষ পর্যন্ত আমাকে দিয়ে লেখাটি লিখিয়ে নিল। আহমাদ মোস্তফা কামাল যখন বললেন, আমি তো জানতাম লেখক খোঁজা হচ্ছে এবং আপনিই কাজটা পারবেন সেই বিশ্বাসও ছিল; কিন্তু কবিরা তো জিনগতভাবেই অলস হয়ে থাকেন, তাই শেষ ভরসা করিনি— এই কথায় আমি প্রেরণা পেয়েছিলাম।
যে লেখায় সব চরিত্রই বাস্তব, আমি মনে করি এই পরিস্থিতিটা লেখকের পক্ষে ঈষৎ ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু সব চরিত্র কাল্পনিক— এই কথাটিতো আর বলবার সুযোগ নাই!
এই ডকুফিকশনে আবুল হাসান তো বটেই, আরও অনেক কবি লেখক ও গবেষকের রচনা, কথা-বার্তা, মন্তব্য ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে— কখনো উদ্ধৃতির ভিতরে, কখনো রচনাটিকে নির্ঘন্ট-কন্টকিত না করার অভিপ্রায়ে অন্তর্বয়নের মাধ্যমে আত্মস্থ করা হয়েছে; সেই মূল্যবান ভাণ্ডারের একটি দীর্ঘ তালিকা সংযোজন করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে। যে লেখায় সব চরিত্রই বাস্তব, আমি মনে করি এই পরিস্থিতিটা লেখকের পক্ষে ঈষৎ ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু সব চরিত্র কাল্পনিক— এই কথাটিতো আর বলবার সুযোগ নাই!
লেখাটি কোনো বিশুদ্ধ গবেষণা নয়, মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখতে আনন্দ পেয়েছি। সে কারণে স্থান কাল পাত্রের কিছুটা বিচ্যুতি আছে। হয়তো আবিদ আজাদকে এক বছর আগেই কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় হাজির করেছি, সুরাইয়া খানমের সাথে ইসরাইল খানের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছি মুদ্রণের তিন বছর আগেই; আর সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার যেটি— কবীর চৌধুরী অনূদিত ফরটিন ইয়াং পোয়েটস বইটি প্রকাশিত হতে দেখিয়েছি আবুল হাসানের জীবদ্দশাতেই! অবশ্য আবুল হাসান (মরনোত্তর) সেই সংকলনে একজন তরুণ কবি হিসেবেই সংকলিত হয়েছিলেন। আবুল হাসানের প্রতি সব কালেই এক ধরণের পক্ষপাতিত্ব ছিল দেখা যাচ্ছে।
আবুল হাসান কেন্দ্রিক দুই আকর গ্রন্থ কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনী গ্রন্থচতুষ্টয়ী মহাজীবনের কাব্য (আমার ছেলেবেলা, আমার কন্ঠস্বর, আত্মকথা ১৯৭১, রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫) এবং বাংলা একাডেমির জীবনী গ্রন্থমালার অন্তর্গত বিশ্বজিৎ ঘোষ রচিত আবুল হাসান— এই বই দুটি আমার ডকুফিকশনটি লেখার মূল ভরসা ছিল। দুই লেখকের সাথেই বই দুটো থেকে গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণের বইটি আমার লেখার কঙ্কালমাত্র নয়, মাংশল কঙ্কাল! কবির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই!
