শুক্রবার, নভেম্বর ২২

আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে : নভেরা হোসেন

0

তারুণ্য মানুষকে সৃষ্টিশীলতার মধ্যে নিমজ্জিত করে। তারুণ্য খুঁজে-ফেরে কথা বলার সঙ্গী, চিন্তা বিনিময়ের সঙ্গী। হ্যাঁ তেমনই এক অস্থির অশান্ত সময়ে শামীমের সাথে পরিচয়। নব্বই সাল। ঢাকাতে রায়েরবাজার টালি অফিস রোডের আমাদের বাসার মুখোমুখি মামুনের বাসা। আব্দুল্লাহ আল মামুন, রংপুর ক্যাডেটের ছাত্র, ‘নদী’ পত্রিকার সাথে যুক্ত। তাজুল হক সম্পাদিত ‘নদী’ পত্রিকার সূত্রে অনেক তরুণ কবি-লেখকের সমাবেশ ওই বাসায়। সেই আড্ডায় যুক্ত হয়ে পড়লাম। একদিন শামীম কবীর আর শিবলী মোকতাদির এলো মামুনের বাসায়। শামীমের সাথে প্রথম পরিচয়েই বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা। এটা যেন অলিখিত; অপেক্ষা করছিলাম ওর জন্য, আর একদিন সে এলো।

সব ছাপিয়ে ওই বয়সে শামীমের সাথে বন্ধুত্বটা যেন এক বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড় করাল। কুলকুল বয়ে যাচ্ছে অগাধ জলরাশি, উপরে আসমানী রঙের আকাশ, দূর দিগন্তে নাম না জানা গাঙচিলেরা। সেই বিশাল সমুদ্রের সামনে দুজনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি। আমাদের যেন অন্তকালের পরিচয়, এই বন্ধুত্ব, এই বিনিময় সব আমাদের জানা।

মনের ভেতর কল্পনা আর বাস্তবের এক অনাস্বাদিত অনুভূতি। কলেজ জীবনের শুরু, অনেক অনেক বন্ধু, অনেক অনেক চিন্তা, কবিতা, কবির সাথে পরিচয়। রুশ গল্প-উপন্যাসে বুদ্ হয়ে থাকতাম; কিন্তু সব ছাপিয়ে ওই বয়সে শামীমের সাথে বন্ধুত্বটা যেন এক বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড় করাল। কুলকুল বয়ে যাচ্ছে অগাধ জলরাশি, উপরে আসমানী রঙের আকাশ, দূর দিগন্তে নাম না জানা গাঙচিলেরা। সেই বিশাল সমুদ্রের সামনে দুজনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি। আমাদের যেন অন্তকালের পরিচয়; এই বন্ধুত্ব, এই বিনিময় সব আমাদের জানা। বহু বছর ধরে একটু একটু হীরক কুচি জমানো নয়— এক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়, স্পর্শ— শামীমকে করে তুলেছিল প্রকৃত বন্ধু; যাকে কখনো ছেড়ে যাওয়া যায় না, আবার দূরে সরে গেলেও অমিয় জলটুকু অক্ষুন্ন থাকে। এক পাত্রে আমরা হেমলক পান করেছি। মাঝে মাঝে শামীম বলত আজ খুব তোমার সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করছে, দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু দেখা করব না। কেন বল তো? আমি জানতে চাইতাম কেন? কারণ তোমার সংস্পর্শ আমাকে উজ্জীবিত করে কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষাকে পূরণ না করে যদি দূরে থাকি তাহলে যেন তোমাকে আরও বেশি অনুভব করতে পারি, কাছে পাই। নব্বইয়ের এপ্রিলে পরিচয়ের পর শামীম বগুড়াতে চলে গেল বাড়িতে। সেসময়ে আমার এক মামা ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি করত। এক কার্টুন সিগারেট এনে বাসায় রেখেছিল। শামীম একটা অদ্ভুতরকম কবিতা লিখে সিগারেট চেয়ে পত্র পাঠাল। ওকে কয়েক প্যাকেট সিগারেট পাঠালাম…

এক প্যাকেট সিগারেট চাহিয়া

তুমি কি আমার অশোভন গৃহলীলা?
প্রদেশ হারানো বারোয়ারী মেয়েলোক—
শবানুগমনে করুণার ভীত ছিল—
তুমি কি আমার বহুঘেঁষা সাদা শোক?

