বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

আমাদের শীতকাল ও আঙুরলতার সম্মোহন : ফয়জুল ইসলাম

0

আশির দশকের অন্যতম একজন কবি রাজা হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমাদের শীতকাল ও আঙুরলতার সম্মোহন’ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-তে প্রকাশিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে মোট ৫৬টি কবিতা। কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৯২ থেকে ২০০৪ সময়কালে।


Amader Sitkal O angurlotar sommohon

আমাদের শীতকাল ও আঙুরলতার সম্মোহন


রোমান্টিক ঘরাণার কবি রাজা হাসানের বর্তমান কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে ফুটে উঠছে প্রেম, কাম, বিচ্ছেদ, ব্যর্থতা, সম্পর্কের ভাঙন, নির্জনতা এবং নাগরিক ক্লান্তি। তবে কবিতাগুলোর মূল সূর হলো স্মৃতিময়তা। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং মধ্য-বয়স কেন্দ্রীক বিভিন্ন স্মৃতির ভেতরে তিনি আমাদেরকে অবলীলায় প্রবিষ্ট করেছেন। কবিতা পাঠ শেষ করে আমার মনে হয়েছে: আচ্ছা! তারপর কী হলো! রাজা হাসান সেই রহস্য আর ভাঙেননি।

 

‘প্রতিটি পৃষ্ঠায় আলোছায়া টানা কৈশোরিক দিনগুলি,
হেরিকেনের নিভু আলো, হিজিবিজি কাটাকুটি, গুঢ় অভিলাষে যে নাম
লিখতাম অস্পষ্ট—রাফখাতা তা জানে’

(রাফখাতা)

 

‘আমরা হেঁটেছি যারা—সেই মুখগুলো এখন নিরুদ্দেশ অন্ধকার’

(সংক্রমণ)

 

‘সমুদ্র ভ্রমণে এসে আমি আজও সমুদ্র দৃশ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি তোমাকে
এসবের কিছুই বলি না’

(পরোক্ষ অন্তহীন)

 

‘কলোনির ঝাঁকড়া কড়ইগাছের অন্ধকারে চাঁদ নিভে গেলে আমরা শুনতে পেতাম ব্রীজের ওপর ট্রেনের দূরাগত গম্ভীর শব্দ’

(চিত্রকল্পের রাত)

 

স্মৃতিময়তার পাশাপাশি কবিতাগুলোতে মূর্ত হয়েছে নারী এবং প্রেম। তাঁর ‘নারী’ অধরা। তাঁর ‘প্রেম’ রক্তাপ্লুত—সেখানে বিরহ থাকে, ব্যর্থতা থাকে, আরও থাকে পশ্চাদ্ধাবনের আকুতি। এমনটাই মনে হয়েছে আমার নিজের কাছে। যেমন তিনি লিখেন:

 

‘ঘটনাহীন অপচয়ে একেকজন
ফুরিয়ে যায়…
সাঁকোর নিচে স্তব্ধ জলে একাকি নৌকার
প্রতিবিম্ব স্থির হয়ে থাকে…’

(দেখা)

 

‘বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি—তবে আজও জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে, আমাকে চিনতে
পেরেছো? রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অর্থহীনতা বুঝে নিতে হয়েছে’

(সংলগ্নতা)

 

‘আমি ঐ মেয়েটির সাথে দেখা করতে চাই। তার বাম চোখ ছোট করে ঠোঁট কামড়ে
ছুঁড়ে দেয়া মার্বেলগুলো লুফে নিতে চাই’

(সাবান সুন্দরী)

 

‘ঐখানে নিরুদ্দেশ যুবকের আর্তস্বর জ্যোৎস্নার অসহ্য নীরবতায় ডুবে গেছে’

(শীতঘুম)

 

আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে, কবি রাজা হাসানের বর্ণনার ভেতরে একটা বৈঠকী আমেজ আছে। ব্যাপারটা এমন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেটের উলটোদিকের ‘মন্টু ভাইয়ের ক্যান্টিন’-এর ভেতরে প্রায়-অন্ধকারে বসে রাজা হাসান আমাকে বলছেন: আরে শোনেন না, তারপর যেটা হলো…! তখন আমি চোখ বুঁজে আছি আর রাজা হাসান নম্র উচ্চারণে একের পর এক গল্প বলে যাচ্ছেন অথবা একই গল্প তিনি বারবার বলে চলেছেন বিভিন্ন ঢঙে। সেসব গল্পে মূর্ত হয়েছে প্রেম, কাম, বিচ্ছেদ, ব্যর্থতা, সম্পর্কের ভাঙন, নির্জনতা এবং নাগরিক ক্লান্তি।

বলাই বাহুল্য, কবি রাজা হাসানের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে শক্তিশালী দুজন পূর্বসূরীর কথা মনে হয়েছে আমার—বুদ্ধদেব বসু এবং আবুল হাসান। তবে তাঁর উচ্চারণ স্বতন্ত্র বৈকি! বুদ্ধদেব বসু মতো বর্ণনাময়তা এবং আবুল হাসানের তদগত ভাব আমি এই কবিতাগুলোতে প্রত্যক্ষ করেছি। তদগতভাবে তিনি ক্রমাগত হেঁটে চলেছেন বিরান এক মাঠের ভেতর দিয়ে আর তাঁর পাশে জমে আছে অখণ্ড নির্জনতা!

কবি রাজা হাসানের ‘আমাদের শীতকাল ও আঙুরলতার সম্মোহন’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছে হাওলাদার প্রকাশনী। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৫ । তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ‘সন্ধ্যা ও ছায়া আখ্যান’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে নৈঋতা ক্যাফে থেকে। রাজা হাসান কবিতা লিখেন কম, ছাপেন আরও কম। তার কাছ থেকে সামনের দিনে বর্ধিত হারে কবিতা আশা করি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাশিল্পী, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে, ঢাকা শহরের সিদ্ধেশ্বরীতে। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের ভেতরে রয়েছে: ‘নক্ষত্রের ঘোড়া’, ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’, ‘আয়না’, ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’,  ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’ এবং ‘ঘুমতৃষ্ণা’। উপন্যাসটির নাম–‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২২-এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে তিনি স্নাতোকোত্তর।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।