তিন দিন পরেই সাজ্জাদ শরিফ ফোন করে জানালেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান, আবুল হাসানের একজন জার্মান শিল্পীবন্ধুকে চিনতেন; সাজ্জাদ শরিফ আমাকে হাসান এবং সেই শিল্পীর বন্ধুত্বের কিছু ঘটনাও বললেন এবং বললেন ওয়াকিলুর রহমানের কাছে বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় জানা যাবে। আমি জানতাম, আমার অগ্রজ শাহাদুজ্জামান ভাই ওয়াকিল ভাইয়ের বন্ধু। শাহাদুজ্জামান ভাইয়ের কাছে আমার উদ্দেশ্য জানিয়ে ওয়াকিল ভাইয়ের ফোন নাম্বার চাই। ওয়াকিলুর রহমান আমাকে যথেষ্ট সময় দিলেন এবং শিল্পীর নামটি জানালেন।
জুন ২০২০ এর শেষ সপ্তাহে লিখতে শুরু করলেও ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত আবুল হাসানের বার্লিন অধ্যায় নিয়ে তিন চারটি ব্যর্থ ইমেইলের উত্তর ছাড়া সঞ্চয়ে কিছুই নাই। বার্লিনের হাসপাতাল থেকে সবিনয়ে কোনো তথ্যই না দেয়ার কথা বলছে বারবার। সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এরকম সময়ে আমার প্রাক্তন সহকর্মী আসফিয়ার (শাওন আজিম) সাথে দেখা হতে তিনি আমার লেখালিখির খোঁজখবর নিলেন। তিন দিন পরেই সাজ্জাদ শরিফ ফোন করে জানালেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান, আবুল হাসানের একজন জার্মান শিল্পীবন্ধুকে চিনতেন; সাজ্জাদ শরিফ আমাকে হাসান এবং সেই শিল্পীর বন্ধুত্বের কিছু ঘটনাও বললেন এবং বললেন ওয়াকিলুর রহমানের কাছে বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় জানা যাবে। আমি জানতাম, আমার অগ্রজ শাহাদুজ্জামান ভাই ওয়াকিল ভাইয়ের বন্ধু। শাহাদুজ্জামান ভাইয়ের কাছে আমার উদ্দেশ্য জানিয়ে ওয়াকিল ভাইয়ের ফোন নাম্বার চাই। ওয়াকিলুর রহমান আমাকে যথেষ্ট সময় দিলেন এবং শিল্পীর নামটি জানালেন। আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে অসুস্থ শিল্পী রাইনহার্ট হেভিক্যার প্রায় নিস্ক্রিয় ফেসবুক একাউন্টের সক্রিয় বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি এবং কবি স্টিফেন মারসিনিয়াকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হই। আত্মস্বীকৃত অলস স্টিফেন আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। স্টিফেনের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ২৩ মার্চ মৃত্যুর আগের শেষ শীতকালটিতে শিল্পী রাইনহার্ট হেভিক্যা এ কথা জেনে নাকি খুব প্রীত আর তৃপ্ত ছিলেন যে আবুল হাসানের পরবর্তী জন্মদিনেই আমার বইটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
জানুয়ারি মাসে আমি যখন বার্লিন অধ্যায় নিয়ে উত্তেজিত, এমন সময় কথাসাহিত্যিক, বন্ধু হামিদ কায়সার ঘোষণা করলেন, বুলবুল চৌধুরীর সাথে কথা না বলে আবুল হাসানের ওপর কাজ শেষ করা মহাপাপ হবে। বুলবুল চৌধুরীর সাথে তিন বার লম্বা কথা বললাম, প্রতিবারই ঊনত্রিশ মিনিট। প্রতিবারই কুশল সংবাদের উত্তরে বলেন, ভালো নেই। কিন্তু প্রতিবারই হীরে মানিকের খনি উপহার দিয়েছেন। হীরে মানিক দিয়েছেন প্রিয় শিক্ষক রফিক কায়সার, জনাব জাহিদুল হক (তিনি বলেন, টি এস এলিয়টকে ওরা কবি এলিয়ট ডাকে না, মি. এলিয়ট ডাকে)— ক’জনের নাম বলি! কত অভাবিত উৎস থেকেই না কত খুঁটিনাটি সাহায্য পেয়েছি। আবুল হাসানের সময়টাকে ধরে রাখার জন্য চলমান উইকিপিডিয়া বন্ধু অমি রহমান পিয়ালের সুইস ঘড়িতে কটা বাজে সে খেয়াল না রেখেই জানতে চেয়েছি নূরা পাগলার বৃত্তান্ত, আজম খানের মুক্তিযুদ্ধের কথা কিংবা শশাঙ্ক পাল বা হুমায়ুন কবিরের নিহত হবার ঘটনা। মুহূর্তের মধ্যে পেপার কাটিং বা স্ক্রিন শট হাজির হয়ে গেছে! অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ, সাময়িকপত্র গবেষক ইসরাইল খান আর বহুপ্রজ তরুণ কবি— গবেষক পিয়াস মজিদ ছিলেন আমার অতন্দ্র প্রহরী।