দেখো ভাঙি আমি, দলছুটো হিমবাহ—
জল ব্যাধি ভুলে স্মৃতি খাই ক্রমাগত :
তুমি বুঝি আয়ু-দূরতিক্রম্য দাহ;
তুমি কি আমার পরিধেয় খুনি ব্রত!

(শামীম কবীর)

বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে উচ্চ-মাধ্যমিক পড়তাম, শুনলাম শামীম বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেবে, ঢাকায় আছে, আবারো দেখা হলো। তখন শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট আমাদের বাড়ি-ঘর। মাসরুর আরেফিন থেকে শুরু করে আদিত্য কবীর, ইকবাল এহসানুল কবীর জুয়েল, তাজুল হক, বায়েজিদ মাহবুব, আসাদ, রোজি, পলি, রেইনি ভাই, পাঠক সমাবেশের বিজু ভাই— বিশাল সে আড্ডা। সকাল দশটায় শুরু হয়ে মধ্য রাত অব্দি। এই আড্ডায় আমি ও শামীম উপস্থিত থাকতাম। বেশিরভাগ সময় কাটত দলের সাথে; তার মধ্যেও দুজনের আলাদা একটা বলয় তৈরি হতো। ধনেশ পাখির মতো লম্বা নাকওয়ালা শামীম খুব শান্ত, সৌম্য, ক্যাটস আইয়ের স্নিগ্ধ পুরুষ। মাঝে মাঝে গান গেয়ে উঠত—


comlapur railway station 1992

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে শামীম কবীর ও অন্যরা, ১৯৯২ | ছবি : লেখক


আমার রাজা ঘোরে বনবাসে গো/ তারে কেমনে ফিরবো আমার প্রেমেরও নগরে/ যবে পাশে ছিলে প্রাণও নাথও মরমে পরশিয়া/ কার স্মরণও স্মরিয়া/ আমার রাজা ঘোরে বনবাসে গো তারে কেমন ফিরবো আমার প্রেমেরও নগরে … শামীমের লেখা, সুর করা, নিজেই গাইত। রবি বাবুর গান গাইত যখন তখন। একবার রায়েরবাজারে মামুনদের বাসায় বেশ রাতে শচীন দেব বর্মনের রঙ্গীলা রঙ্গীলা রঙ্গীলা রে/ আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলা রে/ বন্ধু রঙ্গীলা রঙ্গীলা রঙ্গীলা রে… গেয়ে উঠল, ওর ভরাট স্বরে অনেকেই আসলো গান শুনতে। আদিত্য কবির এবং ইকবাল এহসানুল কবির জুয়েলের সাথে শামীমের খুব বন্ধুত্ব হয়। প্রায়ই ওরা ধোঁয়ার জগতে ভেসে যেত আবার তরলে নিমজ্জিত হতো; কিন্তু কবিতা সব সময় শামীমকে ঘিরে থাকত। একবার লালবাগের খান সাহেবের ডেরায় জুয়েল, আমি ও শামীম গেলাম, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বাংলার সাথে কমলা মিশিয়ে খাওয়া। ফেরার পথে রিকশায় পেট উগরে বমি এলো কিন্তু শামীম খুব যত্ন করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল।

আদিত্য কবির এবং ইকবাল এহসানুল কবির জুয়েলের সাথে শামীমের খুব বন্ধুত্ব হয়। প্রায়ই ওরা ধোঁয়ার জগতে ভেসে যেত আবার তরলে নিমজ্জিত হতো; কিন্তু কবিতা সব সময় শামীমকে ঘিরে থাকত। একবার লালবাগের খান সাহেবের ডেরায় জুয়েল, আমি ও শামীম গেলাম, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বাংলার সাথে কমলা মিশিয়ে খাওয়া। ফেরার পথে রিকশায় পেট উগরে বমি এলো কিন্তু শামীম খুব যত্ন করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল।