আবুল হাসানের আদরের ছোটো বোন বুড়ি (হোসনে আরা খানম) আপা যে কত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নাই। কিন্তু তাঁকে কি কি প্রশ্ন করব তা যদি জানতাম! এত বছর পরেও কি প্রয়াত ভাইকে নিয়ে কথা বলতে গেলে মন হাহাকার করে উঠে! এই অনিশ্চয়তায়ও ভুগেছি।
আবুল হাসানের আবুল হাসান রচনা সমগ্র, শামসুর রাহমান লিখিত সেই বইয়ের ভূমিকা; মুহম্মদ নূরুল হুদা, জাফর ওয়াজেদ ও ফখরুল ইসলাম রচি সম্পাদিত আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা, নসাস; আবুল হাসানের অপ্রকাশিত কবিতা, বিভাস; আবদুল মান্নান সৈয়দের ভূমিকা সম্বলিত আবুল হাসানের কম বয়সের কবিতা মেঘের আকাশ আলোর সূর্য, বিভাস— এই বইগুলো কাজে লেগেছে। মেঘের আকাশ আলোর সূর্য বইতে শেহাবউদ্দীন আহমদ, আবুল হাসানের অপ্রকাশিত কবিতাবলী, প্রাপ্তি ও প্রকাশ লেখাটিও হিরন্ময়।
মোশতাক আহমদ-এর ঝিনুক নীরবে সহো নিয়ে শাহাদুজ্জামান ।। ভিডিও কৃতজ্ঞতা : শাকুর মজিদ
এছাড়া আবুল হাসানের সময়কে খুঁজে পেয়েছি কিছু উৎস থেকে, আবুল হাসানের জীবনের উপাদান খুঁজে নিয়েছি কিছু উৎস থেকে, এই ডকু-ফিকশনে অনেক চরিত্রের মুখে সংলাপ ব্যবহার করেছি বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য বই থেকে, ব্যবহার করেছি পত্রপত্রিকা, অনলাইনের লেখাপত্র, দলিলপত্র, কবিতা। এ ধরণের লেখায় কথা-বার্তা/ সাক্ষাৎকার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতি কথাবার্তার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণ ছিল, আমার স্বভাবও ছিল সাক্ষাতের ক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতা। কিংবা ধরুন, ৩৫ বছর ধরে কবিতাচর্চা করার পরেও নির্মলেন্দু গুণ যখন আমাকে চিনতে পারলেন না, তখন এতটাই ভেঙে গেলাম যে সাক্ষাৎকারটি নিয়ে আর অগ্রসর হতে পারলাম না। একইভাবে মুহম্মদ নূরুল হুদা কিংবা অসীম সাহার কাছেও আর যাবার সাহস হলো না।
কিছু তথ্য পেয়েছি ইমেইল, ক্ষুদে বার্তায়— দেশ-বিদেশ থেকে। পরামর্শ, মন্তব্য ও সহযোগিতা পেয়েছি পরিচিত ও অনেক অভাবিত উৎস থেকেও! কত নতুন মানুষের সাথে আমার সাহিত্যিক পরিচিতি ঘটল এই সূত্রে!
পাণ্ডুলিপির নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করে পাঠকদের কৌতুহল উসকে দিয়েছেন ফেরদৌস নাহার (সাহিত্য ক্যাফে), রাজু আলাউদ্দিন (বিডিনিউজ), বিধান সাহা (শ্রী), পুলক হাসান (খেয়া), মাসুদ হাসান (কালের কণ্ঠ)
পাণ্ডুলিপির গঠনমূলক পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন— রফিক কায়সার (অজস্র টেলিফোন), হামিদ কায়সার (লিখিত), মুনীর হোসেন (ক্ষুদে বার্তা)
‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখা শেষ করার পরপরই চিকিৎসকগণ আবিষ্কার করলেন বাস্তবে আমি আমার মস্তিস্কের কুঠুরিতেও মুক্তার চাষ করে বসে আছি! সে আরেক কাহিনি। অতএব সংগত কারণেই আমার লেখালিখির মূলমন্ত্র শামসুর রাহমান কথিত ‘সংহত কর বাক, থামাও প্রগলভতা’র জায়গায় সুসম্পাদনায় অবিচারের কারণে কিছু প্রগলভতা হয়তো রহিয়াই গেল!
ইচ্ছাপূরণ হলো না
আবুল হাসান যেমনভাবে জগন্নাথ কলেজের এক বন্ধুকে পরীক্ষার আগের রাতে অভিসার সিনেমা হলে ধরে নিয়ে গিয়ে হিচককের সিনেমা দেখিয়েছিলেন, আমিও এখন তেমনিভাবে এই উপাখ্যানে নিজেই একটি চরিত্র হয়ে আসব, সেরকম একটা ইচ্ছা ছিল। সেই লক্ষ্যে ৫৩৪ শব্দের একটা ছোটো অধ্যায় লিখে বন্ধুস্থানীয় এক কথাসাহিত্যিককে পাঠালাম। অবশ্য তার নীরবতাই আমাকে সঠিক পথ দেখাল। আমার ইচ্ছাপূরণের গল্প এখানেই শেষ! আহা! পাঠককে নিয়ে যেতাম আমার ব্যক্তিগত প্রেক্ষাগৃহে! হিচকক কিংবা সুভাস ঘাই তাদের নিজের সিনেমায় ছোট্ট কোনো ভূমিকায় আসতেন, আমিও এই ডকুফিকশনে একবার না হয় সশরীরেই উপস্থিত হলাম! তো সেই সিনেমা দেখে হাসানের বন্ধু গাজী অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিল, হাসানকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে পেরেছিল। ভবিষ্যতে এই গাজী আজিজুর রহমান যে তিন কবিকে নিয়ে ‘কবিদের কবি’ বইটি লিখবেন, আবুল হাসান তাদের একজন; অন্য দুজন হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমান!
এই উপাখ্যানে নিজেই একটি চরিত্র হয়ে আসব, সেরকম একটা ইচ্ছা ছিল। সেই লক্ষ্যে ৫৩৪ শব্দের একটা ছোটো অধ্যায় লিখে বন্ধুস্থানীয় এক কথাসাহিত্যিককে পাঠালাম। অবশ্য তার নীরবতাই আমাকে সঠিক পথ দেখাল। আমার ইচ্ছাপূরণের গল্প এখানেই শেষ! আহা! পাঠককে নিয়ে যেতাম আমার ব্যক্তিগত প্রেক্ষাগৃহে!
যাহোক, আবুল হাসানের অতটুকু চায়নি বালিকা’র প্রতিধ্বনি করে এর পরেও লিখে যাই—
অতটুকু চায়নি বালক,
এই করপোরেট নিঃশ্বাস
ছয় ডিজিটের মায়না—
বিমান ভ্রমণ!
চেয়েছিল আরো কিছু কম…
শার্শিপথে অলস বিকেল
কবিতায় জীবনের অপচয়
ভাগাভাগি করা চা সিগারেট—
স্বপ্ন-দীর্ঘ পথ!
অতটুকু চায়নি বালক!
ঊর্ধশ্বাস ইঁদুর দৌড়, কোলাহল, তদবির!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
চেয়েছিল একটি চিত্রকল্প
নিজস্ব ভাষা—
তাকে দিক শান্তি নিরবধি,
একটি বালিকা তাকে বলুক কবি!
(অতটুকু চায়নি বালক, স্বনির্বাচিত কবিতা : পদ্যাবধি, মোশতাক আহমদ)
আবুল হাসান নিজেই একটি উপাখ্যান রচনার প্ররোচনা
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!