ওর ভেতরে খুব কোমল একজন বাস করত, কঠিন একজনও ছিল কিন্তু তাকে সে আড়াল করে রাখত। প্রকৃত কবির অবয়ব শামীমের মন-মগজ-আচরণে। যেকোনো বাদ্য-যন্ত্র ধরলেই বাজাতে পারত, ছোটোবেলায় বড়ো বোন রিক্তার গান শেখার সময়ে দূর থেকে রপ্ত করেছিল। তিন ভাই, এক বোন আর মা-বাবা এই ছিল শামীমদের পরিবার। বড়ো বোন আর ছোটো ভাইয়ের সাথে খুব বন্ধুত্ব। মা রওশন আরা লতিফ ছেলেকে অনেক ভালোবাসতেন, যত্ন করতেন, বাবার সাথে দূরত্ব জ্ঞাপক সম্পর্ক। আসলে বাঙালি মধ্যবিত্ত পারিবারিক বলয়ের সাথে শামীমের চিন্তা-ভাবনা কখনো তেমন করে মিলত না। রক্ষণশীল সমাজ কাঠামো, ধর্মীয় গোড়ামি সব সময় ওকে পীড়া দিত। চাইতো শোষণহীন স্বাধীন এক জীবন— যা কখনো সে পায়নি। আর তা সম্ভবও না; ইউটোপিয়ান সে জীবনের স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি কিন্তু সেখানে পৌঁছানো কখনো হয়ে ওঠে না। তবু কবি-সাহিত্যিকরা, রাজনীতিবিদরা সমাজ বদলের চিন্তা করে। কেউ কাজ করে অস্ত্র হাতে, কেউ কলম দিয়ে, কেউ ঘাম আর রক্ত দিয়ে। ঢাকায় থাকা অবস্থায় শামীম মাঝে মাঝে বগুড়া গিয়ে থাকত, তখন ওর সাথে কথা হতো ক্যাডেটের বন্ধু মুকুটের বাসার ফোনে। সেই এনালগ যুগে ট্রাঙ্কল পাওয়া খুব কঠিন ছিল। বারান্দায় ফোন নিয়ে মেঝেতে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতাম— কখনো লাইন পেতাম, কখনো পেতাম না। শামীম মুকুটদের বাসায় অপেক্ষা করে করে অধৈর্য হয়ে চলে যেত, তখন হয়তো লাইন পেতাম, কি যে মন খারাপ হতো দুজনের কথা বলতে না পারলে। বিরানব্বই সালে আদিত্য কবির আর আমি শামীমের সাথে দেখা করতে বগুড়া গেলাম। পথে যেতে যেতে নিমজ্জমান চাঁদ। মুকুটের বাসায় রোমেল, মুকুট, মাইনুক ফারুক, আদিত্য আরও দু-একজন বন্ধু, সারারাত আড্ডা। পিয়ারেজ ষ্টুডিওর নীল আলোতে সারারাত একটা দুরন্ত আত্মা ছটফট করল।


cadet college , rangpur

রংপুর ক্যাডেট কলেজে শামীম কবীর ও অন্যরা | ছবি : লেখক


এরপর আরও কয়েকবার বগুড়া গিয়েছিলাম। একবার তিরানব্বইতে রেইনি ভাইসহ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আগে চলে গিয়েছিলাম। বললাম রেজাল্ট খারাপ হলে আর যাব না; শামীম বলল তা হবে না, তুমি অনেকগুলো বিষয়ে চান্স পাবে। হয়েছিল তাই। আমরা বগুড়া শহরে ঢোকার আগেই মোড়ে শামীম লাফ দিয়ে বাসে উঠে আসলো। অনেকদিন পর ওকে দেখে কী যে আনন্দ হলো! সেবার মাসুদ খানের সাথে দেখা হলো তার বাড়িতে। আমাদের মাসুদ খানের বাসায় থাকার কথা ছিল, কিন্তু কোনো এক সমস্যার কারণে মাঝরাতে শামীম আমাকে আর রেইনি ভাইকে ওদের বগুড়ার রহমান নগরের বাসায় নিয়ে গেল। মফস্বলের বাসায় এতো রাতে ঢাকা থেকে আসা বন্ধু নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হওয়া মোটেই কাম্য ছিল না। কিন্তু শামীম খুব সাহসী ছেলে। রাতে হোটেলে থাকার চেয়ে ওর বাসায় আমাদের নিয়ে গেল এবং খুব স্মার্টলি সব ব্যবস্থা করল। আমরা ওর বাসায় থাকলাম, পরদিন মহাস্থানগড়ে বেড়াতে গেলাম, গোকুলে বেহুলার বাসর ঘর দেখলাম। শামীমের সঙ্গে এমনিতেই সময় কাটে আনন্দময় তার উপর ঐসব প্রাচীন ভূমিতে গিয়ে শামীমের কবিতা শুনলাম। পকেটে চিরকুটে সবসময় কবিতা থাকত, ইচ্ছে হলে লিখত, সাথে কাগজ না থাকলে সিগারেটের প্যাকেট খুলে লিখত। আরেকবার বগুড়া যাই আমি আর সন্ত বেলাল। চুরানব্বই সালের এপ্রিলে। লেখক কামরুল হুদা পথিক ভাইয়ের বাসায় আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করল শামীম। সেসময়ে শামীম খুব একাকিত্বে ভুগছিল। ঢাকার আড্ডা, সাহিত্যের পরিবেশ, বোহেমিয়ান জীবন— সব ছেড়ে বগুড়ার বাড়িতে অনেকটা গৃহবন্দীর মতো আর তা নিজেরই তৈরি। ওই সময়ে ওর কিছু চিকিৎসা চলছিল রংপুরে, তা নিয়ে কবিতাও আছে। কিন্তু শামীমের যা দরকার ছিল তেমন মানসিক সাহচর্য, পরিবেশ কিছুই ওই সময়ে ছিল না ওর চারপাশে; বন্ধুরাও ছিল না। একজন সংবেদনশীল মানুষের যা দরকার তেমন পরিবেশ আমাদের এখানে বিরল। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি এইসব মানুষ পছন্দ করে— একজন কবি তার মতো লিখে যাবে, নিভৃতে জীবন যাপন করবে তেমন সুযোগ নাই।

শামীমের যা দরকার ছিল তেমন মানসিক সাহচর্য, পরিবেশ কিছুই ওই সময়ে ছিল না ওর চারপাশে; বন্ধুরাও ছিল না। একজন সংবেদনশীল মানুষের যা দরকার তেমন পরিবেশ আমাদের এখানে বিরল। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি এইসব মানুষ পছন্দ করে— একজন কবি তার মতো লিখে যাবে, নিভৃতে জীবন যাপন করবে তেমন সুযোগ নাই।

তবে এর মধ্যেই নিজেকে বাঁচাতে হয়, শামীম কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। পথিক ভাইয়ের বাসার বারান্দায় বসে কথা বলছিলাম, মনে হচ্ছিল ও সেখানে নাই শুধু একটা ছায়া পড়ে আছে। খুব চেষ্টা করলাম ওকে বোঝাতে আবার সব কিছু আগের মতো হয়ে যাবে, চমৎকার সময় আসবে, তুমি অনেক অনেক লিখবে, আমি সব সময় তোমার পাশে থাকব, কখনো ছেড়ে যাব না, তুমি শুধু লিখবে, যেমন জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে কাটাবে। আমার কথা শুনে ও মৃদু হাসছিল। হয়তো নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছিল তখন। ওই সময়ে শামীমের খুব ঢাকায় থাকা দরকার ছিল। ঢাকার পরিবেশ হয়তো ওকে অন্যরকম, প্রেরণাদায়ক অনুভূতি দিত। বললাম ঢাকায় চলো। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগরে ভূতাত্ত্বিক-বিজ্ঞানে পড়াশোনা করতাম। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় আমার পাশের সিট শামীমের ছিল কিন্তু সে আসে নাই।