‘এক কবিতা সন্ন্যাসী আবুল হাসান’— এই কথাটি হাসানের বন্ধু সুরাইয়া খানমের।
চারপাশে মারি, মন্বন্তর, যুদ্ধ আর বিবিধ অস্থিরতাকে আত্মস্থ করে হাসান নিমগ্ন থেকেছেন কবিতার শিল্পিত উদযাপনে, নিজের সৃষ্টিতে। এই দেশে আবুল হাসানের কবিত্ব ও জীবন প্রবাদপ্রতিম।
কাকতালীয়ভাবে সুকান্তের মৃত্যুর বছরেই আবুল হাসানের জন্ম, ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট; ভারত ও পাকিস্তানের জন্মের কয়েকদিন আগে। সুকান্তের বাবা ১৯২০ সালে সপরিবারে গোপালগঞ্জ থেকে কোলকাতা চলে যান, অন্যদিকে হাসানের বাবা উপমহাদেশ স্বাধীন হবার আগে ভারতীয় পুলিশে চাকুরি করতেন, কোলকাতায়। হাসানের শৈশব কেটেছে গোপালগঞ্জে। হাসান যে সময় কবিতা লিখতে শুরু করলেন, তখনো ‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’ এমন সুকান্তীয় পরিপ্রেক্ষিত থাকলেও তিনি সে পথে গেলেন না। তাঁর সহচরবৃন্দ অনেকেই সে পথে গেছেন।
আবুল হাসান বাংলাদেশের সবচেয়ে টালমাটাল সময়টির সাক্ষী। জীবনানন্দীয় প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠলেও তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা উত্তর অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক মেরুকরণ, জাতির জনক হত্যা ও জেল হত্যার ইতিহাসের মধ্য দিয়ে তিনি কবি হয়ে উঠেছেন এবং অকালে ঝরে গেছেন বিশাল সম্ভাবনার দরোজায় এসে। স্বল্পায়ু জীবন নিয়েও আবুল হাসান অদ্বৈত ও মৃত্যুকে জয় করেছেন।
ষাটের দশকের কবিরা প্রথমার্ধে ছিলেন শিল্পপ্রবণ, দ্বিতীয়ার্ধে ছয় দফা, ছয় দফা উত্তর এগারো দফার ছাত্র আন্দোলনবাহিত হয়ে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের আবহে কেউ কেউ হয়ে পড়েন সংগ্রামী। ষাটের কবিরা নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছেন— ‘ভুগেছেন চরিত্র, মনন ও অস্তিত্বের সংকটে’। অস্থির সময়ের এই কবিরা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় ‘পাপ এবং পবিত্রতা, প্রতিভা এবং অপচয়ের’ শিকার হয়েছেন। হাসান সংগ্রামী পরিপার্শ্ব আত্মস্থ করে শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাই লিখে যাবার ব্রত নিয়েছিলেন।
ষাটের দশকের কবিরা প্রথমার্ধে ছিলেন শিল্পপ্রবণ, দ্বিতীয়ার্ধে ছয় দফা, ছয় দফা উত্তর এগারো দফার ছাত্র আন্দোলনবাহিত হয়ে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের আবহে কেউ কেউ হয়ে পড়েন সংগ্রামী। ষাটের কবিরা নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছেন— ‘ভুগেছেন চরিত্র, মনন ও অস্তিত্বের সংকটে’। অস্থির সময়ের এই কবিরা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় ‘পাপ এবং পবিত্রতা, প্রতিভা এবং অপচয়ের’ শিকার হয়েছেন। হাসান সংগ্রামী পরিপার্শ্ব আত্মস্থ করে শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাই লিখে যাবার ব্রত নিয়েছিলেন। বন্ধুদের কবিতায় তাৎক্ষণিক হাততালি তাকে বিচলিত করেনি তা বলা যাবে না; কিন্তু নিজের সাথে সেই দ্বন্দ্বের বোঝাপড়া করেছেন গদ্যে, কবিতায় বিস্তার করে গেছেন নিজস্ব আলুথালু সুষমারই। এ ব্যাপারে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘আবুল হাসান মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে বয়ে গেছে কবিতা। তাঁর এলোমেলো জীবনের ছাপ পড়েছে তাঁর কবিতাতেও। এই এলোমেলোমি তাঁর কবিতার দুর্বলতা এবং শক্তি।’ সলিমুল্লাহ খান আবার রাহমানের এই পর্যবেক্ষণকে (এলোমেলোমি) তাত্ত্বিকভাবে নাকচ করে দিতে চান তাঁর নিজস্ব ভাষায়– ‘বলা বাহুল্য নয়, এই জাতীয় মতের লগে কার্ল মার্কসের মতের কোনো মিল নাই’।