1992 , rayebazar

শামীম কবীর, রায়েরবাজার, ১৯৯২ | ছবি : লেখক


বুয়েটে স্হাপত্যবিদ্যায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল, সেখানে সুযোগ না পাওয়াটা সে মেনে নিতে পারে নাই। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারে চান্স পেয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে সব ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিকেন্দ্রিক পড়াশোনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। যদিও তিরানব্বইতে বগুড়া চলে যাওয়ার পর আজিজুল হক কলেজে পরিবারের চাপে গ্রাজুয়েশন করার জন্য ভর্তি হয়েছিল এবং কিছু পড়াশোনা করেছিল। সে সময়ে একটা পারিবারিক কাজের সাথেও কিছুটা যুক্ত হয়েছিল। ঢাকা-বগুড়া করার সময়ে অনেক চিঠি পাঠাত আমাকে, চিঠিগুলো আমার মায়ের হাতে পড়ত কিন্তু শেষে আলমারিতে পেয়ে যেতাম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিতুমীর হলের ২০৮ নম্বর রুমে বন্ধু বায়েজিদ মাহবুবের সাথে থাকার সময়ে ভাবলাম ওর কিছু হাত খরচ দরকার, ছোটো বোন ডিকুকে পড়াতে শুরু করল শামীম। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে দুজনে একসাথে আমাদের বাসায় আসতাম, আমার মা-বাবার সাথে ওর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেল। সেসময়ে সারাদিন শাহবাগ, পাবলিক লাইব্রেরি, টিএসসি, চারুকলা, হাকিম চত্বর, বুয়েট এসব জায়গায় সারাদিন আমাদের হাঁটাহাঁটি, ঘোরাঘুরি, এই আড্ডার কোনো নাম নেই। এরকম লাগামহীন আড্ডা আর হয় কি না জানি না। এটা ঠিক শুধু আড্ডা নয়; একরকম জীবন-যাপন, নতুন নতুন চিন্তার বিনিময়, অনেকেই পরে শিল্প-সাহিত্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের তরুণ তুর্কি সেনারা অনেকেই সেখানে উপস্থিত থাকত। সাজ্জাদ শরীফ, ব্রাত্য রাইসু, সৈয়দ তারিক, ফরিদ আহমেদ, জুয়েল মাজহার আরও অনেকেই। চারুকলার বন্ধুরাও আসত।

চারুকলার জলশূন্য পুকুরকে ঘিরে বসে থাকতাম আমরা, কারো কাছে তেমন টাকা-পয়সা থাকত না, আমি বাসা থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসতাম মাঝে মাঝে। ওই সময়ে সবাইকে দশ-বিশ টাকা ধার করে চলতে হতো। এমনকি আজিজ সুপার মার্কেটের দারোয়ানও আমাদের টাকা ধার দিত। অনেক দিন দুপুরে চা খেয়ে কাটিয়ে দিতাম। তখন গরম বা শীত, বৃষ্টি কোনো কিছুই আমাদের ঘরে রাখতে পারত না।

চারুকলার জলশূন্য পুকুরকে ঘিরে বসে থাকতাম আমরা, কারো কাছে তেমন টাকা-পয়সা থাকত না, আমি বাসা থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসতাম মাঝে মাঝে। ওই সময়ে সবাইকে দশ-বিশ টাকা ধার করে চলতে হতো। এমনকি আজিজ সুপার মার্কেটের দারোয়ানও আমাদের টাকা ধার দিত। অনেক দিন দুপুরে চা খেয়ে কাটিয়ে দিতাম। তখন গরম বা শীত, বৃষ্টি কোনো কিছুই আমাদের ঘরে রাখতে পারত না। বৃষ্টিতে ভিজতাম, রোদে পুড়তাম, পাঠক সমাবেশের বিজু ভাই আমাদের অনেক সহযোগিতা করত। খাবার কিনে খাওয়াত, ওনার ছোটো দোকানে সারাদিন ঘুরঘুর করতে দিত, আর সব খবরাখবর তার মাধ্যমেই পাওয়া যেত। কেন না তখন মোবাইল ফোন ছিল না। পাঠক সমাবেশের উল্টো পাশে সন্দেশ আর আরেকটি খাবার দোকান। শামীম ফান্টা খেতে খুব পছন্দ করত। আজিজ মার্কেটের সিঁড়ি অসহ্য হয়ে গেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে চলে যেতাম। ভেতরের দিকে অডিটোরিয়ামের সিঁড়িতে বসতাম। ওখানে বর্ষা-বাদল জুটির সাথে পরিচয় হলো। বিরানব্বইয়ের ডিসেম্বরে পাবলিক লাইব্রেরিতে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব চলছিল লাইব্রেরি চত্বরে সবুজ ঘাসের উপর বসে বাংলা খাওয়া চলল, তারপর সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটা—

ও আলোর পথযাত্রী
এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না
এ বালুর চরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধো না
ও আলোর পথযাত্রী
এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না
এ বালুর চরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধো না…

গান গেয়ে উঠল বিষ্ণু বিশ্বাস, শামীমও গাইতে শুরু করল তারপর সবাই সমবেত সুরে। ওই সময়ে ঢাকা অনেকটা খোলামেলা শহর, প্রশাসন তরুণ শিল্পী-কবিদের আচরণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামাত না সবসময়। তবে রাতের ঢাকা ছিল ভিন্নরকম। শামীম আর জুয়েল একবার শালবনে গাজীপুরে গিয়েছিল, ওখানে গিয়ে একটা কবিতা লেখে ‘গজারি’ গাছ।

গজারি গাছ

শান্ত সমাহিত মন দশমণ পাথরের নিচে
রূপালী কিরিচে কাটা চন্দ্রমুণ্ড হেঁটে যায়
সরাগ সন্ন্যাসে

গাঁজা পোড়ে
ক্ষণে ক্ষণে বেঁচে বেঁচে গজারি বনের দৃশ্য
আর
দুপুরের দাব দপ্তরীটির কাঁধে চেপে
বাতাসের অভিলম্বে ভাসমান
গো চোনায়
ধুয়ে
মছে
বাঁকে চাকু
তৈরি হয় নীলিমা শিকারী

সেখানে বাইশ খণ্ড ধ্যান পেতে ব’সে আছে
ঋষি খর্পর

(নির্বাচিত কবিতা : শামীম কবীর)

 

শামীম আড্ডা, ঘোরাঘুরি, অস্থিরতা, পড়াশোনা সব কিছুর মধ্যে থেকেও নিজস্ব একটা নির্জনতা তৈরি করে নিত লেখার জন্য, কবিতা কখনো অধরা ছিল না, আপাদমস্তক একজন কবি। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে শামীমের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, নিবিড়। একদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে শামীম বললো তুমি বাসায় চলে যাও আমার এক জায়গায় যেতে হবে। আমি যেতে চাইছিলাম না। শামীম বলল আমি এমন একজনের কাছে যাচ্ছি, যে আমার খুব প্রিয়জন, তোমাকে নেওয়া যাবে না। আর তোমার এখানে থাকাও চলবে না। ঐদিন খুব মন খারাপ করে বাসায় চলে গিয়েছিলাম, পরে জানলাম সুব্রতর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। শামীমের সাথে খুব স্বল্প সময়ে দীর্ঘ ভ্রমণ, অল্প কথায় লেখা যায় না। এতটা দিন পরেও সে একইরকম উজ্জ্বল, কোনো মালিন্য নাই তার অবয়বে। বারুদ, লোবান আর গোলাপের মাখামাখি। চুরানব্বইতে কামরুল হুদা পথিক সম্পাদিত বগুড়া থেকে প্রকাশিত দ্রষ্টব্য পত্রিকায় ‘নভেরা’ নামে একটা দীর্ঘ কবিতা লেখে শামীম, দ্রষ্টব্যটা আমাকে পাঠায়। ঐরকম একটা কবিতা শুধুমাত্র শামীমের পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছিল।