হাসান মাঝে মাঝে নিজের মুখোমুখি বসতেন— ‘আমি এখন আমার সত্যি শব্দগুলো কবিতায় লিখতে পারছি না। আমার মনে হয় আমি ভীষণ ভুল করেছি— আমি যে ভাবে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, ওই রকমই আমার লেখা উচিত ছিল।’ আবার ঘরোয়া আড্ডায় অনুজ কবিদেরকে বলেছেন, ‘আরে বেটা, কবিতা হইল গিয়া কবিতা। তার আবার এই সেই কীরে!’ তাঁর মাঝে এক ধরণের সন্ন্যাস ছিল, কবি ছাড়া আর কিছুই তিনি হতে চাননি। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা অসমাপ্ত। চাকুরি জীবন বিক্ষিপ্ত, খণ্ড খণ্ড। তাঁর মাঝে ছিল কিছু স্ববিরোধও। আর খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মতে ‘হাসানের দুঃখের একটি উৎস তাঁর নাম-না-জানা অপরাধবোধ’ যা কিনা ‘শিল্পবৈরী সময়ের প্রেক্ষাপটে নিজকে স্থাপন না করতে পারার ব্যর্থতাবোধ থেকে’ জন্ম নিয়েছে— তার প্রকাশও আছে তাঁর কবিতায়।
মোশতাক আহমদ-এর `ঝিনুক নীরবে সহো’ এবং কবি আবুল হাসানকে নিয়ে কথা বলছেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ।। ভিডিও কৃতজ্ঞতা : শাকুর মজিদ
স্কুল জীবনে কিছুদিন ঢাকায় পড়াশুনা করলেও হাসানের কলেজ জীবন বরিশালে। পিতৃপুরুষের নিবাস বিবেচনা করলে হাসানকে বরিশাইল্যা বলা চলে। হাসানে বরং জীবনানন্দ পাওয়া যায়। জীবনানন্দ দাশকে তিনি সচেতন এবং অবচেতনেও লালন করেছেন। পঞ্চাশের কবিরাও কেউ কেউ ‘চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড়’ হয়ে উঁকি দেন হাসানের কোথাও কোথাও। তাঁর জীবদ্দশায় অপ্রকাশিত কাব্যনাট্য ‘ওরা কয়েকজন’-এ সুনীলের বাক্যবন্ধ আছে (‘মৌমাছির মতো পরিশ্রমী মানুষ’ কিংবা ‘শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি’), শামসুর রাহমানীয় ‘এক ধরনের আলোকাতরতা’ও আছে, পছন্দ করতেন আল মাহমুদকেও, সঙ্গী ছিলেন শহীদ কাদরীর, হরিহর আত্মা ছিলেন নির্মলেন্দু গুণের; অগ্রজ বা অনুজ অনেকের অনেক কবিতাই রীতিমতো মুখস্ত বলতে পারতেন, কিন্তু একাত্তর সালে হাসপাতালে শুয়ে বসে পরিমার্জন করা সেই কাব্যনাট্যের রেলযাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যের মতো হাসানের সতীর্থ কবিদেরও গন্তব্য এক নয়, কিংবা কেউবা গন্তব্যহীন, আয়নায় নিজেরই মুখোমুখি। শেষাবধি ‘রাজা যায় রাজা আসে’ থেকে ‘পৃথক পালংক’ পর্যন্ত তিনি এক স্বতন্ত্র ভুবন গড়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখের সামনে হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, পৃথক পালঙ্কে হাসান কবিতার যে শিখরে পৌঁছেছেন, তাঁর সাথের কেউই সেই উচ্চতায় উঠতে পারেননি। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের মতে, হাসানের ত্রয়ীকাব্য আজ পর্যন্ত অনতিক্রান্ত; তাঁর ঐ সামান্য কর্মপঞ্জির মধ্যে যে একটি নিটোল জগত তাঁর প্রতি-তুলনাও আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। মান্নান সৈয়দ বলেছেন, মানুষ ও প্রকৃতির একটি প্রবহমান মিশ্রণ চিত্রণ আছে হাসানের কবিতায়; সুধীন্দ্রনাথের ‘মৃত্যু যত নিকটবর্তী হয়, তত যেন সমস্ত জীবনচিত্র এক লহমায় পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে’— এই কথার সমর্থন পাওয়া যায় আবুল হাসানের শেষের দিকের কবিতাগুচ্ছে ঘটে যাওয়া ‘সেই ঘনীভবন কেলাসন, আসঞ্জন— সেই বাস্তব ও কল্পনার অপরূপ সঙ্গম, সেই আনন্দ ও যাতনার সহবাস, ‘জ্যোৎস্না, যৌবন, রোদ, ভালোবাসার এক একত্রমিলন : যা সব শিল্পীর উপাস্য।’
তিনি জীবন আর মৃত্যুকে দেখেছেন একই আগ্রহ আর সাহস নিয়ে, আসন্ন মৃত্যুকে লিখেছেন অযথা ‘সেন্টিমেন্টালাইজ’ না করার নির্বিকারতায়—
সূর্যের রৌদ্রের চাবুক বানিয়ে আমি মৃত্যুকে সাবধান করে দিই!