rangpur cadet colege in his room

রংপুর ক্যাডেট কলেজ হোস্টেলে নিজের পড়ার টেবিলে শামীম কবীর


শামীম আর আমি ঠিক করেছিলাম যেখানেই থাকি না কেন ওর আর আমার জন্মদিনে আমাদের দেখা হবে কিন্তু পঁচান্নব্বইতে শামীম এলো না ঢাকায়; বরঞ্চ আমার জন্য একটা গল্প পাঠাল, গল্পটি ‘দ্রষ্টব্য’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আমার জাহাঙ্গীরনগরের হলের রুমে গিয়ে দেখি একটা পার্সেল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা, ‘আবাসন’ গল্প।

ঠনঠনিয়া কবরস্থানের সবুজ ঘেরা ঘরে একটা কুঁজো খেজুর গাছ, নীল পলেথিনে মোড়া, আসলে ওখানে শামীম ছিল না। একজন কবির কোনো মৃত্যু নাই, শব্দের ব্রহ্মা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। কবিতা; একমাত্র কবিতায় সে বেঁচে থাকে আর মানুষের নির্মম স্মৃতিতে, ভালোবাসায়, প্রেমে-ঘৃনায়। শামীম বাংলা কবিতায় তেমন ভাবেই বেঁচে আছে, এই ক্ষণজন্মা কবি বাংলা ভাষার সাথে হাজার বছর বেঁচে থাকবে এটাই তাঁর অদৃষ্ট।

আমার জন্মদিনে গল্পটি পাওয়ার পর ভাবলাম আবার বগুড়া যাব, কিন্তু এর মধ্যেই ৩রা অক্টোবর শামীমের আত্মহননের পরের দিন খবরটি জানতে পারি ফোনে শামীমের এক বন্ধুর মাধ্যমে। তখন পায়ের নিচ থেকে সব মাটি সরে গেল, চারিদিকে অসংখ্য কবর, মাথার উপর নাগরিক চিল, সব পরাবাস্তব ছবির মতো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।

ঠনঠনিয়া কবরস্থানের সবুজ ঘেরা ঘরে একটা কুঁজো খেজুর গাছ, নীল পলেথিনে মোড়া, আসলে ওখানে শামীম ছিল না। একজন কবির কোনো মৃত্যু নাই, শব্দের ব্রহ্মা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। কবিতা; একমাত্র কবিতায় সে বেঁচে থাকে আর মানুষের নির্মম স্মৃতিতে, ভালোবাসায়, প্রেমে-ঘৃনায়। শামীম বাংলা কবিতায় তেমন ভাবেই বেঁচে আছে, এই ক্ষণজন্মা কবি বাংলা ভাষার সাথে হাজার বছর বেঁচে থাকবে এটাই তাঁর অদৃষ্ট।

আমার অদৃষ্ট আমি হারিয়েছি আর
আমার অদৃষ্ট আমি হারিয়ে ফেলেছি
শুধু আর তোমার আঙুল
হেঁটে বেড়ায় আমার থ্যাতলানো গরম চাঁদিতে
আর
আর

(মার সঙ্গে বাক্যালাপ শামীম কবীর)

বিভিন্ন সময়ে আমাকে লেখা চিঠি থেকে কয়েকটা এখানে প্রকাশ করলাম। শামীম তার এক চিঠিতে লিখেছিল— তোমার যখন অনেক বয়স হবে ধরো চল্লিশ-পঞ্চাশ এবং অনেক টাকা হবে তখন আমার লেখা চিঠিগুলো দিয়ে একটা বই করে ফেলো, হা হা হা।


নভেরা হোসেনকে লেখা শামীম কবীরের কয়েকটি চিঠি


chiti 1


chithi 3 a

chithi 3 c


chithi 2

chithi 2 last ongsho

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। প্রকাশিত কবিতার বই ছয়টি, গল্পগ্রন্থ দুইটি, একটি নভেলা সংকলন। এছাড়া পিয়াস মজিদের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর’ (অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। তিনি কিছুদিন নৃবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন, ওয়েব ম্যাগাজিন, জার্নাল ও দৈনিক পত্রিকায় লেখেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।