অসুখে কে আবার কার পদানত?
আবুল হাসানের ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ও হাসানেরই এক বর্ধিত ভুবন। সেই ভুবন স্মৃতিময়, সেই ভুবন জাতিস্মর বাউলের। হাসানের সম্পূর্ণ কাব্যিক ভ্রমণ শেষাবধি তাঁর নিজেরই আত্মজীবনী। তাই ‘হাসানের ব্যক্তি-স্বরূপের অনুধাবন তাঁর কবিতার জগতে প্রবেশের একমাত্র চাবি, সঙ্গত কারণেই।’ লিখেছেন ঝরনাধারার মতো, কিন্তু প্রতিটি লেখারই বারবার সংশোধন আর পরিমার্জনের সাধনাই বলে দেয় তিনি কোনো স্বভাবকবি ছিলেন না। হাসানের বন্ধুভাগ্য ছিল ঈর্ষণীয়; নির্মলেন্দু গুণের সাথে তাঁর উন্মুল উদ্বাস্তু জীবনযাপন এখন কিংবদন্তী। এর সাথে অভূতপূর্ব এক প্রেম উপাখ্যানের কিংবদন্তী যুক্ত হয়ে, সব শেষে অনিবার্য এক জয়শ্রী মৃত্যু যুক্ত হয়ে আবুল হাসান নিজেই একটি উপাখ্যান রচনার প্ররোচনা। সরকারিভাবে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম। সেটি সদ্য স্বাধীন দেশে একটি ঘটনাই ছিল। রাহাত খানের ভাষায়, হাসানকে ঘিরে এই ঈর্ষা-বিদ্বেষ ও গ্লানি অপমানের দেশে ভালোবাসার একটি মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল। হাসান কার বা আপন ছিলেন না? তিনি অসুস্থ শয্যায় থেকে তাঁর ‘মমতা-ক্ষমতা’য় সবাইকে আকর্ষণ করেছেন।
আমাকে গ্রহণ করো, আমাকে, আমাকে!
আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, সব প্রজন্মের তরুণরাই গভীর ভালোবাসায় গ্রহণ করেছেন তাঁকে, বরণ করে নিয়েছেন নিজেদের পরমাত্মীয় হিসেবে। আর নেবেনই না বা কেন, আমাদের সকল বিষাদ-বিপন্নতা আর নিমগ্নতার ছবি যে তিনি এঁকে গেছেন ওই অল্প বয়সেই।
হাসানকেন্দ্রিক এই উপাখ্যানে হাসানের চারপাশে ঘুরে বেড়াবে বাস্তব সব চরিত্র; কিছু ঘটনা ও সংলাপ সত্যাশ্রয়ী, কিছু ঘটনা ও সংলাপ আবার নিরুপায় হয়েই সত্যের কাছাকাছি, তবে তাকে হয়তো সত্যের অপলাপ বলা যাবে না। ঘটে যা সব সত্য নয়, লেখকের উর্বর মস্তিস্কও সত্য সৃষ্টি করে!
জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৯৬৮। মূলত কবি। আটটি কবিতার বই ছাড়াও লিখেছেন ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিপাঠের বই। পেশাগত জীবনে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। প্রকাশিত কবিতার বই : সড়ক নম্বর দুঃখ বাড়ি নম্বর কষ্ট, আমার আনন্দ বাক্যে, পঁচিশ বছর বয়স, মেঘপুরাণ, ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি, বুকপকেটে পাথরকুচি, ডুবোজাহাজের ডানা, অন্ধ ঝরোকায় সখার শিথানে । গল্পের বই : স্বপ্ন মায়া কিংবা মতিভ্রমের গল্প।প্রবন্ধ : তিন ভুবনের যাত্রী । স্মৃতিপাঠ : অক্ষরবন্দি জীবন। স্বনির্বাচিত কবিতা (প্রকাশিতব্য) : পদ্যাবধি । স্মৃতিকথা (প্রকাশিতব্য): গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প : পাবলিক হেলথের প্রথম পাঠ । ডকুফিকশন (প্রকাশিতব্য) : ঝিনুক নীরবে সহো।